আশুলিয়ার ওসির সঙ্গে ‘পরিচিত হতে’ যাওয়া ‘বিএনপি কার্যালয়ের পিয়ন’ চাঁদপুরে গ্রেপ্তার
Published: 6th, March 2025 GMT
ঢাকার আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কক্ষে গিয়ে ‘বিএনপি কার্যালয়ের পিয়ন’ পরিচয় দেওয়া সুমন মিয়া নামের এক যুবক চাঁদপুরে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, সুমন পতিত সরকারের সময় আশুলিয়ায় শ্রমিকনেতা হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পিয়ন পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করছেন।
বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) দুপুরে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী পূর্ব ইউনিয়নের চান্দল গ্রাম থেকে সুমন মিয়াকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলা পুলিশ। সুমন মিয়া শাহরাস্তির চান্দাইল গ্রামের বাসিন্দা। আশুলিয়া থানায় হওয়া বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
এর আগে গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আশুলিয়া থানার ওসির কক্ষে যান সুমন মিয়া। সেখানে কয়েকজন সংবাদকর্মীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সুমন নিজেকে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের পিয়ন পরিচয় দেন। একপর্যায়ে তিনি ওই কক্ষে উপস্থিত কয়েকজনকে আশুলিয়া থানায় সদ্য যোগ দেওয়া ওসি মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামকে ‘ছাত্রলীগের ওসি’ উল্লেখ করেন। সুমন নিজেকে বিএনপির দলীয় কার্যালয় থেকে পাঠানো হয়েছে বলেও দাবি করেন। এ নিয়ে শুরু হয় হট্টগোল।
ওই ঘটনার ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওসির কক্ষে উপস্থিত সাংবাদিকেরা সুমনের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে বিএনপির পার্টি অফিসের পিয়ন পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘ওসি সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি।’ এরপর একজন আগের একটি কথোপকথনের সূত্র ধরে ‘আপনি ওসি সাহেবের কোন বিষয়টি তদন্ত করতে এসেছেন’ জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে সুমনকে বলতে শোনা যায়, ‘দপ্তর স্যার বলছে ওসি নাকি ছাত্রলীগের, ছাত্রলীগের ওসি তাই আমাকে স্যার বলছে, তাই আসছি তার সাথে পরিচিত হতে।’
সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি সুমনের দিকে তেড়ে গিয়ে ‘কে এসব শিখিয়ে দিয়েছে’ বলে জানতে চান। ভিডিওর এক পর্যায়ে সুমন নিজেকে বিএনপির কার্যালয়ের পিয়ন বলে পরিচয় দেন। অফিস থেকে কোনো কাজে নয়, তিনি পরিচিত হতে এসেছেন বলে জানান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের এক পর্যায়ে থানা থেকে সটকে পড়েন সুমন।
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর ওই দিনই যুবকের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানার ওসিকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে বলা হয়, আশুলিয়া থানার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে রুহুল কবির রিজভীর নজরে আসে বিষয়টি। তাৎক্ষণিক তিনি বিএনপির দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, সুমন নামের ব্যক্তিটি ভুয়া পরিচয়ে থানায় গিয়ে বিএনপির নাম নিয়ে এমন অপকর্ম করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আশুলিয়া থানার ওসিকে ফোন করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং ভুয়া পরিচয়ে পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে অসদাচরণ করার জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
এ ঘটনা নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আশুলিয়া থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহীনুর কবির বলেন, গত মঙ্গলবার দুপুরে আশুলিয়া থানার ওসির কক্ষে প্রবেশ করে সুমন নিজেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের পিয়ন পরিচয় দেন। তিনি বিএনপির দলীয় কার্যালয় থেকে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করায় বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে একটার দিকে চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার চিতোষী নামক স্থান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সুমন মিয়া আশুলিয়া এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় পতিত সরকারের সময় শ্রমিকনেতা হিসেবে কাজ করতেন বলে জানান।
সুমন মিয়া বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের পিয়ন পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে থাকেন উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, অনৈতিক সুবিধা আদায়সহ গার্মেন্টস এলাকার অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জন্য একটি মহলের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মূলত আশুলিয়া থানার ওসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পক্ষে অসৎ উদ্দেশ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন সুমন। তাঁকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন জানানো হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীনুর কবির প্রথম আলোকে বলেন, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কোনো নেতার সঙ্গে সুমনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সত্য নয়। আশুলিয়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র ক ন দ র য় স মন ন জ ক স মন ম য় উপস থ ত ন পর চ ন স মন
