‘ঘটনাগুলো আমাকে এত তাড়া করত, আমি কাঁদতাম। আমার ক্লাসে যেতে ইচ্ছা করত না। যৌন হয়রানি নিয়ে অনেকে কথা বলেন। কিন্তু বুলিং-গসিপের মতো মানসিক হয়রানির ভয়াবহতা ততটা গুরুত্ব পায় না।’

কথাগুলো বলেছিলেন এক তরুণী (২৬)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার সময় তিনি কিছু সহপাঠীর মাধ্যমে বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।

তরুণী বলেন, তাঁর অভিজ্ঞতা এতটাই ভীতিকর ছিল যে অনার্সের পর তিনি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করেননি। এর পরিবর্তে চাকরিতে যোগ দেন। প্রায় এক বছর চাকরি করেন। মাস্টার্স করার জন্য গত মাসে তিনি বিদেশে চলে যান।

আরও পড়ুনক্যাম্পাসে এখনও নারীদের বুলিং, ট্যাগিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে: জাকসু ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

দেশে থাকাকালে ভুক্তভোগী তরুণী এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি ‘বুলিংয়ের শিকার’ হওয়ার বিবরণ দিয়েছিলেন। বিদেশে যাওয়ার পর সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে আবার কথা হয়।

ওই তরুণী বলেন, নারীর প্রতি যৌন হয়রানিকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, এ নিয়ে লোকজনকে যতটা প্রতিবাদী হতে দেখা যায়, বুলিং-গসিপের মতো মানসিক হয়রানি-পীড়নের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না।

তরুণী বলেন, তাঁর অভিজ্ঞতা এতটাই ভীতিকর ছিল যে অনার্সের পর তিনি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করেননি। এর পরিবর্তে চাকরিতে যোগ দেন। প্রায় এক বছর চাকরি করেন। মাস্টার্স করার জন্য গত মাসে তিনি বিদেশে চলে যান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের বুলিং-গসিপের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানান ওই তরুণী। তিনি বলেন, মনোবিদের কাছে গিয়ে ছয় থেকে সাতটি কাউন্সেলিং সেশন নিতে হয়েছে তাঁর। তবে তাঁর এই মানসিক হয়রানির বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্ব পায়নি।

তরুণী বলেন, ‘এটা (বুলিং) সেখানে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। অথচ বুলিদের (হেনস্তাকারী) কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করতে পারলাম না।’

আরও পড়ুনশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইবার বুলিং প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ০২ ডিসেম্বর ২০২৪আমি কতটা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম, বোঝাতে পারব না। মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে দুটি ক্লাস করে আর যাইনি। মা–বাবা অবাক হয়েছিলেন। তাঁদের বলেছি, আমি ‘বুলিড’ হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের সঙ্গে আর পড়ব না।ভুক্তভোগী তরুণী‘ওদের সঙ্গে আর পড়ব না’

ভুক্তভোগী তরুণী রাজধানীর একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি-এইচএসসি পাস করেন। তাঁর মা–বাবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন।

তরুণী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি সবার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করতেন। তবে কারও সঙ্গেই খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়নি। এর মধ্যে একটি গ্রুপ হয়ে ওঠে ‘এলিট’ (প্রভাবশালী)। এই গ্রুপে মূলত ছেলেরাই ছিলেন। তাঁরা পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। পারিবারিকভাবে সচ্ছল। তাঁরা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তান। তাঁদের সঙ্গে তাঁর মেশা কম হতো।

২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছোট কয়েকটি গ্রুপ তৈরি হয় বলে জানান তরুণী। তিনি বলেন, তখন কারও কোনো কাজ ছিল না। ফেসবুকে কাউকে না কাউকে নিশানা করে বুলিং করা হতো। কোভিডের পর সরাসরি ক্লাস শুরু হয়। তখনো এসব বুলিং থামেনি। কারও মধ্যে ‘বসিং’ (হুকুমবাজি) প্রবণতা বেশি ছিল। কাকে পশ্চিমা পোশাকে মানায় না, কার পোশাক পরার ধরন ভালো না, কে কোন সহপাঠীদের সঙ্গে প্রেম শুরু করেছে—এসব নিয়ে ক্লাসে গসিপ (পরচর্চা) চলত। সেই সঙ্গে চলত ব্যাকবাইটিং (কারও অনুপস্থিতিতে নিন্দা করা)।

