আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ব্যবহারিক পার্থক্য
Published: 18th, October 2025 GMT
আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কিত জ্ঞান ইসলামের সবচেয়ে মহৎ ও মৌলিক বিষয়। এটি তাওহিদের ভিত্তি ও ইমানের মূল স্তম্ভ। এই জ্ঞান বান্দাকে তার প্রভুর সঙ্গে পরিচিত করে, তাকে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী করে এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা, ভয় ও আশা জাগায়। এর ফলে বান্দা আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করে যেন সে তাঁকে দেখছে।
এই জ্ঞান বান্দার হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আনুগত্যের বীজ বপন করে, যা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের সুখের পথে পরিচালিত করে।
আল্লাহর নাম ও গুণাবলির মধ্যে সম্পর্ক মূল ও শাখার মতো। নামগুলো হলো মূল, যা থেকে গুণাবলি উৎপন্ন হয়। প্রতিটি নাম একটি নির্দিষ্ট গুণের দিকে ইঙ্গিত করে।আল্লাহর নাম ও গুণাবলির পার্থক্যআল্লাহর নাম ও গুণাবলি একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত হলেও এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। আলেমগণ এই পার্থক্য স্পষ্ট করেছেন এবং এদের মধ্যকার সম্পর্ককে মূল ও শাখার সম্পর্ক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
নাম: আল্লাহর নাম হলো সেইসব নাম, যা তাঁর সত্তা ও তাঁর পূর্ণতার গুণাবলির দিকে ইঙ্গিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘আল-কাদির’ (সর্বশক্তিমান) নামটি আল্লাহর সত্তা এবং তাঁর শক্তির গুণের দিকে নির্দেশ করে। আল্লাহর সব নামই হুসনা, অর্থাৎ সৌন্দর্য ও পূর্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থিত। (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৮০)।
গুণাবলি: গুণাবলি হলো আল্লাহর সত্তায় অবস্থিত পূর্ণতার বৈশিষ্ট্য, যেমন জ্ঞান, শক্তি, রহমত, মুখমণ্ডল, হাত ইত্যাদি। গুণাবলি শুধু একটি নির্দিষ্ট অর্থের দিকে ইঙ্গিত করে, যা আল্লাহর সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মূল পার্থক্য১.
উৎপত্তি: আল্লাহর নাম থেকে গুণাবলি উৎপন্ন হয়। যেমন—‘আর-রহিম’ (দয়ালু) নাম থেকে ‘রহমত’ (দয়া) গুণটি পাওয়া যায়। কিন্তু সব গুণ থেকে নাম উৎপন্ন হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ‘আগমন’ বা ‘ওঠা’ গুণ থেকে ‘আল-জা-ই’ বা ‘আল-মুস্তাওয়ি’ নাম গঠন করা যায় না।
২. পরিধি: গুণাবলির পরিধি নামের তুলনায় ব্যাপক। গুণাবলি আল্লাহর কাজ থেকেও উৎপন্ন হতে পারে, যেমন রাগ, আনন্দ বা কৌশল। কিন্তু এই গুণাবলি থেকে নাম গঠিত হয় না।
৩. মানুষের নাম রাখা ও দোয়া: আল্লাহর নামের সঙ্গে ‘আবদ’ যোগ করে মানুষের নাম রাখা যায়। কেউ নিজের নাম রাখতে পারে আবদুর রহমান বা আবদুল করিম। কিন্তু গুণাবলি দিয়ে নাম রাখা যায় না। কেউ আবদুর রহমত বা আবদুল ইজ্জত নাম রাখতে পারে না।
