পুলিশ ভেরিফিকেশন অবশ্যই ন্যায্য ও নিরপেক্ষ হতে হবে: হাইকোর্ট
Published: 17th, October 2025 GMT
পুলিশ ভেরিফিকেশন (যাচাই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) প্রতিবেদনগুলো অবশ্যই ন্যায্য, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য উপকরণের ভিত্তিতে হতে হবে বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। কারারক্ষী পদে নিয়োগবঞ্চিত ২৬ প্রার্থীর করা পৃথক দুটি রিট আবেদনে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ আসে।
আলাদা এই দুই রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মো.
পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন (যাচাই) ও এনএসআই রিপোর্টগুলো অবশ্যই ন্যায্য, নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য উপকরণের ভিত্তিতে হতে হবে; প্রয়োজনে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও আদালত যাতে পরীক্ষা করতে পারেন। এ ধরনের বৈরী প্রতিবেদনের কারণে যেসব ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, তাঁদের অবশ্যই জানাতে হবে, এর বিরোধিতা করার জন্য একইভাবে তাঁদের পর্যাপ্ত এবং উপযুক্ত সুযোগ দিতে হবে। চূড়ান্ত নির্বাচনের (প্রার্থী নির্বাচন) আগে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই এসব সম্পন্ন করতে হবে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন (যাচাই) ও এনএসআই রিপোর্টগুলো অবশ্যই ন্যায্য, নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য উপকরণের ভিত্তিতে হতে হবে; প্রয়োজনে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও আদালত যাতে পরীক্ষা করতে পারেন।এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চলতি বছরের ১৫ প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ সংস্কার কমিশন। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি চাকরিপ্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) মাধ্যমে হয়ে থাকে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে চাকরিপ্রার্থীরা অহেতুক বিড়ম্বনার শিকার হন। স্থায়ী ঠিকানাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে অনেক চাকরিপ্রার্থী চাকরির উপযুক্ততা প্রমাণে জটিলতার সম্মুখীন হন। চাকরিপ্রার্থীর অধ্যয়ন করা একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই-বাছাই করাও দীর্ঘসূত্রতার একটি অন্যতম কারণ ও পুলিশের জন্য সময়সাপেক্ষ বিষয়।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশচাকরিপ্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে কয়েকটি সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। সুপারিশে বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্রধারী (এনআইডি) চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা বাদ দেওয়া যেতে পারে। চাকরিপ্রার্থীর বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা/ শিক্ষাসনদ/ ট্রান্সক্রিপ্ট/ মার্কশিট ইত্যাদি যাচাই-বাছাই করার দায়দায়িত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে। এগুলো পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হবে না।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, চাকরির জন্য সব পুলিশ ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে এবং অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে।পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা রহিত করাসহ এ–সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছে কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাকরিপ্রার্থী বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা-সংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত কি না, তা ভেরিফিকেশন রিপোর্টে প্রতিফলিত করতে হবে। চাকরির জন্য সব পুলিশ ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে এবং অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে সুপারিশে বলা হয়েছে।
মামলার পূর্বাপরমামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে জানা যায়, কারারক্ষী ও নারী কারারক্ষী পদে নিয়োগের জন্য ২০২৩ সালের ২১ জুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কারা কর্তৃপক্ষ। এ অনুসারে রিট আবেদনকারীরা আবেদন করেন। লিখিত ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন তাঁরা। গত বছর ফলাফল প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁরা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যোগ্য বলে বিবেচিত হন এবং অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে তাঁরাও চূড়ান্তভাবে মনোনীত হন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সময়ে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়।
