মহানবী (সা.)–এর জীবনী লেখার জটিলতা ও সম্ভাবনা
Published: 17th, September 2025 GMT
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী ইসলামের ইতিহাসে একটি অমূল্য সম্পদ। তাঁর জীবন শুধু মুসলিমদের জন্য নয়; বরং পুরো মানবজাতির জন্য নৈতিকতা, ন্যায়বিচার ও আধ্যাত্মিকতার এক আলোকবর্তিকা।
কিন্তু তাঁর জীবনী রচনা করা একটি জটিল কাজ। ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যতা যাচাই, বিভিন্ন সূত্রের জটিলতা ও তাঁর সময়ের প্রেক্ষাপট বোঝা—সব মিলিয়ে কম চ্যালেঞ্জিং নয়।
ইদানীং বাংলা ভাষায় মহানবীর (সা.
মহানবী (সা.)–এর জীবনী লেখার জন্য প্রধান দুটি সূত্র হলো পবিত্র কোরআন ও হাদিস। কোরআন মুসলিমদের কাছে আসমানি গ্রন্থ, যা মহানবী (সা.)–এর কাছে অবতীর্ণ হয়েছিল। কোরআন নবীজির শিক্ষা, চিন্তাধারা ও আধ্যাত্মিক বার্তার মূল উৎস।
তবে কোরআনে ঐতিহাসিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ খুব কম। যেমন বদরের যুদ্ধের কথা উল্লেখ আছে, ‘আল্লাহ তোমাদের বদরে সাহায্য করেছিলেন, যখন তোমরা ছিলে দুর্বল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৩)
কিন্তু এখানে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ নেই। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৩০৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
হাদিস হলো মহানবী (সা.)–এর কথা, কাজ ও সম্মতির বর্ণনা, যা তাঁর সাহাবিরা সংরক্ষণ করেছেন। ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ ও ইবনে হিশামের সম্পাদিত সিরাতুন নবী তাঁর জীবনের বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করেছে।
তবে হাদিসের সঙ্গে থাকে ‘ইসনাদ’, অর্থাৎ বর্ণনাকারীদের পরম্পরা, যা প্রথম সাক্ষী থেকে শুরু হয়ে লিখিত রূপে পৌঁছায়। কিন্তু মৌলিক জীবনী গ্রন্থগুলোর মধ্যে অনুরূপ পরম্পরা রাখা হয়নি। অথচ মুসলিম পণ্ডিতেরা এই ইসনাদ ব্যবহার করে হাদিসের সত্যতা যাচাই করতেন।
যেমন মালিক ইবনে আনাস (মৃ. ১৭৯ হি./৭৯৫ খ্রি.) বলতেন, শুধু ধার্মিক ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের বর্ণনা গ্রহণ করা উচিত। (ইয়াসিন ডাটন, দ্য অরিজিন্স অব ইসলামিক ল, পৃ. ১৭, রিচমন্ড: কার্জন প্রেস, ১৯৯৯)
আবার হাদিসের ওপর নির্ভর করলেও হাদিসের দ্বৈত বা একাধিক বর্ণনার সমন্বয় না করে প্রশ্ন তোলা হয়ে থাকে। অনেক হাদিস পরবর্তী সময়ে ধর্মীয়, আইনি বা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ রচিত হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়, বিশেষ করে প্রাচ্যবিদদের তরফ থেকে।
যেমন, গোল্ডজিহার লিখেছেন, একটি হাদিসে বলা হয়, অন্যায়কারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা উচিত। আবার আরেকটিতে বলা হয়, তা করা উচিত নয়। বিশুদ্ধতার প্রশ্নে কোনোটিকে কম মর্যাদা দেওয়া যায় না। (ইগনাজ গোল্ডজিহার, মুহাম্মেদানিশে স্টুডিয়েন, ২/৫, হালে, ১৯৯০)
