ভারতের ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন বাংলাদেশের আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ; কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা হবে না—এমনটা যেন ভাবাই যায় না।

সর্বশেষ বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে মেলবোর্ন ও সিডনি টেস্টে ভারতীয়দের পক্ষে ও বিপক্ষে সিদ্ধান্ত ও বুমরা-কনস্টাসের বিবাদ সামাল দিয়ে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন শরফুদ্দৌলা। এবার অ্যান্ডারসন-টেন্ডুলকার ট্রফিতেও একাধিক সিদ্ধান্ত ঘিরে খবরের শিরোনামে তাঁর নাম।

বার্মিংহামের এজবাস্টনে গতকাল শুরু হয়েছে ইংল্যান্ড-ভারতের দ্বিতীয় টেস্ট। এই ম্যাচে মাঠের আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শরফুদ্দৌলা। কাল তাঁর দুটি সিদ্ধান্ত ভারতের পক্ষে গেছে। এ নিয়ে হতাশ ইংলিশ পেসার ক্রিস ওকস ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম (ডিআরএস) পাল্টানোর দাবি জানিয়েছেন।

প্রথম দিনে নতুন বলে মনে রাখার মতো স্পেল করেছেন ওকস। একটানা ভালো জায়গায় বল ফেলে যাওয়ার পুরস্কার পেয়েছেন ম্যাচের নবম ওভারে। তাঁর অফ স্টাম্পের একটু বাইরে করা লেংথ বল কিছুটা লাফিয়ে উঠেছিল। সেটাই স্টাম্পে টেনে এনে বোল্ড হয়েছেন ভারতীয় ওপেনার লোকেশ রাহুল।

এর আগে আগে ও পরে (তাঁর করা ১৪ বলের মধ্যে) আরও দুটি উইকেট পেতে পারতেন ওকস। ৩৬ বছর বয়সী পেসারের বল ভারতের আরেক ওপেনার যশস্বী জয়সোয়াল ও তিনে নামা করুণ নায়ারের প্যাডে লাগলে এলবিডব্লুর আবেদন করেন ইংলিশরা। দুটি ক্ষেত্রেই আম্পায়ার ছিলেন শরফুদ্দৌলা। কিন্তু ইংলিশদের আবেদনে তিনি সাড়া দেননি।

এরপর ইংল্যান্ড অধিনায়ক বেন স্টোকস রিভিউ নিলে টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, ওকসের বল জয়সোয়ালের লেগ স্টাম্পে এবং নায়ারের অফ স্টাম্পে লাগত। কিন্তু বল ট্র্যাকিংয়ে আম্পায়ার্স কলের (শরফুদ্দৌলার নটআউট সিদ্ধান্ত) কারণে সেই যাত্রায় তাঁরা বেঁচে যান। নায়ার পরে ৩১ এবং জয়সোয়াল ৮৭ রান করে আউট হন। ভারত ততক্ষণে বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছে যায়।

শরফুদ্দৌলা দুজনকেই এলবিডব্লু না দেওয়ায় ওকসকে মাঠে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। বিশেষ করে নায়ার বেঁচে যাওয়ার পর বাংলাদেশি আম্পায়ারকে কিছু একটা বলতে শোনা যায়। শরফুদ্দৌলা জয়সোয়াল ও নায়ারকে আউট দিলে ডিআরএসে তাঁর সিদ্ধান্তই বিবেচনায় নেওয়া হতো এবং ওকস আরও দুটি উইকেট পেয়ে যেতেন। পরে অবশ্য আরেকটি উইকেট নেন ওকস। অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে ঢোকা বল ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হন নীতীশ রেড্ডি।

দিনের খেলা শেষে ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে ওকসই আসেন সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে ডিআরএসের নিয়ম পাল্টানোর দাবি জানিয়েছেন তিনি, ‘এমনিতে ডিআরএস ক্রিকেটের জন্য ভালো। ডিআরএসের কারণে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আমি শুধু একটা বিষয় বলতে চাই, যদি কোনো ব্যাটসম্যান বল ছেড়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নেয় এবং বল স্টাম্পে আঘাত হানত বলে মনে হয়, তাহলে তাকে আউট দেওয়া উচিত—বল স্টাম্পে হালকা স্পর্শ করুক বা না করুক।’

অধিনায়ক শুবমান গিলের সেঞ্চুরিতে ৫ উইকেটে ৩১০ রান তুলে প্রথম দিন শেষ করেছে ভারত। কিন্তু ওকস মনে করেন, শুরুতেই ৩ উইকেট পেয়ে গেলে দিন শেষে ইংল্যান্ডই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকত, ‘সত্যিই সকালটা খুব হতাশাজনক ছিল। আমরা সহজেই ৩০ রানে ৩ উইকেট পেতে পারতাম। যখন আপনি দলের জন্য ও নিজের জন্য ভালো করতে মরিয়া হন, তখন আবেগ তীব্র হয়। যদি (শরফুদ্দৌলার) সেই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের পক্ষে যেত, তাহলে দিনটি সম্পূর্ণ আলাদা হতো। কিন্তু এটাই টেস্ট ক্রিকেট। আমরা এভাবেই এগিয়ে যাই।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শরফ দ দ ল আম প য় র উইক ট প জয়স য় ল ড আরএস

এছাড়াও পড়ুন:

খেলাপি ঋণে বাংলাদেশ এশিয়ায় কেন শীর্ষে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ বা খেলাপি ঋণ অনেক দিনের বিরাট সমস্যা। শুরুতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এ ব্যাধি বিদ্যমান হলেও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি, তথা ঋণখেলাপির সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এক মহিরুহ আকার ধারণ করেছে।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে। আবার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এক বছরের ব্যবধানে মোট ঋণের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি।

 সম্প্রতি প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি সামনে এসেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থিক বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালের তথ্য। তাতেই বাংলাদেশ শীর্ষে। এটি যে ২০২৫ সালে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আমরা জানি।

আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অন্যদিকে সহজে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার কারণেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। এখন ঋণমানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করা শুরু হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও আওয়ামী রাজনীতি–সমর্থিত ব্যক্তিদের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সন্দেহ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী, তাঁরা যেন আবার ব্যবসা শুরু করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়ে সরকার কাজও করছে।

 এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সাল শেষে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ২০২১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার।

দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। যেমন ভুটানের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ। ভারতের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণ তাইওয়ান ও কোরিয়ার। দেশ দুটির খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১ ও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, ঋণখেলাপি হওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

সূত্রগুলো বলছে, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কাজ বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। পাশাপাশি সরকারি খাতের জনতা ও রূপালী এবং বেসরকারি খাতের ইউসিবি, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ট্রাস্ট ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে।

পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১ হাজার ২৫০ প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থার অধীন ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন একটি বিস্তৃত নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, এই নীতিমালায় নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ঋণ পরিশোধে যতটা সময় অবকাশ পাবে, ওই সময়ে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছেন অনেকে। তবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না করলে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় মনোযোগী না হলে তার উল্টোটাও ঘটতে পারে। সুযোগের অসৎ ব্যবহারের উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক।

সামগ্রিক ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে পরিচালকদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ।

মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