অনেক অনেক আগে মানুষের হাঁটাচলা ছিল হাত-পা ভর দিয়ে, ঠিক যেমন করে আর সব চারপায়ী প্রাণী চলে। তখন মানুষের গতি ছিল খরগোশ, চিতা কিংবা গন্ডারের থেকেও দ্রুত। হাত আর পা ছিল একে অপরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন—তাদের গাঁটে গাঁটে ছিল মিল: কাঁধ আর নিতম্ব, কনুই আর হাঁটু, গোড়ালি আর কবজি; আর পায়ের পাতার মতো হাতের তালুতেও ছিল পাঁচটি আঙুল কিংবা তার মতো কোনো কিছু, সব কটির শেষে ছিল নখ। হাত ও পা—দুটোরই গঠন কাঠামো ছিল বড় আঙুল আর বুড়ো আঙুল থেকে শুরু করে ছোট ছোট আঙুল আর কনিষ্ঠা পর্যন্ত একই রকম। সে সময় পায়ের বুড়ো আঙুলের মতো হাতের বুড়ো আঙুল ছিল অন্য আঙুলগুলোর সঙ্গে একেবারে গায়ে গায়ে মেশানো। তখন হাত আর পা একে অপরকে ডাকত—‘আমরা তো প্রথম কাজিন!’
যখন চলাফেরার প্রয়োজন হতো, তারা একে অপরকে সহায়তা করে শরীরকে নিয়ে যেত হাটে, দোকানে, গাছের ওপরে কিংবা পাহাড়ের নিচেসহ সে যেখানে যেতে চায়, সেসব জায়গায়। এমনি পানিতেও তারা মিলেমিশে শরীরের ভেসে থাকায়, সাঁতার কাটায় বা ডুব দেওয়ায় সহায়তা করত। সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা ছিল গণতান্ত্রিক ও সমমানপূর্ণ। তারা শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাছ থেকে তাদের গুণ, যেমন মুখের স্বর, কানের শোনা, নাকের শোঁকার ক্ষমতা, এমনকি চোখের দৃষ্টিও দরকারে ধার নিতে পারত।
হাত ও পায়ের এই ছন্দময় আর নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা দেখে শরীরের অন্য অঙ্গগুলো ঈর্ষায় সজাগ হয়ে ওঠে। তাদের ভেতর ক্ষোভ জন্মে, কেন তাদের বিশেষ গুণগুলো এই দুই কাজিন মানে হাত ও পাকে ধার দিতে হবে? তাই তাদের হাত ও পা মিলে যে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়, তা ভুলে গিয়ে তারা ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের দৃষ্টি ঝাপসা করে দেয়। এমনকি তারা এই জোড়ার বিরুদ্ধে শুরু করে দেয় ষড়যন্ত্র।
জিব তখন মাথা থেকে এক পরিকল্পনা ধার নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর করে। সে হাত ও পায়ের মধ্যকার শক্তির তুলনা নিয়ে প্রকাশ্যে বিস্মিত হয়। কে বেশি শক্তিশালী, সেই প্রশ্ন তোলে। ব্যস, শরীরের যে দুই কাজিন অঙ্গ—হাত ও পা, তাদের মধ্যে কে কেমন, তা নিয়ে আগে তারা কখনো কোনোভাবে মাথা না ঘামালেও এবার মুখ থেকে স্বর ধার নিয়ে শরীরের জন্য কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়।
এই তর্ক দ্রুত কে বেশি শোভন—এ প্রশ্নের দিকে মোড় নেয়। হাত তখন তার লম্বা, স্লিম আঙুলের কথা বলে বড়াই করা শুরু করে। একই সঙ্গে আবার পায়ের আঙুল ছোট ও মোটা হওয়ায় তা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য জুড়ে দেয়। এখানেই শেষ নয়; বরং পায়ের আঙুলগুলো পাল্টা জবাব দিয়ে হাতের সরু আঙুলগুলোকে ‘না খেয়ে শুকিয়ে যাওয়া কাজিন’ বলে মন্তব্য করে। তাদের এই তর্ক দিনের পর দিন চলতে থাকায় তা তাদের একত্রে সঠিকভাবে কাজ করার সক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। শেষমেশ কে বেশি শক্তিশালী, এই প্রশ্ন গিয়ে তর্ক দাঁড়ায়। তা সমাধানে তারা শরীরের অন্য অঙ্গগুলোর কাছে বিচার চায়।
জিব একটি প্রতিযোগিতার প্রস্তাব দেয়। ‘চমৎকার আইডিয়া’ বলে সবাই তাতে সম্মত হয়। কিন্তু কিসের প্রতিযোগিতা?
