গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধাভিযানে ১৫ মাসে ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; লাখ লাখ ফিলিস্তিনি আহত, পঙ্গু ও অক্ষম হয়ে গেছেন; সেখানকার ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও রাস্তাঘাট ধুলায় মিশে গেছে; সেখানকার মাটি ও পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে গাজাকে অবাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে।

এই পুরো কর্মকাণ্ডকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে অভিহিত করা যায় কি না, তা নিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মধ্যে এখন তর্ক চলছে। বলা দরকার যে ইংরেজি ‘জেনোসাইড’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘গণহত্যা’ প্রচলিত হয়ে গেলেও তাতে জেনোসাইডের ব্যাপ্তি ও তাৎপর্য প্রতিফলিত হয় না। ‘ম্যাস কিলিং’ বা ‘ম্যাস মার্ডার’কেও বাংলায় ‘গণহত্যা’ বলা হয়। অনেকে তাই জেনোসাইডকে বাংলায় ‘পরিকল্পিত গণহত্যা’ বলার পক্ষে। আবার অনেকে ‘জাতিগত নিধন’ বা ‘জাতিগত নির্মূলাভিযান’ বলতে চান, যদিও তা ‘এথনিক ক্লিনজিং’-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য।

‘জেনোসাইড’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘গণহত্যা’ প্রচলিত হয়ে গেলেও তাতে জেনোসাইডের ব্যাপ্তি ও তাৎপর্য প্রতিফলিত হয় না।

একটি মানবিক ও জাতি-সমষ্টির সত্তা হিসেবে গাজার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আর জেনোসাইড ঠিক এ রকমই হয়।

২.

 

ইসরায়েলের রিভিশনিস্ট বা সংশোধনবাদী ইতিহাসবিদ হিসেবে খ্যাত বেন্নি মরিসের ভাষ্যটা আগে জানা যাক। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ইসরায়েল গাজায় কোনো জেনোসাইড চালাচ্ছে না। হেগে (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি) প্রসিকিউটর এবং ওমের বারটভ থেকে শুরু করে সব জ্ঞানী অধ্যাপক জেনোসাইড নিয়ে যা বলছেন, তা ভুল। (ইসরায়েল) সরকারের জেনোসাইড-বিষয়ক কোনো নীতি নেই, ইসরায়েলি নেতৃত্ব জেনোসাইড ঘটানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি, ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য পরিকল্পিত কোনো উদ্দেশ্য নেই এবং সরকার বা সেনাপ্রধানদের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর কাছে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজ–এর ইংরেজি সংস্করণে গত ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত এই নিবন্ধে মরিস অবশ্য এটা স্বীকার করেন, গাজায় যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ হয়েছে ও হচ্ছে, তাতে বিষয়টি হয়তো জেনোসাইডের পথে যাচ্ছে।

এর কিছুদিন আগে ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর হারেৎজ–এ (হিব্রু সংস্করণ) আরেক খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ শ্লোমো স্যান্ড লিখেছেন, গাজায় ইসরায়েল ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছে, যুদ্ধাপরাধ করেছে। তারপরও এ সবকিছু মিলিয়ে জেনোসাইড সংঘটিত হয়নি। এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে স্যান্ড গাজা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন ফ্রান্সের আলজেরিয়া যুদ্ধ (১৯৫৪-১৯৬২) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম যুদ্ধে (১৯৬৫-১৯৭৩) লিপ্ত থাকার ঘটনাকে। স্যান্ডের ভাষ্যে, এ দুটি যুদ্ধে ফরাসি ও মার্কিন বাহিনী বেসামরিক জনগণের ওপর যে নৃশংসতা-বর্বরতা চালিয়েছে, তা গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতার চেয়ে ভয়াবহ ছিল। তারপরও তাদের সেই হত্যাযজ্ঞকে জেনোসাইড হিসেবে অভিহিত করা হয়নি।

