গত বছর ঈদুল আজহার আগে ১২ লাখ টাকার এক ছাগল দেশজুড়ে শোরগোল ফেলেছিল। রাজধানীর ‘সাদিক এগ্রো’ থেকে ছাগলটি কিনেছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ছেলে। মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ছাগল নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়। ছাগলকাণ্ড ঘিরে যেন বেরিয়েছিল কেঁচো খুঁড়তে সাপ! দেশজুড়ে তৈরি হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিস্ফোরণ। একে একে বেরিয়ে আসে দুর্নীতবাজ কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদের নানা অপকীর্তির তথ্য। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বছর ঘুরে আবার কোরবানির ঈদ সামনে। তবে এবার দামি গরু কিংবা ছাগলের বিজ্ঞাপনের চাকচিক্য নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেই কোরবানির পশু নিয়ে বাগাড়ম্বর। খামারে খামারে নেই আগের সেই রোশনাই। পশুর হাটে হাটে এক ধরনের সতর্কতা, শঙ্কা। যার পেছনে রয়েছে ছাগলকাণ্ডের ছায়া। এ বাস্তবতায় বড় খামারির মধ্যে আছে উদ্বেগও।

এবার কোরবানির ঈদ ৭ জুন। প্রস্তুত হচ্ছে পশুর হাট। তবে বড় গরু নিয়ে বেকায়দায় আছেন খামারিরা। যেসব বড় গরু সাধারণত বিত্তবানের কাছে বিক্রি হতো, সেসব ক্রেতার অনেকেই আত্মগোপনে। পাশাপাশি আতঙ্কে আছেন ধনাঢ্য ক্রেতারাও। ফলে এবার চাহিদা বেশি ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর। 

বড় গরু বোঝা
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, কোরবানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার গবাদি পশু।

এর মধ্যে গরু-মহিষ ৫৬ লাখ ২ হাজার এবং ছাগল-ভেড়া ৬৮ লাখ ৩৮ হাজার। চাহিদা অনুযায়ী প্রায় ২০ লাখ পশু উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর গরুর চেয়ে ছাগল ও ভেড়ার কোরবানি বেশি হয়েছে। ২০২৩ সালে গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার, আর ছাগল-ভেড়া ৫০ লাখ ৩৮ হাজার। অথচ ২০১৯ সালে গরু-মহিষ কোরবানি ছিল ৫৭ লাখের বেশি।

খামারিরা বলছেন, যারা একসময় কোরবানির হাটে লাখ লাখ টাকা ঢালতেন– রাজনীতিক, প্রভাবশালী আমলা, প্রবাসী পরিবার কিংবা বড় ব্যবসায়ী; তাদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে। কেউ দুর্নীতির মামলায়, কেউ হয়তো পরিস্থিতি বুঝে সতর্ক। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, দুর্নীতির তদন্ত, গণঅভ্যুত্থানের পর দামি পশু কেনা অনেকেই এখন ‘ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত’ মনে করছেন। খামারিরা বলছেন, এ বছর বড় গরুর চাহিদা নেই বললেই চলে। অনেকেই সস্তা ও ছোট পশুর দিকেই ঝুঁকছেন। সব মিলিয়ে ছাগলকাণ্ডের রেশ গিয়ে ঠেকেছে গোয়ালঘরে, কোরবানির হাটের দরকষাকষিতে, এমনকি খামারির সংসারেও।

পাবনার সাঁথিয়ার শামুকজানি গ্রামের খামারি মনজেল হোসেন ‘মোহন রাজ’ নামে ষাঁড়টি তিন বছর ধরে লালনপালন করছিলেন। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, খাওয়া-দাওয়া, পরিচর্যা করে ৯৫ হাজার টাকায় কেনা গরুটাকে বিশাল আকৃতি দিয়েছি। কিন্তু ১০ লাখের আশায় রাখা গরুটি শেষ পর্যন্ত ৬ লাখ টাকায় এক গরু ব্যাপারীর কাছে দিতে বাধ্য হয়েছি। 

রাজশাহীর খড়খড়ির খামারি আনোয়ার হোসেন ৬০টি বড় গরু প্রস্তুত করেছেন। শাহিওয়াল, ব্রাহমা ও দেশি জাতের। বললেন, আগে যারা ৮-১০ লাখে গরু কিনতেন, তারা এখন যোগাযোগই করছেন না। অনলাইনেও সাড়া নেই।

মেহেরপুর সদরের হরিরামপুর গ্রামের খামারি ইলিয়াস আলীর ২৩টি গরু। আগে যেগুলোর একেকটির দাম ছিল ৭ থেকে ১৫ লাখ টাকা, এখন সেই গরু কেউ নিতে আসছেন না। গত বছরের ছাগলকাণ্ডের পর এবার সবাই সতর্ক। ব্যাপরীরা বড় গরু নিতেই চাচ্ছেন না। 

