বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি এবং দেশটিতে রপ্তানির পরিমাণ বিবেচনায় এনে এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর মানে হলো, যুক্তরাষ্ট্র যে শুল্ক আরোপ করেছে, তা কমাতে হলে বাংলাদেশের আমদানি বাড়াতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় কম। তবে রপ্তানি হয় বেশি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি। বাংলাদেশ বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি যদি কমে তাহলে সামনে বাংলাদেশের ওপর শুল্ক–কর কমতে পারে। আবার বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেলে শুল্কহার আরও বাড়তে পারে। অবশ্য ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র এই পর্যালোচনা করবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট করেনি দেশটি।

মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য। বিপরীতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। এই হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ৬১৫ কোটি ডলার।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাণিজ্য ঘাটতিকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে যা পাওয়া যায়, তার শতাংশ ধরে ট্যারিফ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর হার হয় ৭৪ শতাংশ। এর অর্ধেক বা ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বাংলাদেশের পণ্যে।

বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে কী কী আসে, কীভাবে আমদানি বাড়ানো যাবে, তাই এখন আলোচনার বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে যা যা আসে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যভান্ডারে দেখা যায়, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৯১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল রয়েছে ২৯ কোটি ডলার। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের পণ্য রয়েছে ২৬২ কোটি ডলারের।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাবের সঙ্গে এনবিআরের হিসাবের পার্থক্যের কারণ সময়ের ব্যবধান। এনবিআর পণ্য খালাসের পর হিসাব করে, যুক্তরাষ্ট্র পণ্য রপ্তানির সময় হিসাব করে। আরেকটি হলো, তৃতীয় দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আসছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে দেখানো হয়নি।

এনবিআরের হিসাবে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য আমদানি হওয়া ২৬২ কোটি ডলারের পণ্যের মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানিতে কোনো শুল্ক–কর দিতে হয়নি। যেমন গম, তুলার মতো পণ্যে শুল্ক–কর নেই। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে গড়ে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শুল্ক–কর দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে কাস্টমস শুল্ক–কর আদায় করেছে ১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।

এবার দেখা যাক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোন পণ্য বেশি আসে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ হাজার ৫১৫টি এইচএসকোডের (পণ্যের শ্রেণি বিভাজন) পণ্য আমদানি হয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে আট ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে ৬৭ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি পণ্যের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে রড তৈরির কাঁচামাল—পুরোনো লোহার টুকরা বা স্ক্র্যাপ। গত অর্থবছরে পণ্যটি আমদানি হয় ৭৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া মোট পণ্যের প্রায় ২৭ শতাংশ। গড়ে ৪ শতাংশ শুল্কহার রয়েছে পুরোনো লোহার পণ্য আমদানিতে।

আমদানিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পণ্য হলো এলপিজির উপাদান বিউটেন। গত বছর এই পণ্য আমদানি হয়েছে ৩৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের। বাংলাদেশের শুল্কহার গড়ে ৫ শতাংশ।

তৃতীয় সর্বোচ্চ আমদানি পণ্য হলো সয়াবিন বীজ। সয়াবিন তেল ও প্রাণিখাদ্য তৈরির এই কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ৩২ কোটি ডলারের। এই পণ্য আমদানিতে শুল্ক–কর নেই।

চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল তুলা। এই পণ্য আমদানি হয়েছে ২৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের। এটিতেও শুল্ক–কর নেই।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির তালিকায় আরও রয়েছে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, হুইস্কি, গাড়ি, গম, উড পাল্প, পুরোনো জাহাজ, সয়াকেক, কাঠবাদাম ইত্যাদি।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া সর্বোচ্চ শুল্ক–কর আছে এমন পণ্যের মধ্যে রয়েছে হুইস্কি। হুইস্কিতে শুল্ক–কর ৬১১ শতাংশ। তবে আমদানি খুবই কম। গত বছর ২২৮ বোতল জ্যাক ডেনিয়েল হুইস্কি আমদানি হয়েছে দেশটি থেকে। এ ছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শুল্ক–করযুক্ত পণ্য হলো মার্সিডিজ বেঞ্চ। এই গাড়িতে শুল্ক–কর ৪৪৩ শতাংশ। গত বছর আমদানি হয়েছে চারটি গাড়ি।