তবে জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক ড্যানিয়েল ব্লাটম্যান ও অ্যামোস গোল্ডবার্গ স্যান্ডের যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। তাঁরা বলেন, আলজেরিয়ায় ফরাসি ঔপনিবেশিক দখলদারির কালে (১৮৩০-১৮৭৫) ৫ থেকে ১০ লাখ আলজেরীয় ক্ষুধা ও রোগাক্রান্ত হয়ে বা পরিকল্পিতভাবে প্রাণ হারিয়েছিল। বেন কিরানানের ব্লাড অ্যান্ড সয়েল: আ ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি অব জেনোসাইড অ্যান্ড এক্সট্রামিনেশন ফ্রম স্পার্টা টু দারফুর (২০০৭) বই থেকে উদ্ধৃতি টেনে তাঁরা বলেন যে ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনকালে ফরাসিরা যা করেছে, তা জেনোসাইডের সমতুল্য।

৩০ জানুয়ারি হারেৎজ–এর ইংরেজি সংস্করণে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ বিশ্ব ইতিহাসে জেনোসাইডের বিভিন্ন উদাহরণ ও পটভূমি নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তাঁরা এতে লিখেছেন যে লিও কুপার তাঁর জেনোসাইড: ইটস পলিটিক্যাল ইউজ ইন দ্য টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি (১৯৮২) বইয়ে বলেছেন, আলজেরিয়ার যুদ্ধের সময় ফরাসিরা যে নৃশংসতা ঘটিয়েছিল, তা হয়তো পরিকল্পিত গণহত্যার কাছাকাছি নিধনযজ্ঞ (জেনোসাইডাল ম্যাসাকার), তবে পূর্ণাঙ্গ জেনোসাইডের যাবতীয় মানদণ্ড পূরণ করে না।

ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিষয়ে স্যান্ডের অভিমতের সঙ্গে প্রবলভাবে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁরা এ ক্ষেত্রে রাসেল ট্রাইবু৵নালের বিষয়টি তুলে ধরেন। ১৯৬৬ সালে ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার জন্য যে গণ-ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন, ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ পল সাত্রে৴ তার প্রধান ছিলেন। অন্যদের মধ্যে ফরাসি লেখক সিমোন দ্য বোঁভেয়া ইতালির রাজনীতিবিদ লেলিও বাসো এবং যুগোস্লাভিয়ার মানবাধিকারকর্মী ভ্লাদিমির দেদিজা এতে যুক্ত ছিলেন।

এই গণ-ট্রাইব্যুনাল বিচার-বিশ্লেষণ শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যা করেছে, তা জেনোসাইড অপরাধের প্রতিরোধ ও শাস্তিবিষয়ক ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ কনভেনশনের আলোকে জেনোসাইড। নির্বিচার বোমাবর্ষণ, বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার, যুদ্ধবন্দীদের নিপীড়ন ও নির্যাতন এবং ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা ও স্মারক ধ্বংস করায় মার্কিন সেনাবাহিনী জেনোসাইডের অপরাধে অপরাধী হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে পোল্যান্ডের অশউইৎজে স্থাপিত কুখ্যাত বন্দিশিবিরটি ১৯৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সোভিয়েত লালফৌজ মুক্ত করেছিল। এখানে লাখ লাখ ইহুদিকে ধরে এনে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল নাৎসিরা। সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ তাঁদের লেখার উপসংহার টেনেছেন এভাবে; ‘গাজায় যা হচ্ছে, তা হলোকাস্ট নয়। এখানে কোনো অশউইৎজ নেই, নেই কোনো ত্রেবলিঙ্কা। তবে এটা সেই একই ধরনের অপরাধ—জেনোসাইডের অপরাধ’।

৩. 