রিট আবেদনকারীসহ কয়েকজন নিয়োগপত্র না পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি আবেদন করেন। কারারক্ষী পদে নিয়োগপত্র দেওয়া–সংক্রান্ত এ আবেদনে বলা হয়, কারা অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের ১১ জুলাইয়ের এক স্মারকে কারারক্ষী ও মহিলা কারারক্ষী পদে ৫৬৯ জন সুপারিশপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীকালে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য ফরম জমা নেওয়া হয় একই বছরের ১৩ আগস্ট। প্রথমে এসবি দিয়ে তদন্ত হয়, পরে এনএসআই দিয়ে তদন্ত করা হয়। ২০২৪ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে একই বছরের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত আট ধাপে ওয়েবসাইটে নির্বাচিতদের ক্রমিক নম্বর প্রকাশ করা হয়। ৫৬৯ জনের মধ্যে ৫২১ জন নিয়োগপত্র পেয়ে রাজশাহী প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যোগদান করেন। বাকি ৪৮ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি।
নিয়োগপত্র পেতে সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর করা ওই আবেদনে বলা হয়, তাঁদের (আবেদনকারীদের) পরিবারের কোনো সদস্য রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত নন। তাঁদের শিক্ষাজীবনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই, এমনকি পরিবারের কারও সংশ্লিষ্টতা নেই। তাঁদের (আবেদনকারীদের) বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধসংক্রান্ত কোনো মামলা নেই।
আবেদনের পর দৃশ্যমান পদক্ষেপ না দেখে নিয়োগপ্রত্যাশী মো. শাহীন মিয়াসহ ২৫ জন প্রার্থী একটি এবং মো. মেহেদী হাসান নামের এক প্রার্থী আরেকটি রিট আবেদন করেন। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন।
রুল শুনানিতে কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য ছিল, চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত কারারক্ষী পদে ৫৫৪ জন ও মহিলা কারারক্ষী পদে ১৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ৬ জন কারারক্ষী ও ২ জন মহিলা কারারক্ষীর পুলিশ ও এনএসআই ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন জমা হয়নি। ৪৩ জন প্রার্থীর পুলিশ ও এনএসআই প্রতিবেদনের যেকোনো একটিতে অথবা উভয়টিতে বিরূপ মন্তব্য থাকায় তাঁদেরও নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই ৪৩ প্রার্থীর মধ্যে রিট আবেদনকারী ২৬ জনও অন্তর্ভুক্ত।
চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে ৩ সেপ্টেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। রিট আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে পুলিশ ও এনএসআইয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেছেন, ‘“বিরূপ মন্তব্য নাই” বলে পুলিশ ভেরিফিকেশনে এবং “সার্বিক বিবেচনায় বিষয়ব্যক্তি সম্পর্কে আপত্তি জ্ঞাপন করা যেতে পারে” বলে এনএসআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আমরা দেখছি এনএসআই তাদের প্রতিবেদনে “সার্বিক বিবেচনায় বিষয়ব্যক্তি সম্পর্কে আপত্তি জ্ঞাপন করা যেতে পারে”—যান্ত্রিকভাবে লিপিবদ্ধ করেছে। প্রতিবেদনের পক্ষে কোনো ভিত্তি উল্লেখ করেনি। আদালতের সামনে এমন কোনো উপাদান উপস্থাপন করা হয়নি, যার মাধ্যমে প্রতিবেদনের সত্যতা বা যথার্থতা যাচাই করা যেতে পারে।’
এদিকে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে সরকারপক্ষ ও কারা কর্তৃপক্ষ পৃথক আবেদন করে, যা গত ২২ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন চেম্বার আদালত বিষয়টি ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত স্ট্যান্ডওভার (মুলতবি) করেন।
হাইকোর্টে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ সিরাজুম মুনীর ও মো. উজ্জ্বল হোসেন শুনানিতে ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ ওয়ালিউল ইসলাম ওলি।
১৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় ৬ অক্টোবর হাতে পেয়েছেন বলে জানান রিট আবেদনকারীদের অন্যতম আইনজীবী মো. উজ্জ্বল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনে তাঁদের কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি কোনো অপরাধ বা অন্য কোনো অযোগ্যতার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। আইন অনুসারে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনই যথেষ্ট। অথচ দেখা যাচ্ছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মৌখিক নির্দেশনায় এনএসআই নিয়ে আবার ভেরিফিকেশন করা হয়। এতে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ উল্লেখ ছাড়াই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ‘সার্বিক বিবেচনায় বিষয়ব্যক্তি সম্পর্কে আপত্তি জ্ঞাপন করা যেতে পারে’ বলে একই ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে। যে কারণে তাঁরা নিয়োগবঞ্চিত হন। এটি সংবিধানের ২৭, ২৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, তাই নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে পৃথক রিট করেন আবেদনকারীরা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ কর প র র থ র ও এনএসআই ন য় গপত র ম হ ম মদ ক র রক ষ চ কর র র র জন ন কর ন প রক শ পর ক ষ র জন য ত সময় সরক র বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