দোয়া করার ক্ষেত্রেও আল্লাহকে তাঁর নাম ধরে ডাকা যায়, যেমন ‘ইয়া রহিম, আমাদের প্রতি দয়া করো’। কিন্তু গুণাবলি দিয়ে ডাকা যায় না, যেমন ‘ইয়া রহমত, আমাদের প্রতি দয়া করো’ বলা যায় না। কারণ, গুণাবলি স্বয়ং আল্লাহ নয়, বরং তাঁর বৈশিষ্ট্য। মানুষের নাম রাখা ও দোয়া শুধু আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। (ইদরিস আহমদ, আসমা উল্লাহ ওয়া সিফাতুহু, পৃ. ১২, ইসলামিক পাবলিশার্স, কায়রো, ২০২০)
আরও পড়ুনআল্লাহর ৯৯ নাম ও তার ফজিলত২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫নাম ও গুণাবলির সম্পর্ক: মূল ও শাখাআল্লাহর নাম ও গুণাবলির মধ্যে সম্পর্ক মূল ও শাখার মতো। নামগুলো হলো মূল, যা থেকে গুণাবলি উৎপন্ন হয়। প্রতিটি নাম একটি নির্দিষ্ট গুণের দিকে ইঙ্গিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘আস-সামিউ ’ (সর্বশ্রোতা) নামটি ইঙ্গিত করে যে আল্লাহ সবকিছু শোনেন। এই নামের ইমান আনার জন্য চারটি বিষয় মেনে চলতে হবে:
১. এটি আল্লাহর একটি নাম হিসেবে স্বীকার করা। ২. এই নামের মাধ্যমে সূচিত গুণ, অর্থাৎ ‘শ্রবণ’ গুণের প্রতি বিশ্বাস রাখা। ৩. এই গুণের ফলাফল, যেমন আল্লাহ গোপন ও প্রকাশ্য সব কথা শোনেন, তা মেনে নেওয়া। ৪. এই গুণের ব্যবহারিক দিক, যেমন সব সময় আল্লাহর ভয় ও তাঁর প্রতি সচেতনতা রাখা।
এই বিশ্বাস শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং বান্দার জীবনে ব্যবহারিক পরিবর্তন আনে, যা তাকে আল্লাহর নৈকট্যের দিকে নিয়ে যায়।
আল্লাহর নামের সঙ্গে ‘আবদ’ যোগ করে মানুষের নাম রাখা যায়। কেউ নিজের নাম রাখতে পারে আবদুর রহমান বা আবদুল করিম। কিন্তু গুণাবলি দিয়ে নাম রাখা যায় না।গুণাবলির বিশ্বাসের নীতিআলেমগণ আল্লাহর গুণাবলির বিশ্বাসের জন্য কিছু সুস্পষ্ট নীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি উল্লেখ করা হলো:
১. কল্পনা বা তুলনা নয়: আল্লাহ যে গুণ নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন বা রাসুল (সা.) যে গুণ সাব্যস্ত করেছেন, তা বিকৃতি, অস্বীকার, কল্পনা বা সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা না করে মেনে নিতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৩৮৪)
২. অস্বীকৃতিতে পূর্ণতার স্বীকৃতি: আল্লাহ যে গুণ নিজের থেকে অস্বীকার করেছেন, তা অস্বীকার করতে হবে এবং তার বিপরীত পূর্ণতা তাঁর জন্য স্বীকার করতে হবে। যেমন, আল্লাহ মৃত্যু, ঘুম বা অবিচারের গুণ থেকে মুক্ত, বরং তিনি জীবন, জ্ঞান ও ন্যায়ের পূর্ণতায় সমৃদ্ধ। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫৫)
৩. গুণাবলি শরিয়তসম্মত: কোরআন ও সুন্নাহর প্রমাণ ছাড়া আল্লাহর জন্য কোনো গুণ সাব্যস্ত বা অস্বীকার করা যাবে না।
৪. অস্পষ্ট শব্দে সতর্কতা: যে শব্দাবলি কোরআন ও সুন্নাহতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, যেমন দিক, স্থান বা গতি, সেগুলোর ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে এবং এর অর্থ স্পষ্ট করতে হবে।
৫. পদ্ধতির জ্ঞান আল্লাহর কাছে সমর্পণ: গুণের পদ্ধতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা না করে তা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ইমাম মালিক (রহ.) বলেছেন, ‘ইস্তিওয়া (আরশে সমাসীন হওয়া) জানা, তার পদ্ধতি অজানা, এতে ইমান আনা ওয়াজিব এবং এর পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা বিদআত।’ (আল-কাওয়াইদ ফি আসমা ওয়া সিফাত, পৃ. ৬৮, দারুল ফিকর, মদিনা, ২০১৮)