কেউ বলে কুস্তির লড়াই, পা ও হাতের কুস্তি। অন্যরা তলোয়ার চালানো, ভেলকি দেখানো, দৌড় প্রতিযোগিতা কিংবা দাবা বা লুডোর মতো খেলাধুলার লড়াইয়ের কথা বলে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনোটা করা অসম্ভব বলে, আবার কোনোটা কোনো একক অঙ্গের জন্য উপযোগী নয় বলে একের পর এক সব কটি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। শেষমেশ মস্তিষ্ক থেকে ভাবনা ধার করে জিব আবার একটা সহজ সমাধান হাজির করে। সেটা হলো, অঙ্গ দুটি পালাক্রমে একটা করে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। এতে হাত ও পা রাজি হয়ে যায়।
নদীর কাছে বনের ভেতরে ফাঁকা একটি জায়গায় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যেহেতু দুটি অঙ্গ নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়া, তাই এ সময়ে শরীরে অবাক করার মতো কোনো বিপদ কিংবা অন্য কোনো কিছু যদি ঘটে যায়, এ কারণে সব কটি অঙ্গ সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে। ছোটখাটো কোনো বিপদও যাতে এড়িয়ে না যেতে পারে, তাই চোখ তার দৃষ্টি আশপাশের দূর দূর অবধি ছড়িয়ে দেয়। দূর থেকে ক্ষীণতম শব্দটিও শোনার জন্য কান টান টান হয়ে দাঁড়ায়। চোখের নজর বা কানের শোনা এড়িয়ে যাওয়া যেকোনো বিপদের গন্ধ যাতে অনায়াসে ধরা ফেলতে পারে, তাই নাক তার নাসিকা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে নেয়। আর বিপদ বলে চিৎকার জুড়ে দেওয়ার জন্য জিব একেবারে রেডি হয়ে থাকে।
বাতাস বনের চার কোনায়, জলে ও অন্তরিক্ষে প্রতিযোগিতার খবর ছড়িয়ে দেয়। তাই চারপেয়ে প্রাণীগুলো সবার আগে ছুটে এসে হাজির হয়। তাদের মধ্যে বড়গুলোর অনেকেই তারা যে শান্তির জন্য এসেছে, তা বোঝাতে সবুজ ডালপালা সঙ্গে নিয়ে আসে। ফলে তা চিতা, চিতাবাঘ, সিংহ, গন্ডার, হায়না, হাতি, জিরাফ, উট, লম্বা শিংয়ের গরু আর খাটো শিংয়ের মহিষ, হরিণ, চষা হরিণ, খরগোশ, ছুঁচো আর ইঁদুরের এক রঙিন আর বিচিত্র সমাবেশে রূপ নেয়। জলে বাস করা হিপ্পো, মাছ আর কুমিরগুলো এসে ভিড় জমায়। তারা শরীরের ওপরের অংশ মেলে দেয় ডাঙায় আর বাকিটুকু রাখে নদীর জলে।
দুই পায়ে চলা পাখি, যেমন উট, গিনি মুরগি আর ময়ূর উত্তেজনায় পাখা ঝাপটাতে থাকে। গাছে গাছে পাখিগুলো কিচিরমিচির ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। আর ঝিঁঝি পোকাগুলো সারাক্ষণ গেয়ে চলে তাদের একটানা সুর। মাকড়সা, কেঁচো, শতপদী আর সহস্রপদীরা মাটি বা গাছে হামাগুড়ি শুরু করে। গিরগিটি চুপিসারে সময় নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতায় ধীরে ধীরে হাঁটহাঁটি জুড়ে দেয়, আর এক জায়গায় এক মুহূর্তও সুস্থির হয়ে না থেকে টিকটিকি, কেবল এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। বানর, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফালাফি জুড়ে দেয়। এমনকি গাছ আর ঝোপঝাড় অবধি এক পাশ থেকে আরেক পাশে মৃদুমন্দ গতিতে হেলেদুলে শেষে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