দীর্ঘ বিরতির পর কেন এই জরিপ
রাষ্ট্র, সরকার ও দেশের রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর জনমত জরিপ আবার ফিরে এল। প্রথম আলোর উদ্যোগে এ ধরনের সর্বশেষ জনমত জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। মাঝখানের ১২ বছরে পদ্মা দিয়ে বিপুল পানি প্রবাহিত হয়েছে। এ সময়টাতে দেশ কী অবস্থার মধ্যে ছিল, গত বছরের জুলাই গণ–অভ্যুত্থান তার রোমহর্ষক ছবি আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে জনমত জরিপের এই দীর্ঘ বিরতির কারণ নিয়ে আমরা কিছুটা পরে আবার ফিরে আসছি।
দেশের মানুষই গণমাধ্যমের শেষ গন্তব্য। সে কারণে জনমতকে বোঝার চেষ্টা করা এবং পাঠকের কাছে মানুষের মনোভাব তুলে ধরার কাজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রথম আলো গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। প্রথম আলো প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে। ঠিক পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৯ সাল থেকেই আমরা নিয়মিত পাঠকের জনমত জরিপ প্রকাশ করতে শুরু করি। জরিপের বিষয় হতো সাম্প্রতিক রাজনীতি বা জীবনযাত্রা। তাতে অংশ নিতেন পাঠকেরা। জরিপে তাঁরা বেশ ভালো সাড়া দিতেন। কোনো মেথডোলজি বা গবেষণাপ্রক্রিয়া মেনে কিংবা তৃতীয় কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে সেসব জরিপ পরিচালনা করা হতো, তা নয়। তবে স্বতঃস্ফূর্ত সেসব জরিপ থেকে চারপাশের পরিস্থিতি নিয়ে জনমনের সাধারণ ধারণার প্রতিফলন পাওয়া যেত। মাঝেমধ্যে ছেদ পড়লেও ২০০৭ সাল পর্যন্ত এ ধরনের পাঠকমত জরিপ অব্যাহত থাকে।
২০০৮ সাল থেকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আমরা আরও ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণে, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে এবং অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনমত পরিচালনার পরিকল্পনা করি। দেশের মানুষ কেমন আছেন, রাজনীতি–অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন, সরকারের কাছে কোন বিষয়ে কী প্রত্যাশা করছেন—ওই বছর থেকে পাঠকের সামনে সেসব বিস্তৃতভাবে তুলে ধরার যাত্রা শুরু হলো। সেই থেকে সূচনা। এরপর নিয়মিত বিরতিতে প্রতিবছর এ জরিপ চলেছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত আর কোনো বিরতি পড়েনি। সেগুলো পরিচালনা করেছিল পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওআরজি কোয়েস্ট।
এরপর দীর্ঘ বিরতির ইতিহাস। এ বিরতির রাজনৈতিক কারণ পাঠক আন্দাজ করছেন নিশ্চয়ই। তবু সে প্রসঙ্গে আসার আগে কিংবা তাতে প্রবেশের জন্য প্রথম আলোর সেসব জরিপের কিছু তথ্য প্রথমে ভাগ করে নেওয়া যাক।
কোন কোন বিষয়ে দেশের মানুষের মনোভাব কী রকমভাবে পাল্টে যাচ্ছে, সেটা বোঝার জন্য প্রতিবছরের জরিপে বেশ কিছু একই ধরনের প্রশ্ন রাখা হতো। তার একটি ছিল—দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনটিকে মানুষ কী রকম সমর্থন দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ইত্যাদি রাজনৈতিক দলকে সামনে রেখে উত্তরদাতাদের কাছে জানতে চাওয়া হতো, এখনই যদি নির্বাচন হয়, তাহলে তাঁরা কাকে ভোট দেবেন। প্রথম আলোর জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন যথাক্রমে ৫৬, ৪৬, ৩৮ ও ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ দলটির জনপ্রিয়তার রেখা ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে। বিপরীতে বিএনপির ক্ষেত্রে এই রেখা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী—যথাক্রমে ২৫, ৩৯, ৪৩ ও ৪৪ শতাংশ। শেষ দিকের বছরগুলোয় এসে যে বিএনপির জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগকে ছাপিয়ে গেছে, সেটাও লক্ষ করার মতো।
আগের বছরের নভেম্বরে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি যে প্রধান প্রতিবেদনটি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল ‘সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে’। বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তখন সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ।
