Samakal:
2025-05-01@04:37:10 GMT

লভ্যাংশ আয়ে ফের করারোপ কেন

Published: 21st, March 2025 GMT

লভ্যাংশ আয়ে ফের করারোপ কেন

কর-রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য সব সময়ই একটা বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। ফি বছর সরকারের বিশাল বাজেট অর্থায়নে কর আদায়ের বাড়তি চাপ তো থাকেই, তার ওপর উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলো থেকে বাজেট ও প্রকল্প অর্থায়ন সহায়তা পেতে সরকারকে কর আদায় বাড়ানোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এ শর্ত বাস্তবায়নে চাপ ও দায় কার্যত পড়ে এনবিআরের ঘাড়ে।
এ ছাড়া অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় কর-জিডিপি অনুপাত এবং প্রত্যক্ষ কর আদায় বিশ্বের সর্বনিম্নে বাংলাদেশ। যদিও যে জিডিপি বিবেচনায় কর আদায় কম বলা হয়, সেই জিডিপি যে বিগত সরকারের সময়ের ত্রুটিপূর্ণ পরিসংখ্যানের ওপর গড়া, তা কেউ বিবেচনায় নেয় না।
সরকার, উন্নয়ন সহযোগী বা গবেষণা সংস্থাগুলো যখন বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে চাপ বাড়ায় এনবিআরের ওপর, তেমনি এনবিআরও সেই চাপ যারা কর দেন, সেই করদাতাদের ওপর চাপিয়ে দেয়।
বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ সামলাতে গিয়ে নতুন বা উদ্ভাবনী পথে না গিয়ে সব সময় প্রথাগত রাস্তায় হাঁটে এনবিআর। সংস্থাটির বিরুদ্ধে এ অভিযোগ বহু পুরোনো। যারা কর দেয়, তাদের করের ওপর দ্বৈত করও আদায় করছে, কখনও একই আয়ে তিনবারও কর নিচ্ছে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ লভ্যাংশ আয়ে কর কর্তন।

লভ্যাংশ আয়ে কর
কোনো কোম্পানি যখন শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ প্রদান করে, তখন ওই লভ্যাংশের ওপর বর্তমানে ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হয়। শেয়ারহোল্ডারের যদি করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন কোম্পানির কাছে থাকে, তাহলে লভ্যাংশ বিতরণের সময় উৎসে ১০ শতাংশ কর কর্তন করে এনবিআরকে দেওয়ার নির্দেশ আছে। যদি টিআইএন নম্বর না থাকে, তাহলে উৎসে কর কর্তন করা হয় ১৫ শতাংশ।
শেয়ারহোল্ডারদের করপোরেট বা কোনো প্রতিষ্ঠান হলে সে ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ কর্তন করা হয়। এর পর ব্যক্তি যখন আয়বর্ষ শেষে আয়কর রিটার্ন জমা দেন, তখন মোট আয় বেশি হলে প্রযোজ্য হারে উচ্চ করও দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন অর্থ সমন্বয়ের সুযোগ আছে।
কিন্তু এই যে ব্যক্তির লভ্যাংশ আয়ের ওপর কর কর্তন করা হয়েছে, তা তার বিনিয়োগ করা কোম্পানির কর-পরবর্তী আয় থেকে পাওয়া। অর্থাৎ শেয়ারহোল্ডারের কোম্পানি যে আয়ের ওপর সরকারকে কর দিয়েছে, সেই টাকার ওপর ফের কর বসানো হচ্ছে। এখন শেয়ারহোল্ডার কোম্পানি না হয়ে প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি হলে, তাকেও এটাকে আয় ধরে কর দিতে হবে। আবার এই প্রতিষ্ঠান যখন এর ব্যক্তিমালিককে লভ্যাংশ আকারে কর দিতে যায়, তখনও কর দিতে হয়। এভাবে করের চক্রের চাপে পড়েন বিনিয়োগকারী।
এই কর চাপের কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ছাড়া বেসরকারি খাতের অতালিকাভুক্ত লাখ লাখ কোম্পানির কোনোটিই শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ বিতরণ করে না। মালিকরা নানা প্রক্রিয়ায় কোম্পানির পদে থেকে বেতন-ভাতাসহ নানা খাত বের করে প্রয়োজনীয় অর্থ বের করে নেয়।

