মার্চ মাসের শেষ দিকের এক বিকেল। ছোটখাটো একটা হাউস পার্টি চলছে গুলশানের এক আলিশান ফ্ল্যাটে। সেখানে আমি এসেছি এক সিনিয়র সিটিজেন বন্ধুর আমন্ত্রণে। নওশাদ আব্বাস আমার সবচেয়ে সিনিয়র বন্ধু। বয়স ৭২। এই বয়সেও বেশ ফিট এবং হাসিখুশি। আমি অবশ্য তাঁর জীবনকালের এক-তৃতীয়াংশও কাটাইনি। আমার বয়স এখন সবে একুশ বছর পাঁচ মাস। অবশ্য আমাদের বয়সের এই বিশাল ফারাক কখনোই আমাদের বন্ধুত্বে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
মিস্টার আব্বাসের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বছর তিনেক আগে, একটা বুক সাইনিং ইভেন্টে। তবে সময়টা ছিল বেশ বাজে। আমাদের পরিচয় হবার এক মাস পরই তিনি চলে গেলেন ভ্যাঙ্কুভারে.
মি. আব্বাসের মাথার চুল এখনো যথেষ্ট ঘন হলেও চুল-ভুরু সবই পাকা। তাঁর বন্ধু শাহজাদ সাহেবের আবার চুল কম থাকলেও কলপ করা। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। কালো গোঁফের নিচে হাসি লেগেই থাকে। চোখ দুটো তাতে ছোট হয়ে আসে। আর এদিকে দুই দিকে দুই ঝুঁটি করা, আর ট্রেন্ডে থাকা কালো পাফড স্লিভ টপের সঙ্গে মেরুন শাড়ি পরা আমিই আমন্ত্রিতদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। স্বাভাবিকভাবেই তাই একটু বাড়তি আদর–যত্ন পাচ্ছিলাম নওশাদ সাহেব আর তাঁর গৃহকর্তা বন্ধুটির।
অন্য যারা দাওয়াত পেয়েছে, তাদের প্রায় সবারই আমার বয়সী ছেলেমেয়ে রয়েছে। সবার সঙ্গেই আমার আলাপ হলো। নানান ব্যাপারে কথাবার্তা আর হাসাহাসি করছিলাম সবাই। মনেই হচ্ছিল না যে আমাদের মধ্যে কোনো জেনারেশন গ্যাপ আছে।
‘তুমি আমড়া খাও?’আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন শাহজাদ সাহেব। ‘হ্যাঁ, খাই তো!’ উত্তর দিই আমি। ‘তাহলে চলো, তোমাকে ছাদে নিয়ে যাই। আমার নিজের লাগানো আমড়াগাছ আছে ওখানে’, বললেন তিনি।
আমি, মি. আব্বাস আর শাহজাদ সাহেব উঠে এলাম ছাদে। শাহজাদ সাহেবের হাতে একখানা ছুরি আর কাপড়ের ব্যাগ। তিনি আমাকে গাছ দেখিয়ে কিছু আমড়া পছন্দ করতে বললেন। এরপর সেগুলো নিজ হাতে কেটে সেই ব্যাগে পুরে নিলেন। সবাই আবার নিচে নেমে এলাম।
লিভিং রুমে ফিরে এসে নওশাদ আব্বাস বললেন যে তিনি সবার সঙ্গে সেলফি তুলতে চান। ফোন হাতে নিয়ে সেলফি তোলার গুরুদায়িত্ব পড়ল আমার ঘাড়ে। এরপর মি. আব্বাস ছবিটাকে ফেসবুকে নিয়ে ক্যাপশন লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। টাইপ করতে যে তাঁর একটু কষ্টই হচ্ছে, বুঝতে পারলাম। তাঁকে বলে আমিই ক্যাপশন টাইপ করে দিলাম। লেখা শেষ হয়ে গেলে ফোনটা তাঁকে ফেরত দিলাম।
মি. আব্বাস যখন হাসিমুখে ফোন হাতে সেলফি পোস্ট করতে ব্যস্ত, তখন শাহজাদ সাহেব আমাকে বললেন, ‘চলো, তোমাকে কিচেনে নিয়ে যাই। ওখানে আমড়া কেটে নিয়ে নিজের মতো খাবে।’ আমি সোফা থেকে উঠে তাঁর পেছন পেছন চললাম। কিচেনটা ডাইনিংয়ের সঙ্গে একটা থাই গ্লাস ডোর দিয়ে আলাদা করা। সেটাকে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন শাহজাদ সাহেব।
গ্লাস ডোরটা খুলে যেতেই আমার চোখ পড়ল সেটার পেছনে থাকা টাইলসের দেয়ালের দিকে। আর তখনই কিছু একটা দেখে আমার হৃৎস্পন্দন যেন থেমে গেল। ১… ২… ৩ সেকেন্ড। যে জিনিসে আমার চোখ পড়েছে, সেটা একটা ছবি। দেখে মনে হচ্ছে, নাইনটিজের শেষ দিকে তোলা। আমারই বয়সী একটা ছেলে সেখানে। হয়তো দাঁড়িয়ে। ঘাড় পর্যন্ত আসা চুলগুলো জেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা। গায়ে কালো লেদারের জ্যাকেট। চোখ জোড়া খুব মায়াবী। মুখের উজ্জ্বল চামড়ার মসৃণতা কী প্রাকৃতিক, নাকি তখনকার আমলের ছবিতে এমনই দেখাত সবার ত্বক, ঠিক বুঝলাম না। ওর সামনে হাস্যোজ্জ্বল একটা মেয়ে। দেখে মনে হচ্ছে, ছেলেটার ছোট বোন। আমার পা যেন ছবিটা দেখে ওখানেই আটকে গেছে। নড়তে পারছি না, কথাও বলতে পারছি না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন স্মৃতিকাতরতার একটা ঢেউ এসে আমার ওপর আছড়ে পড়েছে।
‘কে এটা!’ ঝুলে পড়া চোয়াল থেকে অনেক কষ্টে বের করলাম শব্দগুলো। শাহজাদ সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে হাসি–হাসি মুখ করে বললেন, ‘এটা? আমার ছেলে। শাবাব। আমেরিকায় থাকে।’
‘এত সুন্দর!’ মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে গেল আমার। শাহজাদ সাহেব মনে হয় সেটা শুনে খানিকটা গর্বের সঙ্গেই হাসলেন। যদিও তাঁর চেহারার সঙ্গে তাঁর ছেলের চেহারার কোনো মিলই নেই। মেয়েটার হাসি আর চোখ দুটো অবশ্য তাঁর মতোই। শাহজাদ সাহেব ভেতরের কিচেন কাউন্টারটা আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পুরো কিচেনে আমি এখন একা। একটা চপিং বোর্ড আর ছুরি নামিয়ে আমি আমড়াগুলো কাটতে শুরু করলাম। দু-তিন টুকরো কাটার পরই ধীরে ধীরে আমার কাটার গতি কমতে কমতে একেবারেই থেমে গেল। চোখ দুটো বন্ধ করে আমি জোরে একটা নিশ্বাস নিলাম। ‘শিট… শিট…!’ ফিসফিসিয়ে বললাম আমি।
ছবিটা দেখে আমার ঠিক কী হলো, কে জানে! মনের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। এটা কি হতাশা? নাকি প্রেমে পড়ার অনুভূতি? কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না। আমড়া কেটে একটা বাটিতে লবণ-মরিচের সঙ্গে রেখে নিয়ে এলাম লিভিং রুমে। যাবার সময় আবার একপলক দেখে নিলাম পাঁচ বাই সাড়ে তিন ইঞ্চি ভার্টিক্যাল ছবিটা। আবার এসে আড্ডায় যোগ দিলাম। মি. আব্বাস আর শাহজাদ সাহেব তখন শিশুদের মতো খুনসুটি করতে ব্যস্ত।
একটু পর বেশ ভালোই বুঝতে পারলাম যে বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। এই ঘরে যা ঘটছে, তার কিছুতেই আমার তেমন মন নেই। একটু পরপর নানা অজুহাতে বারবার কিচেনে যাচ্ছিলাম আমি। গিয়েই শুধু ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম সেটা। (যেন ওটা একটা শিল্পকলা)। আর যতবারই দেখছিলাম, কোনো একটা সুর মনে পড়ে যাচ্ছিল। সুরটা আমি কোথাও শুনেছিলাম খুব ছোটবেলায়। পরে সেটা অনেক খুঁজেছি, কিন্তু আর পাইনি। ওটা শুধু আমার স্মৃতিতেই রয়ে গেছে। আর যতবার আমার মাথায় সেটা বেজেছে, প্রতিবারই মনে হয়েছে আমি এমন কারও প্রেমে পড়ে যাচ্ছি, যাকে আমি কোনো দিন দেখিইনি। তাহলে কি আমি তাকে অবশেষে খুঁজে পেলাম?
সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমাকে জিনিসটা খুব যন্ত্রণা দেবে। বুঝলাম না, ভালো হলো না মন্দ। ওকে কখনো খুঁজে না পেলে ব্যাপারটা বেশি কষ্টদায়ক হতো, নাকি অবশেষে খুঁজে পেয়েও তাকে এখন সেই ছবির ভেতর থেকে, অতীত থেকে নিয়ে না আসতে পারার কষ্টটা বেশি হবে?
কী যেন একটা ব্যাপার ছিল ছবিটাতে। ঠিক ধরতে পারছিলাম না, কী সেটা। হ্যাঁ, ছেলেটা সুন্দর। তবে ঠিকমতো খেয়াল করলে অতও সুন্দর নয় যে দেখলেই একেবারে মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে কেন আমার বারবার এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে? নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করলাম খানিক। শেষমেশ একটা ছবির প্রেমে পড়লাম! তাও এত পুরোনো? ওয়ান-সাইডেড লাভ আমার এই ছোট্ট জীবনে নতুন কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে এতই বিচ্ছিরি রকমের অসহায় অবস্থায় পড়ব?
খানিকটা জোর করেই নিজেকে আবার লিভিং রুমে ফিরিয়ে আনলাম। একটু পর আমি ছাড়া প্রায় সবাই উঠে পড়ল এক–এক করে। শুধু আমি, আব্বাস আর শাহজাদ সাহেবই রয়ে গেলাম বাসায়। শাহজাদ সাহেব জানালেন, একটু পর তাঁর পরিচিত এক ইরানি ভদ্রলোক এবং বিরোধী দলের কোনো এক রাজনীতিবিদ বাসায় আসছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। ‘তার আগে আমরা লাঞ্চটা সেরে ফেলি, কী বলো?’ বললেন তিনি। আমিও সায় দিলাম।
লাঞ্চ করতে করতে শাহজাদ সাহেব তাঁর ছেলের ব্যাপারে বললেন। বছর বিশেক আগে নাকি সে লেখাপড়ার জন্য ট্যালাহ্যাসিতে চলে যায়। এরপর এক ভারতীয় মেয়েকে বিয়ে করে ফ্লোরিডাতেই রয়ে গেছে। দুটো সন্তান আছে তাদের।
আমরা লাঞ্চ সারার কয়েক মিনিট পরই দরজার বেল বাজল। সেই দুজন কাঙ্ক্ষিত অতিথি চলে এসেছেন। সঙ্গে আরও দুজন। সবাই মিলে ভেতরের আরেকটা ফরমাল ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলাম আমরা। রুমটা পুরো বাসার চেয়ে অনেকটা নিচু। আমার সঙ্গে পাশাপাশি বসলেন শাহজাদ সাহেব আর মি. আব্বাস। পাশেই আরেকটা সিঙ্গেল সোফায় বসলেন সেই রাজনীতিবিদ। তাঁর পোশাক খুবই সাদামাটা হলেও বেশ পরিপাটি। সোনালি চ্যাপটা ফ্রেমের চশমার পেছনে তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝলাম যে তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আমার বিপরীতে বসা সেই ইরানি ভদ্রলোকের দিকে। বুঝতেই পারছিলাম যে তিনি কী প্রশ্ন করতে যাচ্ছেন। মনে মনে চাচ্ছিলাম, প্রশ্নটা তিনি যেন আর না করেন।
‘হোয়াট ইজ দ্য ডিফরেন্স বিটুইন শিয়া অ্যান্ড সুন্নি?’ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রলোক। প্রশ্ন শুনেই মাথায় একটা চাপড় মারলাম আমি। যাহ্! যে ভয় পাচ্ছিলাম, শেষমেশ সেটাই হলো। শাহজাদ সাহেব হেসে ইংরেজিতে সবাইকে জানালেন যে এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একদিন মর্নিং ওয়াকে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
