ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের জবাবে কোন দেশ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে
Published: 8th, April 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। সর্ব ব্যাপক এই শুল্কের প্রভাব মোকাবিলায় সবাই কোমর বেঁধে নেমেছে। অনেক দেশ আবার আগে থেকেই ব্যবস্থা নিচ্ছে, যে কারণে তাদের ওপর শুল্কের খড়্গ অতটা মারাত্মক হয়নি। আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে তারা ইতিমধ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
ট্রাম্পের এই শুল্কযুদ্ধের মূল লক্ষ্য চীন। চীনের উত্থান ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক রকম মরিয়া। সেই সঙ্গে দেশটির বিপুলসংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেন, চীনের কারণে তাদের বর্তমান দুর্গতি—কারখানা স্থানান্তর হওয়া, ভালো চাকরি হারানো—সব মিলিয়ে মার্কিনরা ভালো অবস্থায় নেই। ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, বিশ্বের সব দেশ এত দিন যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে; এখন থেকে তা আর হতে দেওয়া হবে না। ফলে ২ এপ্রিল বিশ্বের প্রায় সব দেশর পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করে সেই দিনকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্প। দেখে নেওয়া যাক, বড় দেশগুলোর মধ্যে কারা কী ব্যবস্থা নিচ্ছে—
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তকে ‘বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত’ বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ইউরোপ ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেবে এবং সতর্কবার্তা দিয়েছেন, যদি আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন—যারা ২০ শতাংশ শুল্কের আওতায় পড়েছে—পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
উরসুলা আরও বলেছেন, এই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কারণে নিত্যপণ্য, পরিবহন ও ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। এতে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বিশ্ব বাণিজ্যব্যবস্থায় গুরুতর ত্রুটি আছে বলেও স্বীকার করেছেন তিনি। শুল্কারোপের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইইউ প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে প্রয়োজনে পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুতি রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে কথা বলে না। গত মার্চ মাসে ইইউর ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্যে মার্কিন শুল্ক আরোপের জবাবে তারা পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এই শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা।
এবার যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের জবাবে ইউরোপ শক্ত অবস্থানেই আছে। আজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। সেই ভাষণে পাল্টা পদক্ষেপের রূপরেখা থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে শুল্কমুক্ত মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। শনিবার ইতালির ফ্লোরেন্সে কট্টর ডানপন্থী দল লিগ পার্টি আয়োজিত ভিডিও সম্মেলনে যুক্ত হয়ে ইলন মাস্ক এই অবস্থান ব্যক্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক বাধা দূর করার পক্ষেও অবস্থান জানিয়েছেন তিনি।
চীন
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের জবাবে এবার প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছে চীন। অনেকটা ইটের বদলে পাটকেল মারার ঢঙে ব্যবস্থা নিয়েছে চীন।
চীনের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ১০ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাঁচামালের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করবে তারা। এ ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে দেশটি।
চীনের অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে, তা ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়’। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ঘোষণার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা নতুন করে ১৬টি মার্কিন প্রতিষ্ঠানকে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য চীনের বাজার ও প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারে বিধিনিষেধ আরও বাড়বে।
যুক্তরাজ্য
ব্রিটেনের ওপর ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর জবাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, নিজ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ‘শুল্ক-ঝড়’ থেকে রক্ষা করার জন্য নতুন শিল্পনীতি গ্রহণ করতে প্রস্তুত তিনি। পাশাপাশি মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে অর্থনৈতিক চুক্তির চেষ্টাও চালিয়ে যাবেন তিনি। স্টারমারের মতে, ‘আমরা বিশ্বাস করি না, বাণিজ্যযুদ্ধই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।’
স্টারমার মনে করেন, ট্রাম্পের ঘোষণার ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা বাড়বে। যদিও অনেকেই ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে ‘শাপে বর’ দেখছেন। তিনি মনে করেন, বিভিন্ন দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে জোর দেবে। একই সঙ্গে তারা অর্থনৈতিক সংস্কারের পথেও হাঁটবে।
ইতিমধ্যে ব্রিটেনের অন্যতম গাড়ি কোম্পানি জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার জানিয়েছে, তারা এখন আর আমেরিকায় গাড়ি পাঠাবে না। অন্তত এক মাসের জন্য সেখানে গাড়ি রপ্তানি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। তাদের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘পাল্টা শুল্ক’ আরোপের সিদ্ধান্ত কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেই পথই এখন খুঁজে বের করতে হবে। বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার পর যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি রপ্তানির বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নিয়ে ভাবিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এই আবহে আজ সোমবার বড় ঘোষণা দিতে পারেন তিনি। দ্য টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোমবারের ভাষণে বিশ্বায়নের যুগ শেষ বলে ঘোষণা দিতে পারেন তিনি।
