লতাগুল্ম কেটে আকাশমণি রোপণ, খাদ্যসংকটে হাতি
Published: 7th, June 2025 GMT
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ঈদগড় বাজার থেকে ঈদগড় সড়ক ধরে চার কিলোমিটার এগোলে ভোমরিয়াঘোনা সংরক্ষিত বন। কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলায় অবস্থিত এই বন এশিয়ান হাতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি চলাচলের ক্ষেত্র (করিডোর)। ২০২৩ সাল পর্যন্ত শতবর্ষী গর্জন, বৈলাম, চাপালিশগাছে ভরপুর বনটিতে ঘন ঝোপঝাড়, লতাগুল্মের প্রাচুর্য ছিল। দেখা যেত হাতির পালের বিচরণ। তবে টেকসই বন ও জীবিকা প্রকল্পের (এসইউএফএএল বা ‘সুফল’) আওতায় বনায়ন করতে গিয়ে ঝোপঝাড়-লতাগুল্ম কেটে ফেলা হয়েছে। এতে বনের এই অংশে হাতির খাদ্য কমে গেছে। ফলে প্রাণীগুলোর বিচরণও কমে গেছে।
১৪ মে ভোমরিয়াঘোনায় গিয়ে ঈদগড় সড়কের পাশেই বন বিভাগের সুফল প্রকল্পের একটি ফলক চোখে পড়ল। তাতে লেখা আছে, এখানে ১০ হেক্টর জায়গায় ১৫ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে। ফলকে এই বনায়নকে এএনআর (অ্যাসিস্টেড ন্যাচারাল রিজেনারেশন) বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো চারাকে বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্য এই বনায়ন। তবে বনের ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত আকাশমণিগাছের চারা। এই প্রতিবেদক বনের আধা কিলোমিটারের মতো ভেতরে যান। পুরো পথে আকাশমণির চারা দেখতে পাওয়া যায়। বনের আন্ডারগ্রোথ অর্থাৎ গাছের নিচে জন্ম নেওয়া নানা ধরনের লতাগুল্ম, ছোট উদ্ভিদ—সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে।
কোথায় কোন ধরনের বনায়ন করতে হবে, তা বলা আছে সুফল প্রকল্পের ‘বন পুনরুদ্ধার ও বিভিন্ন বনায়ন পদ্ধতির নির্দেশিকা’য়। এতে এএনআর, এফজিএস (ফাস্ট গ্রোয়িং স্পেসিজ বা দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতি), এসজিএস (স্লো গ্রোয়িং স্পেসিজ বা দীর্ঘ মেয়াদে বর্ধনশীল প্রজাতি) চারা রোপণের মতো ৩২ রকমের বনায়নের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি হেক্টরে চারার সংখ্যা কত হবে, তা–ও নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। যেমন এএনআর বনায়ন করতে হবে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো চারাকে সুরক্ষা দিয়ে। অথচ ভোমরিয়াঘোনায় বনের ঈদগড় সড়ক লাগোয়া অংশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো চারার দেখা পাওয়া গেল না। বন কেটে লাগানো হয়েছে ১৫ প্রজাতির গাছের ১৫ হাজার চারা। নির্দেশিকা অনুযায়ী এএনআর বনায়নে হেক্টরপ্রতি ৫০০ চারা রোপণের কথা; এখানে লাগানো হয়েছে ১ হাজার ৫০০ করে।
প্রাকৃতিক বনে হস্তক্ষেপ করলে হাতি কেন, অন্যান্য বন্য প্রাণীও সংকটে পড়ে যাবে। প্রকৃতিই আসলে নির্ধারণ করবে কে কীভাবে বেঁচে থাকবে। মানুষের হস্তক্ষেপ যত কমানো যায়, তত ভালো। অধ্যাপক এম এ আজিজ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সরেজমিনে দেখা যায়, ভোমরিয়াঘোনার সংরক্ষিত বনের এক পাশে পুরোটাই কেটে নতুন বনায়ন করা হয়েছে। অন্য পাশে রয়ে গেছে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ঘন বন। বন রক্ষার মাঠপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা (ফরেস্টার) নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রচণ্ড রোদে হাতিরা বনের এই অংশের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। রোদের তেজ কমলে বের হয়ে বনের ডোবায় পানি আর নলখাগড়া খায়।
অথচ সুফল প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে বৃক্ষশূন্য ও অবক্ষয়িত বনাঞ্চলে বনায়নের জন্য। অর্থাৎ বনের যে অংশে গাছপালা নেই এবং যেসব অংশে গাছপালা কমে যাচ্ছে, সেসব অংশে নতুন করে গাছের চারা লাগানো হবে।
প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বনায়নে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী বৃক্ষশূন্য বা অবক্ষয়িত বনাঞ্চল নেই বন বিভাগের অধীনে। তাই বনের গহিনে এসব বনায়ন করেছে কেউ কেউ। তিনটি জেলা থেকে এফজিএস (দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতি) বনায়নের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভোমরিয়াঘোনা বনের কিছুটা ভেতরে লাগানো আকাশমণিগাছের চারা। ১৪ মে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
খেলাপি ঋণে বাংলাদেশ এশিয়ায় কেন শীর্ষে
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ বা খেলাপি ঋণ অনেক দিনের বিরাট সমস্যা। শুরুতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এ ব্যাধি বিদ্যমান হলেও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি, তথা ঋণখেলাপির সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এক মহিরুহ আকার ধারণ করেছে।
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে। আবার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এক বছরের ব্যবধানে মোট ঋণের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি।
সম্প্রতি প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি সামনে এসেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থিক বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালের তথ্য। তাতেই বাংলাদেশ শীর্ষে। এটি যে ২০২৫ সালে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আমরা জানি।
আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অন্যদিকে সহজে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার কারণেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। এখন ঋণমানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করা শুরু হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও আওয়ামী রাজনীতি–সমর্থিত ব্যক্তিদের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সন্দেহ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী, তাঁরা যেন আবার ব্যবসা শুরু করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়ে সরকার কাজও করছে।
এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সাল শেষে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ২০২১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার।
দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। যেমন ভুটানের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ। ভারতের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণ তাইওয়ান ও কোরিয়ার। দেশ দুটির খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১ ও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, ঋণখেলাপি হওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
সূত্রগুলো বলছে, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কাজ বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। পাশাপাশি সরকারি খাতের জনতা ও রূপালী এবং বেসরকারি খাতের ইউসিবি, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ট্রাস্ট ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে।
পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১ হাজার ২৫০ প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থার অধীন ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন একটি বিস্তৃত নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, এই নীতিমালায় নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ঋণ পরিশোধে যতটা সময় অবকাশ পাবে, ওই সময়ে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছেন অনেকে। তবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না করলে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় মনোযোগী না হলে তার উল্টোটাও ঘটতে পারে। সুযোগের অসৎ ব্যবহারের উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক।
সামগ্রিক ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে পরিচালকদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ।
মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব