চীন-ভারত ‘ড্যামযুদ্ধে’ বাংলাদেশ কি নীরবই থাকবে
Published: 16th, August 2025 GMT
ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে চীন বিশ্বের বৃহত্তম ‘ড্যাম’ বানাচ্ছে অর্থাৎ পানিনিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ বসাচ্ছে। আগেও তারা এ রকম বানিয়েছে। তবে এবারেরটা অতীতেরগুলোর চেয়ে অনেক বড়।
পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারতও একই স্রোতে কিছু দূরে ড্যাম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রায় সবার অনুমান, আঞ্চলিক দুই পরাশক্তির এ রকম পানিযুদ্ধে বেশ ঝুঁকিতে পড়বে ভাটির বাংলাদেশ।
ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ৮ থেকে ১০ ভাগ বাংলাদেশের ভেতরও আছে। অথচ এখানে চীন-ভারতের চলতি পাল্টাপাল্টি ড্যামযুদ্ধের ফলাফল নিয়ে জোরালো আলাপ নেই, উদ্বেগ-আপত্তি নেই, প্রতিবাদও নেই। স্বভাবত আন্তর্জাতিক নদীতে নিজেদের স্বার্থের প্রশ্নে গত দেড় দশকের চুপ থাকার নীতি থেকে এখনো বাংলাদেশ বের হতে পারছে না বলেই ধরে নিচ্ছে বিশ্বের অনেকে।
তিব্বতে কংক্রিটের মহা আখ্যান
গত ২১ জুলাই, বাংলাদেশে যখন গণ–অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির তোড়জোড় চলছে, সেই ফাঁকে আলোচ্য চীনা ড্যামের কাজের শুরু। গণচীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজ দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ড্যাম বানানোর উদ্বোধন করলেন। এ ড্যাম হবে তিব্বতের মিদং এলাকায় ইয়ারলং চাংপো নদীতে। একই নদী অরুণাচলে সি-আং এবং তার পরের ভাটিতে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নামে বইছে।
চীন বলছে, এ ড্যাম তৈরিতে ১৬৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। বিশাল বাজেট বলে দিচ্ছে, কী ধরনের বড় অবকাঠামো গড়া হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের বুকে।এত দিন বিশ্বের বড় ড্যাম হিসেবে গণ্য হতো চীনের ছাং চিয়াং (ইয়াংৎসি) নদীর ওপর বসানো থ্রি গর্জেস ড্যাম, যার উচ্চতা প্রায় ৬০ তলা ভবনের মতো। বন্যানিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ওটা বসানো হয়েছিল। প্রায় দেড় হাজার গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এতে।
১৪ লাখ স্থানীয় মানুষ ওই ড্যামের কারণে বসতি হারায়। আবার ড্যামের মাধ্যমে বন্যাকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা গেছে এবং এখান থেকে বেশ বড় হিসাবের বিদ্যুৎও মিলেছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, থ্রি গর্জেসের লাভ-ক্ষতির হিসাব ছাড়িয়ে যাবে নতুন ড্যামে।
ভীত ভারতের পাল্টা ড্যাম
চীনের সঙ্গে ভারতের আন্তনদী অনেক। তবে শতদ্রু আর ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ নিয়ে হাইড্রোলজিক্যাল ডেটা লেনদেনের সমঝোতা-স্মারক ছাড়া উভয়ের মধ্যে সামগ্রিক নদীপ্রবাহ নিয়ে আর কোনো চুক্তি নেই। ফলে ভারত বা বাংলাদেশের পরিণতির তোয়াক্কা না করেই চীন ব্রহ্মপুত্রের জলে যা খুশি তা করতে পারে। ২০১৭ সালে সীমান্তযুদ্ধের পর ভারতের সঙ্গে করা আগের স্মারক অনুযায়ীও তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছে না বেইজিং আর।
আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মিদংয়ের ড্যাম ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি এত বৃহৎ যে এ সম্পর্কে ভারতের ভীত না হয়ে উপায় নেই। তাদের ভীতির একটা কারণ, ড্যামের জন্য চীনাদের জায়গা বাছাইয়ের ধরন। অরুণাচলের একেবারে ধার ঘেঁষে ড্যামটি বানাচ্ছে চীন।
