মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে ঈদের উৎসব ছিল সাধারণ কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে গভীর। তবে পরবর্তী ইসলামি সাম্রাজ্যগুলোতে—উমাইয়া, আব্বাসি, ফাতেমি ও মামলুক যুগে ঈদুল আজহা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, বিশাল মিছিল এবং সমাজব্যাপী কোরবানির মাধ্যমে একটি গৌরবময় উৎসবে রূপান্তরিত হয়। এ প্রবন্ধে আমরা ইসলামি ইতিহাসে ঈদুল আজহার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যাপন, কোরবানির অনুষ্ঠানের বিবর্তন ও এর সমাজে প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
উমাইয়া যুগ: রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবে উত্থান
উমাইয়া খিলাফত (৪১-১৩২ হি.
পশু কোরবানির প্রচলনও উমাইয়া যুগে ব্যাপক গুরুত্ব পায়। ইবনে হিশাম (মৃ. ২১৮ হি.) উল্লেখ করেন, খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান (মৃ. ৮৬ হি.) ঈদুল আজহার সময় দামেস্কের প্রধান মসজিদে বিশাল পরিসরে কোরবানির আয়োজন করতেন। তিনি নিজে কোরবানির পশু জবাই করতেন এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। এ প্রচলন জনগণের মধ্যে খলিফার উদারতা ও ধার্মিকতার প্রতিচ্ছবি তৈরি করত। উমাইয়া শাসকেরা প্রায়ই বিদ্রোহী অঞ্চলের নেতাদের ঈদের ভোজে আমন্ত্রণ জানাতেন, যা রাজনৈতিক মিলনের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করত।
আব্বাসি যুগ: গৌরব ও দানশীলতা
আব্বাসি খিলাফত (১৩২-৬৫৬ হি./৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে রাষ্ট্রীয় উৎসবে রূপান্তরিত করে। ইবনে জাওজি (মৃ. ৫৯৭ হি.) তাঁর ‘আল-মুনতাজাম’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, খলিফা মুক্তাফি (মৃ. ৫৫৫ হি.) ৫৫৩ হিজরিতে (১১৫৮ খ্রি.) ঈদুল আজহার জন্য একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করেন। এ মিছিলে অশ্বারোহী সৈন্য, সোনায় সজ্জিত ঘোড়া ও বহু আমির, এমনকি ফকিহরাও অংশ নিতেন। মিছিলটি বাগদাদের প্রধান রাস্তা দিয়ে যেত এবং জনগণ তাকবির ধ্বনি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাত।
আরও পড়ুনমানব–হত্যার প্রথম ঘটনা২৭ মে ২০২৩খলিফা মুক্তাফি ঈদুল আজহার জন্য একটি বিশাল মিছিলের আয়োজন করেন। এ মিছিলে অশ্বারোহী সৈন্য, সোনায় সজ্জিত ঘোড়া ও বহু আমির, এমনকি ফকিহরাও অংশ নিতেন।কোরবানির মাংস বিতরণ আব্বাসি যুগে একটি বড় সামাজিক ঘটনা ছিল। সুয়ুতি (মৃ. ৯১১ হি.) তাঁর তারিখ–উল–খুলাফা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, খলিফা মামুন (মৃ. ২১৮ হি.) ঈদুল আজহার সময় হাজারো পশু কোরবানি করতেন। পশুর মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হতো এবং খলিফার প্রাসাদে বিশাল ভোজের আয়োজন করা হতো। এ ভোজে ফকিহ, কবি, এমনকি সাধারণ জনগণও আমন্ত্রিত হতেন। মামুন নিজে ভোজে উপস্থিত থেকে খাবার পরিবেশন করতেন।
ইবনে তাগরিবারদি (মৃ. ৮৭৪ হি.) একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণনা করেন, ২৩৭ হিজরিতে (৮৫২ খ্রি.) খলিফা মুতাওয়াক্কিল ঈদুল আজহার দিনে একজন বিদ্রোহীর মৃতদেহ তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন। এ ঘটনা জনগণের মধ্যে ব্যাপক আনন্দের সৃষ্টি করে এবং খলিফার দয়ার প্রশংসা করা হয়। এ ধরনের কাজগুলো ঈদুল আজহাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক মিলনের একটি মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ফাতেমি যুগ: বৈচিত্র্য ও উৎসব
ফাতেমি খিলাফত (২৯৭-৫৬৭ হি./৯০৯-১১৭১ খ্রি.) ঈদুল আজহাকে একটি বর্ণিল ও সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত করে। মাকরিজি (মৃ. ৮৪৫ হি.) তাঁর ইত্তিআজ আল-হুনাফা গ্রন্থে বর্ণনা করেন, খলিফা আজিজ (মৃ. ৩৮৬ হি.) ঈদের নামাজের জন্য কায়রোর বিশাল মাঠে বিশেষ মঞ্চ (মাসাতিব) নির্মাণ করতেন। এ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন ও ফকিহরা তাকবির ধ্বনি দিতেন এবং জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে সেখানে অংশ নিত।
