শিল্পে ন্যায্য জ্বালানির জন্য চাই সমন্বিত পথনকশা
Published: 16th, May 2025 GMT
বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত ক্রমবর্ধমানভাবে জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করে আসছে। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান দাম, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অনিশ্চিত গ্যাস সরবরাহ এবং পুরোনো অবকাঠামোর কারণে উৎপাদন সচল রাখতে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যদিও শিল্প উদ্যোক্তারা ব্যবসায় প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিজস্ব উদ্যোগে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এটা বালির বাঁধ নির্মাণের মতোই।
জ্বালানির অন্যতম চ্যালেঞ্জ গ্যাসের শুল্ক নিয়ে দ্বৈত নীতি। পুরোনো কারখানা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য বাবদ প্রায় ১৬ টাকা পরিশোধ করে। নতুন কারখানার জন্য যা ৩০ টাকা অথবা তার বেশি টাকা। দ্বৈত নীতি মিরসরাইয়ের মতো নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন বিনিয়োগকারীর টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। আবার বাংলাদেশে এলএনজি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বিতরণের অবকাঠামোর অভাবও রয়েছে। এলএনজির জন্য আমরা মহেশখালীর কাছে দুটি ভাসমান টার্মিনালের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করি, যেখানে কোনো জমিভিত্তিক স্টোরেজ বা রিজার্ভার নেই। যখন বিশ্বব্যাপী এলএনজির দাম বেড়ে যায় অথবা যখন জাহাজ আসতে দেরি হয়। আমাদের কোনো বাফার থাকে না। নতুন শিল্প এলাকায় প্রায়ই প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাসের চাপ পাওয়া যায় না। অনেক এসএমই প্রতিষ্ঠানের জন্য এলএনজি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। স্যাটেলাইট রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা মডুলার স্টোরেজ সমাধান না থাকায় তারা প্রায়ই ডিজেলের মতো ব্যয়বহুল এবং দূষণকারী বিকল্পের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমাদের অগ্রগতি মন্থর। শিল্প যে জ্বালানি ব্যবহার করে, সেখানে সৌরবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের অংশ এখনও নগণ্য। বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে অনেক কারখানা ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন বা অন-সাইট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নেট মিটারিং ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব– প্রভৃতি কারণে তারা এগোতে পারছে না।
লক্ষ্যণীয় বিষয়, বর্তমান সময়ে শিল্পে জ্বালানি-দক্ষ প্রযুক্তি যেমন ভ্যারিয়েবল স্পিড ড্রাইভস, উচ্চ দক্ষসম্পন্ন মোটর এবং আধুনিক বয়লারের ব্যবহার আর ঐচ্ছিক নয়। এগুলো ব্যবসার নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয়তা। যেহেতু বিদ্যুতের দাম ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে, তাই কারখানাগুলো দূরদর্শিতা সহকারে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কল্পনা করা যাক, একটি কারখানা মাসে এক লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। প্রতি কিলোওয়াট ১০ টাকা করে কারখানাটির মাসিক বিদ্যুৎ বিল হয় ১০ লাখ টাকা। জ্বালানি-দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কারখানাটি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারে। এভাবে প্রতি মাসে ১৫ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বা দেড় লাখ টাকা সাশ্রয় করতে পারে, যা বছরে ১৮ লাখ টাকা। সাশ্রয় করা অর্থ দিয়ে প্রযুক্তি মানোন্নয়ন, মজুরি বা সাসটেইনেবিলিটি ক্ষেত্রে পুনর্বিনিয়োগ করা যেতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়তা করবে। যেহেতু ক্রেতারা ক্রমবর্ধমানভাবে সাপ্লাই চেইন-জুড়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর দাবি করছে, তাই জ্বালানি দক্ষতা শুধু অর্থ সাশ্রয় নয়, বরং শিল্পের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়।
গ্যাসের শুল্কনীতি এমন করে প্রণয়ন করতে হবে, যাতে করে শিল্পে নতুন উদ্যোক্তারা বৈষম্য বা হয়রানির সম্মুখীন না হন। আরও কিছু করণীয় রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ল্যান্ড টার্মিনাল, স্টোরেজ ট্যাঙ্ক এবং মডুলার ডিস্ট্রিবিউশন ইউনিটসহ এলএনজি অবকাঠামো তৈরি করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তর ত্বরান্বিত করা, বিশেষ করে কারখানা ভবনের ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্ন নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কারখানাগুলোকে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাস্তবসম্মত; কিন্তু উচ্চাভিলাষী জ্বালানি লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য সরকারের উচিত হবে শিল্প, উন্নয়ন অংশীদার এবং সুশীল সমাজকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা। ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ এবং এলডিসি থেকে উত্তরণ মসৃণ রাখার জন্য সুস্পষ্ট বাস্তবায়ন পরিকল্পনা দরকার। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চাপের সময়টিতে যদি আমাদের জ্বালানি ব্যবস্থা শিল্পের একটি বড় অংশকে দুর্বল করে রাখে, তাহলে আমরা সবুজ প্রবৃদ্ধিতে যেতে পারব না।
