‘মাওলানা ভাসানী’ বলে যাঁকে আমরা চিনি, সেই ব্যক্তির প্রকৃত নাম তা নয়। তাঁর আসল নামে এ দুই শব্দের কোনোটিই ছিল না। ‘মাওলানা’ ও ‘ভাসানী’—দুটি শব্দই পরবর্তী সময়ে তাঁর অর্জিত পদবি বা বিশেষণ। ‘মাওলানা’ তাঁর ধর্মবিশ্বাস ও চর্চার পরিচয়, আর ‘ভাসানী’ সংগ্রাম ও বিদ্রোহের স্মারক। তাঁর জীবন ও তৎপরতা এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল, যাতে পদবি ও বিশেষণের আড়ালে তাঁর আসল নামই হারিয়ে গেছে। আসলে তাঁর নাম ছিল আবদুল হামিদ খান। ডাকনাম ছিল চ্যাগা, শৈশবে এই নামই ছিল তাঁর পরিচয়।
প্রাচুর্য, বিত্তবৈভব, বংশের প্রভাব, যেগুলো রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠায় সাধারণত কাজে লাগে, সেগুলোর কোনোটিই তাঁর ছিল না। জীবনে তিনি যাত্রাদল থেকে শুরু করে দেওবন্দ মাদ্রাসা—সব অভিজ্ঞতাই ধারণ করেছিলেন। এসবের মধ্যে তাঁর সাধারণ যে প্রবণতা তাঁকে পরবর্তীকালে বিশিষ্ট করে তুলেছিল, তা হলো তাঁর গণসম্পৃক্ততা।
এই গণসম্পৃক্ততা তাঁকে নিজের ও চারপাশের সমষ্টির জীবনকে এক করে দেখার ক্ষমতা দান করেছিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদকে দেখেছিলেন ওপর থেকে নয়, চারপাশের পিষ্ট মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে।
দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব, মানবেতর জীবন যে নিয়তি নয়; নির্দিষ্ট কিছু কারণ, ব্যবস্থা ও ক্ষমতা এগুলোকে সৃজন করে, টিকিয়ে রাখে—এ উপলব্ধি তাঁকে আর সব মাওলানা-পীর থেকে ভিন্ন করে ফেলে। এই কপট জগতে তিনি হয়ে পড়েন নিঃসঙ্গ আর জনতার মধ্যে তিনি পরিণত হন মজলুম জননেতায়। তিনি শুধু মুসলমান নন, হয়ে উঠেছিলেন কথিত তৃতীয় বিশ্বের সব ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর।
আরও পড়ুনইতিহাসের মহানায়ক মওলানা ভাসানী১৬ নভেম্বর ২০১১মাওলানা, পীর-মাশায়েখরা আমাদের সমাজে খুবই ক্ষমতাধর। শাসক ও শোষকেরা তাঁদের সব সময়ই পৃষ্ঠপোষকতা দেন নিজেদের ভিত্তি শক্ত রাখার জন্য। অন্যদিকে বহু মানুষ নিজেদের অসহনীয় জীবনকে সহনীয় করার জন্য এই ধর্মীয় নেতা বা পেশাজীবীদের কাছেই হাজির হন। দোয়া, ভরসা, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ দিয়ে অসহায় মানুষ শরীরের অসুখ সারাতে চান, সন্তানের নিরাপত্তা চান, বিপদে-আপদে আল্লাহর আশ্রয় চান, বিভিন্ন কায়দার জালেমের হাত থেকে বাঁচার জন্য কোনো অলৌকিক সহায়তার প্রার্থনা করেন। যেখানে চিকিৎসার পয়সা নেই, ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই; যেখানে মানুষের নিজেদের যে প্রবল শক্তি আছে, সেই বোধ স্পষ্ট নয়; যেখানে নদীভাঙন, জুলুমবাজ, ক্ষমতাধরদের অত্যাচার-শোষণে বর্তমান রক্তাক্ত, ভবিষ্যৎ ভীতিকর সেখানে এই পথ ছাড়া মানুষ আর কোনো উপায় দেখে না।
অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা পয়সা নেন, এসব বিষয়ে দাওয়াই দেন এবং মানুষকে ধৈর্য ধরতে বলেন, সবুর করতে বলেন, কপাল আর বরাত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলেন। কিন্তু নিজেরা নানাভাবে আটকে থাকেন তাঁদের সঙ্গেই, যাঁরা সংখ্যালঘু, কিন্তু জালেম ক্ষমতাধর। জালেমদের ওপর ধর্মীয় নেতাদের নির্ভরতা, আবার ধর্মীয় সার্টিফিকেটের ব্যাপারে তাঁদের ওপর জালেমদের নির্ভরতা এক দুষ্টচক্র তৈরি করে। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা রক্ষা করেন পরস্পরকে।