মুখ একটা গান দিয়ে প্রতিযোগিতার সূচনা করে:
মোরা সুখী হতে এটা করি
মোরা সুখী হতে এটা করি
মোরা সুখী হতে এটা করি
কারণ একই প্রকৃতি থেকে
মোরা এসেছি সবাই
হাত ও পা শপথ করে নেয় যে ফলাফল শান্তভাবে মেনে নেবে। কোনো রাগ করবে না, বয়কটের হুমকি দেবে না, ধর্মঘট বা ধীরগতির আন্দোলনে যাবে না।
হাত দুটি মাটিতে একটি কাঠের টুকরা ছুড়ে দিয়ে প্রথম চ্যালেঞ্জ দেয়। এবার বাঁ বা ডান পায়ের, অথবা দুটি একসঙ্গে মিলে, সেই কাঠের টুকরাটি মাটি থেকে তুলে ও ছুড়ে দিতে হবে। এ চ্যালেঞ্জে জেতার জন্য প্রতিযোগিতার যেকোনো সময়ে দুই পা পরামর্শ করতে এবং তাদের আঙুলগুলোকে একসঙ্গে বা আলাদাভাবে, যেকোনোভাবে ব্যবহার করতে পারবে। তারা সেটা একবার উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করে, একবার ধাক্কা দেয়, এভাবে সব রকম কৌশলে চেষ্টা চালায়, কিন্তু ঠিকঠাকভাবে সেটা তুলতে পারে না। নাড়ানোর কথা বললে বলতে হয় যে তারা লাথি মেরে সেটাকে কয়েক ইঞ্চি দূরে সরাতে পারে কেবল। আর তাদের এই কসরত দেখে হাতের আঙুলগুলো মুখ থেকে স্বর ধার নিয়ে হাসতে থাকে।
চ্যালেঞ্জকারী হাত যেন কোনো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, এমনভাবে সবার সামনে নিজেদের হাজির করে, তাদের ছিপছিপে গড়নের ঝলক দেখায়। তারপর বিভিন্ন ভঙ্গিতে একত্র হয়ে কাঠের টুকরাটি তুলে নেয়। তারপর সেটা দূরে, জঙ্গলের ভেতরে ছুড়ে মারে। আর তাদের এই নৈপুণ্য দেখে প্রতিযোগী ও দর্শকেরা একসঙ্গে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করে।
তখন তারা ভাতের বাটির মধ্য থেকে বালুর ছোট ছোট দানা তুলে নিয়ে, সুচে সুতা পরিয়ে, ভারী কাঠ সরানোর জন্য ছোট ছোট চাকার মতো পুলি তৈরি করে, কিছু বর্শা বানিয়ে তা অনেক দূর পর্যন্ত ছুড়ে মেরে আরও নৈপুণ্য দেখায়। পায়ের আঙুলগুলোর এসব নৈপুণ্য দেখানো কেবল কল্পনায়–ই সম্ভব। পা কেবল তাই বসে বসে তাদের স্লিম কাজিনদের নিপুণতা আর নড়াচড়ার এই সমারোহ দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
দর্শকদের হাতগুলো করতালিতে বজ্রধ্বনির মতো আওয়াজ তুলে প্রতিযোগী হাত দুটির প্রশংসা করে ও তাদের প্রতি সংহতি জানায়। তা পাগুলোর মনে বেদনার্ত ভাব এনে দেয়। তবে তারা হার মানার লোক নয়। তাই চোখে-মুখে বিমর্ষ ভাব নিয়ে বসে থাকলেও আর তাদের বড় আঙুল বালুর ওপর ছোট ছোট বৃত্ত এঁকে চললেও, মাথার ভেতরে এক বিজয়ী চ্যালেঞ্জ খুঁজে বের করার চেষ্টা তারা চালিয়ে যায়।
শেষে পা ও তার আঙুলগুলোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পালা এলে তারা বলে যে তাদের চ্যালেঞ্জটা খুবই সহজ। পুরো দেহকে বৃত্তের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অবধি হাতগুলোর বহন করে নিয়ে যেতে হবে। তা শুনে অহংকারী আঙুলগুলো মনে মনে ভাবে, হায়! কি স্টুপিড চ্যালেঞ্জ!