এ দ্বন্দ্ব জীবনী রচনার কাজকে জটিল করে তোলে।
আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০পশ্চিমা সূত্রের সংকটমহানবী (সা.) জীবনী লেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সূত্রের সত্যতা নির্ধারণ। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা লেখকদের যুক্তিকে সামনে রাখলে কিংবা তাঁদের সূত্রকে প্রধান ধরলে বিভ্রান্তির আশঙ্কা বেশি।
যেমন পাশ্চাত্য পণ্ডিত ইগনাজ গোল্ডজিহার যুক্তি দেন যে অনেক হাদিস ইসলামের প্রথম দুই শতাব্দীতে বিভিন্ন বিতর্কের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ইতিহাস-আশ্রিত হাদিসগুলো ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের পরিবর্তে পরবর্তী সময়ের ধর্মীয় ও সামাজিক চাহিদার প্রতিফলন ঘটেছে বেশি। (গোল্ডজিহার, মুহাম্মেদানিশে স্টুডিয়েন, খণ্ড ২, পৃ. ৫, হালে, ১৯৯০)
কোরআনে বিস্তারিত বর্ণনা নেই বলেই তো হাদিসের দ্বারস্থ হতে হয়। তা ছাড়া প্রথম দিকের ‘সিরাত’ বা মহানবী (সা.)-এর জীবনী রচনাগুলো হাদিস সংকলনের সময়েই রচিত হয়েছে।অথচ ইগনাজের উল্লেখ করা অনেকগুলো পরবর্তী সময়ে ‘জাল’ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তা ছাড়া প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনলেও হাদিসগুলোর সঠিক মর্ম অনুধাবন করা সম্ভব।
আবার হেনরি ল্যামেন্স মনে করেন, কোরআনের আয়াত থেকে গল্প তৈরি করে জীবনী রচনা করা হয়েছে। যেমন কোরআনের সুরা কুরাইশে (আয়াত: ১-২) ‘কুরাইশের ইলাফ’ উল্লেখ আছে, কিন্তু এর অর্থ স্পষ্ট নয়। পরবর্তী ব্যাখ্যাকারীরা এটিকে মক্কার তীর্থযাত্রা বা বাণিজ্যিক ভ্রমণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা তাঁদের অনুমান ছিল। (ল্যামেন্স, কোরআন অ্যাট ট্র্যাডিশন, পৃ. ২৭, রিসার্চেস দ্য সায়েন্স রিলিজিয়াস, ১৯১০)
অথচ ‘ইলাফ’–এর ব্যাখ্যা নির্ভরযোগ্য তাফসিরে ভ্রমণ নয়; বরং ‘অভ্যাস’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্যাট্রিসিয়া ক্রোন বলেন, অনেক ঐতিহাসিক তথ্য কোরআনের ব্যাখ্যা থেকে এসেছে, যা মূল ঘটনার সঠিক চিত্র না–ও দিতে পারে। (ক্রোন, মক্কান ট্রেড অ্যান্ড দ্য রাইজ অব ইসলাম, পৃ. ২১৪, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭)
কিন্তু জোসেফ শাখট এ ধারণাকে ‘অযৌক্তিক অনুমান’ বলে সমালোচনা করেন। কারণ, তাঁর মতে, হাদিসের বেশির ভাগ তথ্য আইনি বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে তৈরি। (শাখট, অরিজিন্স অব মুহাম্মদান জুরিসপ্রুডেন্স, পৃ. ১৪৯, অক্সফোর্ড, ১৯৪৯)।
এ দ্বন্দ্ব জীবনী রচনাকারীদের জন্য একটি বড় প্রশ্ন তৈরি করে—সত্যকে কীভাবে কল্পনা থেকে আলাদা করা যায়?