একই আয়ে দ্বৈত কর
লভ্যাংশ আয়ে কর কর্তন প্রথা দ্বৈত কর ছাড়া আর কিছুই নয়। অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্য দেশেও এ ধরনের কর আদায় হয়। তবে তা সহনীয় পর্যায়ে। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য এ ধরনের আয়ে কর ধার্য না করার বা কম হারে কর ধার্য করার বহু উদাহরণও আছে বহু দেশে।
প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশে লভ্যাংশ আয়ে কর মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে লভ্যাংশ আয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে কোনো কর নেই, কারণ কোম্পানির পর্যায়ে ইতোমধ্যে কর প্রদান করা হয়েছে। এসব দেশের শেয়ারবাজারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ হয়। সেই বিনিয়োগে কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বাড়ে, সরকারও বেশি রাজস্ব পায়। বাংলাদেশে এর উল্টো।
আবার পাকিস্তানে লভ্যাংশ আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর আদায় করা হয়। এটাই এ আয়ে চূড়ান্ত কর। অর্থাৎ পরে শেয়ারহোল্ডারের অন্যান্য আয়ের সঙ্গে এই আয়কে একীভূত করে প্রযোজ্য হারে কর আদায় করা হয় না। নেপালে লভ্যাংশ আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, যা চূড়ান্ত কর হিসেবে গণ্য হয়। ভুটানে লভ্যাংশ আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। ২০২০ সালের আগে, ভারতে কোম্পানি লভ্যাংশ বিতরণ করার সময় ‘ডিভিডেন্ড ডিস্ট্রিবিউশন ট্যাক্স’ প্রদান করত, যা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য করমুক্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে লভ্যাংশ আয়কে ‘কোয়ালিফায়েড’ ও ‘নন-কোয়ালিফায়েড’ দুই ভাগে ভাগ করা হয় এবং করহার ০ শতাংশ, ১৫ শতাংশ বা ২০ শতাংশ হতে পারে। যুক্তরাজ্যে ব্যক্তির কর ক্যাটেগরির ওপর নির্ভর করে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপ করা হয়।

দ্বৈত করে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত
বাংলাদেশে কর-পরবর্তী মুনাফা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের দেওয়া লভ্যাংশের ওপর ফের কর আরোপ করা হয়। এর ফলে একই আয়ের ওপর দু’বার কর পরিশোধ করতে হয়– একবার কোম্পানির লাভের ওপর এবং পরবর্তী সময়ে শেয়ারহোল্ডারের লভ্যাংশ আয়ের ওপর। এতে বিনিয়োগকারীদের মোট লভ্যাংশ আয়ের প্রকৃত পরিমাণ কমে যায় এবং বাজারে বিনিয়োগের আগ্রহ হ্রাস পায়।

বাজেট বক্তৃতায় প্রতিশ্রুতি, বাস্তবায়ন নেই
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় দ্বৈত কর পরিহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি তা বাস্তবায়ন করেননি, এনবিআরও সে পথে কখনও হাঁটেনি। অতিরিক্ত কর আরোপ করা হলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে যেতে পারে, যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্মকাণ্ড শ্লথ হয় এবং সরকার সম্ভাব্য কর রাজস্ব হারায়।

দ্বৈত কর পরিহার কেন গুরুত্বপূর্ণ
দ্বৈত করের বোঝা থাকলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হন। এটি বাজারের গভীরতা বাড়ানোর জন্য একটি বাধা।
এ ছাড়া কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়লে সরকার বেশি কর রাজস্ব পেতে পারে, যা দ্বৈত কর তুলে দিলে আরও বেশি সহায়ক হবে। শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করতে হলে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। লভ্যাংশ করহীন হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। 
আবার বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনও তুলনামূলক ছোট এবং অর্থনীতিতে পুঁজি সরবরাহের প্রধান উৎস হয়ে ওঠেনি। বড় ও সমৃদ্ধিশালী অর্থনীতি গড়ার ক্ষেত্রে যা বড় প্রতিবন্ধক, এটা সরকারও স্বীকার করছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের জন্য উৎসাহমূলক করনীতি ও প্রণোদনা দরকার। সবার আগে দরকার দ্বৈত করনীতি পরিহার করা।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনও উন্নয়নশীল পর্যায়ে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং বাজারের গভীরতা বাড়াতে হলে দ্বৈত কর পরিহার করা জরুরি। প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশের তুলনায় করনীতি আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। সরকারের উচিত শেয়ারবাজার উন্নয়নে কার্যকর নীতি গ্রহণ করা, যাতে বিনিয়োগকারীরা নির্ভয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আয়কর শ য় রব জ র দ ব ত কর পর হ র পর য য় র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