ভারতনিয়ন্ত্রিত এই প্রদেশ চীন বহুকাল নিজের বলে দাবি করছে। এ রকম একটা জায়গায় চীনের ১৫০ বিলিয়নের বেশি ডলার বিনিয়োগ-উদ্যোগ দেখে ভারত উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। ২০১৭ সালের সংঘাতের পর থেকে চীন গালওয়ান নদীর লাদাখমুখী স্রোত পাল্টে দিচ্ছে দেখেও নয়াদিল্লিতে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
এ রকম সব কিছুর ফল হিসেবে তিব্বতের খানিক ভাটিতে, ব্রহ্মপুত্র অরুণাচলের যেখানে স্থানীয় লোকজনের কাছে সি-আং নদী হিসেবে পরিচিত, সেখানে ভারতও দৈত্যকার এক ড্যাম বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। উভয় ড্যামের দূরত্ব বেশি নয়। হিমালয়ের সর্বপূর্বে নামচা বারোয়া শৃঙ্গের কাছ দিয়ে নদীটি যেখানে ইউটার্ন নিয়েছে, সেখানেই অল্প দূরত্বে দুটি ড্যাম হবে।
অরুণাচলের আপার সি-আং জেলা একেবারে তিব্বত লাগোয়া। নয়াদিল্লি থেকে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার ও চীনের রাজধানী থেকে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে এ জায়গা। উভয় রাজধানীর শাসকদের জন্য শক্তি দেখানোর বড় এক ক্ষেত্র হয়ে উঠছে দূরবর্তী ও দুর্গম এ অঞ্চলের জলসম্পদ।
তবে গণচীন যতটা সহজে ড্যাম তৈরি শুরু করে দিয়েছে, ভারতের পক্ষে তত সহজে সে কাজ সম্ভব হচ্ছে না। অরুণাচলের বাসিন্দা ‘আদি’ ট্রাইবের কাছে সি-আং মাতৃতুল্য। ড্যাম হলে তারা নিজেরাও উদ্বাস্তু হবে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ।
ব্রিটিশরা ভারত দখলের আগে অরুণাচলের এ এলাকা তিব্বতেরই অংশ ছিল। এখানকার ‘আদি’রা তিব্বতের অংশে এখন ‘লোহবা’ নামে পরিচিত। ফলে বলা যায়, তিব্বতের মিদং ও অরুণাচলের আপার সি-আংয়ে ড্যামের তাৎক্ষণিক শিকার হবে আদি ও লোহবারা।
কিন্তু চীন ও ভারতের জাতীয়তাবাদী জিদ ও আধিপত্যের ক্ষুধার কাছে স্থানীয় ট্রাইবাল অসন্তোষের কানাকড়িও দাম নেই; যেভাবে পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই ড্যাম করার সময় চাকমাদের আহাজারির তেমন তোয়াক্কা করেনি। বিশ্ববাসী এ মুহূর্তে যখন ভারত ও চীনের দুই বিশাল নির্মাণযজ্ঞের গল্প শুনছে, তখন এ অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের বিপণ্নতার কথা সামান্যই জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম।
ভারত তার নির্মিতব্য ড্যামের নাম দিয়েছে ‘আপার সি-আং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’। বলা বাহুল্য, বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও এ প্রকল্পে ভূরাজনীতিও মিশে আছে। ভারত মনে করছে, মিদংয়ের ড্যামের মাধ্যমে চীন ব্রহ্মপুত্রে পুরো নিয়ন্ত্রণে নেবে। কখনো তারা এ প্রবাহের পানি আটকাবে, কখনো বেশি করে ছেড়ে বিধ্বংসী বন্যা ঘটাবে। এতে বিশেষভাবে বিপদে পড়বে আসাম।
এ রকম আশঙ্কার সুরক্ষা হিসেবে সি-আং প্রকল্প। এ ড্যাম বসাতে তাদের খরচ হবে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। বিনিময়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে অনুমান রয়েছে।
কিন্তু তাতে মুশকিলের দিক আছে অনেক। এ বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত আল–জাজিরার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অরুণাচলের কয়েক ডজন গ্রাম ডুবে যাবে এ ড্যামে। আর আছে ভূমিকম্পের ভয়। হিমালয়ের এ অঞ্চলে বড় বড় ভূমিকম্পের রেকর্ড অনেক। অনেকের মনে আছে হয়তো, ২০১৫ সালে নেপালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৯ হাজার লোক মারা গেলেন। ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেরও রেকর্ড (১৯৩৪) আছে এ অঞ্চলে। চীনে গত শতাব্দীতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে অন্তত ছয়বার। এ বছর জানুয়ারিতে তিব্বতে যে ভূমিকম্প হলো, তাতেও আশপাশের নানা আয়তনের অন্তত পাঁচটি ড্যাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভবিষ্যতে যেকোনো বড় ভূমিকম্পে নির্মাণাধীন এই দুটি ড্যামের কোনোটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভাটিতে আসাম ও বাংলাদেশে অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা আছে। এ রকম ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে থাকবে গ্রামের পর গ্রাম ধুয়েমুছে চলে যাওয়া। এ ছাড়া এই দুটি ড্যাম পুরো ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রতিবেশকাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে বলে পরিবেশবাদীদের অনুমান। সব মিলে কোটি কোটি মানুষকে চিরস্থায়ী ঝুঁকিতে ফেলতে যাচ্ছে উভয় ড্যাম।
দুই অবকাঠামোতে বাংলাদেশ যেভাবে ঝুঁকিতে
অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু, যিনি নিজে স্থানীয় মনপা ট্রাইবের লোক। তিনি ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে চীনের ড্যামকে বলেছেন সম্ভাব্য এক ‘পানিবোমা’। ব্যাপারটি উজানের মানুষদের জন্য ঠিক তাই। চীন তাদের ড্যাম ৪০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি জমাতে পারবে। তবে বর্তমানের বিজেপির রাজনীতির অনুসারী পেমা চীনের বোমা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, ততটা নন নিজ সরকারের বানাতে চাওয়া ‘পানিবোমা’ নিয়ে।
বাংলাদেশের জন্য আসলে ‘পানিবোমা’ তৈরি হচ্ছে দুটি। চীন ও ভারত উভয়ের ড্যামই বাংলাদেশের জন্য বোমাতুল্য হুমকি হিসেবে ঝুলে থাকবে। সেসব বোমায় বিস্ফোরণ না ঘটলেও ড্যামগুলো ব্রহ্মপুত্রের পলিপ্রবাহে ব্যাঘাত ঘটাবে তাৎক্ষণিকভাবে। এতে নদীর বাংলাদেশ অংশে কৃষি খাতে নানা ধরনের খারাপ পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। মৎস্য খাতেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া অনিবার্য।
বাংলাদেশের নদীর পানির ৬৫ ভাগ হিস্যাই ব্রহ্মপুত্র-যমুনার স্রোতে আসে। অথচ ঢাকা থেকে ড্যাম প্রকল্পগুলো নিয়ে চীন-ভারতের কাছে জোরালো কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়েছে কি?
বাংলাদেশের গত দেড় দশকের পররাষ্ট্রনীতি নয়াদিল্লিমুখী হয়ে হেলে পড়েছিল বলে অভিযোগ আছে। এখন আবার সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দিকে হেলে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। গত ১৫ বছরে আন্তনদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে কখনো শক্তভাবে দর–কষাকষি করেনি এবং সে কারণে কিছু পায়নি।
এখন ব্রহ্মপুত্রে চীনের এবং পাশাপাশি ভারতের বিধ্বংসী ড্যাম প্রকল্পেও বাংলাদেশকে যে নীরব দেখা যাচ্ছে, সেটা দেশের স্বার্থে বেশ বেমানান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিভাগ নদ-নদী প্রশ্নে প্রায় আগের অবস্থাতেই যেন আছে। এখানকার নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোও জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে জরুরি এ বিষয়ে উদাসীন দেখা যাচ্ছে। পরিবেশবাদী যাঁরা সরকারে আছেন, এ বিষয়ে তাঁদেরও কোনো বক্তব্য মিলছে না। তবে নিশ্চয়ই এটা তথাকথিত পরিবেশ প্রশ্নের চেয়েও অনেক বড় বিষয়।
পাকিস্তান যে কারণে খুশি
ব্রহ্মপুত্রে চীনের ড্যাম এবং তার পাল্টা হিসেবে ভারতের অনুরূপ উদ্যোগে পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় বিস্ময়করভাবে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। তারা মনে করছে, এতে পানি বিষয়ে ভারতের হাতে তাদের এত দিনের নিগ্রহদশা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বাড়তি মনোযোগ পাবে। এ ছাড়া ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারকেরা চাইছেন, ভারতের সঙ্গে তাঁদের পানিকেন্দ্রিক উত্তেজনায় চীন জড়িয়ে পড়ুক। তাতে হয়তো ভারত সিন্ধু চুক্তি নাকচ করতে চাইলে চীনকে দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পানি বন্ধ করে দেওয়ার মতো পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
