বাংলাদেশের মোবাইল ফোন খাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ছে, দেশে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর বিনিয়োগও বেড়েছে। এর মাঝেও স্মার্টফোনের গ্রে মার্কেট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে আমদানি হওয়া ফোনের এই বাজার ক্রমেই বাড়ছে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি এটি স্থানীয় স্মার্টফোন উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারের ৪০ শতাংশই গ্রে মার্কেটের দখলে। অর্থের হিসাবে তা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বাজার। বর্তমানে প্রতিটি মোবাইল বিক্রির ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়াও দেশীয়ভাবে উৎপাদিত ফোনের ওপর প্রায় ১৭ শতাংশ কর ও ভ্যাট আরোপ করা হয়। গ্রে মার্কেটের ফোনগুলো অবৈধ পথে প্রবেশ করায় এই করের কোনো অংশই রাষ্ট্র পাচ্ছে না।
শুধু রাজস্ব ক্ষতিই নয়, এর ফলে স্থানীয় উৎপাদনশীলতা ও বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বৈধ ব্র্যান্ডগুলো যখন রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে সংকটের মুখে পড়ে, তখন তারা স্থানীয় উৎপাদনে বিনিয়োগ কমাতে বাধ্য হয়। ফলে দেশীয় উৎপাদনকারীদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যায় এবং তারা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসা করতে পারে না। এ ছাড়াও গ্রে মার্কেটের কারণে বাজারে অফিসিয়াল স্মার্টফোনের বিক্রি কমে যায়, যা দীর্ঘ মেয়াদে স্থানীয় ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই অবৈধ বাজারের মাধ্যমে ক্রেতারা কম দামে ফোন পেলেও, ফোন ব্র্যান্ডগুলোর আস্থা হারানোর কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছেও বাংলাদেশ একটি কম আকর্ষণীয় বাজার হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে পড়ে। গ্রে মার্কেটের বিস্তারের ফলে স্থানীয় উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আর ব্যবসা কমে যাওয়ার সঙ্গে কর্মসংস্থান সংকুচিত বা চাকরিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়। 

বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) চালু করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল অবৈধভাবে আমদানি করা মোবাইল ফোন শনাক্ত করে এগুলোর নেটওয়ার্ক সংযোগ বন্ধ করা। এর মাধ্যমে প্রতিটি মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর নিবন্ধিত হয় এবং যদি কোনো ফোন অনুমোদিত তালিকার বাইরে থাকে, তবে সেটি কোনো স্থানীয় মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হতে পারে না।

এনইআইআর চালুর ফলে প্রথমদিকে বেশ কিছু অবৈধ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ফলে বাজারে অনুমোদিত মোবাইল ফোনের চাহিদাও কিছুটা বেড়ে যায়। পাশাপাশি মোবাইল আমদানি ও উৎপাদন খাতে স্বচ্ছতা আনতে এটি একটি কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তবে এখনও গ্রে মার্কেটের বহু ফোন অনিবন্ধিত অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে যেগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে বা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করছে সেগুলো। কিছু ব্যবহারকারী অবৈধ পন্থায় আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে এনইআইআরের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বলা চলে, এনইআইআর সিস্টেমের আরও উন্নয়ন প্রয়োজন, যেন এটি দ্রুত ও নির্ভুলভাবে অবৈধ ফোন শনাক্ত করতে পারে। সরকারের পাশাপাশি মোবাইল অপারেটর, ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে, যেন গ্রে মার্কেট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।

গ্রে মার্কেটের ফোনে কোনো ওয়ারেন্টি সেবা থাকে না, ফলে ফোনে কোনো সমস্যা হলে ক্রেতা বিপদে পড়েন। গ্রে মার্কেটের অনেক ফোনে অফিসিয়াল সফটওয়্যার আপডেটে সমস্যা হয়। এতে ফোন সুরক্ষা ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বাইরে থেকে অনুমোদন ছাড়া নিয়ে আসা অনেক ফোন বাংলাদেশের নেটওয়ার্কের সঙ্গে ঠিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না; ফলে কল ড্রপ, ধীরগতির ইন্টারনেট ইত্যাদি সমস্যা দেখা যেতে পারে। অন্যদিকে অফিসিয়াল ফোনে নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেট হয় এবং নিরাপত্তা প্যাচ পাওয়া যায়, যা ফোনের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। 
গ্রে মার্কেট নিয়ন্ত্রণে স্মার্টফোনের অবৈধ আমদানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং আইনগত দিক থেকে নজরদারি বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে কেন অফিসিয়াল স্মার্টফোন কেনা জরুরি। সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে স্মার্টফোন প্রতিষ্ঠান ও সরকার একসঙ্গে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে পারে, যেন ক্রেতারা অনুমোদিত চ্যানেলের মাধ্যমে পণ্য কেনার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। এনইআইআর ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং একই সঙ্গে গ্রে মার্কেটের ফোনগুলোকে কার্যকরভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সর্বোপরি নীতি সংস্কার, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ স্মার্টফোন বাজার গড়ে তুলতে পারি, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।