কথা হলো, কোরআনে বিস্তারিত বর্ণনা নেই বলেই তো হাদিসের দ্বারস্থ হতে হয়। তা ছাড়া প্রথম দিকের ‘সিরাত’ বা মহানবী (সা.)-এর জীবনী রচনাগুলো হাদিস সংকলনের সময়েই রচিত হয়েছে। ওসমান ইবনে আবান, ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার (রহ.) মতো রচয়িতাদের অনেকে হাদিস বর্ণনাকারীও ছিলেন।
সুতরাং শুধু কোরআন ও হাদিস নয়, মহানবী (সা.)-এর জীবনী রচনায় প্রাথমিক সিরাত গ্রন্থগুলোকেও উৎস ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরুরি হলো পশ্চিমা সূত্রগুলোর চেয়ে বেশি প্রথম দিকে রচিত সিরাত গ্রন্থগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো হাদিস ও সিরাত সাহিত্যের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য। প্রাথমিক ইসলামি ঐতিহ্যে এই গ্রন্থগুলো শুধু ঐতিহাসিক দলিল নয়; বরং মুসলিম সম্প্রদায়ের পরিচয় ও ধর্মীয় চেতনার অংশ। এগুলো নৈতিক শিক্ষা, সম্প্রদায়ের ঐক্য ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার জন্য রচিত হয়েছিল। ফলে এগুলোর ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাইয়ের সময় তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভূমিকাও বিবেচনা করতে হয়।
সমাধানের পথপ্রাথমিক মুসলিম পণ্ডিতেরা এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, যা আধুনিক গবেষণায়ও গ্রহণ করা হয়।
মুসলিম পণ্ডিতেরা বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা পরীক্ষা করতেন। তাঁরা বর্ণনাকারীদের জীবনী সংকলন করতেন, যেখানে তাঁদের জীবনকাল, শিক্ষক, ছাত্র ও নির্ভুলতার তথ্য থাকত।ইসনাদ যাচাই: মুসলিম পণ্ডিতেরা বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা পরীক্ষা করতেন। তাঁরা বর্ণনাকারীদের জীবনী সংকলন করতেন, যেখানে তাঁদের জীবনকাল, শিক্ষক, ছাত্র ও নির্ভুলতার তথ্য থাকত। উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক পণ্ডিত হারাল্ড মোৎস্কি আবদুর রাজ্জাক আল-সানআনির (মৃ. ২১১ হি./৮২৬ খ্রি.) হাদিস সংকলন বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, অনেক হাদিস ইবনে জুরাইজ (মৃ. ১৫০ হি./৭৬৭ খ্রি.) এবং আতা ইবনে আবি রাবাহ (মৃ. ১১৫ হি./৭৩৩ খ্রি.)-এর মতো পূর্ববর্তী পণ্ডিতদের কাছ থেকে এসেছে। (মোৎস্কি, দ্য মুসান্নাফ অব আবদ আল-রাজ্জাক, পৃ. ১, জার্নাল অব নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজ, ১৯৯১)
তবে ইসনাদ জাল করার আশঙ্কাও যেহেতু ছিল এবং দীর্ঘ পরম্পরা থাকার ফলে বর্ণনার মূল অর্থও পরিবর্তিত হতে পারে। ফলে তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে।
বিভিন্ন সংস্করণ সংগ্রহ: মুসলিম পণ্ডিতেরা একই হাদিসের বিভিন্ন সংস্করণ সংগ্রহ করতেন এবং সেগুলো একসঙ্গে উপস্থাপন করতেন—কোনটি সঠিক তা নির্ধারণ না করেই। ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ ইবনে জারির আল-তাবারি তাঁর তারিখ আল-রুসুল ওয়াল মুলুক–এ বলেন, তিনি কেবল স্পষ্টভাবে চিহ্নিত বর্ণনার ওপর নির্ভর করেছেন এবং নিজের মতামত প্রয়োগ করেননি। (হামফ্রিস, ইসলামিক হিস্ট্রি, পৃ. ৭৩, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯১)
আধুনিক পণ্ডিত গ্রেগর শোলার এ পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রথম ওহি ও “ইফক”–এর হাদিসের বিভিন্ন সংস্করণ তুলনা করে সেগুলোর রূপান্তরপ্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেছেন। (শোলার, ক্যারাকটার উন্ড অথেন্টি, পৃ. ১৫, ১৯৯৬)
ঐতিহ্যের বৈচিত্র্য স্বীকার: হাদিস, সিরাত, মাগাজি ও কিসাসের মতো বিভিন্ন ধরনের উৎস বিভিন্ন উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। কিন্তু সে–সময় ইবনে ইসহাকের মতো ঐতিহাসিকেরা ঘটনার কালানুক্রমিক বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কাহিনিকার (কুসসাস) ও ওয়ায়েজগণ (প্রচারক) নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতেন।
এ বৈচিত্র্য বোঝা জীবনী রচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, মাগাজি সাহিত্য মহানবী (সা.)–এর সামরিক অভিযানের বিবরণ দেয়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের পাশাপাশি সম্প্রদায়ের বীরত্বের গল্প হিসেবে কাজ করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/১০০, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)
নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, যেমন তায়মা ও হেগরার খননকাজ দেখায় যে সেকালেই হিজাজ ছিল সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ।আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫আধুনিক ডিজিটাল টুল: আধুনিক গবেষণায় ডিজিটাল টুল ব্যবহার করে হাদিসের বিশ্লেষণ একটি নতুন সমাধান। যেমন ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ প্রকল্পে ইসনাদ বিশ্লেষণের জন্য ডেটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে, যা বর্ণনাকারীদের শৃঙ্খলের ধরন শনাক্ত করে। এটি হাদিসের প্রাথমিক স্তর চিহ্নিত করতে সাহায্য করছে। লাইডেন ইউনিভার্সিটির প্রকল্পে হাদিসের টেক্সট মাইনিং করে সাধারণ বর্ণনাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে, যা ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
মহানবীর সময়ের প্রেক্ষাপটমহানবী (সা.)–এর জীবনীকে তাঁর সময়ের প্রেক্ষাপটে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, নবীজি যখন ছিলেন, তখন ছিল সপ্তম শতকের হিজাজ, যখন এই অঞ্চল বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিকভাবে যুক্ত ছিল বাইজান্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে। কোরআনে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে, ‘তুমি দেখবে যে ইমানদারদের সবচেয়ে নিকটবর্তী হলো তারা, যারা বলে, “আমরা খ্রিষ্টান।”’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৮২)
এ ছাড়া সুরা ফিলে (আয়াত: ১ থেকে ৫) ইয়েমেন থেকে এসে মক্কায় হাতি বাহিনী নিয়ে আক্রমণের কথা বলা হয়েছে যা দক্ষিণ আরবের সঙ্গে হিজাজের সম্পর্ক নির্দেশ করে। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৭৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)।
প্যাট্রিসিয়া ক্রোন ও মাইকেল কুকের মতো কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন, ইসলামের উৎপত্তি হয়েছে হিজাজের বাইরে, ফার্টাইল ক্রিসেন্টে। কারণ, হিজাজ ছিল তখন খুবই প্রত্যন্ত অঞ্চল, যা একটি বিশ্বধর্মের জন্ম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। (ক্রোন ও কুক, হাগারিজম, পৃ. ৩, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৭)
তবে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালে উন্মোচিত প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রের কারণে আর গ্রহণযোগ্য থাকেনি। নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, যেমন তায়মা ও হেগরার খননকাজ দেখায় যে সেকালেই হিজাজ ছিল সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ।