পরিশেষে, আমাদের জ্বালানি নীতিকে শিল্প কৌশল থেকে আলাদা করে ভাবা বন্ধ করতে হবে। যদি জ্বালানি খুব ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে বা অনিশ্চিত হয়, তাহলে ব্যবসা টিকে থাকবে না। শ্রমিকরা চাকরি হারাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়া আমাদের নাগালের বাইরে থেকে যাবে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে দরকার একটি সাহসী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুদূরপ্রসারী জ্বালানি পরিকল্পনা। ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তর মানে শুধু পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠা বোঝায় না। আমরা যে ভবিষ্যৎ তৈরি করার চেষ্টা করছি, প্রত্যেকেই যেন সেই ভবিষ্যতের অংশ হতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যও এটি দরকার।
লেখক : বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: মত মত ব যবহ র কর ন র জন য আম দ র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্ক চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈঠক বৃহস্পতিবার, বাড়তি শুল্ক কমার আশা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক শুল্ক চু্ক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে ওয়াশিংটনে বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের (ইউএসটিআর) সঙ্গে বৈঠকে বসবেন প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত চূক্তির খসড়া নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। চুক্তি হলে ট্রাম্প প্রশাসনের বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপ করা বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের হার কিছুটা কমবে।সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত পাল্টা শুল্ক চুক্তির একটি খসড়া বাংলাদেশে পাঠিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। জবাবে খসড়ার ওপর মতামত ওয়াশিংটনে পাঠায় ঢাকা। এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিরা (ইউএসটিআর) বৈঠক করেন। বৈঠকে উভয় পক্ষের দরকষাকষির পর খসড়ায় আবারও কিছুটা পরিবর্তন আনছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যা আজ মঙ্গলবার চূড়ান্ত করে নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হবে। এ সংশোধিত খসড়া নিয়েই বৃহস্পতিবার ওই বৈঠকে বসবে উভয় পক্ষ।
একদিনের বৈঠকে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হলে পরদিনও বৈঠক হতে পারে। এসব বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। তবে সেটি সম্ভব না হলে ভার্চুয়ালি তিনি যুক্ত হবেন।
এ বিষয়ে সোমবার বাণিজ্য বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, পাল্টা শুল্ক চুক্তির খসড়ায় সংযোজন-বিয়োজন করে ইতোমধ্যেই দুবার মতামত যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। এসব মতামতের বিষয়ে দরকষাকষি করতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। আজ মঙ্গলবার তার কাছে তৃতীয় মতামতটি পাঠানো হবে। এ মতামতের ভিত্তিতে চুক্তি চূড়ান্ত করতে আগামী বৃহস্পতিবার। সেখানে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না হলে পরবর্তীতে আরও বৈঠকের প্রয়োজন হতে পারে।
দরকষাকষি শেষে চুক্তি করতে কতদিন সময় লাগতে পারে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, চুক্তি করার ক্ষেত্রে অন্যান্য যে কোনো দেশের সঙ্গে এগিয়ে রয়েছি। গত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে এ পর্যন্ত ২৮ দফা বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে গেলে সেটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন নিতে হবে। এরপর ভেটিং হয়ে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন। তারপরই চুক্তি করার বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্রে পক্ষ থেকে বেশকিছু কঠিন প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন–কানুনের মধ্য থেকে বাংলদেশ বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ওপরই বেশি জোর দিয়ে মতামত দিয়েছে। কারণ, বাণিজ্য ঘাটতির ওপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। এক্ষেত্রে খসড়ার মতামতে জানানো হয়, বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করে এমন অন্তত ৪১ পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি আনার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে পেট্রোলিয়াম পণ্য, তুলা, প্রোপেন বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), সয়াবিন তেল, গম, এলএনজি উল্লেখযোগ্য।
সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি কেনাকাটা বাড়ানোর উদ্যোগের বিষয়টিও মতামতে জানানো হয়। এরই অংশ হিসেবে দেশটি থেকে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তির আওতায় বাড়তি আরও ১ বিলিয়ন ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হবে। খাদ্য-শস্য আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। সম্প্রতি ইউক্রেন থেকে ৩ লাখ টন গম আমদানি উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসব গম আমদানি সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বাংলাদেশের সামরিক কেনাকাটার মূল উৎস হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি থেকে এ অস্ত্র কেনা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং–এর প্রায় সবগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটি থেকে আরও কিছু উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।