গুমে রাজি না হওয়া কর্মকর্তাদের তথ্যও যেত শেখ হাসিনার কাছে
Published: 25th, June 2025 GMT
গুম–খুনের ঘটনায় জড়াতে কোনো কোনো কর্মকর্তা যে অস্বীকৃতি জানাতেন, এমন তথ্যও পেয়েছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। এমনকি এ ধরনের কর্মকর্তাদের তথ্য বা অস্বীকৃতি জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তাঁদের লেখা চিঠি সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছানো হতো বলে কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এমন এক ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরা হয় ৪ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে। গত সোমবার প্রকাশ করা তদন্ত কমিশন প্রতিবেদনের একটা অংশে গুমের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিষয়ে শেখ হাসিনাকে অবহিত করার বিষয়টিও রয়েছে।
এমন এক ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক দিন ধরে আটকে রাখা এক বন্দীকে হত্যা করার নির্দেশ পেয়েছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত এক কর্মকর্তা। কারণ, তাঁর এক সহকর্মীর অসতর্কতার কারণে ওই বন্দীর অবস্থান ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই কর্মকর্তা বেআইনি এই হত্যাকাণ্ডে জড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি নির্দেশদাতা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নাকি বলেছিলেন, ‘যদি ওনাকে মারতে হয়, তাহলে আমাকে এখানে থেকে সরিয়ে দিন, আমি মারব না।’ শেষ পর্যন্ত বন্দীকে হত্যা করা হয়নি এবং ওই কর্মকর্তা ৫ আগস্টের পরও চাকরিতে বহাল ছিলেন। এ দ্বারা বোঝা যায় বেআইনি আদেশ অমান্য করলেই তাৎক্ষণিক খারাপ পরিণতি হতো, এমন নয়।
আরও পড়ুন গুমের মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় দুই মাস বাড়ল১৬ ঘণ্টা আগেএ ঘটনাকে অনুসন্ধানে সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রতিবাদের ঘটনা উল্লেখ করে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি পুরোপুরি কাকতালীয়ভাবে উন্মোচিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক সহকর্মী ৫ আগস্টের পর গণভবনে পরিত্যক্ত কিছু নথিপত্র পর্যালোচনা করতে গিয়ে হাতে লেখা দুটি চিঠি আবিষ্কার করেন। ওই চিঠি দুটি র্যাবের দুজন কর্মকর্তা বেআইনি আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক বরাবর লেখা হয়েছিল।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এগুলো কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি ছিল না, বরং ব্যক্তিগত ঘোষণাপত্র ছিল। তবু স্পষ্টতই এগুলো শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তিনি চিঠিগুলো ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত নিজের ফাইলে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। চিঠিগুলোর একটিতে লেখা ছিল: ‘.
কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্টের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়ার প্রকাশ্য বক্তব্য থেকে জানা যায়, ওই কর্মকর্তারা দ্রুত একটি মিলিটারি পুলিশ চেকপোস্টে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যেখান থেকে তাঁদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং লক্ষণীয়ভাবে আদেশ অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ তাঁদের আদেশ অমান্য করার খবর তখনকার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক মহলেও পৌঁছে গিয়েছিল।
আরও পড়ুনগুমে নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরকার মতানৈক্য ও বিদেশি সংযোগ পেয়েছে কমিশন২৪ জুন ২০২৫তদন্ত কমিশন এই ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলেছে, জুনিয়র কর্মকর্তা দ্বারা রচিত এই হাতে লেখা চিরকুটগুলোর অস্তিত্ব এবং সেগুলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হওয়ার বিষয়টি তাঁর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধায়নের বিস্তৃতি ইঙ্গিত করে। প্রায় এক দশক ধরে এসব নথি সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্তটিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে ৫ আগস্টের পর ওই চিঠি বা চিরকুটগুলো আবিষ্কৃত হওয়া কেবল নিপীড়ন