দক্ষিণ আরবের শিলালিপিতে কোরআনের মতো শব্দ, যেমন ‘আল্লাহর কন্যা’ (সুরা নাজম, আয়াত: ১৯-২০), পাওয়া গেছে, যা হিজাজের সাংস্কৃতিক সংযোগ নির্দেশ করে। (রিকম্যানস, লেস ইনস্ক্রিপশন সুদ-আরাবেস, পৃ. ৪৪৩, আনালি ডেল ইস্টিটুটো ওরিয়েন্টালে ডি নাপোলি, ১৯৭৫)
মক্কার ইহুদি পণ্ডিতেরা মহানবী (সা.)–এর জন্মের সময় তাঁর নবুয়তের মোহর দেখে তাঁর আগমন নিশ্চিত করেছিলেন।ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহহিজাজের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মহানবী (সা.)–এর জীবনী বোঝার জন্য স্থানীয় আরব ঐতিহ্যের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। মক্কার কুরাইশ গোত্রের মধ্যে কাবার তত্ত্বাবধান ও হজের আয়োজন একটি ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে হিজাজের গুরুত্ব তুলে ধরে। এ প্রেক্ষাপট মহানবী (সা.)–এর বার্তার গ্রহণযোগ্যতা ও প্রতিরোধের কারণ বোঝাতে সাহায্য করে। (আবু নু’আইম, দালাইলুন নুবুওয়া, ১/৮০, দারুন নাফাইস, বৈরুত, ১৯৮৬)
ভবিষ্যৎ গবেষণার সম্ভাবনামহানবীর জীবনী নিয়ে গবেষণার জন্য এখনো বেশ কিছু সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার: সৌদি পণ্ডিতদের নাবাতিয়ান লিপি থেকে আরবি লিপির রূপান্তর নিয়ে গবেষণা হিজাজের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সাহায্য করছে। তায়মা ও হেগরার খননকাজ মহানবী (সা.)–এর সময়ের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি উন্মোচন করছে।
তুলনামূলক ধর্মীয় গবেষণা: টমাস সিজগোরিচ দেখিয়েছেন যে প্রাথমিক মুসলিমরা ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাধারণ প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেছেন। (সিজগোরিচ, পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট, পৃ. ১৫, ২০০৪)
কোরআনের সুরা আরাফে (আয়াত: ১৫৭) তাওরাত ও ইঞ্জিলে মহানবী (সা.)-এর উল্লেখের কথা বলা হয়েছে, যা তুলনামূলক গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
আধুনিক ডিজিটাল বিশ্লেষণ: ডিজিটাল টুলের মাধ্যমে হাদিসের ইসনাদ ও বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। যেমন মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে হাদিসের সাধারণ বর্ণনাকারীদের শনাক্ত করা যায়, যা তাদের প্রাথমিক স্তর নির্ধারণে সাহায্য করে। এটি আধুনিক গবেষণার একটি উদ্ভাবনী দিক।
মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে হাদিসের সাধারণ বর্ণনাকারীদের শনাক্ত করা যায়, যা তাদের প্রাথমিক স্তর নির্ধারণে সাহায্য করে। এটি আধুনিক গবেষণার একটি উদ্ভাবনী দিক।ইহুদি ও খ্রিষ্টান পূর্বাভাস: মহানবীর জীবনী রচনায় ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের পূর্বাভাসের ভূমিকাও বিবেচনা করা যায়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা সেই রাসুলের অনুসরণ করে, সেই উম্মি নবী, যাঁর বর্ণনা তারা তাদের তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৫৭)
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, মক্কার ইহুদি পণ্ডিতেরা মহানবী (সা.)–এর জন্মের সময় তাঁর নবুয়তের মোহর দেখে তাঁর আগমন নিশ্চিত করেছিলেন। (ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৭০, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)