আরও পড়ুনইসমে আজমের শক্তি ও রহস্য৩০ জুন ২০২৫আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে ইমান আনার প্রভাবআল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে বিশ্বাস বান্দার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এর কিছু ফলাফল হলো:
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টা: বান্দা যখন জানে যে আল্লাহ সুন্দর ও সৌন্দর্য ভালোবাসেন, দয়ালু এবং দয়া পছন্দ করেন, তখন সে তাঁর প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টা করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৭)
২. আল্লাহর প্রতি সচেতনতা ও লজ্জা: আল্লাহর সর্বজ্ঞতা, সর্বব্যাপ্তি ও সাক্ষ্যদানের গুণে বিশ্বাস বান্দাকে সব সময় আল্লাহর প্রতি সচেতন রাখে। এর ফলে সে কেবল ভালো কথা বলে এবং ভালো কাজ করে।
৩. নিরাশা থেকে মুক্তি: আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও ধৈর্যের গুণে বিশ্বাস বান্দাকে পাপের পর তওবার পথে ফিরিয়ে আনে এবং তাকে নিরাশা থেকে রক্ষা করে। (সুরা যুমার, আয়াত: ৫৩)
৪. আল্লাহর মহত্ত্বের অনুভূতি: আল্লাহর মহিমা, শ্রেষ্ঠত্ব ও সমৃদ্ধির গুণ জানা বান্দাকে নম্র করে এবং তাকে আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল করে।
৫. দোয়া ও প্রার্থনা: বান্দা আল্লাহর গুণাবলি দিয়ে তাঁকে ডাকে। যেমন, পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে রহমত ও মাগফিরাতের গুণ দিয়ে, শত্রুর ভয়ে ক্ষমতা ও শক্তির গুণের কথা বলে বলে দোয়া করে।
আল্লাহর নাম ও গুণাবলির বিশ্বাস সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে। এটি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ইমান ও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম। এই বিশ্বাস বান্দার হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আনুগত্য সৃষ্টি করে, যা তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার দিকে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”০১ অক্টোবর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ ণ বল র ব স ব ক র কর আল ল হ র জন য কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
জাপানি প্যাভিলিয়নে মঙ্গল গ্রহের উল্কাপিণ্ড, ছুঁয়ে দেখার সুযোগ
‘আমাদের জীবনের জন্য ভবিষ্যৎ সমাজ গঠন’ প্রতিপাদ্যে জাপানে টানা ছয় মাস ধরে চলল ওসাকা এক্সপো–২০২৫। গত ১৩ এপ্রিল শুরু হওয়া এ মহা আয়োজনের পর্দা নেমেছে ১৩ অক্টোবর। ভবিষ্যতের নানা ধারণা নিয়ে এতে হাজির হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, সংস্থা ও বড় বড় কোম্পানিগুলো। তারা দিয়েছিল আকর্ষণীয় সব প্যাভিলিয়ন। আয়োজক দেশ জাপানের প্যাভিলিয়নটিই ছিল সবচেয়ে বড়।
প্যাভিলিয়নে সবচেয়ে বড় আকর্ষণগুলোর মধ্যে একটি ছিল—মঙ্গল গ্রহের উল্কাপিণ্ডের দেখা পাওয়া। শুধু তা–ই নয়, এর একটি টুকরা স্পর্শ করতে পারা!