তাই হাত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা শুরু করার ফলে দৃশ্যটা দেখার মতো হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, শরীরের সবকিছুই যেন উল্টে যায়। হাত গিয়ে মাটিতে ঠেকে; চোখ মাটির একেবারে কাছাকাছি চলে যাওয়ায় তার নজর খুবই সীমিত হয়ে পড়ে, নাকে ধুলা ঢুকে হাঁচি শুরু হয়ে যায় আর পা ও তার আঙুলগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তাই খেলাধুলার সময় বা আনন্দ প্রকাশ করার জন্য ছেলেমেয়েরা যে গান গায় এ দৃশ্য দেখে দর্শকেরা ‘ন্যায়ো ন্যায়ো’ নামে রসে গান চিৎকার করে সোৎসাহে গাইতে শুরু করে দেয়।
তবে সবার নজর থাকে হাত ও তার বাহুগুলোর পানে। তারা এই কিছুক্ষণ আগেই অসাধারণ সব নৈপুণ্য দেখিয়েছে ঠিকই, তবে এখন এক গজও ঠিকঠাকভাবে এগোতে পারে না। বরং কয়েক কদম এগিয়েই হাতগুলো যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠে। বাহুগুলো কাঁপতে কাঁপতে দোল খায়। শেষে দেহটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর আরেকবার চেষ্টা চালায়। এবার তারা মাটিকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরার জন্য আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু দুই হাতের দুই বুড়ো আঙুলই কেবল ছড়াতে পারে। তখন তারা হাতে ভর দিয়ে শরীর ঘুরিয়ে চাকা ঘোরানোর মতো ভঙ্গি যারে বলে কার্টহুইল, তাকরার চেষ্টা করে। কিন্তু শরীর ঘোরানো সে অ্যাক্রোব্যাট খেলা সম্পূর্ণ করার জন্য পায়ের সাহায্য নেওয়ার দরকার হয় বলে তা বাতিল হয়ে যায়।
ব্যস, এবার পায়ের আঙুলগুলোর হাসার পালা। তাই তারা হাতের আঙুলগুলোর কিচিরমিচির হাসির সঙ্গে নিজেদের হাসির সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করার জন্য মুখের কাছ থেকে মোটা ও ভরাট স্বর ধার নিয়ে হেসে ওঠে।
তাচ্ছিল্যের এই স্বর শুনে হাতগুলো খুব রেগে যায় এবং তারা শরীরটাকে বহন করার জন্য একবার শেষ চেষ্টা চালায়। কিন্তু তারা এক কদমও এগোতে পারে না। তাই ক্লান্ত হয়ে হাত ও তার আঙুলগুলো হাল ছেড়ে দেয়।
পাগুলো তখন খুশি হয়ে তাদের ক্রীড়া-নৈপুণ্য দেখানো শুরু করে। তারা প্রথমে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৌড়ের প্রস্তুতির ভঙ্গি নেয়, তারপর ধীরে দৌড়ায়, আবার ছুটে চলে, কয়েকটি হাইজাম্প ও লংজাম্প দেখায়। তবে একবারের জন্যও শরীরটাকে মাটিতে পড়তে দেয় না। দর্শকদের সব পা তখন মাটিতে চাপড় দিয়ে সমর্থন জানায় ও সংহতি প্রকাশ করে।
হাতগুলো যে তাদের সুবিধামতো সময়ে এ ধরনের অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ শুরু করেছিল, তা ভুলে গিয়ে এবার নিজেদের উঁচুতে তুলে ধরে প্রতিবাদ জানায়।
কিন্তু দর্শকসহ সবাই লক্ষ করে যে হাত দুটি যখন শরীরটাকে বহন করার চেষ্টা করছিল, তখন বুড়ো আঙুল দুটি যেভাবে অন্য আঙুলগুলো থেকে আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা আগের মতোই আলাদা রয়ে গেছে। বিষয়টি তাদের কাছে অদ্ভুত মনে হয়। তাই প্রতিদ্বন্দ্বী পা আবার যখন হাসাহাসি শুরু করতে যায়, ঠিক তখনই তারা আরেকটি বিষয় লক্ষ করে যে বুড়ো আঙুল আলাদা থাকায় হাতগুলোর কাজের ক্ষমতা কমে যাওয়ার বদলে তা বরং তাদের কোনোকিছু ধরার ও আঁকড়ে নেওয়ার ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই সবাই অবাক হয়ে যায়—এ কী! বিকৃতির এমন গঠনের শক্তিতে রূপ নেওয়া কেন।
