ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা মুসলমানদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসব। ইসলামে উৎসব ও আনন্দের উপলক্ষ হিসেবেই দুই ঈদের প্রবর্তন ঘটেছে। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে দেখেন মদিনাবাসী নির্দিষ্ট দুটি দিনে খেলাধুলা ও আনন্দ করে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুটি দিন কিসের? সবাই বলল, জাহেলি যুগে আমরা এই দুই দিন খেলাধুলা করতাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মহান আল্লাহ তোমাদের এ দুই দিনের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তা হলো, ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১১৩৪)
দুই ঈদের ভেতর ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে থাকে। কেননা আদম (আ.
তবে কোরবানির ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও স্মৃতির সবচেয়ে প্রজ্জ্বোল। কেননা তিনি নিজের কলিজার টুকরা সন্তানকে পর্যন্ত কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তার সন্তান ইসমাইল (আ.)-কে রক্ষা করেন এবং বিপরীতে পশু কোরবানির বিধান করেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আমি তাকে মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে।” (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১০৭)
আরো পড়ুন:
কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের ঈদ জামাত
শোলাকিয়ায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় ঈদের নামাজ আদায়
আত্মোৎসর্গ ও আত্মত্যাগের এই নির্মল সুখকে আল্লাহ উৎসবের মর্যাদা দিয়ে তার সঙ্গে ‘ঈদ’ যুক্ত করেছেন। ফলে মুসলমান ঈদ উদযাপন করে থাকে আল্লাহর আনুগত্য ও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণের মাধ্যমে।
ঈদে আনন্দের রীতি ও পদ্ধতি
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে ঈদে আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে-
১. তাকবির পাঠ করা : ঈদের দিন তাকবির পাঠ করার মাধ্যমে মুসলিমরা আনন্দ প্রকাশ করবে। ঈদুল আজহার সময় ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত পাঠ করবে। সন্তান ইসমাইল (আ.)-এর জীবন রক্ষা পেলে ইবরাহিম (আ.) তাকবিরে তাশরিক পাঠ করেছিলেন। তা হলো,‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’
২. গোসল ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা : ঈদের আনন্দ প্রকাশের একটি মাধ্যম হলো গোসল করা এবং অন্যান্য শারীরিক বিষয় থেকে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। বিষয়টি বিপুল সংখ্যক সাহাবির আমলের মাধ্যমে প্রমাণিত। যেমন-আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সম্পর্কে বলা হয়, তিনি এই দুই দিনে গোসল করতেন। (মুয়াত্তায়ে মালিক : ১/১৪৬)
৩. উত্তম পোশাক পরিধান করা : নিজের সামর্থ্য ও শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা উচিত। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘বাজারে বিক্রি হচ্ছিল এমন একটি রেশমি জুব্বা নিয়ে ওমর (রা.) আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এটি ক্রয় করে নিন। ঈদের সময় এবং প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এটি দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করবেন। তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, এটি তো তার পোশাক যার পরকালে কল্যাণের কোনো অংশ নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৪৮)
এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, পোশাক গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের সামর্থ্য ও শরিয়তের বিধি-বিধান অনুসরণ করবে।
৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা : সুগন্ধি এবং সাজসজ্জা গ্রহণ করা মুস্তাহাব। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, ‘আমি জ্ঞানীদের বলতে শুনেছি, প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ও সাজসজ্জা গ্রহণ করা মুস্তাহাব।’(আল মুগনি : ৫/২৫৮)
৫. পরস্পরকে অভিনন্দন জানানো : ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) পরস্পরকে এভাবে অভিনন্দন জানাতেন-, ‘আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করুন।’ (ফাতহুল কাদির : ২/৫১৭)
৬. আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করা : এটি সারা বছরের সুন্নত। তবে এই দিনে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। মুসলিম সমাজে এর সাধারণ প্রচলন আছে।
৭. ভালো খাবার গ্রহণ করা : ঈদ উৎসবের অনুষঙ্গ হলেও ইসলাম খাদ্যের কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রদান করেনি। বরং উত্তম খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করেছে, যেন প্রত্যেক মুসলমান নিজের সামর্থ্য, স্থানীয় রীতি-সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের আলোকে তা গ্রহণ করতে পারে। তবে শর্ত হলো, এসব খাবার হালাল ও স্বাস্থ্যকর হতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আরাফার দিন, কোরবানির দিন ও আইয়ামে তাশরিক মুসলমানের ঈদের দিন। এগুলো খাওয়া ও পান করার দিন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩০০৪)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অভ্যাস ছিল তিনি কোরবানির দিন সর্বপ্রথম কোরবানির পশুর গোশত খেতেন।