সেই জরিপ নিয়ে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম, ‘সরকার কোনো কোনো সূচকে গত চার বছরে ক্রমাগত খারাপ করেছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে বলতে হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা। মানুষ মনে করেছে, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচার বিভাগ বা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি উন্নত হয়নি। দেশ ভুল পথে চলেছে, এ ধারণা ক্রমশ বেড়েছে। মানুষের মনে এমন ধারণাও ধীরে ধীরে বেড়েছে যে দুর্নীতিরও আরও বিস্তার ঘটেছে। তারা মনে করেছে, আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন সংগঠন বছরে বছরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। পদ্মা সেতু ও মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে সরকার মানুষের সমর্থন পায়নি।’
কিন্তু পরিস্থিতি আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়তে লাগল। ১৯৯০ সালের গণ–আন্দোলন দেশে গণতন্ত্রের যে পুনরুদ্ধার ঘটিয়েছিল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সে পাশা পুরোপুরি উল্টে দেয়। শেখ হাসিনা একটি বিতর্কিত নির্বাচনের আয়োজন করেন। বিএনপি বর্জন করে সেই নির্বাচন। ১৫৩টি আসনেই নির্বাচন হয় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া, আওয়ামী লীগ যার বিপুল অংশ হস্তগত করে। শেখ হাসিনার হাতে সেদিন বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবার শোচনীয়ভাবে অস্তমিত হলো।
এরপর শুরু হলো শেখ হাসিনার ক্রমাগত নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পালা। সেই পথে প্রথম কুঠারাঘাত পড়ল বাক্স্বাধীনতার ওপর। আইনি ও বেআইনি নানা উপায়ে স্বাধীন মত বা ভিন্নমতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা শুরু হলো। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করল। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোকে নানাভাবে হেনস্তা করা হলো, রাখা হলো তীব্র চাপে। বাংলাদেশ হয়ে উঠল ত্রাসের রাজ্য। কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আর রাজনৈতিক জরিপ করার সাহস হয়নি। এ রকম স্বৈরতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক বিষয়ে জরিপ পরিচালনা করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে।
তবে রাজনৈতিক বিষয়ের বাইরে প্রথম আলো জরিপ অব্যাহত রাখল অন্য নানা বিষয়ে। এর মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপের কথা। তরুণদের সমস্যা ও সংকট বা প্রত্যাশা ও প্রবণতা বুঝতে ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় সেই জরিপ। কোভিডের প্রাদুর্ভাবে ২০২০ সালে জরিপটি বাধাগ্রস্ত হয়। আয়রোজগার নিয়ে হতাশা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ইত্যাদি দেশের বাস্তব নানা পরিস্থিতি নিয়ে তারুণ্য জরিপগুলোয়ও তরুণ–তরুণীদের মধ্যে তীব্র হতাশার প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে। সরকার সেসব বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করেছে সামান্যই। তরুণদের সেই পুঞ্জীভূত হতাশার বিস্ফোরণ আমরা গত বছর দেখতে পেলাম।
২০২৪ সালের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশ একটি নতুন সংযোগস্থলে। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অভিষিক্ত অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় দেড় বছরের কাছাকাছি সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। সামনের সম্ভাব্য নির্বাচনের পর নতুন রাজনৈতিক সরকার শাসনভার গ্রহণ করবে। দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য। তাঁদের রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক পর্যালোচনা ও অভিপ্রায় বোঝার জন্য সম্ভবত এটিই উত্তম একটি পরিস্থিতি। আমাদের এবারের জনমত জরিপটি পরিচালনা করেছে পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান কি–মেকারস।
প্রথম আলোর এ জরিপের বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের মূল্যায়ন, বর্তমান জনজীবনের পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন এবং সামনের নির্বাচিত সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা।
যুক্তরাজ্যের একসময়কার প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরায়েলির সেই উক্তি তো এখন প্রবচনে পরিণত হয়েছে, ‘মিথ্যা তিন প্রকার: মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।’ কোনো বিষয়ে গণভোটের মাধ্যমেই কেবল চূড়ান্ত সত্য জানা সম্ভব, এ কথা সত্য; কিন্তু সব বিষয়ে গণভোট করা অসম্ভব। সেটি ব্যাপক ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। তাই বিশ্বব্যাপী সবাই পরিসংখ্যানের ওপরই নির্ভর করেন। কারণ, পরিসংখ্যান সত্যের আভাস দেয়। যথাযথ জরিপ দেয় সত্যের জোরালো আভাস। নোবেলজয়ী আইরিশ লেখক জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, ‘পরিসংখ্যান দেখে বিচলিত হওয়া প্রকৃত বুদ্ধিমান ব্যক্তির লক্ষণ।’
আমরা আশা করব, আমাদের বর্তমান ও আসন্ন সরকার দেশবাসীর মতামতের প্রতি সাড়া দিয়ে সে লক্ষণ দেখাবে।