এ পূর্বাভাস তাঁর জীবনীর সর্বজনীন তাৎপর্য তুলে ধরে।
সারকথামহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী রচনা একটি জটিল, কিন্তু সম্মানজনক কাজ। প্রাথমিক মুসলিম পণ্ডিতদের ইসনাদ যাচাই, বিভিন্ন সংস্করণ সংগ্রহ ও ঐতিহ্যের বৈচিত্র্য স্বীকারের পদ্ধতি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করে।
তাঁর সময়ের হিজাজের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার এবং আধুনিক ডিজিটাল টুল তাঁর জীবনীকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝার পথ দেখায়। এই জীবনী শুধু ইতিহাস নয়; বরং মানবজাতির জন্য একটি আধ্যাত্মিক যাত্রার সূচনা, যা পাঠকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
আরও পড়ুনমহানবীর (সা.) বিশদ জীবনী১১ মে ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ভ ন ন স স করণ ন র ভরয গ য ইউন ভ র স ট ব যবহ র কর স হ য য কর গ রহণ কর দ র জ বন কর ছ ল ন ম হ ম মদ ক রআন র ইসল ম র প রথম দ পরবর ত কর ছ ন গ রন থ র জন য উল ল খ করত ন র সময ইসন দ ইসহ ক ঘটন র স কলন রচন র
এছাড়াও পড়ুন:
আফ্রিদির অলরাউন্ড নৈপুণ্যে আমিরাতকে হারিয়ে সুপার ফোরে পাকিস্তান
বিকেলে ছিল ম্যাচ হবে কি না অনিশ্চয়তা। নানা নাটকীয়তার পর অনিশ্চয়তা কেটে ম্যাচ শুরু হলো এক ঘণ্টা দেরিতে। তবে বিলম্বিত ম্যাচে আর খুব বেশি অনিশ্চয়তা–নাটকীয়তার দেখা মিলল না। দুবাইয়ে ফেবারিট হিসেবে মাঠে নেমে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ৪১ রানে হারিয়েছে পাকিস্তান।
এই জয়ে এশিয়া কাপের সুপার ফোরে জায়গা করেছে সালমান আগার দল। ‘এ’ গ্রুপ থেকে সেরা চারে জায়গা করেছে ভারতও। যার অর্থ, ২১ সেপ্টেম্বর আবারও মুখোমুখি হতে চলেছে ভারত–পাকিস্তান।
গতকাল দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাকিস্তান–আরব আমিরাত ম্যাচ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল ১৪ সেপ্টেম্বরের ভারত–পাকিস্তান গ্রুপ ম্যাচের ঘটনার জেরে। সেদিন ভারতের খেলোয়াড়েরা পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ম্যাচের শুরু ও শেষে হাত না মেলানোয় ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)।
পাইক্রফট টসের সময় অধিনায়ককে হাত না মেলানোর পরামর্শ দিয়ে নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন অভিযোগ তুলে তাঁর অপসারণ চেয়ে রীতিমতো এশিয়া কাপ বর্জনের আবহ তৈরি করে পিসিবি।
শেষ পর্যন্ত পাইক্রফটের ক্ষমা প্রার্থনায় গতকাল তাঁর পরিচালনায় আরব আমিরাতের বিপক্ষে মাঠে নামে পাকিস্তান। তবে খেলতে নামার সিদ্ধান্ত নিতে আলোচনার জন্য এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয় ম্যাচ শুরুর সময়।
আরও পড়ুনপাকিস্তান অধিনায়কের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ম্যাচ রেফারি পাইক্রফট, দাবি পিসিবির৬ ঘণ্টা আগেদেরিতে শুরু হওয়া ম্যাচে আমিরাত অধিনায়ক টসে জিতে পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠান। ফখর জামানের ৩৬ বলে ৫০ আর শেষ দিকে শাহিন আফ্রিদির ১৪ বলে ২৯ রানের অপরাজিত ইনিংসে ভর করে পাকিস্তান করে ২০ ওভারে ৯ উইকেটে ১৪৬। মূলত আফ্রিদির শেষ দিকের ঝোড়ো ব্যাটিংই পাকিস্তানের রান দেড় শর কাছাকাছি নিয়ে যায়।
নানা নাটকীয়তার পর অ্যান্ডি পাইক্রফটই পাকিস্তান–আমিরাত ম্যাচে রেফারির দায়িত্বে ছিলেন