আরও পড়ুনসাইবার বুলিং কাদের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলে১০ অক্টোবর ২০২৪ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের বুলিং-গসিপের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানান তরুণী। তিনি বলেন, মনোবিদের কাছে গিয়ে ছয় থেকে সাতটি কাউন্সেলিং সেশন নিতে হয়েছে তাঁর। তবে তাঁর এই মানসিক হয়রানির বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্ব পায়নি।

তরুণীর ভাষ্য, তিনি খেয়াল করলেন, যা তিনি বলেননি, তা নিয়ে তাঁকে দোষারোপ করা হচ্ছে। বুলিং করা হচ্ছে। যে গ্রুপটা এলিট ছিল, সেই গ্রুপের ছেলেরা ছিল বুলি টাইপের। তিনজন ছেলে বেশি বুলি ছিলেন। তাঁরা গসিপও করতেন বেশি। তাঁরা নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করতেন খুব। বডি শেমিং, স্লাট শেমিং করতেন। একজন ছেলে কথা বলার সময় বাজে দৃষ্টিতে তাকাতেন। একবার একজন শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে ‘বেখেয়ালের’ অজুহাত দিতে ‘সরি’ বলেছিলেন।

বছর দুয়েক পর এই ‘এলিট’ গ্রুপের তুলনামূলক ‘নিরীহ’ একটি ছেলের সঙ্গে ভালো লাগার সম্পর্ক গড়ে ওঠে বলে জানান তরুণী। সম্পর্কটিকে তিনি বর্ণনা করেন ‘সিচুয়েশনশিপ’ হিসেবে। তিনি বলেন, সম্পর্কটিকে দীর্ঘ বা স্থায়ী করার ক্ষেত্রে তাঁরা কেউ কারও প্রতি প্রতিশ্রুতবদ্ধ ছিলেন না। শুরুতে তাঁরা বলেছিলেন, সম্পর্ক ভেঙে গেলে তাঁরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। সম্পর্কের এক বছরের মধ্যে ছেলেটি সাবেক প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তখন তিনি (তরুণী) সম্পর্কটি ভেঙে দেন।

তরুণীর ভাষ্য, এরপর দেখলেন, তিনি ক্লাসে গেলে অনেকে ফিসফিস করেন। তিনি বুঝতে পারতেন, তাঁকে নিয়েই কিছু বলা হচ্ছে। যাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে গেছে, সেই ছেলে, তাঁর বন্ধুসহ কিছু সহপাঠী মিলে তাঁকে নানান ধরনের মন্তব্য করে কোণঠাসা করে ফেলেন। সে সময় তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন। ক্লাসে যেতে ইচ্ছা করত না। পড়াশোনা করতে পারতেন না। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করেন।

তরুণী বলেন, ‘আমি কতটা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম, বোঝাতে পারব না। মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে দুটি ক্লাস করে আর যাইনি। মা–বাবা অবাক হয়েছিলেন। তাঁদের বলেছি, আমি “বুলিড” হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের সঙ্গে আর পড়ব না।’

আরও পড়ুন‘বুলিং ও র‌্যাগিং’ রোধে নীতিমালা বাস্তবায়নের নির্দেশ২১ আগস্ট ২০২৪মেয়েটি যে ধরনের অভিযোগ করেছিল, তা প্রমাণ করা কঠিন। ফলে মেয়েটিকে আমি মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার জন্য বুঝিয়েছিলাম। মেয়েটি অন্তর্মুখী। সে তার কষ্টের কথা সেভাবে শেয়ার করতে পারত না।বিভাগের শিক্ষকশিক্ষক যা বললেন

তরুণীর অভিযোগ নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগটির শিক্ষক ও তৎকালীন স্টুডেন্ট কাউন্সেলরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের ডেকে তিনি কথা বলেছিলেন। অন্য সহপাঠীদের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন। তাঁদের কথা ছিল, ‘ব্রেকআপ’ হওয়ার কারণে মেয়েটি বিষণ্ন ছিল।

