আজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মতিথি। শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলাই ‘জন্মাষ্টমী’ নামে অভিহিত ও স্মরণীয়। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম আঁধার থেকে আলোর পথের দিশারি হিসেবে। তিনি শুনিয়েছেন ধর্মের কথা। মানুষের ভেতরের পাপ-পঙ্কিলতাকে দূর করে মুখে দিয়েছেন অমৃত সুধা। মানবজাতির কল্যাণের নিমিত্তে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।

স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, ‘শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার। তিনি মানবজাতির উদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গোপীলীলা প্রেমধর্মের পরাকাষ্ঠা, এই প্রেমে সব ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এবং পরম মিলন ঘটে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আমাকে পাওয়ার জন্য অন্য সব বন্ধন ত্যাগ করো। শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বাস ও প্রেমের দেবতা, পাণ্ডিত্যের দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না। যায় ভালোবাসা দিয়ে। গোপীদের কাছে প্রেম ও ঈশ্বর এক বস্তু। তাঁরা জানতেন, শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের মূর্ত বিগ্রহ। দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণ কর্তব্য শিক্ষা দিয়েছেন। বৃন্দাবনে প্রেম।’ (উৎস: স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ১০ খণ্ড) 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আছে, যখনই পৃথিবীতে অধর্মের প্রাদুর্ভাবে ভক্ত ও সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখন ধর্মসংস্থাপনের জন্য কৃপা করে ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর ‘অবতার’ রূপ নিয়ে থাকেন। তখন তিনি ষড়্‌গুণ যথা ঐশ্বর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্যসম্পন্ন ‘পূর্ণাবতার রূপে’ প্রকাশিত হন।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।/ অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥/ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।/ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥’ (গীতা-৪/৭-৮) বাংলায় অর্থ হলো, ‘যখনই ধর্মের অধঃপতন ও অধর্মের উদ্ভব হয়, তখনই সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্ট লোকের বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপন করার জন্য আমি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হই।’

দ্বাপর যুগে ভাদ্র মাসে রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে আবির্ভূত হন শ্রীকৃষ্ণ। দ্বাপর যুগের শেষ ভাগে ভারতে এক অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। অত্যাচারী রাজা জরাসন্ধ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে এক শ রাজাকে বলি দেওয়ার জন্য এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। এ জন্য ৮৬ জন রাজাকে ধরেও আনেন তিনি। পশ্চিম ভারতে এই অত্যাচারী রাজা জরাসন্ধের জামাতা কংস পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে মথুরার সিংহাসন অধিকার করে আত্মীয়স্বজনের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। 

গীতায় পুরুষোত্তম যেমন সম, শান্ত, নির্গুণ, অনন্ত, অখিলাত্মা; আবার তিনিই গুণপালক, গুণধারক, প্রকৃতি বা কর্মের প্রেরয়িতা, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোক মহেশ্বর। সুতরাং সর্বভূতাত্মৈক্যের জ্ঞানই পুরুষোত্তম জ্ঞান, সর্বভূতে ভালোবাসাও সর্বশরণে আত্মসমর্পণই পুরুষোত্তমে ভক্তি ও সর্বলোকসংগ্রহার্থ নিষ্কাম কর্ম পুরুষোত্তমেরই কর্ম এই জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের মিলন দিয়ে আত্মা সর্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যিনি একই কালে অনন্ত আধ্যাত্মিক শান্তি এবং অনন্ত বিশ্বব্যাপী কর্ম উভয়েরই অধীশ্বর সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করেন।

কেউ কেউ বলেন, ‘অক্ষর বলতে বোঝায় অব্যক্ত প্রকৃতি বা মায়া; আর ক্ষয় বলতে বোঝায় ব্যক্ত জগৎ। আর ব্যক্ত সৃষ্টি ও অব্যক্ত প্রকৃতির অতীত যে ব্রহ্ম, তিনিই পুরুষোত্তম।’

শ্রীকৃষ্ণ অন্যভাবে বলেছেন, ‘আমিই পরতত্ত্ব পুরুষোত্তম। লোকে অক্ষর ও অক্ষয় এই দুই পুরুষ প্রথিত আছে। আমি অক্ষরের অতীত এবং কূটস্থ হতেও উত্তম, এ জন্য আমি পুরুষোত্তম বলে খ্যাতি লাভ করেছি। আমাকে পুরুষোত্তমরূপে জানলে আর কিছুই জানার বাকি থাকে না। তখন জীব বুঝতে পারে যে আমি নির্গুণ, আমিই সগুণ, আমিই বিশ্বরূপ, আমিই অবতার, অমিই আত্মা। এই পুরুষোত্তম তত্ত্ব অতি গুহ্য। এটা জানলে জীব কৃতবিদ্য হয়; সে সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করে।’

পুরুষের ভেতরে উত্তম যিনি, তিনিই পুরুষোত্তম। শ্রীকৃষ্ণ সেই পুরুষোত্তম। এই পুরুষোত্তম এসেছিলেন মানুষের সার্বিক কল্যাণের নিমিত্তে। মৌলিক বিষয়ে কোনো প্রভেদ নেই। প্রভেদ যা কিছু, মূলত প্রথাগত ও আনুষ্ঠানিকতায়। ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান। তিনি পরম করুণাময়। আজকের এই শুভ দিনে আমাদের সবার ভেতর শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

তারাপদ আচার্য্য সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ই প র ষ ত তম র জন য অবত র

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী: তাঁকে পাণ্ডিত্য দিয়ে নয়, পাওয়া যায় ভালোবাসা দিয়ে

আজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মতিথি। শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলাই ‘জন্মাষ্টমী’ নামে অভিহিত ও স্মরণীয়। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম আঁধার থেকে আলোর পথের দিশারি হিসেবে। তিনি শুনিয়েছেন ধর্মের কথা। মানুষের ভেতরের পাপ-পঙ্কিলতাকে দূর করে মুখে দিয়েছেন অমৃত সুধা। মানবজাতির কল্যাণের নিমিত্তে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।

স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, ‘শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরাবতার। তিনি মানবজাতির উদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গোপীলীলা প্রেমধর্মের পরাকাষ্ঠা, এই প্রেমে সব ব্যক্তিত্ব লোপ পায় এবং পরম মিলন ঘটে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, আমাকে পাওয়ার জন্য অন্য সব বন্ধন ত্যাগ করো। শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বাস ও প্রেমের দেবতা, পাণ্ডিত্যের দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না। যায় ভালোবাসা দিয়ে। গোপীদের কাছে প্রেম ও ঈশ্বর এক বস্তু। তাঁরা জানতেন, শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের মূর্ত বিগ্রহ। দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণ কর্তব্য শিক্ষা দিয়েছেন। বৃন্দাবনে প্রেম।’ (উৎস: স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ১০ খণ্ড) 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আছে, যখনই পৃথিবীতে অধর্মের প্রাদুর্ভাবে ভক্ত ও সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখন ধর্মসংস্থাপনের জন্য কৃপা করে ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর ‘অবতার’ রূপ নিয়ে থাকেন। তখন তিনি ষড়্‌গুণ যথা ঐশ্বর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্যসম্পন্ন ‘পূর্ণাবতার রূপে’ প্রকাশিত হন।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।/ অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥/ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।/ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥’ (গীতা-৪/৭-৮) বাংলায় অর্থ হলো, ‘যখনই ধর্মের অধঃপতন ও অধর্মের উদ্ভব হয়, তখনই সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্ট লোকের বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপন করার জন্য আমি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হই।’

দ্বাপর যুগে ভাদ্র মাসে রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে আবির্ভূত হন শ্রীকৃষ্ণ। দ্বাপর যুগের শেষ ভাগে ভারতে এক অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। অত্যাচারী রাজা জরাসন্ধ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে এক শ রাজাকে বলি দেওয়ার জন্য এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। এ জন্য ৮৬ জন রাজাকে ধরেও আনেন তিনি। পশ্চিম ভারতে এই অত্যাচারী রাজা জরাসন্ধের জামাতা কংস পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে মথুরার সিংহাসন অধিকার করে আত্মীয়স্বজনের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। 

গীতায় পুরুষোত্তম যেমন সম, শান্ত, নির্গুণ, অনন্ত, অখিলাত্মা; আবার তিনিই গুণপালক, গুণধারক, প্রকৃতি বা কর্মের প্রেরয়িতা, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোক মহেশ্বর। সুতরাং সর্বভূতাত্মৈক্যের জ্ঞানই পুরুষোত্তম জ্ঞান, সর্বভূতে ভালোবাসাও সর্বশরণে আত্মসমর্পণই পুরুষোত্তমে ভক্তি ও সর্বলোকসংগ্রহার্থ নিষ্কাম কর্ম পুরুষোত্তমেরই কর্ম এই জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের মিলন দিয়ে আত্মা সর্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যিনি একই কালে অনন্ত আধ্যাত্মিক শান্তি এবং অনন্ত বিশ্বব্যাপী কর্ম উভয়েরই অধীশ্বর সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করেন।

কেউ কেউ বলেন, ‘অক্ষর বলতে বোঝায় অব্যক্ত প্রকৃতি বা মায়া; আর ক্ষয় বলতে বোঝায় ব্যক্ত জগৎ। আর ব্যক্ত সৃষ্টি ও অব্যক্ত প্রকৃতির অতীত যে ব্রহ্ম, তিনিই পুরুষোত্তম।’

শ্রীকৃষ্ণ অন্যভাবে বলেছেন, ‘আমিই পরতত্ত্ব পুরুষোত্তম। লোকে অক্ষর ও অক্ষয় এই দুই পুরুষ প্রথিত আছে। আমি অক্ষরের অতীত এবং কূটস্থ হতেও উত্তম, এ জন্য আমি পুরুষোত্তম বলে খ্যাতি লাভ করেছি। আমাকে পুরুষোত্তমরূপে জানলে আর কিছুই জানার বাকি থাকে না। তখন জীব বুঝতে পারে যে আমি নির্গুণ, আমিই সগুণ, আমিই বিশ্বরূপ, আমিই অবতার, অমিই আত্মা। এই পুরুষোত্তম তত্ত্ব অতি গুহ্য। এটা জানলে জীব কৃতবিদ্য হয়; সে সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করে।’

পুরুষের ভেতরে উত্তম যিনি, তিনিই পুরুষোত্তম। শ্রীকৃষ্ণ সেই পুরুষোত্তম। এই পুরুষোত্তম এসেছিলেন মানুষের সার্বিক কল্যাণের নিমিত্তে। মৌলিক বিষয়ে কোনো প্রভেদ নেই। প্রভেদ যা কিছু, মূলত প্রথাগত ও আনুষ্ঠানিকতায়। ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান। তিনি পরম করুণাময়। আজকের এই শুভ দিনে আমাদের সবার ভেতর শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

তারাপদ আচার্য্য সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

সম্পর্কিত নিবন্ধ