Samakal:
2025-09-18@04:53:05 GMT

উৎসবের যত রং

Published: 3rd, June 2025 GMT

উৎসবের যত রং

আমার কৈশোর কেটেছে সিলেটে। শহরটা ছিল নিরিবিলি, ছিমছাম সুন্দর। মানুষগুলোও। এ শুধু বয়ঃপ্রাপ্তির আগের নিষ্পাপ চোখের দেখা না, সমাজ ইতিহাসের পাতাতেও লেখা। আমার স্কুলে যাওয়ার পথে মন্দির পড়ত, একটা ছবির মতো গির্জাও। যে যার মতো ধর্ম পালন করত। কোনো হুজ্জত-হাঙ্গামা হতো না। সেসব উৎসবে চাকচিক্য ছিল না, আধিক্য অথবা দেখানোর মহড়া ছিল না। আনন্দটাই প্রধান ছিল। নির্মল আনন্দ।
দুই ঈদে আমরা উৎসব করতাম। ঈদুল আজহাকে বলা হতো ‘বকরা’ অথবা ‘বকরি’ ঈদ। মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা সেই সময় এমন ছিল না যে ঘরে ঘরে পশু জবাই হবে। অনেক সময় তাই ‘ভাগে’ গরু কেনা হতো। আজকের গল্পটা সেই রকম ‘ভাগে’ কেনা গরু হারিয়ে যাওয়ার, যথাসময়ে খুঁজে না পাওয়ার এবং সেই অপ্রাপ্তির সঙ্গে একজনের সুবর্ণ এক প্রাপ্তির। ভাগের সঙ্গে ভাগ্যের এই রকম সংযোগ আর ঘটেছে কিনা, আমার জানা নেই।
আমার এক বন্ধুর বাবা একটা গরু কেনার সাধের সঙ্গে সাধ্যের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে দেরি করে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত সাধ-কে পরের বছর পর্যন্ত মুলতবি রেখে ভাগে কিনতে গিয়ে দেখলেন, পাড়ায় তাঁর জন্য কেউ বসে নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি শহরের আরেক পাড়ায় এক পরিচিতজনের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করলেন। তাতে তিনি স্বস্তি পেলেও অস্বস্তিতে পড়ল আমার বন্ধু। কারণ কোরবানির সকাল-দুপুর তাকে কাটাতে হবে ওই পাড়ায়, যে পাড়ার ক্রিকেট টিমকে আমরা শুধু আমাদের পাড়াতে নয়, তাদের পাড়াতেও, হোমগ্রাউন্ডেই হারিয়েছি। এই শেষ পরাজয়টা অপমানেরও অধিক। ফলে আমার বন্ধু ওই পাড়ায় অবাঞ্ছিত। এবার যদি তাকে একা পেয়ে পরাজয়ের শোধ মেটায়?
আমার বন্ধু, তার বাবার মতোই, আরেক দোটানায় পড়ল। তাকে উদ্ধার করলেন আমাদের প্রতিবেশী পাড়ার ফুটবল নায়ক মুরাদ ভাই। মুরাদ নামটা, এই উপমহাদেশের অনেক ফিল্মি নায়কের নামের মতো, নকল। আসল নামটা তাঁর ঊহ্য থাকল, প্রাইভেসি প্রটেকশনের বিধান অনুযায়ী, যদিও গল্পের ঘটনাটা দুই পাড়াতে ঊহ্য থাকেনি। আমার বন্ধুকে তিনি জানালেন, তার বাবাকে তিনিই ওই পাড়ায় ভাগে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি নিজেও ভাগে আছেন। তার বাবা কিছুদিন ধরে শয্যাশায়ী। অসুস্থ। পরিবারের সামর্থ্যে টান পড়েছে। ঈদের দিন কোরবানিতে তিনিও থাকবেন।
আমার বন্ধুর দোটানা-পর্ব শেষ হলো। এই দোটানায় থাকাটা সেই সময়ে মানুষের বেশ পছন্দের ছিল। তাতে বেশ একটা দার্শনিক আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ মিলত। সময়টা ছিল দর্শনের, প্রদর্শনের নয়। যাক সে কথা।
মুরাদ ভাইকে ভাগে পেয়ে আমার বন্ধু হাতে চাঁদ পেল। পাওয়ারই কথা। তাঁর অল-সিলেট ফেইম তাকে কোনো পাড়াবন্দি করেনি। তদুপরি তিনি সুদর্শন মানুষ, চোখে রোদচশমা পরেন, কায়দা করে ক্যাপস্টান সিগারেট খান, রমরমা এক ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজারি করেন। তাঁর সঙ্গে ওই পাড়ায় আমার বন্ধু নিরাপদ।
ঈদের দিন নামাজ শেষে মুরাদ ভাইয়ের চকচকে র‍্যালি সাইকেলের পেছনে বসে আনন্দভরা মন নিয়ে আমার বন্ধু চলল ওই পাড়ায়। পাড়ায় পৌঁছে তার সব আনন্দ উবে গেল, অথবা ডুবে গেল। 
কেন? না, কোরবানির গরুটা দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে, সবাই যখন ঈদগাহতে কোলাকুলি করছেন।
গরু পালালে বুদ্ধি বাড়ে না, কষ্ট বাড়ে। যে লোকের জিম্মায় গরুটা ছিল, সেও গিয়েছিল নামাজে। সেজন্য কেউ তাকে জবাবদিহি করার কথা ভাবল না, বকাঝকাও দিল না, শুধু দুঃখ প্রকাশ করে মুরব্বিরা বললেন, ‘ইতা কিতা অইল বা! অখন যাও। তুকাও।’ তুকাও অর্থাৎ তালাশ করো। ফলে সবাই মিলে গরু-খোঁজায় নামা হলো। মুরাদ ভাই দেখলেন, তালাশকারীদের মনোযোগ রাস্তায়, মাঠে, বাড়িঘরের সামনের আঙিনায়। কিন্তু তিনি তো ফরওয়ার্ডে খেলেন না, পেছনটা সামলান, দলের পেছনের স্তম্ভ, ব্যাক পজিশনে খেলেন, যাকে সিলেটে বলা হতো ‘বেকি’। তিনি ভাবলেন, তাঁর মনোযোগ থাকবে দৃশ্যের পেছনে। তাঁর ধারণা হলো, গরুটা পেছনলভ্য তাজা ঘাস আর কচি পাতার সন্ধানে থাকবে। এ বাসা-ও বাসার কোনাকাঞ্চিতে, যতটা সম্ভব পেছনে, তিনি উঁকি দিলেন। হঠাৎ একটা বাড়ির পেছন থেকে একটা গম্ভীর হাম্বা ধ্বনি শুনে উল্লসিত মনে নিজেকে বললেন, ইউরেকা! পাওয়া গেছে। গরুটা বলছে, আমি এখানে। 
দ্রুত পা চালিয়ে তিনি গরুর কাছে গেলেন।
গরুটা একটা গাছের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। সামনে একটা টুকরি, কিছু ঘাস টুকরিতে দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, আহারে তৃপ্ত গরুটা তার হাম্বারবে সন্তোষ প্রকাশ করছে।
মুরাদ ভাই কী করবেন, ভেবে নিতে একটু সময় নিলেন। কিন্তু এক নারীকণ্ঠের চিৎকার তাতে যবনিকা টানল। চিৎকারটা প্রথমে আর্ত, তারপর ভয়ার্ত, তারপর বিস্মিত। শেষে একটা প্রশ্ন, কে আপনি?
নারীকণ্ঠে এমন অস্তিত্ববাদী প্রশ্ন শুনে মুরাদ ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন, নিশ্চয় বহুদিন পর। আপনি কে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন।
নিজের বাড়িতে ঢুকে একটা অপরিচিত, উটকো লোক– গরুচোরও হতে পারে– এ রকম প্রশ্ন তাঁকে করতে পারে তা ভেবে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার কথা সেই নারীর। যুদ্ধ লাগাবেন কি, যুদ্ধের একটা আয়োজন তৈরির দিকেও তিনি গেলেন না যখন তাঁর চোখ পড়ল মুরাদ ভাইয়ের ওপর, সেই বিস্মিত পর্যায়ের শুরুতে। মুরাদ ভাইয়ের ঈদের পাঞ্জাবিটা দারুণ, তাঁর চুলের অবিন্যস্ত বিন্যাসটাও অটুট। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াজনিত কিছু গোলাপি রং তাঁর ফর্সা গালে। তার ওপর তাঁর চোখে লন্ডন থেকে আনানো চকচকে রে-ব্যান রোদচশমা। যুদ্ধের আয়োজনের দিকে না যাওয়ার একটা বড় কারণ: দিনটা ঈদের।
নারীর গলা নামল, কোমল হলো। তিনি বললেন, গরুটাকে তিনি খুব আদর করেন। গরুর নাম নিম্মি। নিম্মির দিকে তিনি যেন দয়া করে হাত না বাড়ান।
মুরাদ ভাই জিব কেটে বললেন, এসব কী বলেন। আমি এসেছি আমাদের কোরবানির হারানো গরুর খোঁজে।
জিব কাটার কারণ: নারীর মুখে তাঁর চোখ পড়েছে। অপূর্ব সেই মুখটা দেখে হাছন রাজার একটা গান এলোমেলো তাঁর মনে বাজল– রূপ দেখিলাম রে নয়নে!
সিলেটের ওই সময়ের সমাজে এই যে মুরাদ ভাই এবং নারী– নারী মানে কলেজপড়ুয়া অথবা পাস করা ছাত্রী– কিছুক্ষণ কথা বললেন, তা ওই কয়েকটা ক্ষণই বটে। ঘড়ির কাঁটায় হয়তো দুই মিনিট। এই দুই মিনিটের শেষে পাগলা ঘণ্টার মতো পুরুষদের পদধ্বনি শোনা গেল। নারী/ছাত্রী পালালেন অকুস্থল থেকে। ততক্ষণে মুরাদ ভাই বুঝে ফেলেছেন, যত কড়া ডিফেন্ডারই তিনি হোন না কেন, তাঁকে ফাঁকি দিয়ে ওই নারী/ছাত্রী একটা গোল করে বসেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার পুরুষদের ভালো ট্যাকল দিতে হবে। তিনি তাদের সামনাসামনি হলেন। পুরুষরা কঠিন কিছু বলবেন কি, তাঁর মতো সেলিব্রেটিকে বাড়িতে পেয়ে– বাড়ির যে ভূগোলেই তাঁর অবস্থান হোক না কেন– বিগলিত হয়ে গেলেন। তার ওপর আবার ঈদের দিনে! আদর আপ্যায়ন হলো। গরু খোঁজায় তাদের কাজের একটি ছেলেকেও পাঠানো হলো। মুরাদ ভাই সব ভুলে উদার আনন্দে সেই আপ্যায়ন গ্রহণ করলেন, কিন্তু সারাক্ষণ তিনি উন্মুখ হয়ে রইলেন সেই নারী/ছাত্রীকে দর্শন, নিদেনপক্ষে শ্রবণের জন্য।
সেই নারী/ছাত্রী দুইটি শোকে কাতর হলেন– এক.