ইরানি ভদ্রলোক বলতে লাগলেন। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু আমার তাতে মন নেই। কিছুক্ষণ সবার কথা শুনে আমি ওয়াশরুমে যাব বলে সেখান থেকে উঠে পড়লাম। না, তাঁদের আলাপের বিষয়ে যে আমার আগ্রহ নেই, তা নয়। আসলে তখন আমার মাথার ভেতর শুধু চলছে অন্য কিছু। আর কোনো কিছু নিয়েই যেন ভাবতে পারছি না।
ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং স্পেস আর লিভিং রুম পার হয়ে আরেকটা রুমের ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম। কিছুক্ষণ চুপ করে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী করব আমি? কেন ছবিটার কথা চিন্তা করা থামাতে পারছি না?
কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং স্পেসে এসে দেখি, আব্বাস সাহেব হাতে অরেঞ্জ জুসের একটা গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন তিনি। ‘এ জন্যই আমার কানাডা ভালো লাগে, বুঝলে? ওখানে মানুষ কখনো ধর্ম বা রাজনীতি নিয়ে শুধু শুধু আলোচনা করে না,’ বললেন তিনি। বাইরে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরে ধীরে। লিভিং রুমের বিশাল টিভির পর্দায় সিএনএনে খবর চলছে নিঃশব্দে যুদ্ধ, মিসাইল, আরও কত কী নিয়ে। হলুদ বাল্বের আলোয় পুরো ঘরটা ঝলমল করছে। একগ্লাস পানি হাতে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম ‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, মারা যাবার ঠিক আগে যখন জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকগুলো আমার চোখের সামনে ভাসবে, তখন তার মধ্যে আজকের দিনটা অবশ্যই থাকবে।’
‘আর্ন্ট ইউ ঠু ইয়াং টু বি থিঙ্কিং অ্যাবাউট ডেথ অলরেডি?’ মি. আব্বাস জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে। উত্তরে কিছু বলি না আমি। বাইরের দিকে তাকাই। ছবিটার কথা চিন্তা করা থামাতেই পারছি না ভেতরে ভেতরে। কিচেনের থাইটা তখন খোলাই ছিল। দুজন রাঁধুনী সেখানে যাওয়া–আসা করছে। আমি ছবিটার দিকে আরেকবার তাকালাম। মনে হচ্ছিল, সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে আমি অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারব।
নওশাদ আব্বাস আর আমি ফের ড্রয়িং স্পেসে ঢুকলাম। ইরানি ভদ্রলোক এখনো কথা বলছেন। আমি আবার শাহজাদ সাহেবের পাশে গিয়ে বসলাম। তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার ছেলের এখনকার ছবি আছে আপনার কাছে?’ তিনি আবার হাসি দিয়ে বললেন, ‘আছে তো।’ ‘দেখান’, একটু আহ্লাদি গলায় বললাম আমি। শাহজাদ সাহেব হাতের ফোনটা আনলক করলেন। এরপর গ্যালারিতে ঢুকে স্ক্রল করে যেতে লাগলেন। মিনিটখানেক পর একটা ছবি বের করে বললেন, ‘এই যে, এরা আমার দুই নাতি-নাতনি।’ ছবিটা দেখিয়ে আবার শুরু করলেন স্ক্রল করা। এক–এক করে তার মেয়ে, ছেলের বউয়ের ছবি দেখালেন। এবার একটু অধৈর্য গলায় বললাম, ‘আহা! সবই তো বুঝলাম। আপনার ছেলের ছবি কই?’ আমার এ কথা শুনে সেই হাসিমুখেই একটু ভ্রু কুঁচকে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি আমার ছেলের প্রতি অ্যাট্রাক্টেড?’ এবার মুখেও একটু আহ্লাদি ভাব এনে আমি বললাম, ‘তো আপনি আর কী মনে করেছিলেন?’
