ব্যক্তিগত জমিতে বহুতল ভবন প্রকল্প রাজউকের
Published: 1st, February 2025 GMT
রাজধানীর গুলশান মডেল টাউনের ৩৫ নম্বর সড়কের সিডব্লিউএন(বি)-৮ প্লটের মালিক জহিরা ওসমান শেখ। আশির দশকে প্লটটি সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। পরে রাজউক থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেওয়া প্লটটি ফেরত পেতে দুই দশকে আদালতে চক্কর কাটার পর সেটেলমেন্ট আদালত থেকে উচ্চ আদালত তাঁকে প্লটটি বুঝে দিতে আদেশ দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ১৪ বছরেও আদালতের এ আদেশ কার্যকর হয়নি।
মালিকপক্ষের অভিযোগ, আদেশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে প্লট মালিকের কাছে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করা হয়েছিল। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় রায় বাস্তবায়ন না করে গণপূর্ত উল্টো হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। এখন রাজউক সেখানে আবাসন সংকট নিরসনে ‘রূপসা অ্যাপার্টমেন্ট’ নামে ১৫তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এ অ্যাপার্টমেন্টেই সরকারি কোটায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, তৎকালীন বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, কামরুল হাসান মোল্লা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খানকে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকারি কোটায় এখানে আরেকটি ফ্ল্যাট রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞা নিজেই বরাদ্দ নেন।
জানা যায়, জহিরা ওসমান শেখের স্বামী মো.
নিজের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার অন্তহীন অপেক্ষায় থাকা এ নারীর পক্ষে এখন আর দৌড়াদৌড়ি করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই তাঁর পক্ষে সব কাজ সম্পন্ন করতে বিশ্বস্ত এম এ মোতালেবকে আমমোক্তার নিযুক্ত করেছেন। মোতালেবই জহিরা ওসমান শেখের পক্ষে রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং আদালতে যাতায়াত করছেন।
এম এ মোতালেব সমকালকে বলেন, জহিরার মৃত স্বামী মো. ওসমান শেখ রাজউক থেকে প্লটটি বরাদ্দ পাওয়ার কিছুদিন পর প্লটটিকে সরকার ‘ক’ তপশিলভুক্ত, অর্থাৎ পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তালিকাভুক্ত করে।
বিষয়টি জানতে পেরে জহিরা তৎকালীন ঢাকার প্রথম সেলেটমেন্ট আদালতে মামলা করেন। দুই বছর পর সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ শেষে ১৯৯১ সালের সেটেলমেন্ট আদালত জহিরার পক্ষে রায় দেন। সরকারকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে অবমুক্ত করে জহিরা শেখকে মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
এম এ মোতালেব বলেন, পরে সেটেলমেন্ট আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা দায়ের করে। রিট শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগ ১৯৯৭ সালে সেটেলমেন্ট আদালতের রায় বহাল রেখে সরকারের দায়ের করা রিট খারিজ করে দেন। এ রায়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সরকারকে সেটেলমেন্ট আদালতের রায় দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ অমান্য করে সম্পত্তিটি সরকার জহিরাকে বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব করলে তিনি হাইকোর্টে আবার একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ওই রিট শুনানি শেষে ১৯৯৭ সালে রায় দেন। রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ স্পষ্টভাবে সরকারকে নির্দেশ দেন, রায়ের কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে সম্পত্তিটি ‘ক’ তপশিলভুক্ত থেকে অবমুক্ত করে জহিরার কাছে হস্তান্তর করতে। এ মর্মে জহিরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করেনি।
নিজের মালিকানা বুঝে পেতে আর কোনো উপায় না পেয়ে জহিরা ওসমান শেখ ২০০৮ সালে হাইকোর্টে একটি কনটেম্পট মামলা করেন। আগে দায়ের করা রিট মামলার রায় সরকার বাস্তবায়ন না করায় এ কনটেম্পট মামলা করা হয়। মামলায় আদালতের এন এ সুলতানা ও মো. সামসুল হুদার দ্বৈত বেঞ্চ গত ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবেদনকারীর পরিচয় যাচাই সাপেক্ষে রায় দ্রুত বাস্তবায়নের আদেশ দেন। পরে জহিরা ও এম এ মোতালেব গণপূর্তের আইন উপদেষ্টার কাছে কাগজপত্রসহ উপস্থিত হলে মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, সিআইডির হস্তরেখা বিশারদের কাছ থেকেও যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু এবারও জমি বুঝিয়ে দেয় না গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আদালতের রায় বাস্তবায়ন না করে উল্টো মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবার ২০১৬ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে।
এম এ মোতালেব বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা আদালতের আদেশ অনুযায়ী পরিচয় যাচাইয়ের পর আমাদের কাছে ৮-১০ কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেন। কিন্তু এ টাকা না দেওয়ায় তারা প্লট বুঝিয়ে না দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এখন আপিল শুনানি চললেও সেখানে ভবন নির্মাণ চলছে। আর এই ভবনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, মন্ত্রীদের স্বজনকে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতিদের ফ্ল্যাট দিয়েছে মন্ত্রণালয়।’
জহিরা ওসমান শেখ সমকালকে বলেন, ‘১৪ বছর ধরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। তবুও নিজের ন্যায্য জমি বুঝে পাচ্ছি না। আদালত আমার পক্ষে রায় দেওয়ার পরও জমির মালিকানা পাচ্ছি না। ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা আমার প্লটে নিজেদের আলিসান ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এখন আদালতের আদেশ অমান্য করে আমার জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন বৈষম্যহীন সরকার। আমার প্রতি যে অন্যায় করা হচ্ছে, সেটি দেখার কি কেউ নেই? আমার নিজের জমির অধিকার বুঝে পেতে আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে?’
সরেজমিন দেখা যায়, ৩২ কাঠা আয়তনের প্লটটিতে দুই তলা ভবন ভেঙে রাজউকের রূপসা অ্যাপার্টমেন্টের ১৫ তলা ভবনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া ভবনটির এখন ১৪ তলা ছাদের কাজ চলমান। রূপসা অ্যাপার্টমেন্টের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘ভবনটির ১৪ তলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কাজ শেষ হবে।’
রাজউক সূত্র জানায়, রূপসা প্রকল্পে তিন হাজার বর্গফুটের ৪৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ হবে। গত বছরের ৩১ মার্চ লটারির মাধ্যমে ৪৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে পাঁচটি মন্ত্রণালয় ও সরকারের কাছে রেখে বাকি ৪৩টির লটারি অনুষ্ঠিত হয়।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১) এ বি এম এহছানুল মামুন সমকালকে বলেন, ‘চলতি মাসে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। বিচারাধীন সম্পত্তিতে কীভাবে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে, সেটি জানা নেই। তবে নিয়ম না মেনে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি সম্ভব নয়। এটি আবার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে হবে।’
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা (অতিরিক্ত সচিব) মো. ফজলুল কবির বলেন, ‘প্লটটি সম্পর্কে আমার কাছে তথ্য নেই। তবে কাগজপত্রসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে এলে বিবেচনা করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভবন ন র ম ণ এম এ ম ত ল ব ওসম ন শ খ দ য় র কর তৎক ল ন ক ত কর র জউক
এছাড়াও পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।
বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী
‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত
সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।
লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড
ঢাকা/লিপি