লেনদেন কর বৃদ্ধির কারণে চাপে পড়বে ছোট কোম্পানি
Published: 18th, June 2025 GMT
লাভ-লোকসান যা-ই হোক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হবে। সেই টার্নওভার ট্যাক্স বা লেনদেন করহার এত দিন ছিল শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। আগামী অর্থবছর থেকে সেটি বাড়িয়ে ১ শতাংশে উন্নীত করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, লেনদেন কর বৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে।
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, লেনদেন করের কারণে কোম্পানির লোকসানের পাল্লা ভারী হবে। তাতে অনেক ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা থেকে ছিটকে যেতে পারেন। এনবিআর রাজস্ব বাড়াতে লেনদেন কর বৃদ্ধির মতো অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বদলে অটোমেশন চালু ও তদারকি বাড়ানো দরকার। তাহলেই রাজস্ব আদায় বাড়বে সরকারের।
জানতে চাইলে এফএম প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ গাজী তৌহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লেনদেন কর বাড়ানো উচিত হয়নি। এতে লোকসান করলে কোম্পানিগুলোর বিপদ বাড়বে। শুধু তাই নয়, আমাদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে যেসব ব্যবসায়ী কম মুনাফায় ব্যবসা করেন, তাঁরা ভয়াবহ সমস্যায় পড়বেন। কারণ তাঁদের মুনাফার তুলনায় লেনদেন বেশি হয়। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের জন্য লেনদেন কর একটা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ লেনদেন কর বর্তমানের চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার ঘোষণা দেন। মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও অন্যান্য করের বাইরে সরকার এ ১ শতাংশ অর্থ নেবে আয়কর হিসেবে। বছর শেষে কোম্পানি যদি লোকসানে থাকে, তাহলেও এই কর দিতে হবে। যদিও তা সমন্বয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে।
ধরা যাক, দেশের কোনো একটি কোম্পানি ১০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। তাহলে তাকে লেনদেন কর দিতে হবে ১ কোটি টাকা; কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল পণ্য বিক্রি করে কোম্পানিটি ১০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। তাহলে তার ওপর কোনো করপোরেট কর বা আয়কর প্রযোজ্য হবে না। তবু তার কাছ থেকে সরকার ১ কোটি টাকা নেবে, যেটিকে লেনদেন কর বলা হলেও তা মূলত করপোরেট কর।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোকসানে থাকা কোম্পানির ওপর লেনদেন কর বেশি প্রভাব ফেলবে। যারা অনেক টাকা মুনাফা করে, তাদের ওপর এটি তেমন একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ, তাদের লেনদেন করের চেয়ে বছর শেষে আয়করের পরিমাণ বেশি হয়। ফলে তারা লেনদেন কর বাবদ দেওয়া টাকা বাদ দিয়ে বাকি টাকা সরকারকে দিতে পারবে।
ফ্যাশন হাউস উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতির (এফইএবি) সভাপতি আজহারুল হক আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ছোট-মাঝারি ফ্যাশন হাউসগুলো কোন রকমে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর তারা লাভের জায়গায় নেই। এমন প্রেক্ষাপটে লেনদেন কর বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পাল্লা ভারী হবে। চলতি মূলধনের ঘাটতিতে পড়বে অনেকে। তখন খরচ কমানোর দিকে হাঁটবে কোম্পানিগুলো। ফলে কর্মী ছাঁটাই বাড়বে। দুঃখজনক হচ্ছে, এ বিষয়গুলো সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বুঝছেন না।
দেশে অনেক দিন ধরেই লেনদেন কর রয়েছে। বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরাও দীর্ঘদিন ধরে এই কর বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। প্রস্তাবিত বাজেটে টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানির ক্ষেত্রে এই কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদক ও বিক্রেতা এবং কোমল পানীয় উৎপাদনকারীদের ওপর আগের মতোই ৩ শতাংশ রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে কেপিসি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান কাজী সাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যেসব কোম্পানি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে চুরি করে তাদের ধরতে লেনদেন কর বাড়ানো হয়েছে। তবে তার দায় কেন ছোটদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। লেনদেন কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অমানবিক। বছর শেষে যখন একসঙ্গে অনেক টাকা দিতে হবে, তখন চলতি মূলধনের ঘাটতিতে পড়ে যাবে অনেক ছোট কোম্পানি। বাড়তি করের বোঝার কারণে অনেকে ব্যবসা থেকে ঝরে পড়তে পারে।
