জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে মাথায় গুলিবিদ্ধ শিশু মুসা সাড়ে পাঁচ মাস পর দেশে ফিরছে
Published: 3rd, April 2025 GMT
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত শিশু বাসিত খান মুসা (৭) সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরছে। ৫ মাস ১২ দিন পর আজ বৃহস্পতিবার মা–বাবার সঙ্গে দেশে ফিরছে সে। অত্যন্ত সংকটাপন্ন মুসাকে নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনের পর গত ২২ অক্টোবর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠায় সরকার।
সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে দীর্ঘ সময় ধরে তার চিকিৎসা হয়েছে। মুসার ডান পাশ এখনো প্যারালাইজড। সে এখন কিছুটা সাহায্য নিয়ে নিজে থেকে বসে থাকতে পারে। নিজে নিজে খেলে। লোকজনকে দেখলে হাসে। চিকিৎসকেরা মুসার মা–বাবাকে জানিয়েছেন, মুসার মাথায় গুলি রয়ে গেছে। এ কারণে যেকোনো সময় তার সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। তাই তাকে সাবধানে রাখতে হবে।
মুস্তাফিজুর রহমান ও নিশামনি দম্পতির একমাত্র সন্তান বাসিত খান মুসা। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় মেরাদিয়া হাট এলাকায় নিজ বাসার নিচে মুসাকে আইসক্রিম কিনে দিতে নেমে দাদি মায়া ইসলাম (৬০) ও মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। মায়া ইসলাম পরদিন মারা যান। মালিবাগে মুসার বাবা ও দাদার ইলেকট্রনিক পণ্যের একটি দোকান রয়েছে।
মুসার মা নিশামনি গতকাল বুধবার হোয়াটসঅ্যাপ কলে প্রথম আলোকে জানান, বৃহস্পতিবার (আজ) বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে তাঁরা দেশের উদ্দেশে রওনা দেবেন। ঢাকায় পৌঁছাবেন রাত ১১টার দিকে। ঢাকায় ফেরার পরপরই মুসাকে নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। মুসাকে তিন মাসের কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে। বাসায় নিলে সেভাবে ব্যবস্থা করতে হবে। সংক্রমণ এড়াতে মুসাকে কেউ যেন দেখতে না আসে, সেটি নিশ্চিত করতে বলেছেন চিকিৎসকেরা।
মুসার পরিবার ও সিএমএইচের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, দেশে থাকা অবস্থায় মুসা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিল। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র ছাড়া শ্বাস নিতে পারত না। খিঁচুনি হতো। মুসার দেহ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে পড়েছিল। রক্তে সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছিল না বলে শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছিল। তার ডান পাশ শুরু থেকেই প্যারালাইজড ছিল। চোখের পাতাও নড়াত না।
সিঙ্গাপুরে অনেক ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে মুসার সংক্রমণ ঠেকানো হয়। তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র খুলে দেওয়া হয়। নভেম্বর মাসে মুসা কিছুটা তাকায় ও হাত-পা কিছুটা নাড়ে। তবে সেই সময় তাঁর দৃষ্টি অর্থপূর্ণ ছিল না। চোখে আলো ফেললে কোনো সাড়া দিত না। ডান পাশ প্যারালাইজড ছিল। ফিজিওথেরাপি শুরু করার পর জানুয়ারি মাসে তাকে কিছু সময় ধরে বসানো শুরু হয়। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ সময়ের চিকিৎসায় মুসার মাথা, গলা, পেটে ২০টির বেশি অস্ত্রোপচার হয়েছে।
মুসা ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতাল ও পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সরকারি ব্যয়ে চিকিৎসাধীন থাকার সময় একাধিকবার প্রথম আলো সংবাদ প্রকাশ করে। মুসাকে নিয়ে গত ২৮ জুলাই প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। দেশে মুসার চিকিৎসা আর সম্ভব নয় জানার পর গত ৭ অক্টোবর ‘আন্দোলনকালে গুলিবিদ্ধ শিশু মুসাকে সিঙ্গাপুরে নিতে বলছেন চিকিৎসকেরা, কে দেবে এত টাকা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। এই সংবাদ প্রকাশের পর চ্যানেল আই মুসাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেয়। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ২০তম ব্যাচের চিকিৎসকদের উদ্যোগে দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত চিকিৎসক ও প্রবাসীরা ও দেশের মানুষ অর্থসহায়তা দিয়ে মুসার পাশে দাঁড়ান। সরকার সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে মুসার চিকিৎসা নিশ্চিত করে।
মুসা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে সিএমএইচের নিউরোসার্জারি বিভাগে (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য) স্থানান্তর করা হয় গত ২৬ আগস্ট। আর গত ৪ সেপ্টেম্বর তাকে স্থানান্তর করা হয় হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি বিভাগে। সিএমএইচে মুসা জ্যেষ্ঠ নিউরোসার্জন অধ্যাপক কর্নেল মো.