এভাবেই নিপীড়িত মানুষের সামনে তৈরি হয় এক অচলায়তন। নানা ঝড়ঝাপটা আর আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত মানুষদের কাছে তাঁদের একমাত্র বক্তব্য থাকে ধর্মীয় আচার পালনে, পরকালের অসীম সুখ পাওয়ার জন্য ইহকালের বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করতে। এ ধরনের ধর্মীয় নেতাদের বয়ানে তাই ক্ষমতার তোয়াজ, নারীবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিষ থাকে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে, গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার বিপরীত যাত্রায়, বাংলাদেশের মানুষ যখন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশি-বিদেশি শাসকশ্রেণির নানামুখী আগ্রাসনে বিপর্যস্ত, বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠীর দখল, লুণ্ঠন, জোরজবরদস্তিতে দিশাহারা, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সম্প্রসারণে বিভ্রান্ত, তখন নিপীড়িত মানুষের ধর্মের মুক্তির ভাষা নিয়ে মাওলানা ভাসানী দেশি-বিদেশি দানবের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবের প্রবল আওয়াজ হয়ে বারবার হাজির হন—‘খামোশ’!মাওলানা ভাসানীও পীর ছিলেন। লাখ লাখ মানুষ তাঁর মুরিদ ছিলেন। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভেদ না থাকায় তাঁর কাছে কারও আসতে বাধা ছিল না। বিভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষ এবং বলাই বাহুল্য গরিব মানুষ, যাঁরা জমিদার, মহাজন আর মালিকশ্রেণির শোষণ-পীড়নে বিপর্যস্ত ও ক্লিষ্ট, তাঁর কাছে হাজির হতেন। অন্যান্য ধর্মজীবীর মতো এসব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মাওলানা ভাসানীর আয়-উপার্জনের উৎস ছিল না। তিনি দোয়া, পানিপড়া, ঝাড়ফুঁক—সবই দিতেন, কিন্তু অসুখ বেশি হলে পরামর্শ দিতেন ডাক্তার দেখাতে, প্রয়োজনে ওষুধ কেনার জন্য টাকাও দিতেন।
আরও যে জায়গায় এসে মাওলানা ভাসানী অন্যদের চেয়ে শুধু আলাদা নয়, প্রায় বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিলেন নিজেকে, সেটিই এক মাওলানাকে যুক্ত করেছিল এক ভাসানীর সঙ্গে। মানুষ তাঁর কাছে ভরসা চাইতেন আর বলতেন তাঁদের অবর্ণনীয় অন্যায় ও অবিচার ভরা জীবনের কথা।
এ ক্ষেত্রে ভাসানীর অবস্থান ছিল এ-ই যে এই নারকীয় অবস্থা নিয়তি নয়, এটা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিধান নয় আর সর্বোপরি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে এ অবস্থা পরিবর্তন করা যায়। এই ভিন্ন অবস্থানের কারণেই তিনি জীবনের তরুণকাল থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী অবস্থান নিয়েছিলেন। ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সংগত’, এটি তাঁর জীবনের আরেক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আরও পড়ুনকাছে থেকে দেখা মওলানা ভাসানী২২ ফেব্রুয়ারি ২০১১মাওলানা ভাসানীর জীবন, উচ্চারণ ও সংগ্রাম, ইসলাম ধর্মের মালিকানায় অধিষ্ঠিত তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্র, সামরিক শাসক, জোতদার, মহাজন, সামন্ত প্রভু এবং তাঁদের প্রিয় ধর্মীয় নেতাদের ক্ষিপ্ত করেছিল। তাঁকে অভিহিত করা হতো ‘ভারতের দালাল’, ‘লুঙ্গিসর্বস্ব মাওলানা’ এমনকি ‘মুরতাদ’ হিসেবে! শাসক-শোষকদের এই ক্ষিপ্ততা আসলে ছিল একটা শ্রেণিগত রোষ। পোশাক, জীবনযাপন, বয়ান, আওয়াজ—সব দিক থেকেই ভাসানী ছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ। লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই অভিজাত ইসলামের বিপরীতে তাঁর কাছে ইসলামের নিপীড়িত মানুষের ভাষা তৈরি হয়। ধর্ম যেখানে শাসক-জালেমদের একচেটিয়া মালিকানাধীন নিরাপদ অবলম্বন, সেখানে মাওলানা ভাসানী সেই নিরাপদ দুর্গকেই প্রশ্ন করেন।
অন্যায়-অবিচার তো বিমূর্ত নয়, দুঃখ-দুর্দশাও অজানা গ্রহ থেকে নেমে আসা ব্যাপার নয়। দায়িত্ব আর সংবেদনশীলতা দিয়ে মানুষের এসব অভিজ্ঞতা দেখলে উন্মোচিত হয় এক বিরাট রহস্য। আবিষ্কার করা যায় মানুষের মানবেতর জীবনের কারণ, শনাক্ত করা যায় এর পেছনের সামাজিক ব্যবস্থা, নিয়ম ও বিধি। পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করা যায় সেসব শ্রেণি-গোষ্ঠীকে, যারা এসব ব্যবস্থার ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে, এসব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যাবতীয় শক্তি প্রয়োগ করে; ধর্মও যা থেকে বাদ যায় না।
