জীবন-বৃত্তান্ত
ফ্রাঞ্জ কাফকা জন্মেছিলেন ১৮৮৩ সালের ৩ জুলাই চেকোশ্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে। তাঁর শিক্ষা শুরু জার্মান স্কুলে। ১৯০৬ সালে তিনি আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পেশা হিসেবে প্রথমে বেছে নেন ইনসিওরেন্স কোম্পানির চাকরি। কিন্তু অচিরেই এই চাকরি ছেড়ে দেন। ১৮৯৮ সালে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। ১৯১৩ সালে তাঁর ছোটগল্পের সংকলন Meditation বের হয়। ব্যর্থ প্রেম, বাবার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা, অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণতা তাঁকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। এর মাঝেই ১৯১৭ সালে তিনি নিশ্চিত হন যে, তিনি যক্ষারোগে আক্রান্ত। ১৯২৩ সালে তাঁর দেখা হয় ডোরা ডাইমান্টের সাথে। তারা একত্রে কিছুকাল বার্লিনে বসবাস করেন। রোগের দাপট বেড়ে যাওয়ায় তিনি ভিয়েনার একটি স্বাস্থ্যনিবাসে ভর্তি হন। পরের বছর তিনি পরলোকগমন করেন। জীবদ্দশায় তাঁর মাত্র ৭টি বই প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রড কাফকার লেখা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। ফলে ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় The Trial, পরের বছর The Castle, ১৯২৭ সালে Amerika এবং ১৯৩১ সালে ছোটগল্পের সংকলন The Great Wall of China। ‘আমার প্রতিবেশী’ কাফকার My Neighbour গল্পের অনুবাদ।
ব্যবসার সমস্ত দায়-দায়িত্বটা আমার কাঁধে। টাইপরাইটার আর টালিখাতা নিয়ে মহিলা কেরানি দুজন বসে সামনের ঘরে। আমার ঘরে আমার লেখার টবিল, সিন্দুক, কনফারেন্স টেবিল, আরাম কেদারা আর টেলিফোনসহ দরকারি জিনিসগুলো রয়েছে। এগুলো নিয়েই আমি কাজ করি; খুব সহজেই নাড়াচাড়া ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমি বয়সে তরুণ। ব্যবসাটা আমার ভালোই চলছে। আর এ নিয়ে আমার তেমন কোনো উদ্বেগ কাজ করে না।
এ বছরের শুরুতে এক যুবক আমার অফিসের ঠিক পাশের ঘরটা ভাড়া নিল। আমি খুব বোকার মতো কাজ করে ফেললাম। ঘরটা ভাড়া নিতে দোমনা করার ফলে দেরি হলো, আর সেই কারণে তা হাতছাড়া হয়ে গেল। সেখানেও একটা রান্নাঘরসহ আলাদা একখানা ঘর, আর ওপাশে বসবার ঘর আছে। আমার আরো একখানা ঘর ও বসার ঘরের দরকার ছিল, তাতে অন্তত আমার মহিলা কেরানি দুজন খানিকটা খুশি হতো। কিন্তু রান্নাঘর আমার কোন কাজে লাগতো? আমার নাকের ডগা দিয়ে অফিসটা ছিনতাই হয়ে যাওয়ার জন্য আমার এই মামুলি অজুহাতই দায়ী।
বর্তমানে ছেলেটি সেখানে বসছে। নাম 'হ্যারাজ'। সেখানে সে ঠিক কি করে আমার জানা নেই। দরজার উপর লেখা আছে 'হ্যারাজ ব্যুরো'। আমি খোঁজ নিয়েছিলাম। আমাকে জানালো যে, এটা ঠিক আমার ব্যবসার মতই একটা ব্যবসা। আসলে কাউকেতো যেচে উপদেশ দেওয়া যায় না, বিশেষ করে ব্যবসায়ীটি যখন তরুণ এবং নিজের উন্নতি ঘটাতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ ব্যবসায়ে তার ভবিষ্যত আছে; তথাপি কেউ যেন বেশি ছোটাছুটি না করে সবাই সেই পরামর্শই দিয়ে থাকে, কারণ ছেলেটির চলাফেরা দেখে মনে হয় তার কোনো বিশ্রাম নেই। আর যখন কোনোকিছু ঠিকঠাক মতো জানা যায় না তখন গৎবাঁধা দুয়েকটি কথাই কানে আসে । কখনো কখনো সিঁড়িতে হ্যারাজের সঙ্গে আমার দেখা হয়, তাকে সবসময়ই অস্বাভাবিক ব্যস্ত দেখি। খুব দ্রুত সে আমার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আমি কখনোই তার তার চেহারাটা ভালোভাবে দেখতে পাইনি। তবে দেখতাম অফিসের চাবিটা সবসময় তার হাতে থাকে। একদিন মুহূর্তের জন্য তার অফিসের দরজাটা খোলা দেখাম। আর ঠিক ইঁদুরের লেজের মতো সুড়ৎ করে সে দরজার আড়ালে চলে গেল। আমি আবার 'হ্যারাজ ব্যুরো' লেখাটার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম যেটা ইতোমধ্যে যতবার পড়া উচিত তার চেয়ে বেশিবার পড়ে ফেলেছি।