ইবনে কাসির উল্লেখ করেন, মামলুক সুলতান বাইবার্স ঈদুল আজহার সময় কারাবন্দীদের মুক্তি দিতেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দীদের।ফাতেমিদের সময়ে কোরবানির করার আয়োজন ছিল অত্যন্ত সংগঠিত। ইবনে তাগরি বারদি উল্লেখ করেন, ফাতেমি খলিফারা ঈদুল আজহার জন্য হাজারো পশু ক্রয় করতেন। পশুগুলো কায়রোর প্রধান মাঠে জবাই করা হতো এবং মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষণ করা হতো।
ফাতেমিদের একটি উল্লেখযোগ্য প্রথা ছিল ‘ঈদিয়া’ বা ঈদ উপহার। মাকরিজি বর্ণনা করেন, খলিফারা ফকিহ, সুফি, এমনকি অমুসলিম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ঈদিয়া হিসেবে নগদ অর্থ, পোশাক ও মিষ্টান্ন উপহার দিতেন। একটি মজার প্রথা ছিল মিষ্টির ভেতরে সোনার দিনার লুকিয়ে রাখা, যা অতিথিদের সীমাহীন বিস্ময় ও আনন্দ জোগাত।
ফাতেমিদের ঈদের ভোজও বিখ্যাত ছিল। মাকরিজি উল্লেখ করেন, খলিফা মুসতানসিরের (মৃ. ৪৮৭ হি.) ঈদুল আজহার ভোজে ৩০০ রকমের খাবার পরিবেশন করা হতো। এ ভোজে কুসকুস, হারিসা ও বিভিন্ন মিষ্টান্ন যেমন খুশকনান (মিষ্টি রুটি) ও বেসতানদুদ (মিষ্টি পিঠা) থাকত। ভোজসভাগুলো শুধু আনন্দের নয়; বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল।
আরও পড়ুনযেভাবে ঈদ উৎসব উদ্যাপন শুরু হয়েছিল২৯ মার্চ ২০২৫ঈদুল আজহার ভোজে ৩০০ রকমের খাবার পরিবেশন করা হতোউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ঈদ ল আজহ ক র জন ত ক ক রব ন র র পর ব গ রন থ র জন য পর ব শ ব তরণ ন করত করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
১২ ঘণ্টার মধ্যে কোরবানির বর্জ্য সরাবে ডিএসসিসি, কমিটমেন্ট দিলেন প্রশাসক
পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর বর্জ্য ১২ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক শাহজাহান মিয়া। তিনি বলেন, ‘কোরবানির দিন বিকেল থেকে আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম শুরু হবে। আমাদের কমিটমেন্ট, ১২ ঘণ্টার ভেতরে আমরা এ ময়লা পরিষ্কার করব।’
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান ডিএসসিসির প্রশাসক শাহজাহান মিয়া।
শাহজাহান মিয়া আরও বলেন, ‘বর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য ১০ হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রস্তুত রেখেছি। সিটি করপোরেশনের গাড়িও আমরা রেখেছি। একই সঙ্গে সরকারের অন্যান্য সংস্থায়ও চাহিদা দিয়ে রেখেছি। যদি প্রয়োজন হয়, আমরা তাদের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে আসব।’
মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে কোরবানি দিতে পারে ও উৎসব যাতে নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে, এ বিষয়ে যেকোনো অভিযোগ দেওয়ার জন্য একটি হটলাইন ও কন্ট্রোলরুম খোলা থাকবে বলেও জানান প্রশাসক শাহজাহান মিয়া। তিনি বলেন, বর্জ্য নিয়ে যেকোনো অভিযোগ দিলেই সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবেন। বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য নেওয়া প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদেরও যুক্ত করা হবে।
আরও পড়ুন৬০০ কর্মী নিয়ে ডিএসসিসির বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান১৯ এপ্রিল ২০২৫নগর ভবনে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সমর্থকদের অবরোধের বিষয়ের এক প্রশ্নের জবাবে প্রশাসক শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি উত্তর দিতে চাই না। এটা রাজনৈতিক বিষয়। সেনসিটিভ ইস্যু। এই আইনগত বিষয়গুলোয় আমি কথা বলতে চাই না।’
তবে এ বিষয়ে শাহজাহান মিয়া আরও বলেন, ‘নগর ভবন বন্ধ থাকলেও আমাদের তিনটি দপ্তর সেখানে কাজ করতে পারছে। সেগুলো হলো—বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ভান্ডার বিভাগ, পরিবহন বিভাগ।’
শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ড অফিসগুলো খোলা আছে। জনগণ সেখান থেকে সেবা নিচ্ছেন। জনগণের একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা যেকোনোভাবে তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’
আরও পড়ুনআইনি লড়াই কেন মাঠে গড়াতে দেওয়া হলো১৭ মে ২০২৫আরও পড়ুনএডিস মশা প্রতিরোধে সন্ধ্যায় দরজা-জানালা বন্ধ রাখার আহ্বান ডিএসসিসি প্রশাসকের০৫ মে ২০২৫