এর থেকে সার্বিক মুক্তি লাভের লড়াই তাই অনির্দিষ্ট হতে পারে না, লক্ষ্যহীন হতে পারে না। এর জন্য দরকার এমন একটা সমাজ, এর চিন্তা করা, স্বপ্ন দেখা ও দেখানো, যার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মানুষ এই নারকীয় অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করবে। তাই সৌদি আরবের রাজতন্ত্র নয়, ভাসানী লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন শোষণ-নিপীড়ন-বৈষম্য থেকে মুক্ত সমাজব্যবস্থা। যে সমাজ মানুষকে হাসি দিতে পারে, মানবিক জীবন দিতে পারে, কর্তৃত্ব দিতে পারে, সে রকম সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই-ই তিনি কর্তব্য হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থিত করেছিলেন।
সুতরাং অন্যায়-অবিচার আর দুঃখ-দুর্দশা থেকে মানুষের মুক্তির জন্য দোয়া-দরুদ নয়, দরকার সমষ্টিগত লড়াইয়ের রাস্তা তৈরি—এ উপলব্ধি মাওলানাকে একই সঙ্গে সক্ষম করেছিল সংগ্রামের প্রতীক ভাসানী হয়ে উঠতে। যে ভাসানী সব রকম জালেমদের প্রবল দাপট আর আগ্রাসনের সামনে লাখো মানুষের স্বর নিজের কণ্ঠে ধারণ করে পাল্টা ক্ষমতার প্রবল শক্তিতে রুখে দাঁড়াতেন, এক কণ্ঠে জনতার ভেতর থেকে উঠে আসা অসীম শক্তিকে মূর্ত রূপ দিতেন। ক্লান্ত, বিবর্ণ, ক্লিষ্ট মানুষ শুধু নয়, প্রকৃতিকেও প্রাণবন্ত, তরতাজা করে তুলত জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের হুঁশিয়ারি—‘খামোশ’!
এই উচ্চারণ নিয়ে মাওলানা ভাসানী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তরকালে, স্বপ্নভঙ্গের কালে মানুষের হতাশা ও প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, ভারতের শাসকশ্রেণির পরাক্রমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফারাক্কার অভিশাপের বিরুদ্ধে সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বামপন্থী নেতাদের ভ্রান্তি ও হঠকারিতায় ভাসানীর ক্ষমতা নানা পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তিনিও হতাশায় নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তাঁর শক্তি ও সীমাবদ্ধতা—দুটিই তাই আমাদের লড়াইয়ের শিক্ষা।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে, গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার বিপরীত যাত্রায়, বাংলাদেশের মানুষ যখন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশি-বিদেশি শাসকশ্রেণির নানামুখী আগ্রাসনে বিপর্যস্ত, বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠীর দখল, লুণ্ঠন, জোরজবরদস্তিতে দিশাহারা, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সম্প্রসারণে বিভ্রান্ত, তখন নিপীড়িত মানুষের ধর্মের মুক্তির ভাষা নিয়ে মাওলানা ভাসানী দেশি-বিদেশি দানবের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবের প্রবল আওয়াজ হয়ে বারবার হাজির হন—‘খামোশ’!
● আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ল মদ র ব যবস থ র প রবল র ব পর ব পর ত র জন য জ বন র কর ছ ল অন য য় র জ বন ক ষমত অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে ডিবিসিসিআই প্রতিনিধি দলের বৈঠক
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ডাচ-বাংলা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিবিসিসিআই) প্রতিনিধি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রবিবার (১৬ নভেম্বর ২০২৫) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার কক্ষে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন, নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশি মেলার আয়োজন এবং বিটুবি-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে ডিবিসিসিআইয়ের পক্ষে সভাপতি মো. শাখাওয়াত হোসেন মামুন, প্রথম সহ-সভাপতি মো. শহিদ আলম, পরিচালক মো. সায়েম ফারুকী, পরিচালক শাহ্ মো. রাফকাত আফসার ও পরিচালক আবদুল হাকিম সুমন উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা/রাজীব