এরপর আরও একটু স্ক্রল করে একটা খুব ঝাপসা ছবি বের করে আনলেন তিনি। তাও নাকি সাত বছর আগের ছবি। কোনো একটা পার্টিতে তোলা। শাবাবের মুখ এখানে স্পষ্ট নয়। আশা ছেড়ে দিলাম আমি।
খানিক পর আবার সবাই খাবার টেবিলে গিয়ে বসলেন। রাঁধুনীরা ততক্ষণে গরম গরম খাবার সাজিয়ে রেখেছে সেখানে। আমার আর খিদে নেই বলে আর বসলাম না। একসঙ্গে ছবি তুলে দিলাম সবার। এদিকে প্রায় আটটা বাজতে চলছে। কীভাবে যেন এতটা সময় কেটে গেল। বেরোতে মন চাচ্ছিল না। তবু যেতে হবে। ‘আমি উঠি’ বললাম আমি মি. আব্বাসকে। তিনি উঠে পড়ে আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। কোনো কারণে তাঁর মুখে সব সময় থাকা হাসিটা এখন নেই।
দরজাটা বন্ধ হতেই বুকটা কেমন ধক করে উঠল। একা বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম, হু হু করে বাতাস বইছে। ঠিক যেন ছবিটার মতোই স্নিগ্ধ, সুন্দর, মিষ্টি আর নির্ঝঞ্ঝাট সেই ঝোড়ো বাতাস। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াতে মন চাইছিল। কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে। ধীরপায়ে এগোতে থাকলাম আমি। রিকশা নিতে হবে। বাড়িটাকে পেছনে ফেলে যতই এগোচ্ছি, বুকটা ভারী ভারী লাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে যে খুব মূল্যবান কিছু হয়তো ফেলে এসেছি। আর যদি কোনো দিন তাকে না দেখি!
বাসায় ফিরে ফেসবুক খুললাম। নওশাদ আব্বাসের আইডিতে একটু খোঁজ করেই পেয়ে গেলাম শাহজাদ সাহেবের অ্যাকাউন্ট। ইংরেজিতে ‘শাবাব’ লিখে সার্চ করে তাঁর ছেলের আইডিটাও পেয়ে গেলাম। ‘শাবাব’ নয়, ওর ভালো নামে আইডিটা। শাহজাদ সাহেবের একটা পোস্টে দেখতে পেলাম একসঙ্গে ছবি পোস্ট করে লিখেছেন ‘আমার ছেলে, শাবাব।’ দেখে নিশ্চিত হলাম, এ-ই সেই শাবাব। ঢুকলাম ওর আইডিতে। স্বাভাবিকভাবেই বয়স বেড়ে সে এখন প্রায় মধ্যবয়সী। চেহারায় সেই লাবণ্য আর নেই। ওয়ালজুড়ে তার স্ত্রী-সন্তানের ছবির ছড়াছড়ি।
প্রোফাইল পিকচার অ্যালবামে ঢুকে একেবারে গোড়ার দিকের ছবিগুলো থেকে দেখা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে স্ক্রল করে ওপরে যেতে থাকলাম। যতই ওপরে যাচ্ছি, ওর মাথার চুল পাতলা হয়ে আসছে। অনেকটা বাপের মতোই। কিন্তু এটা কি সত্যিই সেই শাবাব? চুল বেশি থাকা ছবিগুলোতেও ওর চোখের সেই মায়া যেন আর খুঁজে পেলাম না। কিছু একটা যেন হারিয়ে গেছে ওর মুখ থেকে। যেন শাবাব মারা গেছে। শাবাবের কোনো ভাইয়ের ছবি দেখছি আমি। অনেক খুঁজেও কিচেনের সেই ছবির মধ্যে থাকা সেই মায়া আর কোত্থাও খুঁজে পেলাম না। খুব হতাশ হলাম মনে মনে। জানি না ঠিক কী খুঁজছি, কিন্তু সেটা খুঁজে না পাবার হতাশা আমাকে গিলে খাচ্ছে। হ্যাঁ, তার যে বয়স বেড়েছে, তা আমি প্রত্যাশা করেই ছিলাম। কিন্তু ঠিক কী হারানো গেল ওর মুখ থেকে, যেটা আমি না পেয়ে এত হতাশ হচ্ছি? অনেক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সেদিন রাতে ঘুমোতে গেলাম।
