অন্তর্বর্তী সরকার কেন পুরোনো পথে হাঁটবে
Published: 22nd, May 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন খাতে চলতি অর্থবছরের চেয়ে কম বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের খসড়া এডিপি অনুসারে, শিক্ষা খাতে ৯১টি প্রকল্পে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা, যা চলতি এডিপির বরাদ্দ থেকে ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা।
একটানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার অনেক অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প করে জনগণের ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার যে অনেক বড় প্রকল্প বাদ দিয়েছে, সেটা সঠিক বলেই মনে করি। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমানো কোনোভাবে কাম্য নয়। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ না বাড়ালে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারব না। আর একটি সুস্থ ও সবল জাতি গড়ে তুলতে হলে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
নতুন খসড়া এডিপিতে সর্বোচ্চ ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে শিক্ষা খাত। এই খাতের আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ থাকছে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। চলতি এডিপিতে বরাদ্দ ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমছে আড়াই হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোয় লেখা নিবন্ধে বলেছেন, ‘এবারের বাজেটে বরাদ্দের যে বিন্যাস দেখছি, সেটা প্রথাগত ঐতিহ্যেরই প্রতিফলন।’
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, যাঁরা এখন নীতিনির্ধারকের দায়িত্বে, তাঁরা এত বছর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি কাঠামোগত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। অথচ আগামী বছরের বাজেট প্রস্তাবে তার প্রতিফলন নেই। অর্থাৎ গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারও পুরোনো পথে হাঁটছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু খরচ হয় ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই নাগরিকেরা নিজেরা ব্যয় করেন।
বাজেট কেবল আর্থিক হিসাব–নিকাশ নয়। সরকারের অর্থনৈতিক দর্শনেরও প্রতিফলন। অতীতে ক্ষমতায় থাকা সব সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে অবহেলা করার অভিযোগ ছিল। বিগত সরকারগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বাজেটকে মূলত শিক্ষা অবকাঠামো ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো বাজেটে পরিণত করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, এমন প্রমাণ নেই। সরকার গঠিত স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন যেখানে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের সুপারিশ করেছে, সেখানে সরকার মাত্র ৫ শতাংশের ঘর পার হতে পারেনি। উন্নত দেশের তুলনা বাদ দিলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দের হার সর্বনিম্ন। সর্বনিম্ন বরাদ্দ দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা আশা করা যায় না।
আশা করি, অর্থ উপদেষ্টা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বর দ দ র বছর র ব সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
লাভজনক গাজী ওয়্যারস এখন লোকসানে ধুঁকছে
দেশের একমাত্র তামার তার প্রস্তুতকারী রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। প্রতিবছর গড়ে ৪০০ টন তার কিনত তারা। বছর চারেক ধরে আর তার নিচ্ছে না বিআরইবি। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে গাজী ওয়্যারসকে। গত বছর ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪–২৫ অর্থবছরেও লোকসানের পরিমাণ ৫ কোটির বেশি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিআরইবি ছিল গাজী ওয়্যারসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বশেষ তার কিনেছিল তারা। এখন বাড়তি দামের কথা বলে আর তার কিনছে না। এ কারণেই মূলত লোকসান গুনতে হচ্ছে গাজী ওয়্যারসকে। একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতাই লোকসানের অন্যতম কারণ। আবার বিকল্প ক্রেতা খোঁজার ক্ষেত্রেও গাজী ওয়্যারসের উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।
গাজী ওয়্যারস হলো শিল্প মন্ত্রণালয়ভুক্ত বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি মালিকানার একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৫ সালে ব্যক্তিমালিকানায় জাপানের ফুরুকাওয়া ইলেকট্রিক কোম্পানির সহযোগিতায় এটি চালু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করে এটিকে বিএসইসির সঙ্গে একীভূত করা হয়। এরপর আবার এটিকে বিএসইসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। বর্তমানে তিন ধরনের তার উৎপাদন করছে গাজী ওয়্যারস। এগুলো হচ্ছে সুপার এনামেল তামার তার (গেজ ১২ থেকে ৪৬), এনিল্ড তামার তার (গেজ ১০ থেকে ৪৬) ও হার্ডড্রন বেয়ার তামার তার (গেজ ১ থেকে ৪৬)। সবচেয়ে বেশি বিক্রি ও উৎপাদন হয় সুপার এনামেল তামার তার। প্রতিষ্ঠানটিতে ১২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন।
সর্বশেষ ২০২০–২১ অর্থবছরে পৌনে ৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। সেখানে গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করেছে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, গাজী ওয়্যারসের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা দেড় হাজার টন। তবে চাহিদা না থাকায় ওই সক্ষমতা অনুযায়ী কখনো উৎপাদন হয়নি। মোটাদাগে ৮০০ টন তার উৎপাদন করলে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় না। কিন্তু গত বছর উৎপাদন হয়েছে ২৬৭ টন। আর চলতি অর্থবছরে উৎপাদন মাত্র ৮৭ টন। প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার কাছাকাছি।
জানতে চাইলে গাজী ওয়্যারসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশি দামের কথা বলে বিআরইবি তার কেনা বন্ধ রেখেছে। অথচ আমরা ভালো মানের তার উৎপাদন করি। তাই লোকসান কমাতে এখন আমরা বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা করছি। সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। এর মধ্যে রয়েছে বিপিসির বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।’
আবদুল হালিম আরও বলেন, ‘বিআরইবি কর্তৃপক্ষ গত ২২ মে গাজী ওয়্যারস কারখানা পরিদর্শন করেছে। তারা দাম নিয়ে আবার আলোচনা করছে। এ প্রতিষ্ঠান আবার তার কেনা শুরু করলে লাভে ফিরতে পারব। অন্যদিকে গত মাসে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে গাজী ওয়্যারস থেকে পণ্য কেনার বিষয়ে আদেশ দিয়েছে।’
লোকসান বেড়েছে ১১ গুণ
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ থেকে ২০২০-২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৭৩ কোটি টাকা লাভ করেছিল। ২০২০-২০২১ অর্থবছরেও ৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা লাভ হয়। এরপর ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এসে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সেই হিসাবে চার বছরের ব্যবধানে লোকসান বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ।
অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা
ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে যে প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন বাজার হারাচ্ছে, তা–ও উঠে এসেছিল বিএসইসির এক তদন্ত প্রতিবেদনে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়মসংক্রান্ত অভিযোগ পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি পরে অনিয়মের সত্যতা খুঁজে পায়। মূলত ওই প্রকল্পে জাপান ও তাইওয়ানে উৎপাদিত ‘জাপানি মানের’ ৪৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার কথা। কিন্তু কেনাকাটা শেষে যন্ত্রপাতি কারখানায় স্থাপন করা হয়ে গেলেও জানা যায়নি এগুলো আসলে কোন দেশে তৈরি। যন্ত্রপাতি কেনার আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি।
পরিকল্পনার ঘাটতি, এক ক্রেতার ওপর নির্ভরশীলতা, বাজার সম্প্রসারণ না করা ও অদক্ষতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ধুঁকছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক মো. আলী আরশাদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাজার সম্প্রসারণ বা ক্রেতা না বাড়ালে প্রতিষ্ঠানটি লাভে ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি বাঁচাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।