ঠিক যেমন হাত ও পায়ের পাঁচটি করে আঙুল, তেমনি এ চ্যালেঞ্জে কে বিজয়ী তা ঠিক করতে বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে পাঁচ দিন ধরে বিতর্ক চলে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারা কোনো একক বিজয়ীর নাম ঘোষণা করতে পারে না। কারণ, প্রতিটি অঙ্গই তাদের নিজ নিজ কাজে সেরা আর একটিও অন্যদের ছাড়া চলতে পারে না। তখন শুরু হয় দার্শনিক ভাবনার এক পর্ব—দেহ মূলত কী? সবাই এই প্রশ্ন তোলে। ফলে অঙ্গগুলো বুঝতে পারে যে দেহ মানেই তাদের সবার মিলিত রূপ। তারা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়ানো। তাই সবাই যাতে ঠিকমতো কাজ করতে পারে এ জন্য প্রতিটি অঙ্গকে ঠিকঠাকমতো কাজ করতে হয়।
তবে ভবিষ্যতে যাতে এমন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি না হতে হয় এবং এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, তাই সব অঙ্গ মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে এখন থেকে দেহ সোজা হয়ে হাঁটবে, পা মাটিতে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াবে আর বাহুগুলো থাকবে ওপরের দিকে আকাশ পানে উঁচিয়ে। দেহ এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়, তবে নিজেদের উৎপত্তির কথা ভুলে না যাওয়ার জন্য সে শিশুদের চার পায়ে হাঁটার অনুমতি দেয়।
তারা কাজ ভাগ করে নেয়। যেমন পা দেহকে বহন করবে, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর পর কোনো কিছু তৈরি করার বা কোনো যন্ত্র ধরে রাখার যত কাজ তার সবকিছু করবে হাত। যখন পা ও পায়ের পাতাগুলো ভার বহনের মতো কঠিন কাজে নিয়োজিত থাকবে, তখন হাত সামনে বাড়িয়ে তাদের দক্ষতা ব্যবহার করে পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেবে। আর খাবারদাবার মুখ অবধি পৌঁছে দেওয়া নিশ্চিত করবে। মুখ বা আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, তার দাঁতগুলো খাবার চিবিয়ে গিলতে সাহায্য করে তা গলার ভেতর দিয়ে পেটে পাঠাবে। সে খাবারদাবার থেকে পুষ্টিগুণ বের করে নিয়ে পেট নিজের সঞ্চালন নালির ভেতর দিয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে দেবে, যাতে শরীরের প্রতিটি কোনায় কোনায় সে গুণ গিয়ে হাজির হয়।
তারপর ব্যবহৃত অংশগুলোকে পেট আবার পাঠাবে তার মল নিষ্কাশনব্যবস্থায়, সেখান থেকে দেহ তা ফেলে দেবে মাটিকে উর্বর করার জন্য খোলা মাঠে বা মাটির নিচে। ফলে যাতে সেই মাটিতে জন্মাবে গাছ, তাতে ধরবে ফল। হাত সেই ফল তুলে নিয়ে মুখে দেবে। বাহ, হ্যাঁ–এটাই হলো জীবনের চক্র।
