ইরান কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, বরং গোটা এক সভ্যতা। প্রাচীন ও আত্মসচেতন এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে শত শত বছর ধরে দর্শন, শিল্প ও আধ্যাত্মিকতার চর্চার মধ্য দিয়ে। এই সভ্যতাগত চরিত্রই যুগে যুগে ইরানের রাজনৈতিক ও নৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। 

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ। তবে তা আত্মসম্মানবোধ থেকে, আত্মসমর্পণ থেকে নয়। তবু পশ্চিমা গণমাধ্যম ও তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকেরা ইরানকে এক ‘দুষ্ট রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরেছে। যেন পশ্চিমের নৈতিকতার মিথ ধরে রাখার জন্য ইরান এক সুবিধাজনক ‘অপর’। 

ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই দাঁড়িয়ে আছে প্রতিরোধের নীতির ওপর। হিজবুল্লাহ ও হামাসকে ইরানের সমর্থন কখনোই অন্ধ সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ছিল না। সেই সমর্থন মূলত এমন এক আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে, যারা আজও ফিলিস্তিনিদের পিষ্ট করে চলেছে গণহত্যার মতো নির্যাতনের মাধ্যমে। 

আরও পড়ুনআরব দেশগুলো এখন বুঝছে—ইরান নয়, ইসরায়েলই তাদের জন্য বড় হুমকি১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

যেখানে ইসরায়েল শরণার্থীশিবির ও হাসপাতাল বোমাবর্ষণকেও নিজেদের ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে দাবি করে, সেখানে ইরানের সংহতি আক্রমণ নয়, বরং নৈতিক দায়িত্ব। পশ্চিমা গণমাধ্যমে যেভাবে ইরানকে রহস্যঘেরা ও গোপনীয়তার আড়ালে ঢেকে রাখা এক রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো হয়, বাস্তবতা তার থেকে অনেক জটিল এবং ভিন্ন। 

ওয়াশিংটনের নৈতিক চশমা দিয়ে ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বোঝা যায় না। পারস্যের উত্তরসূরি হিসেবে এই ইসলামি প্রজাতন্ত্র এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে, যেখানে সম্পর্কের ভিত্তি সততা আর শক্তি মানেই সংযম। আধুনিক ইতিহাসে ইরান কোনো দেশে আক্রমণ বা উপনিবেশ স্থাপন করেনি। বরং আক্রমণ, নিষেধাজ্ঞা ও বিশ্বের থেকে একঘরে হয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা সয়েছে। তবু ইরান আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে সরে দাঁড়ায়নি। 

ইরানের অভ্যন্তরীণ জটিলতা যা–ই থাকুক, এই নৈতিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ করেছে। ওয়াশিংটনের কথামতো না চলার জন্যই ইরানকে শাস্তি দেওয়া হয়, নিজের জনগণকে দমন করার কারণে নয়। 

ইরান পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের পথে হাঁটতে চাইলে (যদি সত্যিই সেই পথ বেছে নেয়) তাকে আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে বিচার করা যায় না। ইসরায়েলের একটি অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার আছে। দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে সই করেনি এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার কাছেও তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। 

তাহলে ইরান কেন প্রতিরোধক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবে? বিশেষ করে এমন এক পরিবেশে, যেখানে পশ্চিমের নৈতিকতা প্রয়োগ হয় বেছে বেছে। আর আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহৃত হয় দুর্বলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে। সেখানে তো প্রতিরোধই টিকে থাকার উপায়। 

পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার নিয়ে দুনিয়াকে নসিহত করে, কিন্তু অস্ত্র বিক্রি করে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের কাছে। গাজায় ‘সন্ত্রাসীদের’ নিন্দা করে, অথচ শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াকে ক্ষমা করে দেয়। ইরানকে তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানার দাবি জানায়, কিন্তু নিজেরা সুযোগ পেলেই তা লঙ্ঘন করে। এই ভণ্ডামি ব্যক্তিগত নয়, এর শিকড় গাথা আছে ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্যের শত শত বছরের অভ্যাসে। যে শক্তিগুলো একসময় এশিয়া ও আফ্রিকা লুট করে বেরিয়েছে, আজ তারাই গণতন্ত্র ও শান্তি নিয়ে জ্ঞান দেয়। 

আরও পড়ুনইরান–আমেরিকা ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ যে চার কারণে আসন্ন৩১ আগস্ট ২০২৫

ইরানের অভ্যন্তরীণ জটিলতা যা–ই থাকুক, এই নৈতিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ করেছে। ওয়াশিংটনের কথামতো না চলার জন্যই ইরানকে শাস্তি দেওয়া হয়, নিজের জনগণকে দমন করার কারণে নয়। 