প্যাভিলিয়নে প্রদর্শিত হয়েছে অমূল্য আরও দুটি উপাদান। একটি হচ্ছে ২০০৫ সালে ইতোকাওয়া গ্রহাণু থেকে জাপানের মহাকাশযান হায়াবুসার প্রথমবারের মতো সংগ্রহ করা নমুনার অংশ। অন্যটি হচ্ছে জাপানি মহাকাশযান হায়াবুসা–২–এর রিয়ুগু গ্রহাণু থেকে আনা নমুনা।
প্যাভিলিয়ন কেমন ছিলমূলত মানবজাতির টেকসই ভবিষ্যতের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ চক্রাকার জীবনের ধারণাকে তুলে ধরেছিল এটি। থরে থরে সাজানো অসংখ্য জাপানি সিডারগাছের পাটাতনের বিশাল বৃত্তাকার এ প্যাভিলিয়ন। ক্রস–ল্যামিনেটেড কাঠ (সিএলটি) দিয়ে তৈরি এ পাটাতনগুলো। এক্সপো শেষ হওয়ার পরে জাপানজুড়ে বিভিন্ন ভবনে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করে নকশা করা হয় এটি। বিখ্যাত জাপানি কোম্পানি নিকেন সেক্কেই লিমিটেড এর নকশাকার।
জাপানি অ্যান্টার্কটিক গবেষণা অনুসন্ধান দল ২০০০ সালের নভেম্বরে শোওয়া স্টেশন থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইয়ামাতো পর্বতমালার কাছে এ অসাধারণ উল্কাপিণ্ডটি খুঁজে পায়। প্রথম আবিষ্কার করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পোলার রিসার্চের (এনআইপিআর) অধ্যাপক নাওইয়া ইমায়ে। প্রায় ২৯ সেন্টিমিটার চওড়া ও সাড়ে ১৭ সেন্টিমিটার উঁচু রাগবি বলের মতো এ উল্কাপিণ্ডের রং সবুজ।প্যাভিলিয়নটি তিনটি জোনে বিভক্ত ছিল—প্ল্যান্ট বা প্রক্রিয়াকরণ, ফার্ম বা খামার ও ফ্যাক্টরি বা কারখানা এলাকা। প্ল্যান্ট জোনে বর্জ্য পানিতে পরিণত হয়। ফার্ম এলাকায় পানি পদার্থে পরিণত হয় এবং কারখানায় পদার্থ পণ্যে পরিণত হয়। এ চক্র নিয়ত চলমান। এটি একটি জীবন্ত প্যাভিলিয়ন। কারণ, সেখানে ঘটমান সবকিছু কেবল প্রদর্শনী নয়, বাস্তবও বটে। যেমন প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় রয়েছে একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। এক্সপোর সব বর্জ্য যেখানে নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন অণুজীবের (মাইক্রোবিয়াল) ক্রিয়ায় সেই আবর্জনা পচে বায়োগ্যাসে রূপান্তরিত হয়।
এ বায়োগ্যাস থেকেই প্ল্যান্টটিকে চালানোর শক্তির জোগান দেওয়া হয়। অন্যদিকে এ পচনের প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন কার্বন ডাই–অক্সাইড ব্যবহারযোগ্য। যে কার্বন ডাই–অক্সাইড ছিল এত দিন পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে মূল মাথাব্যথা, সেটিই এখন সম্পদে রূপান্তরিত করার একটি অভিনব উপায় তুলে ধরা হয়েছে এ প্যাভিলিয়নে। খাদ্যবর্জ্যের অণুজীবগত পচনের সময় উৎপাদিত কার্বন ডাই–অক্সাইডকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে উৎপন্ন হয় প্রাকৃতিক পচনযোগ্য (বায়োডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিক, যা দিয়ে নির্মাণ করা যাবে বিভিন্ন জিনিস। এ রকমের একটি পাত্র প্যাভিলিয়নে প্রদর্শিত হয়েছে। আবার সেটি কীভাবে ভেঙে পানিতে মিশে যাচ্ছে, তারও একটি নমুনা আছে সেখানে।
ওসাকা এক্সপোর গ্র্যান্ড রিং