ঘরের দুর্বল ও পাতলা দেয়ালগুলো সৎ ও যোগ্য লোকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও অসৎ লোককে ঠিকই সুরক্ষা দিয়ে থাকে। আমার টেলিফোনটা যে দেয়ালের গায়ে আছে সেটাই আমাকে আমার প্রতিবেশী থেকে আলাদা করে রেখেছে। কিন্তু সেদিনের ঐ ঘটনাটাকে একটা বিশেষ তামাশার ঘটনা হিসেবেই মনে হলো আমার। এই টেলিফোনটা উল্টোদিকের দেওয়ালে ঝোলানো ছিল, তবুও পাশের ঘরে সবকিছুই শোনা যেত। তাই আমি যখন গ্রাহকদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতাম তখন তাদের নাম উচ্চারণ করতাম না। এভাবেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কথাবার্তার ধরনে যেসব লক্ষণ প্রকাশ পেত তার থেকে তাদের নাম অনুমান করতে খুব বেশি দক্ষতার প্রয়োজন পড়ত না। কোনো কোনো সময় সে সব আশঙ্কা করেই আমি টেলিফোনের চারিপাশে দাপাদাপি-নাচানাচি করতাম যাতে ওপাশে আওয়াজ না যায়। টেলিফোনটা আমার কানেই লাগানো থাকতো, তবে গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে তা কোনো সাহায্যই করতো না।
এইসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমার ব্যবসার বিগত সিদ্ধান্তগুলো হুমকির মুখে পড়লো এবং আমার গলার আওয়াজ খাটো হয়ে গেল। আমি যখন টেলিফোন করি তখন হ্যারাজ কি করে? আমি ব্যাপারটায় রং চড়াতে না চাইলেও―কেউ কেউ অবশ্যই তা করে থাকেন, আর তাতে বিষয়টা খোলাসা হয়―নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, হ্যারাজের টেলিফোনের প্রয়োজন নেই, সে আমার টেলিফোনটাই ব্যবহার করে। সোফাটা দেওয়ালের দিকে সরিয়ে নিয়ে সে আমার কথাবার্তা শোনে।
যখন দেয়ালের এপাশে টেলিফোন ব্যবহার করি, গ্রাহকদের যাবতীয় কথা শুনি, জটিল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেই, বড় বড় হিসাবগুলো মেলাই, তখন সারা সময় ধরে আমি আমার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক তথ্যগুলো দেয়ালের ওপাশে হ্যারাজকেই সরবরাহ করি। আর সম্ভবত, সে আমার আলাপ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেনা। কথাবার্তার মাঝখানেই উঠে পড়ে কারণ ততক্ষণে ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এবার সে অভ্যস্ত ব্যস্ততায় শহরময় উড়ে বেড়ায় এবং আমি ফোনের রিসিভারটা দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখবার আগেই ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে সে আমার বিরুদ্ধে লেগে তার গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ট ল ফ নট আম র প প রক শ আম র ক ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।
বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী
‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত
সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।
লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড
ঢাকা/লিপি