যন্ত্রের ক্ষুদ্রতম অংশের সঙ্গেও শেখ হাসিনার সক্রিয় জড়িত থাকার প্রমাণই দেয় না; বরং সীমিত এবং বিপৎসংকুল হলেও সর্বোচ্চ দমনমূলক পরিবেশেও যে অবৈধ আদেশ অস্বীকারের জন্য অল্প কিছু হলেও স্থান ছিল, কর্মকর্তাদের বিবেকবোধও যে পরিস্ফুটিত হতে পারত, এটিরও বিরল স্মারক হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুনগুমের ঘটনা সেনাবাহিনীর না জানার সুযোগ নেই১৯ জুন ২০২৫আওয়ামী লীগ দায় চাপাচ্ছে বাহিনীর ওপরগুমে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দিক তুলে ধরে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের আদেশ দেওয়ার সময় ডিজিএফআইতে যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁরা কার্যত সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ করে শেখ হাসিনা ও মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মধ্যবর্তী সংযোগকারীর ভূমিকায় ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব). আকবর হোসেন তদন্ত কমিশনকে জানান, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল বা জেআইসিতে বন্দী থাকা হুম্মাম কাদের চৌধুরীর (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে) বিষয়টি তিনি সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
ডিজিএফআইতে কর্মরত একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তাও কমিশনকে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর পরিচালককে এক বন্দীর ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুনেছিলেন, যাতে স্পষ্ট ছিল শেখ হাসিনা ওই বন্দী সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং এ বিষয়ে নিজস্ব মতও দিয়েছিলেন। মন্তব্যটি যে রকম সহজ ভঙ্গিতে করা হয়েছিল তা ইঙ্গিত করে, যেসব ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতো, প্রতিষ্ঠানের ভেতরে সেসব ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে কমিশন বলছে, এসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাই বেসামরিক আদেশদাতাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বাস্তবায়ন কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে অবস্থান করতেন। এটি স্পষ্ট যে এ ধরনের ঘটনা নিরাপত্তা বাহিনীর নিজস্ব কাঠামো থেকে নয়; বরং রাজনৈতিক আদেশের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে গুমের ঘটনা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এসেছে। বারবার বিকল্প ব্যাখ্যা দিয়েছে, যেমন গুম হওয়া ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছেন বা অপরাধে জড়িত ছিলেন। তবে শেখ হাসিনার নির্দেশের দায় প্রমাণ করতে পারে এমন সাক্ষ্যদাতারা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের অবস্থান নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
আরও পড়ুনগুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল১৯ জুন ২০২৫আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৬ এপ্রিল আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত আবারও প্রকাশ্যে দল বা এর নেতৃত্বের কোনো ভূমিকার কথা অস্বীকার করেন। তবে এবার তিনি দাবি করেন, তাঁদের শাসনামলে বলপূর্বক গুমের ঘটনা যদি কিছু ঘটে থাকে, তা শুধু সামরিক বাহিনীর নিজস্ব উদ্যোগে ঘটতে পারে। এ ধরনের কাজ শেখ হাসিনা বা তাঁর মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের নির্দেশনায় করা হয়নি।
অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনাগুলোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে বয়ান তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে সামরিক বাহিনীকেই একমাত্র দোষী হিসেবে চিহ্নিত করছে; যা একদিকে অসত্য, অন্যদিকে বেসামরিক নেতৃত্বের দায় সম্পূর্ণরূপে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে একটি আরও উদ্বেগজনক নতুন ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যেসব ব্যক্তি শুরুতে গুমের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, যাঁদের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তাঁরা এমন অপরাধে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁরাও এখন একধরনের দ্বিতীয় স্তরের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে বৈধ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল, তাঁদের পলায়নে সহায়তা করে এই ব্যক্তিরা নতুন করে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন।