আমদানি কীভাবে বাড়ানো সম্ভব

ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানিতে দুটি বিষয়ের ওপর জোর দেন। আমদানিতে খরচ কত এবং পণ্যের মান কেমন? তবে শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে কত কম সময়ে আনা যাবে, তা–ও গুরুত্ব দেন ব্যবসায়ীরা।

শুল্ক–করের হার সব দেশেই প্রায় একই। কিছু মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আওতায় (যেমন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা সাফটা) নির্ধারিত পণ্যে শুল্ক সুবিধা রয়েছে। এখন বেসরকারি আমদানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিতে উৎসাহ দিতে হলে শুল্ক–করে সুবিধা দিতে হবে। কারণ, খরচ কম পড়লে সেখান থেকে আমদানিতে উৎসাহিত হবেন ব্যবসায়ীরা।

আবার যেসব পণ্যে শুল্কহার নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রে বিকল্প ভাবতে হবে। যেমন এনবিআরের হিসাবে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ৪৪ শতাংশে কোনো শুল্ক–কর দিতে হয়নি। এই তালিকায় রয়েছে সয়াবিন বীজ, তুলা ইত্যাদি।

তবে আমদানিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সরকার। যেমন সরকার যেসব পণ্য আমদানি করে তার তালিকায় রয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, এয়ারক্রাফট ও যন্ত্রাংশ, অস্ত্র ইত্যাদি। গত বছর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ২১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ আমদানি করেছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করেছে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ডলারের।

আমদানি বাড়লে শুল্ক কত কমতে পারে

পোশাক খাতের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে হিসাব করেছে তাতে আমাদের আমদানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। সরকারি–বেসরকারি খাত মিলিয়ে যদি আমদানি বাড়াতে পারি, তাহলে দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসবে। যেমন এখন যা আমদানি তা যদি দ্বিগুণ করা যায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের হার ২৪–২৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তারা পর্যালোচনার ঘোষণা না দিলেও আমাদের প্রস্তুতি এখনই শুরু করে দেওয়া দরকার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি আমদানি বাড়িয়ে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হলে রপ্তানি খাত প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে পারবে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুল্ক–কর কমিয়ে কৃত্রিমভাবে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং দেশে মার্কিন বিনিয়োগ আনা হলে সহজভাবে আমদানি বাড়বে। কারণ, মার্কিন উদ্যোক্তারা নিজ দেশ থেকে বাংলাদেশে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানি করবেন।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুল্ক আরোপের পর সব দেশই নানামুখী নীতি নিচ্ছে। কেউ শূন্য শুল্কের পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কেউ পাল্টা শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বাইরে অন্য কোনো সুযোগ নেই। আমরা যেসব পণ্য রপ্তানি করি, তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রান্তিক মানুষের জন্য। আবার তাদের তুলা ব্যবহার করছি। বিষয়টি যদি আমরা যুক্তি দিয়ে দাঁড় করাতে পারি এবং যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনায় নেয়, তাহলে প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে বিশেষ প্রণোদনা দিতে পারে সরকার।

ট্রাম্পের সূত্র যুক্তিসংগত নয় উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ট্রাম্পের সূত্র ব্যবহার করলে বাংলাদেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে ৮৫ শতাংশ এবং চীন থেকে পণ্য আমদানিতে ৯৫ শতাংশ শুল্ক বসাতে পারবে। এভাবে হলে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা ভেঙে যাবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক কর ন র আমদ ন ব যবহ র গত বছর ব যবস সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে

অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।

শ্রমবাজারে দুর্বলতা

পাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।

পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।

মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।

ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।

রাজনৈতিক টানাপোড়েন

এ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।

পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’

বাজারের প্রতিক্রিয়া

সুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নীতিসুদ কী

কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।

কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাব

বিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।

নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।

সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