রাজধানীর গুলশান মডেল টাউনের ৩৫ নম্বর সড়কের সিডব্লিউএন(বি)-৮ প্লটের মালিক জহিরা ওসমান শেখ। আশির দশকে প্লটটি সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। পরে রাজউক থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেওয়া প্লটটি ফেরত পেতে দুই দশকে আদালতে চক্কর কাটার পর সেটেলমেন্ট আদালত থেকে উচ্চ আদালত তাঁকে প্লটটি বুঝে দিতে আদেশ দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ১৪ বছরেও আদালতের এ আদেশ কার্যকর হয়নি। 

মালিকপক্ষের অভিযোগ, আদেশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে প্লট মালিকের কাছে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করা হয়েছিল। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় রায় বাস্তবায়ন না করে গণপূর্ত উল্টো হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। এখন রাজউক সেখানে আবাসন সংকট নিরসনে ‘রূপসা অ্যাপার্টমেন্ট’ নামে ১৫তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এ অ্যাপার্টমেন্টেই সরকারি কোটায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, তৎকালীন বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, কামরুল হাসান মোল্লা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খানকে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকারি কোটায় এখানে আরেকটি ফ্ল্যাট রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞা নিজেই বরাদ্দ নেন। 
জানা যায়, জহিরা ওসমান শেখের স্বামী মো.

ওসমান শেখ ১৯৬৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ডিআইটি, বর্তমানে রাজউক থেকে গুলশান মডেল টাউনের ৩৫ নম্বর প্লটের সিডব্লিউএন(বি)-৮ প্লটটি লিজ নেন। পরে সম্পত্তিটি ওসমান শেখ তাঁর স্ত্রী জহিরা ওসমান শেখকে ১৯৯০ সালের ২৬ অক্টোবর ঘোষণাপত্র দলিলের মাধ্যমে দান করেন। বর্তমানে জহিরা ওসমান অসুস্থ। জীবনের অন্তিম প্রান্তে নিজের শেষ সম্বলটুকু ফিরে পেতে আর্জি নিয়ে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ১৯ বছর ঘুরেছেন। কখনও সেলেটমেন্ট আদালত, কখনও সুপ্রিম কোর্ট। সব ক্ষেত্রেই রায় পেয়েছেন নিজের পক্ষে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিজের পক্ষে রায় পাওয়ার ১৬ বছর পার হলেও রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্লটটি জহিরা ওসমানকে হস্তান্তর করেনি।

নিজের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার অন্তহীন অপেক্ষায় থাকা এ নারীর পক্ষে এখন আর দৌড়াদৌড়ি করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই তাঁর পক্ষে সব কাজ সম্পন্ন করতে বিশ্বস্ত এম এ মোতালেবকে আমমোক্তার নিযুক্ত করেছেন। মোতালেবই জহিরা ওসমান শেখের পক্ষে রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং আদালতে যাতায়াত করছেন।
এম এ মোতালেব সমকালকে বলেন, জহিরার মৃত স্বামী মো. ওসমান শেখ রাজউক থেকে প্লটটি বরাদ্দ পাওয়ার কিছুদিন পর প্লটটিকে সরকার ‘ক’ তপশিলভুক্ত, অর্থাৎ পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তালিকাভুক্ত করে।

 বিষয়টি জানতে পেরে জহিরা তৎকালীন ঢাকার প্রথম সেলেটমেন্ট আদালতে মামলা করেন। দুই বছর পর সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ শেষে ১৯৯১ সালের সেটেলমেন্ট আদালত জহিরার পক্ষে রায় দেন। সরকারকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে অবমুক্ত করে জহিরা শেখকে মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। 
এম এ মোতালেব বলেন, পরে সেটেলমেন্ট আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা দায়ের করে। রিট শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগ ১৯৯৭ সালে সেটেলমেন্ট আদালতের রায় বহাল রেখে সরকারের দায়ের করা রিট খারিজ করে দেন। এ রায়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সরকারকে সেটেলমেন্ট আদালতের রায় দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।

মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ অমান্য করে সম্পত্তিটি সরকার জহিরাকে বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব করলে তিনি হাইকোর্টে আবার একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ওই রিট শুনানি শেষে ১৯৯৭ সালে রায় দেন। রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ স্পষ্টভাবে সরকারকে নির্দেশ দেন, রায়ের কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে সম্পত্তিটি ‘ক’ তপশিলভুক্ত থেকে অবমুক্ত করে জহিরার কাছে হস্তান্তর করতে। এ মর্মে জহিরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করেনি।

নিজের মালিকানা বুঝে পেতে আর কোনো উপায় না পেয়ে জহিরা ওসমান শেখ ২০০৮ সালে হাইকোর্টে একটি কনটেম্পট মামলা করেন। আগে দায়ের করা রিট মামলার রায় সরকার বাস্তবায়ন না করায় এ কনটেম্পট মামলা করা হয়। মামলায় আদালতের এন এ সুলতানা ও মো. সামসুল হুদার দ্বৈত বেঞ্চ গত ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবেদনকারীর পরিচয় যাচাই সাপেক্ষে রায় দ্রুত বাস্তবায়নের আদেশ দেন। পরে জহিরা ও এম এ মোতালেব গণপূর্তের আইন উপদেষ্টার কাছে কাগজপত্রসহ উপস্থিত হলে মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, সিআইডির হস্তরেখা বিশারদের কাছ থেকেও যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু এবারও জমি বুঝিয়ে দেয় না গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আদালতের রায় বাস্তবায়ন না করে উল্টো মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবার ২০১৬ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। 

এম এ মোতালেব বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা আদালতের আদেশ অনুযায়ী পরিচয় যাচাইয়ের পর আমাদের কাছে ৮-১০ কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেন। কিন্তু এ টাকা না দেওয়ায় তারা প্লট বুঝিয়ে না দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এখন আপিল শুনানি চললেও সেখানে ভবন নির্মাণ চলছে। আর এই ভবনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, মন্ত্রীদের স্বজনকে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতিদের ফ্ল্যাট দিয়েছে মন্ত্রণালয়।’

জহিরা ওসমান শেখ সমকালকে বলেন, ‘১৪ বছর ধরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। তবুও নিজের ন্যায্য জমি বুঝে পাচ্ছি না। আদালত আমার পক্ষে রায় দেওয়ার পরও জমির মালিকানা পাচ্ছি না। ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা আমার প্লটে নিজেদের আলিসান ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এখন আদালতের আদেশ অমান্য করে আমার জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন বৈষম্যহীন সরকার। আমার প্রতি যে অন্যায় করা হচ্ছে, সেটি দেখার কি কেউ নেই? আমার নিজের জমির অধিকার বুঝে পেতে আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে?’
সরেজমিন দেখা যায়, ৩২ কাঠা আয়তনের প্লটটিতে দুই তলা ভবন ভেঙে রাজউকের রূপসা অ্যাপার্টমেন্টের ১৫ তলা ভবনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া ভবনটির এখন ১৪ তলা ছাদের কাজ চলমান। রূপসা অ্যাপার্টমেন্টের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘ভবনটির ১৪ তলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কাজ শেষ হবে।’ 

রাজউক সূত্র জানায়, রূপসা প্রকল্পে তিন হাজার বর্গফুটের ৪৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ হবে। গত বছরের ৩১ মার্চ লটারির মাধ্যমে ৪৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে পাঁচটি মন্ত্রণালয় ও সরকারের কাছে রেখে বাকি ৪৩টির লটারি অনুষ্ঠিত হয়। 

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১) এ বি এম এহছানুল মামুন সমকালকে বলেন, ‘চলতি মাসে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। বিচারাধীন সম্পত্তিতে কীভাবে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে, সেটি জানা নেই। তবে নিয়ম না মেনে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি সম্ভব নয়। এটি আবার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে হবে।’ 
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা (অতিরিক্ত সচিব) মো. ফজলুল কবির বলেন, ‘প্লটটি সম্পর্কে আমার কাছে তথ্য নেই। তবে কাগজপত্রসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে এলে বিবেচনা করা হবে। 

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভবন ন র ম ণ এম এ ম ত ল ব ওসম ন শ খ দ য় র কর তৎক ল ন ক ত কর র জউক