আরও পড়ুনঅনেক অপরাধী ক্ষমতার আসনে১৮ জুন ২০২৫বন্দিশালায় কর্মরতদের ওপর নজরদারিগুমসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে এমন সাত কর্মকর্তার বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার নথিপত্র পর্যালোচনা করেছে গুম–সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনাগুলোর প্রকৃতি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে এগুলো একক ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন কাজ ছিল না; বরং প্রতিটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ইউনিটের একাধিক সদস্যের অংশগ্রহণ ছিল, যা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অজান্তে হওয়া
প্রায় অসম্ভব। এসব ইউনিটে গোয়েন্দা সংস্থার নিজস্ব সদস্যরা নিয়মিতভাবে নিযুক্ত থাকতেন, যাঁদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল সহকর্মীদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে ঊর্ধ্বতনদের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া। তবে ওই সব নথিপত্রে কোথাও ‘গুম’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি।
কমিশন যে নথিগুলো পর্যালোচনা করেছে, সেখানে অত্যন্ত যত্নসহকারে গুমের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা লিপিবদ্ধ ছিল। এমনকি তাঁদের বিস্তৃত আত্মীয়–পরিজন, এমনকি স্ত্রীর খালার রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত নথিতে উল্লেখ ছিল। পাশাপাশি ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ, যেমন দুর্নীতি, শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অসদাচরণের কথাও উল্লেখ ছিল। তবে নথিতে গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের কোনো উল্লেখ করত না।
আরও পড়ুনগুম করা হতো তিনটি ধাপে ১৫ জুন ২০২৫প্রশ্ন তুললে ক্ষতির মুখে পড়তে হতোঅন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে গুম, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কিংবা প্রতিষ্ঠানগত জবাবদিহির মতো বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। যেসব সদস্য এই প্রশ্ন তুলেছিলেন বা ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন, তাঁদের প্রায় ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।
বয়স চল্লিশের কোঠায় একজন কর্মকর্তা তদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, গুম বিষয়ে তিনি নিজস্ব মত প্রকাশ করেন এবং তৎকালীন সরকার নির্ধারিত অবস্থান মেনে চলেনি। এ জন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তিনি কমিশনকে বলেন, প্রতিটি নতুন পোস্টিংয়ের (পদায়ন) আগে তাঁর নতুন কর্মস্থলের সহকর্মীদের সতর্ক করে দেওয়া হতো, যাতে তাঁকে বিশ্বাস না করা হয়। এমনকি তাঁর পারিবারিক যোগাযোগের ওপর নজরদারি করা হতো। তাঁর বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ আনা হতো। যদিও তিনি কখনো কোনো ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গ করেননি। তারপরও তথাকথিত অভ্যন্তরীণ তদন্ত এবং নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিলকরণের মতো প্রশাসনিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাঁর পেশাগত অগ্রগতি নষ্ট করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুনগুমের ঘটনায় প্রধান ভূমিকা পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও সিটিটিসির০৫ জুন ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ৫ আগস ট র পর কর মকর ত দ র গ ম র ঘটন য় ন কর মকর ত র জন ত ক অবস থ ন তৎক ল ন সহকর ম পর চ ল হয় ছ ল প রক শ আওয় ম সদস য অপর ধ ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
সেরা প্রধান শিক্ষিকা শিক্ষক হয়ে ওঠার কারিগর বাবা
সরকারি ভালো চাকরি পেলেও বাবা করতে দেননি। শিক্ষক হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তাঁর থেকে পেয়েছি। শিক্ষাজীবনে এমন কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছি, যারা আমাকে শিখিয়েছেন– সফলতা পেতে হলে সব সময় সৎ, কর্মঠ ও প্রগতিশীল মানুষ হতে হবে। এসব ভালো মানুষের আশীর্বাদ দেশসেরা হতে সহায়তা করেছে।
কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের সাবর্ডিনেট কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শিউলি সুলতানা। তিনি সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ক্যাটেগরিতে প্রথম হয়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, একই স্কুলড্রেসে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছে। শিক্ষকরাও পরেছেন অ্যাপ্রোন। পরিপাটি শ্রেণিকক্ষ। পড়ার উপকরণের অভাব নেই। বিদ্যালয় মাঠের কোনায় ফুলের বাগান। সুন্দর খেলার মাঠ। প্রধান শিক্ষকের কক্ষের শোভা বাড়িয়েছে সিটিজেন চার্টার ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।
শিউলি বাংলাদেশ ডাকবিভাগে উচ্চ পদে চাকরি পান। তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা আব্বাস আলী চেয়েছেন, তাঁর মেয়ে শিক্ষক হোক। এজন্য যোগদান করতে দেননি। ২০০৭ সালে বাবার ইচ্ছাপূরণ হয়। শিউলি জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ দুরাকুঠি বাহাগিলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। পরে ২০০৯ সালে বদলি হয়ে আসেন সাবর্ডিনেট কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
গত ১০ মে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে শিউলিকে জাতীয় শিক্ষাপদক দেওয়া হয়। তবে গর্বের পদকটি বাবার হাতে তুলে দিতে পারেননি তিনি।
পদকটি নিয়ে ট্রেনে করে রাজধানী থেকে গ্রামের বাড়ি নওগাঁর আত্রাইয়ের শাহাগোলায় ফিরছিলেন শিউলি। জয়দেবপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে তাঁর ৮৫ বছর বয়সী বাবার মৃত্যুর সংবাদ পান। বাবার দাফনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সম্প্রতি শিউলি ফিরেছেন প্রিয় কর্মস্থলে।
সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা সংবর্ধনার প্রস্তুতি নিলেও শিউলির অনুরোধে তা বাতিল করা হয়। তবে আগেই তারা বাবার মৃত্যুতে সমবেদনার পাশাপাশি দেশসেরা হওয়ায় ফোন করে ও এসএমএস পাঠিয়েছেন।
শিক্ষকতাকে শিউলি চাকরি নয়, ব্রত মনে করেন। শিক্ষক তাঁর ছাত্রের কাছের বন্ধু, তাঁর জীবনের দর্শন এমনকি পরিচালকও। ফলে শিক্ষককে চিন্তাচেতনা ও নৈতিকতায় সেভাবে গড়ে উঠতে হয়। শিউলি মনে করেন, বর্তমানে শিক্ষকরা এ দর্শন থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। আবার শাসনের পরিমাণও অনেক কমে গেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক স্খলনের প্রবণতা বেশি। পরিস্থিতির উত্তরণ এবং সুন্দর সমাজ গঠনে অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশসেরা সাফল্যের বিষয়ে শিউলি সুলতানা জানান, পেশাদারিত্বে তিনি কোনো আপস করেন না। ফজর নামাজের পর থেকে শুরু করেন দিনের কর্মসূচি। শিক্ষার্থীদের আজ নতুন কী শিখাবেন, সে চিন্তা থেকে অন্তত একটি ভিডিও কনটেন্ট বানান। তাঁর মৌলিক পাঁচ শতাধিক শ্রেণি পাঠদানের কনটেন্ট রয়েছে।
স্কুলে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম তদারকির পর দাপ্তরিক কাজ করেন। ক্লাস শুরুর আগে সহকর্মী শিক্ষকদের নিয়ে সারাদিনের পাঠদানের পরিকল্পনা ঠিক করেন। সহকারী শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন কিনা, তা তদারকি করেন। দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা পাঠদানের ব্যবস্থা করেন। এমনকি বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন শিক্ষার্থীর। অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও সমাজের দক্ষ মানুষের পরামর্শ নিয়ে স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনা করে সফলতা পেয়েছেন বলে জানান শিউলি।
সৈয়দপুরের সাবর্ডিনেট কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৪০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। অবকাঠামো সংকটের কারণে গত তিন বছর তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সৈয়দপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল আলম জানান, শিউলি সুলতানা মেধাবী ও সৃজনশীল প্রধান শিক্ষিকা। দেশসেরা হতে যেসব সূচক প্রয়োজন, সবই অর্জন করেছেন তিনি।