এই তিন দেশের পানিকেন্দ্রিক সংঘাতের লক্ষণীয় একটা দিক—তারা সবাই এমন দুই অঞ্চলের জলসম্পদ (তিব্বত ও কাশ্মীর) ব্যবহার করে বিবাদে লিপ্ত, খোদ যেসব এলাকার মানুষ নানা রূপে স্বাধিকারের দাবিতে কমবেশি সোচ্চার। কাশ্মীর ভারত-পাকিস্তান ভাগ করে নিয়ন্ত্রণ করছে প্রায় আট দশক। অন্যদিকে চীন তিব্বতের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, সে–ও সাত দশক হয়ে গেল। কেন্দ্র থেকে বহু দূরের ‘নিয়ন্ত্রিত এলাকা’য় ড্যামযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি যে রকম হচ্ছে ও হবে—রাষ্ট্রসমূহের কেন্দ্রে থাকা অভিজাত নীতিনির্ধারকদের জীবনে সে রকম আঁচ ও আঁচড় লাগবে সামান্যই।
তবে অর্থের হিসাব দেখলেও বোঝা যায়, আলোচ্য তিন দেশ ড্যামযুদ্ধকে অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচি হিসেবে নিচ্ছে। এ বছর ভারত সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিতমাত্র পাকিস্তান তাদের উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (খাইবার পাখতুনখায়া) মহমান্দ ড্যাম গড়ার কাজে চীনের সংশ্লিষ্টতা বাড়িয়েছে।
বিষয়টা স্পষ্ট, সিন্ধু চুক্তি অনুযায়ী পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারত কখনো বড় আকারে বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার বিকল্প উৎস ঠিক করে রাখছে পাকিস্তান এবং চীন তাতে সহযোগিতা করছে; যদিও সোয়াত নদীর ওপর মহমান্দ ড্যাম কেবল পেশোয়ারের পানিনিরাপত্তা বাড়াবে, তবে পাকিস্তান সারা দেশের জন্য এ রকম নানামুখী কারিগরি বিকল্প ভাবছে এখন। চীনকে দিয়ে আজাদ কাশ্মীরেও নদীপ্রবাহে অন্তত পাঁচটি জলপ্রপাত বানাতে চায় ইসলামাবাদ।
এভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শাসকদের জাতীয়তাবাদী দ্বন্দ্ব ও মেরুকরণ পুরো অঞ্চলের প্রতিবেশের স্বাভাবিক ধরন ধ্বংস করে দিচ্ছে। নদীগুলোর ওপর চেপে বসছে একের পর এক কংক্রিটের কাঠামো।
এ ধরনের অবকাঠামোগত নির্মাণে সব দেশের ব্যবসায়ী মহলও অত্যুৎসাহী। বাংলাদেশেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বৃহত্তর রংপুরে সম্ভাব্য ওই অবকাঠামোর পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া নিয়ে তেমন অনুসন্ধানী বক্তব্য পাওয়া যায় না।
নদী ও পানি যখন সংঘাতের উপাদান
এটা বেশ স্পষ্ট, ভারত ও চীনের চলতি ড্যামযুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে উদীয়মান পানিযুদ্ধের সর্বশেষ একাংশ। মে মাসে ভারত-পাকিস্তানে যে যুদ্ধ হয়ে গেল, তাতেও পানিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। সিন্ধু নদীচুক্তি স্থগিত করার কথা জানিয়েছিল ভারত তখন। আবার সিন্ধুতে বাঁধ দিলে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান সেটা ধ্বংসে মিসাইল ছোড়ার হুমকি দিলেন সম্প্রতি।
চীন-ভারত-পাকিস্তান সামনের দিনগুলোতে আন্তসীমান্ত নদীগুলোকে পরস্পরকে মোকাবিলার উপাদান হিসেবে ভাবছে এবং পানিপ্রবাহকে দখল-বেদখলের বিষয় করে তুলছে। তাদের এ যুদ্ধ-প্রতিযোগিতার অনিবার্য বলি হতে পারে ভাটির বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের নেতারা এসব বিষয়ে কথা বলেন না। কখনো ভারতের প্রতি, কখনোবা চীনের প্রতি সমর্পিত হয়ে থাকছে বিশেষজ্ঞ কণ্ঠস্বরগুলো। দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চিন্তায়ও নদী ও পানি অনেকাংশে অনুপস্থিত।
গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়েও সমাধানমূলক কথা শোনা যাচ্ছে না কোনো তরফ থেকে এখনো। অথচ কিছুদিন পরই ৩০ বছর মেয়াদি এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। নির্বাচনপরবর্তী সরকারের জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে এটা তখন।
আলতাফ পারভেজ গবেষক ও ভূরাজনীতি বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ ম কম প অবক ঠ ম প রকল প র জন ত র জন য পর ব শ অন য য় প রব হ সরক র এ রকম ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বের সেরা কর্মস্থল হিলটন হোটেল, সেরা তালিকায় আছে মেটলাইফ
আধুনিক মানুষের দিনের বড় একটা সময় যায় কর্মস্থলে। ফলে সেই কর্মস্থলের পরিবেশ কেমন, কর্তৃপক্ষ কর্মীদের কথা কতটা ভাবছে—এ সবকিছু এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে।
সম্মান, নিরাপত্তা, উন্নতির সুযোগ ও কাজের অর্থবহতা আছে—মানুষ সাধারণত এমন কর্মস্থলই চায়। এসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের সেরা কর্মস্থলের তালিকা প্রকাশ করে থাকে। তারা মূলত বিশ্বের সেরা ২৫ কর্মস্থলের তালিকা করে। সেই তালিকায় সবার ওপরে আছে হিলটন হোটেল। মূলত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নিয়ে এই জরিপ ও তালিকা করা হয়েছে।
এবারের তালিকায় ২৫টি কোম্পানির মধ্যে ১৬টি যুক্তরাষ্ট্রের। অন্যগুলো বিভিন্ন দেশের, মূলত ইউরোপের। কোম্পানিগুলোর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে—২৫টি কোম্পানির মধ্যে ৮টি এই খাতের। এ ছাড়া নির্মাণ, জৈব ওষুধ, উৎপাদন, কুরিয়ার, আর্থিক ও পেশাদার সেবা দেওয়া কোম্পানিগুলোও তালিকায় আছে।
সেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি কোম্পানি হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জীবনবিমা কোম্পানি মেটলাইফ। ২০২৫ সালে দশম স্থান অর্জন করে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো এই মর্যাদাপূর্ণ বৈশ্বিক স্বীকৃতি ধরে রাখল কোম্পানিটি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪০টি দেশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম রয়েছে।
৯০ লাখের বেশি উত্তরের ওপর ভিত্তি করে ফরচুনের সেরা ২৫টি কর্মক্ষেত্রের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী আড়াই কোটি কর্মীর কাজের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে মেটলাইফের প্রেসিডেন্ট ও সিইও মিশেল খালাফ বলেন, ‘টানা দ্বিতীয় বছরের মতো বিশ্বের সেরা কর্মস্থলের তালিকায় স্থান পাওয়া কর্মীদের নিষ্ঠা ও উদ্যোগের প্রমাণ।’
কারা আছে তালিকায়দেখে নেওয়া যাক এবারের তালিকায় কোন কোন দেশের কোম্পানি আছে। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে কুরিয়ার ও যাতায়াত খাতের কোম্পানি ডিএইচএল। তৃতীয় স্থানে আছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি সিসকো। এর সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রে। চতুর্থ স্থানে আছে পেশাদার সেবা দেওয়া আইরিশ কোম্পানি অ্যাক্সেনচিউর, পঞ্চম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বিশ্বখ্যাত হোটেল ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল। ষষ্ঠ স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব ওষুধ কোম্পানি অ্যাব ভিয়ে, সপ্তম স্থানে আছে ফ্রান্সের পেশাদার সেবা দেওয়া কোম্পানি টিপি। অষ্টম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনভিত্তিক কোম্পানি স্ট্রাইকার, নবম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি সেলস ফোর্স।
দশম স্থানে আছে মার্কিন বিমা কোম্পানি মেটলাইফ, ১১তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি সার্ভিস নাউ। ১২তম স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি স্পেকসেভার্স। ১৩তম স্থানে আছে জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা কোম্পানি সিমেন্স হেলদিনেস; ১৪তম স্থানে আছে আইরিশ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এক্সপেরিয়েন। ১৫তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি এনভিডিয়া, ১৬তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি কেডেন্স। ১৭তম স্থানে আছে জার্মানির বিমা ও আর্থিক কোম্পানি আলিয়াঞ্জ এবং ১৮তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতের কোম্পানি ডাও।
১৯ থেকে ২১তম স্থানে আছে তিনটি মার্কিন কোম্পানি। ১৯তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের জৈব ওষুধ কোম্পানি ভিয়াট্রিস, ২০তম স্থানে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাডোবি, ২১তম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ক্রাউডস্ট্রাইক।
২২ ও ২৩তম স্থানেও আছে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি কোম্পানি—উৎপাদন খাতের এসসি জনসন ও খুচরা বিক্রয় খাতের ট্রেক বাইসাইকেল। ২৪তম স্থানে আছে লিচেনস্টাইনের নির্মাণ কোম্পানি হিলতি ও ২৫তম স্থানে আছে যুক্তরাজ্যের বিমা ও আর্থিক খাতের কোম্পানি অ্যাডমিরাল গ্রুপ।
কীভাবে এই মূল্যায়ন৩০ বছর ধরে এই জরিপ পরিচালনা করছে ফরচুন ম্যাগাজিন। সারা বিশ্বের কর্মীদের কাছ থেকে তারা জানতে চায়, কর্মস্থলে তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কিছু মানদণ্ড তৈরি করে। সেই মানদণ্ডের ভিত্তিতে বোঝা যায়, কোনো কর্মস্থল প্রকৃত অর্থেই ‘দারুণ’ কি না। সেই সঙ্গে কর্মীরা সে প্রতিষ্ঠানে থাকতে চান কি না, প্রতিষ্ঠান কত দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে ও তার সামগ্রিক ব্যবসায়িক সাফল্য কতটা মিলবে—এসব বিষয়েও ধারণা পাওয়া যায় জরিপে।
ফরচুন ম্যাগাজিন নিজস্ব ট্রাস্ট ইনডেক্স বা আস্থাসূচক তৈরি করেছে। ব্যবস্থাপনার প্রতি কর্মীদের আস্থা কতটা, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ও কোম্পানির প্রতি কর্মীদের আনুগত্য কতটা—এসব আস্থাসূচকের মাধ্যমে এসব বিষয় পরিমাপ করা হয়।
এ জরিপে কর্মীরা গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁদের মতামত জানাতে পারেন। ৬০টি বিষয়ের ওপর ৫ পয়েন্টের ভিত্তিতে উত্তর দিতে হয়, সঙ্গে থাকে ২টি উন্মুক্ত প্রশ্ন।
কর্মীদের কাছ থেকে যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয়, সেগুলো হলো নেতৃত্বের কাছে কি সহজে যাওয়া যায়, নেতৃত্ব সততা ও স্বচ্চতার সঙ্গে কথা বলেন ও কাজ করেন কি না, নেতৃত্বের কথা ও কাজে মিল আছে কি না। সেই সঙ্গে কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে সম্মানিত বোধ করেন কি না এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কতটা। নেতৃত্ব কর্মীদের কৃতজ্ঞতা জানান কি না এবং কর্মীদের সুস্থতা বজায় রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি না। এ ছাড়া কর্মীদের অবদান রাখার সুযোগ আছে কি না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়।
জরিপে কর্মীদের কাছে আরও যেসব বিষয় জানতে চাওয়া হয় সেগুলো হলো:বেতন, মুনাফা, পদোন্নতি, স্বীকৃতি ও সুযোগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কতটা ন্যায়সংগত;
কর্মীরা নিজেদের কাজ, কর্মদল ও প্রতিষ্ঠানের জন্য গর্ব বোধ করেন;
কাজ অর্থবহ এবং তা পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে;
সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগে;
কর্মীরা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারেন।
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অভিজ্ঞতার ভিন্নতা কতটা, তা–ও জরিপে পরিমাপ করা হয়। কর্মীদের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা ও গুণগত মানও মূল্যায়ন করা হয়। এভাবে প্রতিটি ধাপে কঠোর মানদণ্ড মেনে এই তালিকা করা হয় বলে জানিয়েছে ফরচুন ম্যাগাজিন।