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ খাতে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে: পর্যালোচনা কমিটি

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির নামে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া বাবদ অর্থ নিয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেয়ে দুর্নীতিই মুখ্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছে সরকার গঠিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তারা বলেছে, চুক্তিতে ব‍্যবসায়ীদের কোনো ঝুঁকি নেই, সব ঝুঁকি সরকারের। এটি সরকারের অদক্ষতাজনিত ব‍্যর্থতা নয়, দুর্নীতি জড়িত। তাই চুক্তি বাতিল করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, গত সরকারের দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনটি করাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। এখানে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো ভাড়া আদায়ের নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি আমদানি করেছে নিজেরা। এতেও দুর্নীতি হয়েছে।

তবে এখন এসব চুক্তি বাতিল করতে হলে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরা। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। গত সরকারের সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একের পর এক একতরফা চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তিতে সব সুবিধা দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে, রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। একটি চুক্তি যেন আরেকটির প্রতিলিপি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো এতে জড়িত ছিল। গ্যাস পাওয়া যাবে না, চুক্তি করা হোক—এমন সুপারিশও দেখা গেছে মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে।

পর্যালোচনা কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুধু চুক্তি নয়, চুক্তির আগের পুরো প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের নমুনা পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক দুই বিদ্যুৎসচিব, যাঁরা পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হয়েছিলেন; তাঁদের সংশ্লিষ্টতা আছে সংঘবদ্ধ দুর্নীতিতে। এই দুজন হলেন আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউস।

# চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
# দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, খরচ বেড়েছে ১১ গুণ
# ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের শীর্ষ পর্যায় মিলে সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
# চুক্তি বাতিল সম্ভব, দুদকের তদন্ত করতে হবে
# আদানির চুক্তিতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে

দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।

জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন

আজ রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তারা। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে করা চুক্তির অনিয়ম নিয়েও একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। প্রতিবেদন জমার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন কমিটির সদস্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে তার ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চুক্তিতেই বলা আছে। তবে প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে এই চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। এটা যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। কিন্তু মুখের কথা তো আদালত মানতে চাইবেন না, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে আদালতে। কমিটির সহায়তায় চুক্তির অনিয়ম খুঁজে দেখা হচ্ছে। কারণ, খুঁজে পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিলে দ্বিধা করা হবে না।

কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, চুক্তি–সম্পর্কিত নথি দেখা হয়েছে। পিডিবি থেকে পরিশোধ করা বিলের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে, কী কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ ছিল, মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ছিল। বিদ্যুৎ খাতে যে পরিমাণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং এর বিপরীতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, এর হিসাব আইনস্টাইনও মেলাতে পারবেন না।

চুক্তি বাতিল করলে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন, তাঁরা তাঁদের ক্ষতির হিসাব দেবেন। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা তো এ কমিটি বলতে পারবে না।

দুর্নীতির কারণে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্য মোশতাক হোসেন খান বলেন, ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। ভর্তুকি না থাকলে ৪০ শতাংশ বেড়ে যেত। এ দামে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকতে পারবে না। এটা কমাতে হবে। যারা টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বোঝাতে হবে, তারা পার পাবে না। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হতে পারে, তাই সময় লেগেছে। তবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তিগুলো সার্বভৌম চুক্তি। চাইলেই এটা বাতিল করা যায় না। বড় জরিমানা দিতে হতে পারে।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, আদানির চুক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। আদালত প্রতিবেদন চেয়েছেন। মাসখানেকের মধ্যে শক্ত প্রমাণ সামনে আসবে। এসব প্রমাণ নিয়ে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া যাবে।

পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজ চলমান।

চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে একটি সূত্র দেওয়া আছে চুক্তিতে। এ সূত্র অনুসারে দাম নির্ধারিত হয়। একেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে একেক দাম। সমঝোতার মাধ্যমে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ বিধান আইনে এভাবে চুক্তি করার সুযোগ নিয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিশেষ বিধান আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। এরপর দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই আইনের অধীনে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়া একটার পর একটা চুক্তি করেছিল গত সরকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