কেন তিনি নিম্মিকে মুরাদ ভাইয়ের হাতে তুলে দেননি; দুই. কেন তাঁর ওপর মুরাদ ভাইয়ের চোখ পড়ার আগে তিনি ঈদের সাজে সাজেননি।
মুরাদ ভাই যখন ভাগের আয়োজকের বাড়ি ফিরলেন, কতগুলো উৎকণ্ঠিত মুখের ভিড়ে আমার বন্ধুর করুণ মুখটি দেখে বুঝলেন, কতটা সময় তিনি ওই বাড়িতে কাটিয়েছেন। তাঁর অপরাধবোধ প্রবল হলো যখন তিনি শুনলেন, গরুটাকে পাওয়া যায়নি।
গল্পটা শেষ করতে হয়। 
গরুটা পাওয়া গিয়েছিল, একটা বাড়ির পেছনে জংলা মতো জায়গায়, বুনো ঘাসের সাম্রাজ্যে। ভাগ্য ভালো কোরবানি দেওয়া যায় পরের দিনও। কাজেই আমার বন্ধুকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে তিনি গেলেন ওই পাড়ায়। অবশ্য আরও একদিন বন্ধুকে নিয়ে তিনি ওই পাড়ায় গেলেন, একটা হিলম্যান মিনক্স গাড়ির পেছনে তাকে গাদাগাদি বসিয়ে, বৈরাতির দলে। তিনি ছিলেন বরের সাজে।
তাঁর বিয়ের শামিয়ানা টানানো হয়েছিল ওই বাড়ির সামনের আঙিনায়। নিম্মি ছিল যথারীতি বাড়ির পেছনে। তার মালকিন যে তাকে মুরাদ ভাইয়ের হাতে তুলে না দিয়ে নিজেকেই দিয়েছেন, এ কথা ভেবে সে পরম সুখে জাবর কাটছিল। 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ওই প ড় য় ক রব ন র একট বলল ন করল ন র ওপর আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি

‎নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আইনসৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে সকল ধর্মমত, সকল  সম্প্রদায় তারা একত্রিত হয়েছে।

সকলেই সার্বিক সহয়তা করছে যাতে করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উৎসব সুন্দর ভাবে পজলন করতে পারে। পূজাকে ঘিরে  একটি গোষ্ঠি চাইবে পূজা উৎসব নষ্ট করে দেয়ার জন্য। 

সে জন্য আমাদের তৎপরতা রয়েছে। আমাদের  গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তার পাশাপাশি র‍্যাব, বিজিবি,  সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশবাহিহনী সবাই কাজ করছে যাতে করে সুন্দর ভাবে পূজা উৎসব শেষ করতে পারি।

‎‎মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর)  শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫নং ঘাটে দূর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জনের স্থান পরিদর্শনকালে তিনি এ নির্দেশনা দেন।

‎দূর্গা পূজা বিজয়া দশমী শেষে প্রতিমা বিসর্জনের সময় যেকোনো অপ্রীতিকর দূর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুন্দর ভাবে প্রতিমা বিসর্জনের স্থান নিরাপদ রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন জেলা প্রশাসক।

‎‎জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ২২৩টি পূজা মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বর্তমানে পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে।

‎‎এসময় তিনি প্রতিটি মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে ও নির্বিঘ্নে পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ সহযোগিতার নির্দেশনা দেন।

‎‎তিনি বলেন, সকলে মিলে সব উৎসব উদযাপন করাই বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব।

‎‎এসময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • উৎসব ঘুরে প্রেক্ষাগৃহে ‘বাড়ির নাম শাহানা’
  • কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে হারাল বায়ার্ন, চ্যাম্পিয়ন পিএসজির গোল উৎসব
  • কারও কোনো অপরাধ নাই
  • বিশ্বকর্মা পূজা: গাঙ্গেয় শিল্পের উৎসব
  • আজ থেকে বুসান উৎসব, নানাভাবে রয়েছে বাংলাদেশ
  • ‎সকলে মিলে সব উৎসব উদযাপন করাই বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব : ডিসি
  • ‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি
  • ঘুম থেকে অনন্ত ঘুমে অস্কারজয়ী রবার্ট রেডফোর্ড
  • ২০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে ভোলার বৈষা দধি
  • শেষ হলো সপ্তম যোসেফাইট ম্যাথ ম্যানিয়া ২০২৫