ওই শিক্ষক বলেন, ‘মেয়েটি যে ধরনের অভিযোগ করেছিল, তা প্রমাণ করা কঠিন। ফলে মেয়েটিকে আমি মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার জন্য বুঝিয়েছিলাম। মেয়েটি অন্তর্মুখী। সে তার কষ্টের কথা সেভাবে শেয়ার করতে পারত না।’

বুলিংয়ের মতো হেনস্তার বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সুযোগ নেই—এমন প্রশ্নে ওই শিক্ষক বলেন, ব্যবস্থা আছে। তবে অভিযোগ প্রমাণিত হতে হবে। শুরুতে তিনি মেয়েটিকে লিখিতভাবে অভিযোগ দিতে বলেছিলেন। পরে মেয়েটি বিভাগের প্রধানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স পরীক্ষা হয়ে গেছে।

তরুণী বলেন, অনার্স ও ইন্টার্নশিপ শেষে তিনি প্রথম মৌখিক অভিযোগ করেন। পরে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের মাস্টার্স পরীক্ষার পর লিখিত অভিযোগ দেন। তিনি পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এর মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি এবং দুজনের বিরুদ্ধে মানসিক ও মৌখিক হয়রানির অভিযোগ দেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, একটা কমিটি হয়েছে। মাস্টার্সের ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে এখনো ব্যবস্থা নিতে পারে।

মৌখিক অভিযোগ যখন করেছিলেন, তখন সেটাকে আমলে নেওয়া হয়নি বলে দাবি তরুণীর। তিনি বলেন, ফলে হেনস্তাকারীরা নিজেদের আরও ক্ষমতায়িত বোধ করেছেন। তাঁদের কোনো অনুতাপ হয়নি। তাঁরা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে ‘ব্রেকআপ’ বিষয়টিকে সামনে আনেন। এখানে ‘ব্রেকআপ’ কোনো বিষয় ছিল না।

আরও পড়ুনসাইবার বুলিং থেকে কি নারীদের মুক্তি নেই২০ ডিসেম্বর ২০২২২০২১ সালে পোল্যান্ডের ম্যানেজমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘কনসিকোয়েন্সেস অব বুলিং অন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে আসে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বুলিং হয়।সহপাঠীদের আচরণে হীনম্মন্যতায় ভোগে ৫ শতাংশ

বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন ২০২২ সালের অক্টোবরে ‘করোনা-পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একাডেমিক চাপের প্রভাব এবং তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শীর্ষক জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সহপাঠীদের দ্বারা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কারণে হীনম্মন্যতায় ভোগেন প্রায় ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।

জরিপে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার মোট ১ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৫৬ শতাংশ।

একই সংগঠন ২০২২ সালের মার্চে ‘তরুণীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শিরোনামে আরেকটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, তরুণীরা তাঁদের দেহের আকৃতি, গঠন ও অবয়ব নিয়ে কথাবার্তায় হেয়প্রতিপন্ন বোধ করেন। বন্ধুবান্ধবের কাছে ‘বডি শেমিং’-এর শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ তরুণী। এই জরিপে এক হাজারের বেশি তরুণী অংশ নিয়েছিলেন।

২০২১ সালে পোল্যান্ডের ম্যানেজমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘কনসিকোয়েন্সেস অব বুলিং অন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর বুলিংয়ের পরিণতি) শীর্ষক এক গবেষণায় উঠে আসে, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বুলিং হয়। বুলিং প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের তাঁদের অধিকার সম্পর্কে জানা, অভিযোগ করার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হওয়া, অন্যদের সচেতন করা, পরিবারকে ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো, শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গবেষণা প্রতিবেদনে জোর দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনসাইবার বুলিংয়ের শিকার নারীরাই বেশি২৯ মার্চ ২০২২বুলিংয়ের মতো ঘটনায় ভুক্তভোগীর মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, ক্লাসে যেতে ভয় পাওয়া, মানসিকভাবে দুর্বল বোধ করা, হীনম্মন্যতা, এমনকি অপরাধবোধে ভোগার মতো প্রবণতা দেখা যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে নিজের ক্ষতি করা বা আত্মহত্যায় ঝুঁকতে দেখা যায়। ফলে কেউ বুলিংয়ের অভিযোগ করলে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।কামাল চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক‘বুলিংয়ের অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক কামাল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সেল রয়েছে। যৌন পীড়নের ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বুলিংয়ের বিরুদ্ধে সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বুলিংয়ের মতো ঘটনায় ভুক্তভোগীর মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, ক্লাসে যেতে ভয় পাওয়া, মানসিকভাবে দুর্বল বোধ করা, হীনম্মন্যতা, এমনকি অপরাধবোধে ভোগার মতো প্রবণতা দেখা যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে নিজের ক্ষতি করা বা আত্মহত্যায় ঝুঁকতে দেখা যায়। এ কারণে কেউ বুলিংয়ের অভিযোগ করলে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে ভুক্তভোগীকে কাউন্সেলিংয়ের মতো মানসিক সহায়তা দেওয়া উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের হলে ও ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) তিনতলায় বিনা মূল্যে মানসিক সহায়তা দেওয়া হয় বলে জানান অধ্যাপক কামাল চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রচার কম থাকায় অনেক শিক্ষার্থী এসব সেবা সম্পর্কে জানেন না। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে অবস্থিত নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটে ফি দিয়ে সেবা নেওয়া যায়।

আরও পড়ুনসাইবার বুলিংয়ের শিকার হলে­­­­­ কী করবেন, কোথায় যাবেন১৮ জুন ২০২২.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম স ট র স কর সহপ ঠ দ র ক হয়র ন র বল ছ ল ন ক উন স ল ব যবস থ প রবণত প রক শ র জন য হয় ছ ল ব ধ কর য় র মত ন তর ণ কর ছ ল তর ণ র দ র বল স কর ন অন র স অপর ধ করত ন র ওপর হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

খেলাপি ঋণে বাংলাদেশ এশিয়ায় কেন শীর্ষে

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মন্দ বা খেলাপি ঋণ অনেক দিনের বিরাট সমস্যা। শুরুতে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এ ব্যাধি বিদ্যমান হলেও পরবর্তী সময়ে বৃহৎ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি, তথা ঋণখেলাপির সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এক মহিরুহ আকার ধারণ করেছে।

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে। আবার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এক বছরের ব্যবধানে মোট ঋণের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি।

 সম্প্রতি প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি সামনে এসেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থিক বিভিন্ন সূচকের অবস্থা নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ২০২৩ সালের তথ্য। তাতেই বাংলাদেশ শীর্ষে। এটি যে ২০২৫ সালে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আমরা জানি।

আগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কায়দায় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অন্যদিকে সহজে ঋণ পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করার কারণেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। এখন ঋণমানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করা শুরু হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও আওয়ামী রাজনীতি–সমর্থিত ব্যক্তিদের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

খেলাপি ঋণ এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, সন্দেহ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী, তাঁরা যেন আবার ব্যবসা শুরু করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়ে সরকার কাজও করছে।

 এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২৩ সাল শেষে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছরই বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মতো ২০২১ সাল থেকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার।

দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে। যেমন ভুটানের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৩ শতাংশ। ভারতের খেলাপি ঋণের হার ২০২০ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। মালদ্বীপের খেলাপি ঋণ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। একই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণ তাইওয়ান ও কোরিয়ার। দেশ দুটির খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১ ও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জুন শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশি খেলাপি হয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলতে শুনেছি, গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আগেই বলেছি, ঋণখেলাপি হওয়ার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যাচ্ছেন, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

সূত্রগুলো বলছে, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই কাজ বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। পাশাপাশি সরকারি খাতের জনতা ও রূপালী এবং বেসরকারি খাতের ইউসিবি, আইএফআইসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ট্রাস্ট ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে।

পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১ হাজার ২৫০ প্রতিষ্ঠান বিশেষ ব্যবস্থার অধীন ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন একটি বিস্তৃত নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, এই নীতিমালায় নির্দিষ্ট অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ঋণ পরিশোধে যতটা সময় অবকাশ পাবে, ওই সময়ে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে আশা করছেন অনেকে। তবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না করলে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় মনোযোগী না হলে তার উল্টোটাও ঘটতে পারে। সুযোগের অসৎ ব্যবহারের উদাহরণ বাংলাদেশে অনেক।

সামগ্রিক ঋণখেলাপির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে গেলে আমাদের দুষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কমাতে হবে পরিচালকদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ।

মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