৮. বৈধ খেলাধুলা : ঈদের দিন বৈধ খেলাধূলা করা জায়েজ। হাদিসে এসেছে, ঈদের দিন মসজিদে নববীর আঙিনায় হাবশি বালকরা তীর নিক্ষেপের প্রতিযোগিতা করছিল এবং আয়েশা (রা.)-এর ঘরে বালিকারা গান গাইছিল। (সহিহ বুখারি)
৯. কোরবানি করা : কোরবানির দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অর্থ-সম্পদ ও পশুর মায়া ত্যাগ করার মাধ্যমে আত্মত্যাগের উৎসবে শামিল হয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেন। তিনি প্রত্যেক বছর কোরবানি করেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৭)
১০. গোশত খাওয়া ও অন্যকে খাওয়ানো : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পরিবারকে কোরবানির এক-তৃতীয়াংশ আহার করাতেন, প্রতিবেশীদের এক-তৃতীয়াংশ আহার করাতেন আর ভিক্ষুকদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সদকা করতেন।’ (আল-মুগনি : ৯/৪৪৯)
আল্লাহ সবাইকে সঠিকভাবে দ্বীন পালনের তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা
ঢাকা/শাহেদ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ঈদ আবদ ল ল হ ইবন ঈদ ল আজহ ঈদ র দ ন ম সলম ন রব ন র প ঠ কর আল ল হ আকব র আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
পবিত্র ঈদুল আজহা আজ
ত্যাগ আর উৎসর্গের আদর্শে মহিমান্বিত পবিত্র ঈদুল আজহা আজ। আরবি মাসের ১০ জিলহজ তারিখে এই ঈদ উদ্যাপিত হয়। যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে মুসলিম সম্প্রদায় দিনটি উদযাপন করবে। মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় ঈদের জামাত শেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করবেন।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীসহ বিশ্বের সকল মুসলমানদের আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানিয়েছেন।
ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। যুগ যুগ ধরে এই ঈদ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে আসছে। সকালে মুসল্লিরা কাছাকাছি ঈদগাহ বা মসজিদে ঈদুল আজহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করবেন। খতিব নামাজের খুতবায় তুলে ধরবেন কোরবানির তাৎপর্য। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই একত্রে নামাজ আদায় ও শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন।
ঈদের নামাজ শেষে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করবেন সামর্থ্যবান মুসলমানরা। ঈদুল আজহার সঙ্গে পবিত্র হজের সম্পর্ক রয়েছে। মক্কার অদূরে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায় হজ পালন করেছেন।
স্থানীয় হিজরি মাস গণনা অনুযায়ী শুক্রবার সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়েছে। সকালে মুজদালিফা থেকে ফিরে হাজিরা মিনায় অবস্থান করে পশু কোরবানিসহ হজের অন্য কার্যাদি সম্পাদন করেছেন। সৌদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে পৃথিবীর বহু দেশ আজ ঈদুল আজহা উদযাপন করছে।
ঈদুল আজহা হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুত্র হজরত ইসমাইলের (আ.) সঙ্গে সম্পর্কিত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পুত্র ইসমাইলকে আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি করতে গিয়েছিলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই আদেশ ছিল হজরত ইব্রাহিমের জন্য পরীক্ষা। তিনি পুত্রকে আল্লাহর নির্দেশে জবাই করার সব প্রস্তুতি নিয়ে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইসলামে বর্ণিত আছে, নিজের চোখ বেঁধে পুত্র ইসমাইলকে ভেবে যখন জবেহ সম্পন্ন করেন, তখন চোখ খুলে দেখেন ইসমাইলের পরিবর্তে পশু কোরবানি হয়েছে, যা এসেছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে।
সেই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি ধারণ করেই হজরত ইব্রাহিমের (আ.) সুন্নত হিসেবে পশু জবাইয়ের মধ্য দিয়ে কোরবানির বিধান এসেছে ইসলামি শরিয়তে। সেই মোতাবেক প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। ইসলামে কোরবানি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে আজ দেশের প্রতিটি শহর, গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায় পশু কোরবানির দৃশ্য দেখা যাবে। রাস্তাঘাটে দেখা যাবে ঈদ আনন্দে ভাসমান মানুষের মুখ। এদিকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা, আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিবেশন করা হবে উন্নতমানের খাবার।
এবার ঈদের ছুটি সরকারি কর্মীদের জন্য চলবে ১৪ জুন পর্যন্ত— সব মিলিয়ে এবারের ঈদে মিলেছে ১০ দিনের ছুটি। প্রসঙ্গত, ঈদে শহর থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ গ্রামের বাড়িতে গেছেন প্রিয়জনের সঙ্গে উৎসব উদযাপন করতে। ফলে রাজধানী এখন কিছুটা ফাঁকা।