আবদুল্লাহ আল মামুন: উদ্যােক্তা
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অন ম দ ত অফ স য ব যবস ন টওয আমদ ন সরক র উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

ঋণ নেওয়ার আগে যে ১০টি বিষয় অবশ্যই জানা উচিত

নানা কারণে আপনার ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় মানুষ ব্যক্তিগত ঋণ, গৃহঋণ নেয়। আবার গাড়ি কেনার জন্যও অনেকে ঋণ নেন। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও ঋণ নেওয়া হয়।

কিন্তু অনেকেই ঋণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু মৌলিক শব্দ সম্পর্কে জানেন না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন এসব শব্দ বলেন, তখন অনেক কিছুই বোঝেন না ঋণ নিতে ইচ্ছুক গ্রাহকেরা। ফলে নিয়মকানুন না জেনেই ঋণ নেন। এতে নানা অপ্রত্যাশিত ঝামেলা তৈরি হয়। তাই ঋণ নেওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝা খুব দরকার।

১. আসল টাকা (প্রিন্সিপাল)

আপনি যে পরিমাণ টাকা ঋণ নিচ্ছেন, সেটিই আসল। এর ওপরই সুদ ধরা হয়। কিস্তি পরিশোধের সঙ্গে আসল ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

২. সুদের হার (ইন্টারেস্ট রেট)

ঋণ নেওয়ার আগে সবচেয়ে ভাবতে হয় সুদের হার নিয়ে। সুদের হার বেশি হলে খরচ বেড়ে যায়। ঋণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুদের হার। এটি স্থিরও হতে পারে, আবার বাজারদরের ওপর নির্ভর করে বাড়তে-কমতেও পারে।

৩. মাসিক কিস্তি (ইএমআই)

ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ বাবদ প্রতি মাসে যে নির্দিষ্ট টাকা আপনাকে দিতে হবে। সেটি হলো ইএমআই বা ঋণের কিস্তি।

৪. ঋণের মেয়াদ

কত বছরের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হবে, সেটিই হলো ঋণের মেয়াদ। মেয়াদ বেশি হলে কিস্তি ছোট হয়। কিন্তু মোট সুদের টাকা বেড়ে যায়। ছোট মেয়াদে কিস্তি বড় হয়। কিন্তু মোট সুদের টাকা কমে।

৫. অ্যানুয়াল পারসেন্টেজ রেট (এপিআর)

শুধু সুদ ও আসল নয়, বরং ঋণের সব খরচ (যেমন ফি, চার্জ) মিলিয়ে আসল ব্যয় কত হবে, তার হিসাব হলো অ্যানুয়াল পারসেন্টেজ রেট (এপিআর)। এটিই প্রকৃত খরচ বোঝায়।

৬. আগাম পরিশোধ (প্রিপেমেন্ট)

ঋণের বোঝা কমাতে অনেকে ঋণের সুদ ও আসলের টাকা আগেই শোধ করে দিতে চান। এতে সুদের খরচ কমে যায়।

৭. প্রসেসিং ফি

আপনি ঋণের জন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করলেন। কিন্তু ঋণ আবেদন মঞ্জুর থেকে শুরু করে ছাড় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু মাশুল দিতে হয়। এটিই প্রসেসিং ফি। এটি কখনো ঋণের টাকা থেকে কেটে নেওয়া হয়, আবার কখনো আলাদা দিতে হয়।

৮. স্থগিতকাল (মোরাটোরিয়াম)

বিশেষ পরিস্থিতিতে কিছুদিনের জন্য কিস্তি বন্ধ রাখার সুযোগকেই বলে স্থগিতকাল। তবে এই সময়েও সুদ জমতে থাকে। অনেক সময় ঋণ পরিশোধের জন্য বিশেষ কিস্তি ভাগও করে দেওয়া হয়।

৯. জামানত (কোলেটারাল)

ঋণের নিরাপত্তা হিসেবে আপনার সম্পদ (যেমন বাড়ি, সোনা, জমি) ব্যাংকে বন্ধক রাখা হয়। কিস্তি না দিলে ব্যাংক ওই সম্পদ বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়।

১০. লোন-টু-ভ্যালু রেশিও

আপনি যত টাকা ঋণ নিচ্ছেন আর জামানতের মূল্য কত—এই অনুপাতকে বলে লোন টু ভ্যালু রেশিও (এলটিভি)। এর অনুপাত যত কম হয়, ব্যাংকের ঝুঁকি তত কম।

সম্পর্কিত নিবন্ধ