মুসা এখন কেমন আছে জানতে চাইলে মা নিশামনি বলেন, ‘সবার দোয়ায় মুসার শরীর আগের চেয়ে ভালো আছে। ওর স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। ওর মাথায় গুলি বাঁ দিক দিয়ে ঢুকেছিল। অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হয়েছেন গুলিটা ডান পাশে আটকে আছে। এটা বের করা যাচ্ছে না। ওর ডান হাত ও পা, মুখমণ্ডল অর্থাৎ পুরো ডান পাশ প্যারালাইজড। ফলে ও নিজে থেকে উঠে বসতে পারে না। কিছুটা সাহায্য করলে উঠে বসতে পারে। তবে ও হাসে–খেলে। নিজে থেকে মোবাইলের লক খুলে পছন্দমতো ভিডিও বের করে দেখতে পারে। লোকজনকে খুব পছন্দ করে। কাউকে দেখলেই হাসি দেয়। মুঠোফোনে কেউ ভিডিও কল করলে আনন্দ প্রকাশ করতে মুঠোফোনে চুমু খায়।’
মুসাকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স লেগেছিল। এখন সে আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ বলে মা–বাবার সঙ্গে উড়োজাহাজের আসনে বসেই ফিরবে। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর নভেম্বরের একদিন মুসার মা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, কোনো একদিন হুট করে ছেলে আবার তাকে ‘মা’ বলে ডেকে উঠবে, সেই অপেক্ষায় দিন গুনছেন তিনি। এখনো তিনি সেই অপেক্ষায় আছেন বলে জানান। কারণ, মুসা এখনো কথা বলে না। তিনি বলেন, এক পাশ প্যারালাইজড হওয়ায় মুসা হাঁ করে নিজে থেকে খেতে পারে না। তাকে টিউব দিয়ে খাওয়ানো হয়। প্রস্রাব–পায়খানার কথাও বলতে পারে না। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ধীরে ধীরে মুসার উন্নতি হতে পারে।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে জানান, পুরোপুরি সুস্থতার জন্য মুসার দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনমূলক চিকিৎসা দরকার। সরকার সিঙ্গাপুরে যেভাবে চিকিৎসাসহায়তা দিয়েছে, দেশেও তা অব্যাহত রাখবে। সিএমএইচে কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে রাখার পর মুসাকে সিআরপিতে নেওয়া হবে। সে যেন হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে, সে লক্ষে৵ লম্বা সময় ধরে ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং স্পিচ থেরাপি দেওয়া হবে। সরকার এ ব্যয় বহন করবে। তিনি আরও বলেন, সিঙ্গাপুরে মুসাকে পঞ্চম প্রজন্মের যে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে, তা দেশে পাওয়া যায় না। তাই তাকে লোকজন থেকে বেশ কিছুদিন আলাদা রাখতে হবে যেন সংক্রমণ না হয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প য র ল ইজড চ ক ৎসক র প রথম আল স এমএইচ স ক রমণ র জন য সরক র অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।
বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী
‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত
সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।
লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড
ঢাকা/লিপি