রাজধানীর গুলশান মডেল টাউনের ৩৫ নম্বর সড়কের সিডব্লিউএন(বি)-৮ প্লটের মালিক জহিরা ওসমান শেখ। আশির দশকে প্লটটি সরকার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। পরে রাজউক থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেওয়া প্লটটি ফেরত পেতে দুই দশকে আদালতে চক্কর কাটার পর সেটেলমেন্ট আদালত থেকে উচ্চ আদালত তাঁকে প্লটটি বুঝে দিতে আদেশ দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ১৪ বছরেও আদালতের এ আদেশ কার্যকর হয়নি। 

মালিকপক্ষের অভিযোগ, আদেশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে প্লট মালিকের কাছে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করা হয়েছিল। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় রায় বাস্তবায়ন না করে গণপূর্ত উল্টো হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। এখন রাজউক সেখানে আবাসন সংকট নিরসনে ‘রূপসা অ্যাপার্টমেন্ট’ নামে ১৫তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এ অ্যাপার্টমেন্টেই সরকারি কোটায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, তৎকালীন বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, কামরুল হাসান মোল্লা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সচিব আমিনুল ইসলাম খানকে ৩ হাজার বর্গফুটের একটি করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকারি কোটায় এখানে আরেকটি ফ্ল্যাট রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিঞা নিজেই বরাদ্দ নেন। 
জানা যায়, জহিরা ওসমান শেখের স্বামী মো.

ওসমান শেখ ১৯৬৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ডিআইটি, বর্তমানে রাজউক থেকে গুলশান মডেল টাউনের ৩৫ নম্বর প্লটের সিডব্লিউএন(বি)-৮ প্লটটি লিজ নেন। পরে সম্পত্তিটি ওসমান শেখ তাঁর স্ত্রী জহিরা ওসমান শেখকে ১৯৯০ সালের ২৬ অক্টোবর ঘোষণাপত্র দলিলের মাধ্যমে দান করেন। বর্তমানে জহিরা ওসমান অসুস্থ। জীবনের অন্তিম প্রান্তে নিজের শেষ সম্বলটুকু ফিরে পেতে আর্জি নিয়ে আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ১৯ বছর ঘুরেছেন। কখনও সেলেটমেন্ট আদালত, কখনও সুপ্রিম কোর্ট। সব ক্ষেত্রেই রায় পেয়েছেন নিজের পক্ষে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিজের পক্ষে রায় পাওয়ার ১৬ বছর পার হলেও রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্লটটি জহিরা ওসমানকে হস্তান্তর করেনি।

নিজের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার অন্তহীন অপেক্ষায় থাকা এ নারীর পক্ষে এখন আর দৌড়াদৌড়ি করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই তাঁর পক্ষে সব কাজ সম্পন্ন করতে বিশ্বস্ত এম এ মোতালেবকে আমমোক্তার নিযুক্ত করেছেন। মোতালেবই জহিরা ওসমান শেখের পক্ষে রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং আদালতে যাতায়াত করছেন।
এম এ মোতালেব সমকালকে বলেন, জহিরার মৃত স্বামী মো. ওসমান শেখ রাজউক থেকে প্লটটি বরাদ্দ পাওয়ার কিছুদিন পর প্লটটিকে সরকার ‘ক’ তপশিলভুক্ত, অর্থাৎ পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তালিকাভুক্ত করে।

 বিষয়টি জানতে পেরে জহিরা তৎকালীন ঢাকার প্রথম সেলেটমেন্ট আদালতে মামলা করেন। দুই বছর পর সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ শেষে ১৯৯১ সালের সেটেলমেন্ট আদালত জহিরার পক্ষে রায় দেন। সরকারকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে অবমুক্ত করে জহিরা শেখকে মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। 
এম এ মোতালেব বলেন, পরে সেটেলমেন্ট আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা দায়ের করে। রিট শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগ ১৯৯৭ সালে সেটেলমেন্ট আদালতের রায় বহাল রেখে সরকারের দায়ের করা রিট খারিজ করে দেন। এ রায়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সরকারকে সেটেলমেন্ট আদালতের রায় দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।

মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ অমান্য করে সম্পত্তিটি সরকার জহিরাকে বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব করলে তিনি হাইকোর্টে আবার একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ওই রিট শুনানি শেষে ১৯৯৭ সালে রায় দেন। রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ স্পষ্টভাবে সরকারকে নির্দেশ দেন, রায়ের কপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে সম্পত্তিটি ‘ক’ তপশিলভুক্ত থেকে অবমুক্ত করে জহিরার কাছে হস্তান্তর করতে। এ মর্মে জহিরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করেনি।

নিজের মালিকানা বুঝে পেতে আর কোনো উপায় না পেয়ে জহিরা ওসমান শেখ ২০০৮ সালে হাইকোর্টে একটি কনটেম্পট মামলা করেন। আগে দায়ের করা রিট মামলার রায় সরকার বাস্তবায়ন না করায় এ কনটেম্পট মামলা করা হয়। মামলায় আদালতের এন এ সুলতানা ও মো. সামসুল হুদার দ্বৈত বেঞ্চ গত ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবেদনকারীর পরিচয় যাচাই সাপেক্ষে রায় দ্রুত বাস্তবায়নের আদেশ দেন। পরে জহিরা ও এম এ মোতালেব গণপূর্তের আইন উপদেষ্টার কাছে কাগজপত্রসহ উপস্থিত হলে মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, সিআইডির হস্তরেখা বিশারদের কাছ থেকেও যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু এবারও জমি বুঝিয়ে দেয় না গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আদালতের রায় বাস্তবায়ন না করে উল্টো মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবার ২০১৬ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। 