এর পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে পুরো ঘটনাটার কথা চিন্তা করা থামাতে পারিনি। কিছুদিন কেটে যাবার পর একসময় নিজেই বুঝতে পারলাম যে কেন ওর চোখের সেই মায়া বয়স বাড়ার পর চলে গেছে। তখনকার শাবাব নিশ্চয়ই জীবনে তখনো কোনো বড় আঘাত পায়নি। কোনো প্রিয় মানুষকে হারায়নি। ওর চোখে যেটা আমি দেখেছিলাম, সেটা ঠিক ‘ইনোসেন্স’ নয়। সেটা ছিল দুনিয়াদারি নিয়ে কম জানার উজ্জ্বলতা। হয়তো তখনো নাইন-ইলেভেন হয়নি, স্মার্ট ফোনও আসেনি। পৃথিবীটা এত উন্মাদ হয়ে যায়নি তখনো। ক্রেডিট স্কোর, প্রপার্টি, ট্যাক্স, বিল, ইনস্যুরেন্স—এসবের কিছু নিয়েই হয়তো তখন তার মাথা ঘামানো লাগত না। ওর কাজ ছিল তখন বসন্তের ট্যালাহাসিতে নরম রোদ আর হাওয়া গায়ে লাগিয়ে বেড়ানো। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। সংসারসহ আরও নানা কিছুর দায়িত্ব ছিল না ওর ওপর। হয়তো যাকে বিয়ে করেছে, তার সঙ্গে তখনো দেখাও হয়নি। হয়তো বা সে অন্য কারোর প্রেমে পড়েছিল সে সময়। সেই প্রথম প্রেমের সঙ্গে কোনো পার্কের সবুজ কচি ঘাসের ওপর ও হেঁটে বেড়াত। পরে সেই প্রেমে সে ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু নিজের অজান্তেই জীবনের সেরা সময়টা কাটানো সেই শাবাব এখন শুধুই একটা ছবির ভেতর আটকে আছে। ওকে সেখান থেকে বের করে ফিরিয়ে আনা যাবে না। না, আমি তার প্রেমে পড়িনি। পড়লেও হয়তো ব্যাপারটা আমার জন্যে প্রচণ্ড কষ্টকর হতো, যেহেতু আমরা দুজন দুই সময়ের। আসলে পুরো ঘটনাটাই আমাকে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে।
এরপর কতবার যে মন চেয়েছে আরেকবার ছবিটা মন ভরে দেখতে। কখনো গুলশানের সেই এলাকার পাশ দিয়ে গেলেই ভাবতাম ওর কথা। কখনো ইচ্ছে হতো, কোনো এক বিকেলে সোনালি গোধূলির আলোয় পুরো বাড়িটায় একলা থেকে সেই কিচেনের সামনে মুখোমুখি বসে তাকিয়ে থাকি ছবিটার দিকে। কাটিয়ে দিই ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনের পর দিন। চোখ ভরে দেখি ছবিটাকে। ছোটবেলায় যেভাবে একদিন বৃষ্টির পর সোনালি আকাশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল রংধনু দেখেছিলাম অবাক চোখে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার স্মৃতিতে ক্রমেই ছবিটার খুঁটিনাটি ঝাপসা হয়ে আসছে যে, বুঝতে পারি। কিন্তু কী আর করার? ভাগ্যে হয়তো নেই আবার দেখা হওয়া। হয়তো কিছু জিনিস স্মৃতিতে ঝাপসা আর অসম্পূর্ণ অবস্থায় থেকে যায় বলেই সেগুলোকে আরও সুন্দর মনে হয়।