ভারত
বিভিন্ন দেশের উদ্যোগ বিচার করা হলে দেখা যাবে, অর্থনৈতিক কূটনীতিতে ভারত সবচেয়ে এগিয়ে। সেই ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় থেকেই দেশটি এ বিষয়ে তৎপর। ট্রাম্প আগে থেকেই ভারতকে ‘শুল্কের রাজা’ আখ্যা দেন। ফলে আগেভাগে ব্যবস্থা না নিলে ভারত যে বিপদে পড়বে, সেটা তারা আগে থেকেই জানত। ফলে চলতি অর্থবছরের বাজেটেই বেশ কিছু মার্কিন পণ্যে শুল্ক হ্রাস করেছে ভারত। সেই সঙ্গে দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলও ভারত সফর করেছে।
সম্প্রতি ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার সংবাদে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের হাত থেকে বাঁচতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য যেমন কাঠবাদাম ও ক্র্যানবেরিতে আরও শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব দিয়েছে। এর আগে রয়টার্সের আরেক সাংবাদে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যের মধ্যে ৫৫ শতাংশের ওপর শুল্ক কমাতে রাজি হতে পারে ভারত।
ভারত এ ক্ষেত্রে বেশ কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। শুল্ক নিয়ে আলোচনা করতে ২৬ মার্চ চার দিনের নয়াদিল্লি সফরে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধিদল। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডেন লিঞ্চের নেতৃত্বাধীন ওই প্রতিনিধিদল ভারতে আসার পরই শুল্ক প্রশ্নে ইতিবাচক ও নমনীয় বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
২৬ মার্চ লোকসভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভারতের গড় আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ করা হয়েছে। বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী জিতিন প্রসাদ এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ২০২৩ সালে ভারতের সরল গড় শুল্কহার ছিল ১৭ শতাংশ। ২০২৫-২৬ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটের পর সরল গড় শিল্প শুল্ক ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
সম্প্রতি লোকসভায় অর্থ বিল পাসের সময়ে ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য যে ৬ শতাংশ করারোপ করা হতো, সেটাও তুলে নেওয়া হয়েছে। মূলত ইলন মাস্কের এক্স, গুগল ও মেটার ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হতো। বার্তা পরিষ্কার, সুর নরম করেছে নয়াদিল্লি।
এ ছাড়া চলতি বছরের বাজেটে মার্কিন মোটরসাইকেলে শুল্ক হ্রাস করেছে ভারত। তখন মার্কিন ব্র্যান্ড হারলে ডেভিডসনের আমদানিতে ভারত আরও ১০ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করে। এর আগে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হারলে ডেভিডসনের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছিল ভারত। এবারের বাজেটে যা আরও কিছুটা কমানো হয়।
ভিয়েতনাম
ভিয়েতনামের পণ্যে ৪৬ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এর আগে ভিয়েতনাম সরকার জানিয়েছিল, এ বিষয়ে আলোচনা চায় তারা। সেই আলোচনার জন্য এক থেকে তিন মাস সময় চায় তারা। এই কয়েক মাস তাদের চড়া শুল্কের হাত থেকে নিস্তার দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছে তারা। ৪ এপ্রিল ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক টু ল্যামের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির বিনিময়ে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনতে চায়।
ভিয়েতনাম সরকার আগেই জানিয়েছে, বিমান ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসসহ আরও বেশি মার্কিন পণ্য ভিয়েতনামে আমদানির জন্য ব্যবস্থা নেবে তারা। পাশাপাশি মার্কিন কোম্পানিগুলো যেন সহজে ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করতে পারে, সেই লক্ষ্যেও ব্যবস্থা নেবে তারা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পও বিষয়টি ভালোভাবে নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এক পোস্টে ট্রাম্প বলেছেন, ‘ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক টু ল্যামের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তিনি আমাকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি চুক্তি করতে চান। এর বিনিময়ে ভিয়েতনাম তাদের শুল্ক শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে চায়।’ ট্রাম্প তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরও বলেছেন, অদূর ভবিষ্যতে তাঁর সঙ্গে বৈঠকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তিনি।
বস্তুত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যে কজন বিশ্বনেতা প্রথমেই আলাপ করেছেন, টু ল্যাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একই সঙ্গে তিনি ট্রাম্পকে জানিয়েছেন, ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি পণ্যে গড় শুল্ক মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ তারা নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো, ভিয়েতনাম এখন তাদের মধ্যে অন্যতম। যদিও এই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা দীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ করেছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের এই শুল্ক ঘোষণার আগে থেকে নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেয় ভিয়েতনাম। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে তারা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিতে সাময়িক চুক্তি করেছে। সেই সঙ্গে মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করেছে। ইলন মাস্কের স্টারলিংক ভিয়েতনামে নতুন কোম্পানি খুলে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। এমনকি ট্রাম্প অর্গানাইজেশন টু ল্যামের নিজ প্রদেশে ১৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে গলফ কোর্স তৈরি করছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক হ র স কর শ ল ক আর প র ইলন ম স ক প রস ত ত এই শ ল ক ব যবস থ অবস থ ন ইউর প য় র জন য কর ছ ন মন ত র বল ছ ন আরও ব র ওপর আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।