গাজায় ইসরায়েলের চলমান কর্মকাণ্ড পশ্চিমা দ্বিমুখিতার সর্বোচ্চ অশ্লীল প্রদর্শন। বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছে শিশুরা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ছে, হাসপাতালে বোমা হামলা হচ্ছে, শরণার্থীরা অনাহারে মরছে। আর এসবই ন্যায্যতা পাচ্ছে ‘নিরাপত্তার’ নামে। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিটি নীতি পায়ের তলায় পিষ্ট করা হচ্ছে, তবু কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে না। যে সরকারগুলো একসময় ইউক্রেনের দুর্দশায় চোখের জল ফেলেছিল, তারাই এখন ফিলিস্তিনে গণহত্যার অর্থ জোগাচ্ছে। 

পার্সেপোলিস থেকে তেহরান পর্যন্ত, কবি থেকে বিপ্লবী পর্যন্ত ইরান এমন এক ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে, যা কোনো সাম্রাজ্যই মুছে দিতে পারেনি। ইরানের রাজনীতি বিতর্কিত হতে পারে, শাসনব্যবস্থা অপূর্ণ হতে পারে কিন্তু তার সভ্যতাগত মনন অটুট। এর বিপরীতে পশ্চিমারা অস্ত্র চুক্তি ও তেল-স্বার্থের বিনিময়ে বিসর্জন দিয়েছে নিজেদের নৈতিক দিশা। 

রঞ্জন সলোমন গোয়াভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও মানবাধিকারকর্মী

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজিতে থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল এমন এক র জন ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

গণভোটে সংস্কারের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলবে জামায়াতসহ আট দল: গোলাম পরওয়ার

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য যে গণভোট হবে, সেখানে তাঁর দলসহ আট দল সংস্কারের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলবে। জনগণকেও গণভোটে ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হবে।

আজ রোববার দুপুরে রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সংলগ্ন আল ফালাহ মিলনায়তনে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মিয়া গোলাম পরওয়ার এসব কথা বলেন। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনরত আট দল এই যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে। এর আগে বেলা ১১টায় আল ফালাহ মিলনায়তনে আট দলের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসেন। এরপর সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আট দল শুরু থেকেই সংস্কারের পক্ষে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সংস্কারের অনেক বিষয়ে একটি দল বিরোধিতা করেছে। তাই জাতিকে সংস্কারের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। সরকারও যেন আগে কী ছিল, নতুন করে কী কী সংস্কার হচ্ছে, সেটি নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করে, প্রচারপত্র বিলি করে, জাতীয় প্রচারমাধ্যমে প্রচার করে জনগণকে জানায়।

সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, অনলাইনে একটি দলের কর্মী বাহিনী আগে থেকেই গণভোটে ‘না’-এর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে কারা সংস্কারের পক্ষে নেই, সংস্কারের বিরোধিতা করছে, জাতি তাদের চিনতে পারল। গোটা জাতি সংস্কারের পক্ষে। যারা এর বিপক্ষে যাবে, জাতি নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যাখ্যান করবে।

আগের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছিলেন, তিনজন উপদেষ্টা সরকারপ্রধানকে ভুল তথ্য দিচ্ছেন। তাঁরা একটি দলের হয়ে কাজ করছেন।

সেই তিনজন উপদেষ্টা কারা, সে বিষয়ে আজ জানতে চাইলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, তাঁদের বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ আট দলের কাছে। প্রয়োজন হলে সেগুলো সময়মতো সামনে আনা হবে। সরকার যেন এ বিষয়ে সজাগ থাকে। প্রধান উপদেষ্টা যেন তাঁর নিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রাখেন।

আট দলের কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আট দলের লিয়াজোঁ কমিটি আছে। শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে তাদের দায়িত্ব দেওয়া আছে। তারা আলোচনা করে কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। দলগুলোর সব দাবি পূরণ হয়নি। এ জন্য আন্দোলন চলমান থাকবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আট দলের কর্মসূচির কারণে জাতীয় নির্বাচন প্রভাবিত হবে না। বরং এই আন্দোলনের কারণে সংস্কার প্রস্তাবের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গণভোটে যাচ্ছে। এটা আন্দোলনেরই ফসল। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতেই এই আন্দোলন ভূমিকা রাখবে।

গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে ‘জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছেন কেন’—জামায়াতের উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্ন করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভালো হয়ে যান।

এ বিষয়ে জামায়াতের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘উনি যা বলেছেন, আমাদের ৮ দলের একই কথা ওনার জন্য প্রযোজ্য। এটা ওনাকে অনুরোধ করছি।’

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় আগামীকাল সোমবার ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘোষণা উপলক্ষে আট দল কোনো কর্মসূচি দেবে কি না, জানতে চাইলে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আট দল ফ্যাসিবাদবিরোধী আগের কর্মসূচিগুলোর সময় মাঠে ছিল। আগামীকালও তারা মাঠে থাকবে। কোনো নাশকতা করতে দেওয়া হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম ও এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুছ আহমাদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইযহারসহ আট দলের শীর্ষ নেতারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঐতিহাসিক রায়, জনগণকে সংযত থাকার আহ্বান জানাল সরকার
  • গণভোটে সংস্কারের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলবে জামায়াতসহ আট দল: গোলাম পরওয়ার