এছাড়াও পড়ুন:
সমান কাজ করেও কম মজুরি পান আদিবাসী নারীরা
দিন যায়, আসে নতুন দিন। প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যায় অনেক কিছুই। শুধু বদল হয় না সমাজের পিছিয়ে পড়া কিছু জনগোষ্ঠীর ভাগ্য। বিশেষ করে, আদিবাসী নারী শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন যুগ যুগ ধরে।
সমালোচনার মুখে ও সময়ের প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রেই লিঙ্গ বৈষম্য কমেছে। নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য দিনে দিনে কমছে। কিন্তু, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল পল্লীর নারী শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আগের মতোই।
দিনাজপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটামোড় এলাকার সাঁওতাল পল্লী জয়পুর পাড়া। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামটি দেখতে বেশ সুন্দর। নিরিবিলি পরিবেশ, চারদিকে সবুজের সমারোহ। সবুজ ধানক্ষেত আর কিছু দূর পর পর সাঁওতালদের বাড়ি। কোথাও কোথাও উঁচু টিলার মাঝে বড় বড় পুকুর। পুকুর পাড়ে কিছু সাঁওতাল ঘর বেঁধে থাকছেন। পাশের বড় মাঠে খেলা করছে কিছু আদিবাসী শিশু।
আরো পড়ুন:
গাজীপুরে পেশা বদলাচ্ছেন অনেক শ্রমিক
ছোট্ট হাতে সংসারের হাল
পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের কেউ কেউ বাঁশের চটা তুলছেন, কেউ রান্নার জন্য গাছের ডাল কাটছেন। বাড়িতে পালন গরু-ছাগল দেখভাল করছেন পুরুষ ও নারী উভয়ই। নারীদের অধিকাংশই গরু-ছাগল চড়ানোসহ বিভিন্ন কাজে বাড়ির বাইরে। যদিও ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়নি তেমন।
কয়েকজন সাঁওতাল নারীকে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। তারদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমরাও পুরুষের মতো জমিতে বীজ বপন, চারা উত্তোলন, রোপণ, সার দেওয়া, নিড়ানি ও ধান কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত সব কাজ করি। কিন্তু, এখনো সেই আগের মতোই মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছি আমরা।”
গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়নের জয়পুর পাড়া গ্রামের কর্মজীবী সাঁওতাল নারী মমতা হেমব্রম। তিনি বলেন, “পুরুষরা কাজ করে মজুরি পান ৫০০ টাকা আর আমাদেরকে দেওয়া হয় ৪৫০ টাকা। ক্ষেত-খামারের কাজ অনেক কঠিন। পুরুষ-নারী তো সমান কাজ করি। আমরা সমান মজুরি চাই, কিন্তু চাইলেও তো তারা দেন না।”
একই গ্রামের সাবিনা হাসদা। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, “এই অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষ ও নারী ধান-আখ ও মাছ চাষ ও গরু-ছাগল লালনপালন করেন। কাজ একই হলেও আমাদের মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। আমরা সমান মজুরি চাই।”
সুরুজ মনি টুডু নামের আরেক নারী বলেন, “আমরা পুরুষের সমান কাজ করি, তাই আমরা এই মে দিবস থেকেই সমান মজুরি চাই। আপনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছে সমান মজুরি নিশ্চিত করার দাবি করছি।”
সাপমারা গ্রামের দেলু মারমা বলেন, “আমাদের সব কাজই কৃষিনির্ভর। সে কারণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের কাজ করতে হয়। তা না হলে সংসার চলে না। আমরাও চাই, পুরুষ এবং নারী যেন সমান মজুরি পান।”
পুকুর পাড়েই বাস করেন অমেদা হাজদা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “সব জায়গায় পুরুষের দাম বেশি, নারীদের দাম কম। সে কারণে তাদের মজুরি বেশি, আমাদের কম। আমাদেরকেও পুরুষের সমান দাম দেবে, সমান মজুরি দেবে, এটাই আমাদের দাবি।”
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে রাইজিংবিডিকে বলেন, “এই এলাকার অধিকাংশ নারী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা বিষয়ে তাদের ধারণাই নেই। অনেকে জানলেও কাজ হারানোর ভয়ে ন্যায্য মজুরির বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সমঅধিকারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক রিকতু প্রসাদ বলেন, “গাইবান্ধার নারীরা আজও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে, গোবিন্দগঞ্জের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নারীরা। নারী-পুরুষ সবাই শ্রমিক, বৈষম্য করতেই তাদের আলাদা চোখে দেখা হয়। মে দিবসে মুখে যতই বলি না কেন, পুরুষশাসিত সমাজে এখনো পরিবর্তন আসেনি। সমাজ থেকে মজুরি বৈষম্য দূর করার জোর দাবি জানাই।”
বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী রাইজিংবিডিকে বলেন, সব ক্ষেত্রেই নারীরা অবহেলিত এবং বঞ্চিত। মুখে সবাই নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উল্টো। সাঁওতাল তথা আদিবাসী নারীদের সমান মজুরি পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। তারা এ দেশেরই নাগরিক। তাদের সমান মজুরি নিশ্চিত করতে করা প্রয়োজন।
ঢাকা/মাসুম/রফিক