কয়েক শ বা কয়েক হাজার মানুষের ওপর নির্বিচার চালানো হত্যাযজ্ঞকে আইনিভাবে জেনোসাইডের অন্তর্ভুক্ত করতে গেলে এহেন হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে হয়, যা বেশ কঠিন কাজ। জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশন অনুসারে এ রকম হত্যাযজ্ঞ দ্বারা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে (যা কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র হতে পারে) ‘পুরোপুরি বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য’ থাকতে হবে।

ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ বলেন, ‘উদ্দেশ্য’ (ইনটেন্ট) নির্ধারণের বিষয়টি কনভেনশনে যুক্ত করার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ স্বার্থ। ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালে দুই পরাশক্তিই কিছুটা শঙ্কিত হয়েছিল এই ভেবে যে এই কনভেনশনের আলোকে তাদেরও কখনো–বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে—অতীতে সংঘটিত বা ভবিষ্যতে ঘটানো হতে পারে এমন সহিংসতার জন্য। 

জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে কি না, তা নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। এ কারণেই ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে বসনিয়ার সার্বদের দ্বারা বসনিয়ার মুসলমানদের স্রেব্রেনিৎসা জেনোসাইড এর একটি উদাহরণ। এ-সংক্রান্ত রায়ে বলা হয় যে জনগোষ্ঠীর আক্রান্ত অংশটিকে স্বতন্ত্র ও সুচিহ্নিত হতে হবে এবং তাদের নির্মূল করা হলে গোটা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়তে পারে।

সাবেক যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধবিষয়ক দুটি রায়ে আইসিজে বলেছে যে ‘ধ্বংস করার উদ্দেশ্য’ প্রমাণের জন্য বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও আচরণকে এমন হতে হবে, যেগুলো অন্য কোনোভাবে যৌক্তিক ব্যাখ্যা করা যায় না। মানে এসব কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা ‘ধ্বংস করার উদ্দেশ্য’হলেই হবে না, এসবের অন্য আর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই, তা-ও দেখাতে হবে। 

৪. 

গাজার ক্ষেত্রে কি ‘ধ্বংস করার উদ্দেশ্য’ প্রমাণ করা সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের চিন্তার বিষয়টি বাদ দিলেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্টসহ ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ এবং ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা একাধিক বিবৃতিতে তাঁরা যে জেনোসাইড ঘটাতে ইচ্ছুক, সে রকম আভাস দিয়েছেন। 

‘গাজায় নিরীহ কেউ নেই’, ‘আমরা এবার দ্বিতীয় নাকবা ঘটাব’ এবং আরও অনেক বক্তব্য এসেছে, যা সবই সংরক্ষিত আছে। এসব বক্তব্য-বিবৃতি গাজায় ইসরায়েলের জেনোসাইড ঘটানোর পক্ষে প্রমাণ হিসেবে দেখানো যায় বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা জেনোসাইড-গবেষক ও বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম স্ক্যাবাসের শরণ নিয়েছেন।

স্ক্যাবাসের যুক্তি হলো, হামলাকারী ও হত্যাকারীরা যদি জেনোসাইডমূলক বিবৃতি, নির্দেশ ও বক্তব্য দেন, তাহলে ‘ধ্বংস করার উদ্দেশ্য’ তথা জেনোসাইড ঘটানোর উদ্দেশ্য প্রমাণ করা সহজ। সে কারণেই আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা অভিযোগ অত্যন্ত জোরালো বলে মনে করেন স্ক্যাবাস। কারণ, ইসরায়েলি সিদ্ধান্তপ্রণেতাদের জেনোসাইডমূলক অগণিত বক্তব্য যেমন আছে, তেমনি আছে তাঁদের কর্মকাণ্ডের ধরনও। গাজাবাসীকে পদ্ধতিগতভাবে অনাহারে রাখা, গাজার বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া, উত্তরাঞ্চলে জাতিগত নিধন ঘটানো এবং ‘নিরাপদ’ হিসেবে চিহ্নিত স্থানগুলোয় হামলা চালানো এসব কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত।

আবার ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ বলেন যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জেনোসাইড সংঘটনকারীরা তাঁদের কর্মকাণ্ডকে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে দাবি করে থাকেন। গাজার জেনোসাইডকে বেশির ভাগ ইসরায়েলি হামাসের ভয়াবহ আক্রমণের প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ হিসেবেই বিবেচনা করেন।