বিনোদন ও খেলাধুলাও সে অনুযায়ী ভাগ করে নেওয়া হয়। গান গাওয়া, হাসাহাসি করা আর কথা বলার কাজ পায় মুখ। দৌড়ানো আর ফুটবল হবে মূলত পায়ের জন্য। যদিও দৌড়ানোর কাজটা পা-ই করবে, তবে বেসবল ও বাস্কেটবল খেলার দায়িত্ব পড়ে হাতের ওপর। অ্যাথলেটিকসে তো প্রায় পুরো মাঠই থাকে পায়ের দখলে। কাজের এই ক্লিয়ারকাট ভাগাভাগির ফলে মানুষের দেহকে এক দুর্দান্ত জৈব যন্ত্রে পরিণত করে। ফলে তারা কাজ–কামের পরিমাণ ও গুণমানে, এমনকি সবচেয়ে বড় প্রাণীকেও হার মানাতে সক্ষম হয়ে ওঠে।
তবে দেহের অঙ্গগুলো বুঝতে পারে, এই যে স্থায়ী ব্যবস্থা তৈরি করা হলো, তা থেকেও নিজের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে। যেমন মাথা যেহেতু ওপরের দিকে থাকে, তাই সে ভাবতে পারে যে সে মাটির সঙ্গে লেগে থাকা পায়ের চেয়ে সেরা। অথবা সে প্রভু আর নিচের অঙ্গগুলো শুধুই তার অধীন কর্মচারী।
তাই তারা জোর দিয়ে বলে যে ক্ষমতার দিক থেকে মাথা এবং তার নিচে থাকা যেকোনো অঙ্গ একে অপরের সমান। এই বার্তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শরীরের অঙ্গগুলো ঠিক করে, যেকোনো একটি অঙ্গ সুখ বা দুঃখ বোধ করলে পুরো দেহ তা অনুভব করবে। তারা মুখকে সতর্ক করে দেয় যে যখন সে বলে ‘আমার এই’ বা ‘আমার ওটা’, তখন তার এই বলা হবে পুরো দেহের পক্ষ থেকেই, নিজেকে একক মালিক ভেবে নয়।
শেষে সবাই মিলে তারা গায়:
মোদের দেহে
কোনো চাকর নেই
মোদের দেহে
কোনো চাকর নেই
মোরা একে অপরের সেবা করি
মোরা-মোদের জন্য
মোরা একে অপরের সেবা করি
মোরা-মোদের জন্য
মোরা একে অপরের সেবা করি
জিব মোদের কণ্ঠস্বর
তুমি মোরে ধরো, মুইও তোমারে ধরি
মোরা গড়ি এক স্বাস্থ্যবান দেহ
তুমি মোরে ধরো, মুইও তোমায় ধরি
মোরা গড়ি এক স্বাস্থ্যবান দেহ
একতা মানেই সুন্দর
একসঙ্গে মোরা কাজ করি
একটা সুস্থ দেহের জন্য
একসঙ্গে মোরা কাজ করি
একটা সুস্থ দেহের জন্য
একতাই মোদের শক্তি।
এটাই হয়ে ওঠে ‘সারা দেহের গান’। তাই আজও দেহ এই গান গায়। এ থেকেই বোঝা যায়, মানুষ ও পশু বা যারা সোজা হয়ে হাঁটার বিপ্লবকে অস্বীকার করেছে, তাদের মধ্যে পার্থক্য।
কিন্তু চোখের সামনে সবকিছু দেখা সত্ত্বেও চার পায়ে চলা জীবরা এই বিপ্লব কিছুতেই মেনে নিতে চায়নি। গানটাকে তারা একেবারেই হাস্যকর বলে মনে করে। তাদের মতে, মুখ তৈরি হয়েছে গান গাওয়ার জন্য নয়; বরং খাওয়াদাওয়ার জন্য। তাই তারা গড়ে তোলে প্রকৃতিসংরক্ষণ দল এবং তাদের অভ্যাস কখনোই বদলায় না; বরং আগের পথেই অবিচল হয়ে থাকে তারা।
তাই যখন মানুষ দেহের অঙ্গগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শিক্ষা নেয়, তখন তারা ভালো করে; কিন্তু যখন তারা দেহ ও মাথাকে দুটি বিরোধী পক্ষ হিসেবে দেখে, একটি অন্যটির ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী মনে করে, তখনই তারা সোজা হয়ে হাঁটার বিপ্লবকে প্রত্যাখ্যানকারী তাদের সেই পশু-আত্মীয়দের মতো হয়ে ওঠে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন য য় র জন য অপর র স তখন ত র ক জ কর এক ব র র ভ তর কর ম র ক র কর র ওপর ত রপর একব র র একট ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
শাহরুখের ব্যাপারে সাবধান করলেন জুহি চাওলা
বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। অভিনয় গুণে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে যশ-খ্যাতি যেমন পেয়েছেন, তেমনি আয় করেছেন মোটা অঙ্কের অর্থও। রবিবার (২ নভেম্বর) ৬০ বছর পূর্ণ করে একষট্টিতে পা দেবেন এই তারকা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অনেক নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান। তাদের মধ্যে অন্যতম জুহি চাওলা। ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’, ‘রামজানে’, ‘ডর’, ‘ইয়েস বস’, ‘ডুপ্লিকেট’সহ আরো কিছু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন এই জুটি। একসঙ্গে অভিনয় ছাড়াও, এই দুই তারকা বাস্তব জীবনে খুবই ভালো বন্ধু। কেবল তাই নয়, ব্যবসায়ীক অংশীদারও তারা।
আরো পড়ুন:
শাহরুখের অজানা এই সাত তথ্য জানেন?
পাকিস্তানের সন্ত্রাসী তালিকায় সালমান খান কেন?
বন্ধু শাহরুখের জন্মদিন উপলক্ষে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন জুহি। এ আলাপচারিতায় স্মৃতিচারণ তো করেছেনই, পাশাপাশি শাহরুখের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
শাহরুখের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “আমি যখন প্রথম ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই, তখন সহপ্রযোজক বিবেক ভাসওয়ানি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার নায়ক দেখতে আমির খানের মতো।’ আমি শাহরুখকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। দেখি, শাহরুখের চুল চোখের ওপরে নেমে এসেছে। আর সে একেবারেই আমার কল্পনার সেই ‘চকলেট বয়’ নয়! যখন কাজ শুরু করি, তখন বুঝতে পারি, সে একদম নতুন অভিনেতাদের মতো নয়, সে পরিশ্রমী, দিনে তিন শিফটে কাজ করছে।”
একটি ঘটনা বর্ণনা করে জুহি চাওলা বলেন, “আমার মনে আছে, ‘ইয়েস বস’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়, কোনো দৃশ্য ঠিকমতো লেখা না থাকলে পরিচালক আজিজজি (আজিজ মির্জা) বলতেন, ‘শাহরুখ আসুক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রোমান্স আর মজার মিশেলে থাকা দৃশ্যগুলো আমাদের সবচেয়ে ভালো ছিল। সেই সূত্রেই আমরা অনেকগুলো সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি।”
শাহরুখের পাশে অবস্থান করলে সাবধান থাকার কথার কথা বলেছেন জুহি। হাসতে হাসতে এ অভিনেত্রী বলেন, “শাহরুখের আশেপাশে থাকলে সাবধানে থাকবেন। কারণ সে কথা দিয়ে আপনাকে যেকোনো কিছু করাতে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে। ওর কথাবলার ভঙ্গি এমন যে, আপনি ‘না’ বলতেই পারবে না। আমি ‘ডুপ্লিকেট’ সিনেমা করতে চাইছিলাম না, কারণ সেখানে আমার তেমন কিছু করার ছিল না। আমরা তখন আরেকটি সিনেমার শুটিং করছিলাম, আর শাহরুখ আমাকে সিঁড়িতে বসিয়ে দুই ঘণ্টা বোঝায় এবং আমি সিনেমাটিতে চুক্তিবদ্ধ হই। সে আপনাকে যেকোনো কিছু করতে রাজি করাতে পারে, তাই সাবধানে থাকবেন।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে জুহি চাওলা বলেন, “অফস্ক্রিনে আমাদের সম্পর্কেও উত্থান-পতন রয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কোনো না কোনোভাবে আমাদের যুক্ত রেখেছেন, এমনকি আইপিএলের মাধ্যমেও। আমাদের বন্ধন কোনো পরিকল্পনার ফল নয়, এটা একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার।”