পাবনা সদরের খামারি রিপন হোসেন বলেন, গতবার বড় গরু বিক্রি করতে গিয়ে ফেঁসে গিয়েছিলাম। এবার ৩৫টি ছোট গরু রেখেছিলাম। ১ থেকে ২ লাখের মধ্যে এগুলো বিক্রি হয়ে গেছে।

চুয়াডাঙ্গার নিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমি এবার ছোট জাতের ১১টি গরু এনেছি। এগুলোর দাম দেড় থেকে আড়াই লাখ। বড় গরু নিয়ে এখন ভিডিও কিংবা চটকদার বিজ্ঞাপন দিলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেশ কয়েকটি খামার ঘুরে দেখা গেছে, আগের মতো জমকালো অবস্থা নেই। ৯-১০ মণ ওজনের গরু আছে। ফলকে দাম লেখা ৮-৯ লাখ টাকা। কিন্তু কেউ এসে দামও জানতে চাচ্ছেন না।

রাজধানীর গাবতলী হাট ঘুরেও ছোট-মাঝারি গরুর সরবরাহ বেশি দেখা গেছে। গরু ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দিন বলেন, মানুষ বড় গরুতে ভয় পায়। এই ভয় শুধু টাকার না– সামাজিক, প্রশাসনিক, সব ধরনের ভয় কাজ করছে। ছোট গরু মানেই এখন ‘নিরাপদ’। 

বড় গরুতে খরচ বাড়লেও লাভ নেই
খামারিরা বলছেন, খরচ বাড়লেও লাভের মুখ দেখা কঠিন হয়ে গেছে। প্রাণী খাদ্যের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৮৭ শতাংশ। ভুসি, খৈল, ভুট্টা, খড়–সবকিছুর দাম বেড়েছে।
পাবনার রাইয়ান ডেইরি ফার্মের ব্যবস্থাপক ইকবাল মৃধা বলেন, প্রতিটি গরুর পেছনে দিনে ৫০০-৫৫০ টাকা খরচ হয়। দেড় বছরে ২ লাখের বেশি খরচ পড়ে। যে ভুসির বস্তা আগে ১ হাজার ৬০০ টাকায় পেতাম, এখন তা ২ হাজার ২০০ টাকা।

চুয়াডাঙ্গার খামারি নিয়াজ উদ্দিন বললেন, ১১টি গরু আছে, খরচ আকাশছোঁয়া। লাভ দূরে থাক, মূলধন তুলতেই হিমশিম খেতে হবে। প্রাণী খাদ্য ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। বড় গরু পালনে আগে ছিল বিনিয়োগ, এখন সেটা বোঝা। উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রির সমন্বয় হচ্ছে না। সরকারিভাবে দাম নিয়ন্ত্রণ না এলে এই খাত টিকে থাকবে না।

এদিকে অন্য বছর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কোরবানির গরু নিয়ে প্রচার ছিল। এবার এখনও অনলাইন হাট জমেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা বলেন,  আগের বছর যেখানে বড় গরুর বিজ্ঞাপন ছিল ৩০-৪০ ভাগ, এবার তা ১০ ভাগের নিচে। এ বছর বড় গরুর বিক্রি আশানুরূপ হচ্ছে না। ছোট-মাঝারি গরুর প্রতি মনোযোগ বেশি। 

ছিনতাই-ডাকাতির নতুন আতঙ্ক
বাজার আর দামে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি নতুন করে ভয় ঢুকেছে পরিবহনে। বর্ষাকালীন ঈদের মৌসুমে পশুবাহী ট্রাক অনেক সময় দীর্ঘ যানজটে পড়ে। সেই সঙ্গে মহাসড়কে ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। খাগড়াছড়ির খামারি আব্দুর রহমান বলেন, জেলার বাইরের ব্যাপারীরা ছিনতাই ও ডাকাতির ভয়ে খামারে আসতেই চান না। এবারের ঈদ বর্ষাকালে। মহাসড়কে যানজট, কাদাযুক্ত গ্রামীণ রাস্তা আর ছিনতাইকারীর তৎপরতা মিলিয়ে বিক্রির পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক।

বিশেষজ্ঞ মত
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড.

জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, কোরবানির হাট কখনও ছিল ধর্মীয় আবেগের জায়গা, কখনও সামাজিক প্রতিপত্তির। এখন সেখানে জায়গা নিয়েছে আতঙ্ক, হিসাবনিকাশ আর সম্ভাব্য জবাবদিহির ভয়। 

তিনি বলেন, বড় গরুর পরিচর্যায় সময়, শ্রম, অর্থ সবই ব্যয় করেছেন খামারিরা। কিন্তু এবার সেই গরুর ক্রেতা নেই। বড় গরুর খামারিদের দীর্ঘমেয়াদি লাভ নিশ্চিত করতে হলে দরকার পরিকল্পিত বাজার ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ পরিবহন ও সরকারি সহায়তা। পাশাপাশি দরকার ভয় দূর করা। সামর্থ্য থাকলে বড় গরু কিনতে যেন কোনো বাধা দেওয়া না হয়। কারণ, দেশে হাজার হাজার বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে, যারা শুধু কোরবানি ঘিরে বড় গরু উৎপাদন করে। তারা লোকসানে পড়লে সার্বিক মাংস উৎপাদন ব্যাহত হবে।

সরকারি উদ্যোগ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, আমরা এ বছর সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশেষ নজর দিয়েছি। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় পশু আনতে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ব্যবস্থা থাকবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বড় গরু বিক্রির সুযোগ থাকছে। হাটগুলোতে ভেটেরিনারি সার্জনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে, যেন গরুর স্বাস্থ্য নিয়ে বিভ্রান্তি না থাকে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ঈদের সময় হাটের শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিটি ট্রাকে নির্দিষ্ট হাটের তথ্য থাকতে হবে। রাস্তায় পশু নামানো যাবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মহাসড়কে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন থাকবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক রব ন গর ছ গলক ণ ড র ক রব ন র ব যবস থ ন বল ন ছ নত ই অন ক ই সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাজেটে কালোটাকা সাদা করার বিধান, সংবিধান পরিপন্থি: টিআইবি

প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সংস্থাটি জানিয়েছে, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।

সোমবার (২ জুন) ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথাগুলো বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

আরো পড়ুন:

বাজেটের আকার আরো ছোট হওয়া উচিত ছিল: আমির খসরু

তামাকবিরোধী জোটের বাজেট প্রতিক্রিয়া
সিগারেটে অতিরিক্ত ২০ হাজার কোটি টাকা আয়ের সুযোগ হাতছাড়া

ইফতেখারুজ্জামান জানান, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে রাষ্ট্র সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করেছেন তারা। তিনি মনে করেন, সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

ইফতেখারুজ্জামান জানান, করহার যা–ই হোক না কেন, এটি সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে যে অনুপার্জিত আয় অবৈধ হবে। 

তিনি জানান, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ একই সঙ্গে বৈষম্যমূলক। কারণ, এই সিদ্ধান্তের ফলে আবাসন খাতে অবৈধ অর্থের মালিকদের অধিকতর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সৎ উপার্জনকারীদের ফ্ল্যাট বা ভবনের অংশীদার হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।

সরকারের এমন সিদ্ধান্ত দুর্নীতিকে উৎসাহ দেবে, এমন আশঙ্কার কথা জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি জানান, এর মাধ্যমে সরকার বছরজুড়ে অবৈধ ও অপ্রদর্শিত অর্থ–সম্পদ অর্জনের জন্য নাগরিকদের উৎসাহিত করছে এবং বছর শেষে কালোটাকাকে বৈধতা দেওয়ার অঙ্গীকার করছে। আবাসন খাতকে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।

বিজ্ঞপ্তিতে অবিলম্বে কালোটাকা সাদা করার দুর্নীতিবান্ধব সুযোগ বাতিল করার জোর দাবি জানিয়েছে টিআইবি। পাশাপাশি কালোটাকার উৎস অনুসন্ধান করে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা, কর ব্যবস্থায় সমতা ও ন্যায় নিশ্চিতের দাবিও জানানো হয়েছে।

ইফতেখারুজ্জামান জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বাজেটে তাদের প্রত্যাশা ছিল, দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের অগ্রগতির বিষয়ে ধারণা দেওয়া হবে। অর্থ উপদেষ্টা এ ব্যাপারে একটিমাত্র বাক্য ব্যবহার করেই দায় সেরেছেন। একই সঙ্গে দেশ থেকে অর্থ–সম্পদ পাচার করেছেন এবং পরে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন, এমন ব্যক্তিদের অর্থ–সম্পদের ওপর কর ও জরিমানা আরোপের বিধান করা হলেও কী প্রক্রিয়ায় তা বাস্তবায়ন করা হবে, তা পরিষ্কার করা হয়নি।

তিনি জানান, রাজস্ব আদায় বাড়াতে এর ব্যবস্থাপনা থেকে নীতিকে আলাদা করার সঙ্গে এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের কৌশলগুলো বাজেট বক্তৃতায় উঠে না আসা হতাশার।

ঢাকা/এনএফ/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