এম এ মোতালেব বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা আদালতের আদেশ অনুযায়ী পরিচয় যাচাইয়ের পর আমাদের কাছে ৮-১০ কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেন। কিন্তু এ টাকা না দেওয়ায় তারা প্লট বুঝিয়ে না দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এখন আপিল শুনানি চললেও সেখানে ভবন নির্মাণ চলছে। আর এই ভবনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, মন্ত্রীদের স্বজনকে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতিদের ফ্ল্যাট দিয়েছে মন্ত্রণালয়।’

জহিরা ওসমান শেখ সমকালকে বলেন, ‘১৪ বছর ধরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। তবুও নিজের ন্যায্য জমি বুঝে পাচ্ছি না। আদালত আমার পক্ষে রায় দেওয়ার পরও জমির মালিকানা পাচ্ছি না। ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা আমার প্লটে নিজেদের আলিসান ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এখন আদালতের আদেশ অমান্য করে আমার জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন বৈষম্যহীন সরকার। আমার প্রতি যে অন্যায় করা হচ্ছে, সেটি দেখার কি কেউ নেই? আমার নিজের জমির অধিকার বুঝে পেতে আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে?’
সরেজমিন দেখা যায়, ৩২ কাঠা আয়তনের প্লটটিতে দুই তলা ভবন ভেঙে রাজউকের রূপসা অ্যাপার্টমেন্টের ১৫ তলা ভবনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া ভবনটির এখন ১৪ তলা ছাদের কাজ চলমান। রূপসা অ্যাপার্টমেন্টের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাহাত মুসলেমীন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘ভবনটির ১৪ তলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কাজ শেষ হবে।’ 

রাজউক সূত্র জানায়, রূপসা প্রকল্পে তিন হাজার বর্গফুটের ৪৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ হবে। গত বছরের ৩১ মার্চ লটারির মাধ্যমে ৪৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে পাঁচটি মন্ত্রণালয় ও সরকারের কাছে রেখে বাকি ৪৩টির লটারি অনুষ্ঠিত হয়। 

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-১) এ বি এম এহছানুল মামুন সমকালকে বলেন, ‘চলতি মাসে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। বিচারাধীন সম্পত্তিতে কীভাবে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে, সেটি জানা নেই। তবে নিয়ম না মেনে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি সম্ভব নয়। এটি আবার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে হবে।’ 
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা (অতিরিক্ত সচিব) মো. ফজলুল কবির বলেন, ‘প্লটটি সম্পর্কে আমার কাছে তথ্য নেই। তবে কাগজপত্রসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে এলে বিবেচনা করা হবে। 

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভবন ন র ম ণ এম এ ম ত ল ব ওসম ন শ খ দ য় র কর তৎক ল ন ক ত কর র জউক

এছাড়াও পড়ুন:

খেলাপি ঋণে বাংলাদেশ এশিয়ায় কেন শীর্ষে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ বা খেলাপি ঋণ অনেক দিনের বিরাট সমস্যা। শুরুতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এ ব্যাধি বিদ্যমান হলেও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি, তথা ঋণখেলাপির সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এক মহিরুহ আকার ধারণ করেছে।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে। আবার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এক বছরের ব্যবধানে মোট ঋণের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি।

 সম্প্রতি প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি সামনে এসেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থিক বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালের তথ্য। তাতেই বাংলাদেশ শীর্ষে। এটি যে ২০২৫ সালে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আমরা জানি।

আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অন্যদিকে সহজে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার কারণেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। এখন ঋণমানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করা শুরু হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও আওয়ামী রাজনীতি–সমর্থিত ব্যক্তিদের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সন্দেহ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী, তাঁরা যেন আবার ব্যবসা শুরু করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়ে সরকার কাজও করছে।

 এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সাল শেষে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ২০২১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার।

দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। যেমন ভুটানের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ। ভারতের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণ তাইওয়ান ও কোরিয়ার। দেশ দুটির খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১ ও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, ঋণখেলাপি হওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

সূত্রগুলো বলছে, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কাজ বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। পাশাপাশি সরকারি খাতের জনতা ও রূপালী এবং বেসরকারি খাতের ইউসিবি, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ট্রাস্ট ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে।

পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১ হাজার ২৫০ প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থার অধীন ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন একটি বিস্তৃত নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, এই নীতিমালায় নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ঋণ পরিশোধে যতটা সময় অবকাশ পাবে, ওই সময়ে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছেন অনেকে। তবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না করলে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় মনোযোগী না হলে তার উল্টোটাও ঘটতে পারে। সুযোগের অসৎ ব্যবহারের উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক।

সামগ্রিক ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে পরিচালকদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ।

মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