গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কমিটিতে পদ পেতে মরিয়া ছাত্রলীগ
Published: 25th, February 2025 GMT
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গোবিপ্রবি) নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই ছাত্রদলে ভিড়েছেন।
ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের ব্যানার ধরে স্লোগান দিলেও এখন তারা নিয়মিত ছাত্রদলের হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন। এছাড়া কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য সদস্য ফরম পূরণ করে জমা দিতে দেখা গেছে জীবন বৃত্তান্তও।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ছাত্রদলের কোন সাংগঠনিক কার্যক্রম না থাকলেও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী নিজেদের জাতীয়তাবাদী আদর্শের সৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসে শোডাউন দিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। এছাড়াও কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য জেলা বিএনপি ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাখছেন নিয়মিত যোগাযোগ।
তবে অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রদলের এসব নতুন নেতৃত্বের অধিকাংশই ইতিপূর্বে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্রলীগের হয়ে বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে তোলা তাদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো দেখা মিলছে।
গত রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ছাত্রদলের কমিটি গঠনের লক্ষ্যে সদস্য ফরম বিতরণ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে নির্বাচন দিয়ে কমিটি হওয়ার কথা রয়েছে। কমিটিতে পদ পাওয়ার জন্য নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা নেতারা এখন ছাত্রদল নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছে।
সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে ছাত্রদলের সভাপতি পদপ্রত্যাশী মাহমুদুল হাসান রাকিবকে ছাত্রলীগের ব্যানারে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে মিছিল করতে দেখা যায়। এছাড়াও তাকে ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীর গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে চেনেন শিক্ষার্থীরা। তাকে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচীতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।
নিজেকে ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী শফিকুল ইসলামকে ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের বিভিন্ন মিছিলে দেখা গেছে। সর্বশেষ টুঙ্গিপাড়ায় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক ইনান এলে কমিটির জন্য তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি।
ছাত্রদলের আরেক সক্রিয় কর্মী শাহজাহানকে ২০২৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিতে দেখা গেছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচীতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন তিনি। একইভাবে ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী ও বর্তমান ছাত্রদল নেতা জহিরুল ইসলাম জহিরকে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন।
এছাড়াও ছাত্রলীগের মিছিল মিটিংয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী মেহেদী হাসান সাকিব, সাব্বির হোসেন, হেদায়েতুল সানিসহ বেশ কয়েকজন এখন রূপ বদল করে ছাত্রদলের কর্মী হয়েছেন।
ছাত্রলীগ নেতা চন্দ্রনাথ মজুমদারের ডান হাত হিসেবে পরিচিত মো.
তবে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমি ছাত্রদলের সদস্য হওয়ার ফরম পূরণ করেছি। আমি ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মিথ্যা লেখালেখি হচ্ছে।”
ছাত্রদলের সভাপতি পদপ্রত্যাশী মাহমুদুল হাসান রাকিব বলেন, “আমি যখন প্রথম বর্ষে ভর্তি হই, তখন আমাদের ময়মনসিংহ বিভাগীয় ছাত্র সংসদ এ ক্যাম্পাসে ভালো একটা অবস্থান ছিল। সে সময় আমি ময়মনসিংহ ছাত্র সংসদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। ময়মনসিংহ বিভাগীয় কিছু বড় ভাই ছিলেন, যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। বিভাগীয় সংগঠনে আমার একটি বড় সার্কেল ছিল।”
তিনি বলেন, “প্রথম বর্ষের হওয়ায় বড় ভাইয়েরা মাদকবিরোধী মিছিল বলে আমাদের নিয়ে যান। মিছিলের একপর্যায়ে তারা আমাকে সামনে দিয়ে দেন। আর আমি যদি সত্যিই ছাত্রলীগ করতাম, তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গোপালগঞ্জের মতো জায়গায় আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রদল করতাম? আমি তো নতুন ছাত্রদল করি না। আমি আওয়ামী লীগের আমল থেকেই ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত।”
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ ও কমিটিতে পদ পাওয়ার বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এবং গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষক মশিউর রহমান সরকার বলেন, “আমরা সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই দায়িত্ব দেব। সবকিছু এত সহজেই কেউ পাবে না। এত বছর আমরা কষ্ট করেছি আর কেউ দুইদিন রাজনীতি করে লোকজন দেখিয়ে পদ পাবে, তা হবে না।”
তিনি বলেন, “ইতোপূর্বে কেউ কোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল কিনা, সবকিছু যাচাই করেই দায়িত্ব দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আপনারাও সহযোগিতা করবেন আশাকরি।”
ঢাকা/রিশাদ/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ছ ত রদল র ক ন ছ ত রদল গ প লগঞ জ র জন য কম ট ত স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
অনশনের পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেলেন ছয় সমন্বয়ক
নিরাপত্তার অজুহাতে গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয়জন সমন্বয়ককে। আটক থাকার এক পর্যায়ে তাঁরা অনশন শুরু করেন। ৩২ ঘণ্টা অনশনের পর ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) দুপুরে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে যাঁর যাঁর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও আবু বাকের মজুমদারকে ছয় দিন; সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে পাঁচ দিন এবং নুসরাত তাবাসসুমকে চার দিন ডিবি কার্যালয়ে তখন আটক রাখা হয়েছিল। এই ছয় সমন্বয়কের মধ্যে নাহিদ এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক। আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। সারজিস, হাসনাত ও নুসরাত এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আবু বাকের এখন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক।
ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার সেই ঘটনা সম্পর্কে সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার বোনের বাসার লোকেশন (ঠিকানা) দিয়েছিলাম ডিবিকে। ১ আগস্ট (২০২৪ সাল) ডিবি তাদের তত্ত্বাবধানেই আমাদের ছয়জনকে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। বোনের বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর আমি প্রথমে আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানিকনগরের একটা জায়গায় দেখা করি। আমরা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। কীভাবে এক দফার (সরকার পতনের) ঘোষণায় যাওয়া যায়, সে বিষয়েও সেদিন আমরা চিন্তা করি।’
সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালিত হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গণসংগীত, পথনাটক, দেয়াললিখন, স্মৃতিচারণা ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয় রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১৬টি জেলা ও মহানগরে। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিছু জায়গায় শিক্ষক ও আইনজীবীরা অংশ নেন। তবে কোথাও কোথাও কর্মসূচিতে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়।
প্রতিবাদ, বিক্ষোভসেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উদ্যোগে পৃথক সমাবেশ-মানববন্ধন ও মিছিল করা হয়। পাশাপাশি সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মহাসড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যা’র প্রতিবাদে ১ আগস্ট বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল শিল্পী ও কলাকুশলীদের। ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে তাঁরা প্রথমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ–সংলগ্ন ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সেদিন সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিল্পীরা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন।
পরে শিল্পীরা ইন্দিরা রোড দিয়ে শোভাযাত্রা করে ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের কাছে সমবেত হন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা সেখানে সড়কের পাশে ব্যানার-পোস্টার নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। শিল্পী, নির্মাতা ও কলাকুশলীরা ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, যে বর্বর পন্থায় শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।
দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের সমাবেশ থেকে সেদিন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণগ্রেপ্তার, মামলা ও হয়রানি বন্ধের দাবি করা হয়। সমাবেশ থেকে আরও জানানো হয়, শিল্পীরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
সেদিন বিকেলে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। মানববন্ধনে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, গুলি করে শিশুসহ নির্বিচার মানুষ হত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে করতে হবে।
সেই মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) বলেন, হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে।
কূটনীতিকদের ‘ব্রিফ’জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট বিকেলে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানান।