স্মার্টফোনের ‘গ্রে মার্কেট’ যে কারণে ক্ষতিকর
Published: 26th, April 2025 GMT
বাংলাদেশের মোবাইল ফোন খাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ছে, দেশে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর বিনিয়োগও বেড়েছে। এর মাঝেও স্মার্টফোনের গ্রে মার্কেট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে আমদানি হওয়া ফোনের এই বাজার ক্রমেই বাড়ছে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি এটি স্থানীয় স্মার্টফোন উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারের ৪০ শতাংশই গ্রে মার্কেটের দখলে। অর্থের হিসাবে তা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বাজার। বর্তমানে প্রতিটি মোবাইল বিক্রির ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়াও দেশীয়ভাবে উৎপাদিত ফোনের ওপর প্রায় ১৭ শতাংশ কর ও ভ্যাট আরোপ করা হয়। গ্রে মার্কেটের ফোনগুলো অবৈধ পথে প্রবেশ করায় এই করের কোনো অংশই রাষ্ট্র পাচ্ছে না।
শুধু রাজস্ব ক্ষতিই নয়, এর ফলে স্থানীয় উৎপাদনশীলতা ও বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বৈধ ব্র্যান্ডগুলো যখন রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে সংকটের মুখে পড়ে, তখন তারা স্থানীয় উৎপাদনে বিনিয়োগ কমাতে বাধ্য হয়। ফলে দেশীয় উৎপাদনকারীদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যায় এবং তারা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসা করতে পারে না। এ ছাড়াও গ্রে মার্কেটের কারণে বাজারে অফিসিয়াল স্মার্টফোনের বিক্রি কমে যায়, যা দীর্ঘ মেয়াদে স্থানীয় ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই অবৈধ বাজারের মাধ্যমে ক্রেতারা কম দামে ফোন পেলেও, ফোন ব্র্যান্ডগুলোর আস্থা হারানোর কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছেও বাংলাদেশ একটি কম আকর্ষণীয় বাজার হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে পড়ে। গ্রে মার্কেটের বিস্তারের ফলে স্থানীয় উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আর ব্যবসা কমে যাওয়ার সঙ্গে কর্মসংস্থান সংকুচিত বা চাকরিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়।
বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) চালু করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোন শনাক্ত করে এগুলোর নেটওয়ার্ক সংযোগ বন্ধ করা। এর মাধ্যমে প্রতিটি মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর নিবন্ধিত হয় এবং যদি কোনো ফোন অনুমোদিত তালিকার বাইরে থাকে, তবে সেটি কোনো স্থানীয় মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হতে পারে না।
এনইআইআর চালুর ফলে প্রথমদিকে বেশ কিছু অবৈধ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ফলে বাজারে অনুমোদিত মোবাইল ফোনের চাহিদাও কিছুটা বেড়ে যায়। পাশাপাশি মোবাইল আমদানি ও উৎপাদন খাতে স্বচ্ছতা আনতে এটি একটি কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তবে এখনও গ্রে মার্কেটের বহু ফোন অনিবন্ধিত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে যেগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে বা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করছে সেগুলো। কিছু ব্যবহারকারী অবৈধ পন্থায় আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে এনইআইআরের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বলা চলে, এনইআইআর সিস্টেমের আরও উন্নয়ন প্রয়োজন, যেন এটি দ্রুত ও নির্ভুলভাবে অবৈধ ফোন শনাক্ত করতে পারে। সরকারের পাশাপাশি মোবাইল অপারেটর, ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে, যেন গ্রে মার্কেট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
গ্রে মার্কেটের ফোনে কোনো ওয়ারেন্টি সেবা থাকে না, ফলে ফোনে কোনো সমস্যা হলে ক্রেতা বিপদে পড়েন। গ্রে মার্কেটের অনেক ফোনে অফিসিয়াল সফটওয়্যার আপডেটে সমস্যা হয়। এতে ফোন সুরক্ষা ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বাইরে থেকে অনুমোদন ছাড়া নিয়ে আসা অনেক ফোন বাংলাদেশের নেটওয়ার্কের সঙ্গে ঠিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না; ফলে কল ড্রপ, ধীরগতির ইন্টারনেট ইত্যাদি সমস্যা দেখা যেতে পারে। অন্যদিকে অফিসিয়াল ফোনে নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেট হয় এবং নিরাপত্তা প্যাচ পাওয়া যায়, যা ফোনের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে।
গ্রে মার্কেট নিয়ন্ত্রণে স্মার্টফোনের অবৈধ আমদানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং আইনগত দিক থেকে নজরদারি বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে কেন অফিসিয়াল স্মার্টফোন কেনা জরুরি। সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে স্মার্টফোন প্রতিষ্ঠান ও সরকার একসঙ্গে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে পারে, যেন ক্রেতারা অনুমোদিত চ্যানেলের মাধ্যমে পণ্য কেনার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। এনইআইআর ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং একই সঙ্গে গ্রে মার্কেটের ফোনগুলোকে কার্যকরভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সর্বোপরি নীতি সংস্কার, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ স্মার্টফোন বাজার গড়ে তুলতে পারি, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।
আবদুল্লাহ আল মামুন: উদ্যােক্তা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অন ম দ ত অফ স য ব যবস ন টওয আমদ ন সরক র উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।
বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী
‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত
সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।
লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড
ঢাকা/লিপি