মাঝেমধ্যে খুব আফসোস হতো। যদিও কাজটা হয়তো ঠিক হতো না, তবু যদি সেদিন লুকিয়ে একটা ছবি তুলে রাখতাম নিজের ফোনে? পরক্ষণেই আবার ভাবতাম, ছবি তুলে রাখার কথা তো একবারও মনে হয়নি তখন। যেন ওর চোখ দিয়েই ও বারবার আমাকে বলে দিচ্ছিল, ‘লিভ ইন দ্য মোমেন্ট।’
অনেক বছর কেটে গেছে তারপর। নওশাদ আব্বাস মারা গেছেন গত বছর বার্ধক্যজনিত নানান জটিলতায়। তাঁর সেই বন্ধু এখন কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কি না, জানি না। আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুকে বলেছি এই ঘটনার ব্যাপারে। কেউ পাত্তাই দেয়নি। কেন তাদের বলছি এই কাহিনি, তা–ও হয়তো বুঝতে পারেনি। আমার বন্ধুদের আমি এ–ও বলি যে আমার প্রচণ্ড রকম ‘ফিয়ার অব এজিং’। সবাই ব্যাপারটাকে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। আমার গবেষক বন্ধুটি বলেছে, এগুলো সবই ‘পিঙ্ক ট্যাক্স’–এর জন্য মিডিয়ার তৈরি করা ভীতি এবং আমি সাকসেসফুলি ব্রেইনওয়াশড। ওরা বোঝে না যে ব্যাপারটা শুধু মুখের চামড়া ঝুলে পড়া বা মাথার চুলের সংখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ওরা যে বুঝবে, সেটা আমি আশাও করি না।
শাবাব এখনো মাঝেমধ্যে আসে আমার স্বপ্নে। সেই কালো লেদার জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে। কখনো ওকে দেখি রাস্তায়, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছে। কখনো আবার দেখি কোনো অচেনা ক্যাফেতে, আমার মুখোমুখি বসে। ও কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে চুপচাপ, সেই জীবন্ত চোখ জোড়া দিয়ে। তারপর হঠাৎ মিলিয়ে যায়…
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ হজ দ স হ ব শ হজ দ স হ ব র র শ হজ দ স হ ব র জন ত আম দ র ই আম র ব র কর র বন ধ আম র স র স মন স ন দর আম র ব আম র ক ওর চ খ ল ম আম অন ভ ত আম র দ করল ন অবশ য করল ম র একট বলল ন বলল ম
এছাড়াও পড়ুন:
বগুড়ায় বাঙালী নদী থেকে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় বাঙালী নদী থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সদর ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর এলাকা থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়।
সোনাতলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মিলাদুন্নবী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘‘নিহতের বয়স আনুমানিক ৩২ থেকে ৩৭ বছর। লাশটি অর্ধগলিত ছিল এবং নিহতের শরীরে কোনো পোশাক ছিল না। মরদেহের সুরতহাল প্রস্তুত করা হয়েছে। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিতে মরদেহ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।’’
আরো পড়ুন:
পিয়াইন নদীতে নিখোঁজ বালু শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার
দেবীগঞ্জে ধানখেত থেকে তরুণীর মরদেহ উদ্ধার
ঢাকা/এনাম/রাজীব