লেনদেন করের বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান প্রথম আলোকে বলেন, লেনদেন কর বাড়ানো কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হয়নি। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যখন রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না তখন বিভিন্ন জায়গায় করহার বাড়িয়ে দেয়। অথচ অটোমেশন চালু ও করজাল বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব। অথচ এনবিআর সেই পথে হাঁটছে না। ছোট ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থে লেনদেন কর বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক র ব যবস য় বছর শ ষ র ওপর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৩০ নভেম্বরের মধ্যে করদাতাদের ই-রিটার্ন জমা দিতে বলেছে এনবিআর
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে তাঁদের ই-রিটার্ন জমা দিয়েছেন। গত আগস্টে সব করদাতার জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
ই-রিটার্ন সিস্টেম ব্যবহার করে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে সব ব্যক্তি করদাতাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ অনুরোধ জানায় সংস্থাটি।
গত বছর নির্দিষ্ট এলাকার অধিক্ষেত্রের ব্যক্তি করদাতা, সারা দেশে ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। তাতে ১৭ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেন।
দেশে বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখের মতো কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রতিবছর মাত্র ৪০ লাখ টিআইএনধারী রিটার্ন দাখিল করেন।
এনবিআর জানায়, এক বিশেষ আদেশের মাধ্যমে চলতি বছর ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের প্রবীণ করদাতা, শারীরিকভাবে অসমর্থ বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন করদাতা, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতা, মৃত করদাতার পক্ষে আইনগত প্রতিনিধি কর্তৃক রিটার্ন দাখিল এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক ছাড়া সব ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
চলতি ২০২৫-২৬ করবর্ষে যেসব করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, তাঁরাও চাইলে অনলাইনে ই-রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। অন্যদিকে ই-রিটার্ন সিস্টেমে নিবন্ধনসংক্রান্ত সমস্যার কারণে কোনো করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে না পারলে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপকর কমিশনারের কাছে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে আবেদন করলে অতিরিক্ত বা যুগ্ম কর কমিশনারের অনুমোদনক্রমে কাগুজে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এই সময়সীমা ৩১ অক্টোবর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে।
এনবিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করদাতার পক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিও অনলাইনে ই-রিটার্ন জমা দিতে পারছেন। এ ছাড়া বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতাদের ক্ষেত্রে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও তাঁদের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, ই-মেইল ইত্যাদি তথ্য দিয়ে ই-মেইল করলে ই-রিটার্নের নিবন্ধন লিংক পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি করদাতারা ই-রিটার্ন সিস্টেমে নিবন্ধন করে সহজেই অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। কোনো ধরনের কাগজপত্র বা দলিল আপলোড না করেই করদাতারা তাঁদের আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের প্রকৃত তথ্য ই-রিটার্ন সিস্টেমে এন্ট্রি করে ঝামেলাহীনভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। ই-রিটার্ন দাখিলের পর তাৎক্ষণিকভাবে জমা স্লিপ পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে আয়কর সনদও প্রিন্ট করে নিতে পারছেন করদাতারা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ই-রিটার্ন জমা সহজ করার জন্য গত বছরের মতো এবারও করদাতাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ই-রিটার্নসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় করদাতাদের সহায়তা দিতে একটি কল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। আবার ওয়েবসাইটে ই-রিটার্নসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা লিখিতভাবে জানালেও তার সমাধান পাচ্ছেন করদাতারা। কোনো করদাতা সশরীর নিজ নিজ কর অঞ্চলে গিয়েও ই-রিটার্ন জমা দেওয়াসংক্রান্ত সেবা নিতে পারছেন।