শাহরুখ খানের সঙ্গে আইপিএল দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) সহ-মালিক জুহি ও তার স্বামী জয় মেহতা। এই দলের পেছনে জুহি বিনিয়োগ করেছেন ৬২৯ কোটি রুপি। বর্তমানে এই দলটির মূল্য আছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি রুপি। শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘রেড চিলিস গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন জুহি।
১৯৬৫ সালে ২ নভেম্বর ভারতের নয়াদিল্লিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহরুখ খান। তার শৈশবের প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে ম্যাঙ্গালুরুতে। শাহরুখের দাদা ইফতিখার আহমেদ স্থানীয় পোর্টের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যার কারণে সেখানে বসবাস করেন তারা। শাহরুখের বাবার নাম তাজ মোহাম্মদ খান, মা লতিফ ফাতিমা।
দিল্লির হংসরাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন শাহরুখ খান। তারপর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে গণযোগাযোগ বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন। কিন্তু অভিনয় জীবন শুরু করার কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি। তবে বলিউডে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-তে ভর্তি হন এই শিল্পী।
১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন শাহরুখ খান। রোমান্টিক ঘরানার এ সিনেমায় অভিনয় করে নজর কাড়েন তিনি। সিনেমাটিতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে সেরা নবাগত অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
একই বছর ‘চমৎকার’, ‘দিল আসনা হে’ ও ‘রাজু বান গায়া জেন্টলম্যান’ সিনেমায় অভিনয় করেন শাহরুখ। তার পরের বছর ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জাত চেনান শাহরুখ। তার অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ হন কোটি ভক্ত; পৌঁছে যান সাফল্যের চূড়ায়। তার অভিনয়ের খ্যাতি আরো বাড়তে থাকে যশরাজ ফিল্মসের সিনেমায় ধারাবাহিকভাবে অভিনয় করে। একের পর এক হিট সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেন শাহরুখ। যদিও তার এই সফলতার জার্নির গল্প মোটেও সহজ ছিল। আর সে গল্প সবারই জানা।
অভিনয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন শাহরুখ খান। তার মধ্যে মোট পনেরোবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মধ্যে আটবার সেরা অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। হিন্দি সিনেমায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে ভারত সরকার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন মোট পাঁচবার। তবে শাহরুখ খানের ৩৩ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে অধরা ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চলতি বছর ‘জওয়ান’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন শাহরুখ।
ঢাকা/শান্ত