গাজায় ইসরায়েল যা করেছে, তার সঙ্গে হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের অনেক মিল পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছেন ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ইয়ান কেরশ তাঁর ফেটফুল চয়েসেস: টেন ডিসিশনস দ্যাট চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড, ১৯৪০-১৯৪১ বইয়ে দেখিয়েছেন যে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার জন্য খোদ হিটলারের কাছ থেকে সরাসরি কোনো নির্দেশ জারি করা হয়নি, তবে নানা রকম বার্তা ও কথা–চালাচালির জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে, যা সহিংসতা বাড়াতে এবং হত্যাযজ্ঞের বিস্তার ঘটাতে ভূমিকা রেখেছে।

গাজায় জেনোসাইড ঘটানোর বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়নের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলছেন, ২০১৬ সাল থেকে সাড়ে আট লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ৯ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ সব বা বেশির ভাগ রোহিঙ্গাকে সশরীর নিধন করা হয়নি; বরং এক ক্ষুদ্রাংশকে হত্যা করা হয়েছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র পুরো ঘটনাকে রোহিঙ্গা জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। হলোকাস্টের বাইরে এটা হলো যুক্তরাষ্ট্র-স্বীকৃত অষ্টম জেনোসাইড। এ জন্য মিয়ানমারকে আইসিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে গাম্বিয়া আরও কয়েকটি দেশের সমর্থনে।

ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সমষ্টিগতভাবে কোনো জনগোষ্ঠীর নিজ অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার সামর্থ্যকে ধ্বংস করে দেয়, এমন যেকোনো পদক্ষেপই হলো জেনোসাইড, এ জন্য ওই জনগোষ্ঠীর পূর্ণাঙ্গ নিধন জরুরি নয়। তাঁরা এ-ও বলেছেন যে গাজায় প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, ১ লাখের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে কতজন চাপা পড়েছেন, তার সঠিক তথ্য কখনোই জানা যাবে না। আর আক্রান্ত মানুষের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক।

জাতিসংঘের হিসাবে গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং মানবেতর জীবন যাপন করছেন, যা মৃত্যুহার বাড়িয়েছে। গাজায় শিশুহত্যা, ক্ষুধা, স্বাস্থ্য পরিষেবাসহ অবকাঠামো ধ্বংস করা, বেশির ভাগ ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, জাবালিয়া ও রাফাহর মতো শহর ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া, উত্তর দিকের উপত্যকায় জাতিগত নিধন, গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেশির ভাগ মসজিদ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া, সরকারি অবকাঠামোসহ স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন ও পানি সরবরাহের অবকাঠামোর বিনাশ সাধন এবং অগণিত গণকবর—এ সবকিছুই জেনোসাইডের পরিষ্কার একটি ছবি তুলে ধরে বলে মন্তব্য করেছেন ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ। তাঁদের মতে, একটি মানবিক ও জাতি-সমষ্টির সত্তা হিসেবে গাজার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আর জেনোসাইড ঠিক এ রকমই হয়।

গাজায় জেনোসাইড ঘটানো হয়েছে উল্লেখ করে ইসরায়েলের এই দুই ইতিহাসবিদ অনেকটা আত্মসমালোচনার মতো করে বলেন, ‘আমাদের ইসরায়েলিদের উচিত হবে নিজ আয়নায় নিজেদের দেখা, যেখানে আমরা এমন একটা সমাজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাব, যে সমাজ নিজের নাগরিকদের হামাসের খুনে আক্রমণ থেকে রক্ষা করেনি এবং অপহৃত হওয়া নিজের পুত্র ও কন্যাদের অবহেলা করেছে। পাশাপাশি গাজায় এসব কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই জেনোসাইড ইহুদিদের ইতিহাসে এখন থেকে চিরকাল একটি কালো দাগ হয়ে থাকবে। আমাদের এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে এবং আমরা যে ভয়াবহতা সঞ্চারিত করেছি, তার গভীরতা বুঝতে হবে।’

ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গের নিবন্ধটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন অশউইৎজ বন্দিশিবির মু্ক্তির ৮০ বছর উদ্‌যাপিত হচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে পোল্যান্ডের অশউইৎজে স্থাপিত কুখ্যাত বন্দিশিবিরটি ১৯৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সোভিয়েত লালফৌজ মুক্ত করেছিল। এখানে লাখ লাখ ইহুদিকে ধরে এনে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল নাৎসিরা। সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে ব্লাটম্যান ও গোল্ডবার্গ তাঁদের লেখার উপসংহার টেনেছেন এভাবে; ‘গাজায় যা হচ্ছে, তা হলোকাস্ট নয়। এখানে কোনো অশউইৎজ নেই, নেই কোনো ত্রেবলিঙ্কা। তবে এটা সেই একই ধরনের অপরাধ—জেনোসাইডের অপরাধ’।

আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ জ য় ইসর য় ল ইসর য় ল র জনগ ষ ঠ র কনভ নশন জ ত গত ন ত হয় ছ ন র ব ষয়ট র অপর ধ অবক ঠ ম গণহত য কর ছ ল র জন য ত কর ছ ক ত কর কর ছ ন আইস জ

এছাড়াও পড়ুন:

২ মে ঢাকায় এনসিপির বিক্ষোভ, প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ৭ অপরাধ

‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে’ আগামী ২ মে (শুক্রবার) রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করবে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাজধানীর গুলিস্তানে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে এনসিপির ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে এই সমাবেশ হবে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে গঠিত দল এনসিপি।

সমাবেশ উপলক্ষে তৈরি করা প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলের সাতটি অপরাধের কথা উল্লেখ করেছে এনসিপি। এগুলো হলো ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ দমনের নামে ৫৭ সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড; গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহরণ; ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ; ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চালানো হত্যাযজ্ঞ; লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার; ২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলনে চালানো হত্যাকাণ্ড এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় চালানো নজিরবিহীন গণহত্যা।

এরপর চারটি দাবিও উল্লেখ করা হয়েছে প্রচারপত্রে। এগুলো হলো প্রতিটি অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন গঠন করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচারের ব্যবস্থা; আগামী নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ প্রশ্নের মীমাংসা তথা আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল; বিচার চলাকালে আওয়ামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার ও তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা।

দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, সমাবেশে প্রায় ২০ হাজার মানুষের জমায়েত হতে পারে। এই সমাবেশে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

দলগতভাবে আওয়ামী লীগের বিচার, দলটির নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে গত ২১ এপ্রিল থেকে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মশালমিছিল করছে এনসিপি। এর ধারাবাহিকতায় এবার কিছুটা বড় পরিসরে ঢাকা মহানগর শাখার ব্যানারে সমাবেশ হতে যাচ্ছে।

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগরের থানা পর্যায়ে কিছুদিন ধরে এনসিপির যে কর্মসূচিগুলো হচ্ছে, এগুলোরই চূড়ান্ত সমাবেশটা হবে আগামী ২ মে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৫১ ফিলিস্তিনি নিহত
  • রাজধানীতে পরপর তিন দিনে তিন জনসমাবেশ
  • বিশ্বনেতাদের সতর্ক দৃষ্টির সামনেই ঘটছে গণহত্যা
  • ইসলামবিরোধী প্রস্তাবনা রুখে দেওয়া হবে: মামুনুল হক
  • ২ মে ঢাকায় এনসিপির বিক্ষোভ, প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ৭ অপরাধ
  • শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে মামলা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ মির্জা ফখরুলের
  • ‘বিশ্বের নজরদারির মধ্যেই ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল’
  • রাখাইনে করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ হেফাজতের
  • ইয়েমেনে মার্কিন হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ আখ্যা দিয়ে নিন্দা ইরানের
  • নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি