গুমে রাজি না হওয়া কর্মকর্তাদের তথ্যও যেত শেখ হাসিনার কাছে
Published: 25th, June 2025 GMT
গুম–খুনের ঘটনায় জড়াতে কোনো কোনো কর্মকর্তা যে অস্বীকৃতি জানাতেন, এমন তথ্যও পেয়েছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। এমনকি এ ধরনের কর্মকর্তাদের তথ্য বা অস্বীকৃতি জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তাঁদের লেখা চিঠি সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছানো হতো বলে কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এমন এক ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরা হয় ৪ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে। গত সোমবার প্রকাশ করা তদন্ত কমিশন প্রতিবেদনের একটা অংশে গুমের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিষয়ে শেখ হাসিনাকে অবহিত করার বিষয়টিও রয়েছে।
এমন এক ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক দিন ধরে আটকে রাখা এক বন্দীকে হত্যা করার নির্দেশ পেয়েছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত এক কর্মকর্তা। কারণ, তাঁর এক সহকর্মীর অসতর্কতার কারণে ওই বন্দীর অবস্থান ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই কর্মকর্তা বেআইনি এই হত্যাকাণ্ডে জড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি নির্দেশদাতা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নাকি বলেছিলেন, ‘যদি ওনাকে মারতে হয়, তাহলে আমাকে এখানে থেকে সরিয়ে দিন, আমি মারব না।’ শেষ পর্যন্ত বন্দীকে হত্যা করা হয়নি এবং ওই কর্মকর্তা ৫ আগস্টের পরও চাকরিতে বহাল ছিলেন। এ দ্বারা বোঝা যায় বেআইনি আদেশ অমান্য করলেই তাৎক্ষণিক খারাপ পরিণতি হতো, এমন নয়।
আরও পড়ুন গুমের মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় দুই মাস বাড়ল১৬ ঘণ্টা আগেএ ঘটনাকে অনুসন্ধানে সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রতিবাদের ঘটনা উল্লেখ করে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি পুরোপুরি কাকতালীয়ভাবে উন্মোচিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক সহকর্মী ৫ আগস্টের পর গণভবনে পরিত্যক্ত কিছু নথিপত্র পর্যালোচনা করতে গিয়ে হাতে লেখা দুটি চিঠি আবিষ্কার করেন। ওই চিঠি দুটি র্যাবের দুজন কর্মকর্তা বেআইনি আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক বরাবর লেখা হয়েছিল।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এগুলো কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি ছিল না, বরং ব্যক্তিগত ঘোষণাপত্র ছিল। তবু স্পষ্টতই এগুলো শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তিনি চিঠিগুলো ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত নিজের ফাইলে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। চিঠিগুলোর একটিতে লেখা ছিল: ‘.
কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্টের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়ার প্রকাশ্য বক্তব্য থেকে জানা যায়, ওই কর্মকর্তারা দ্রুত একটি মিলিটারি পুলিশ চেকপোস্টে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যেখান থেকে তাঁদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং লক্ষণীয়ভাবে আদেশ অমান্য করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ তাঁদের আদেশ অমান্য করার খবর তখনকার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক মহলেও পৌঁছে গিয়েছিল।
আরও পড়ুনগুমে নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরকার মতানৈক্য ও বিদেশি সংযোগ পেয়েছে কমিশন২৪ জুন ২০২৫তদন্ত কমিশন এই ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলেছে, জুনিয়র কর্মকর্তা দ্বারা রচিত এই হাতে লেখা চিরকুটগুলোর অস্তিত্ব এবং সেগুলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হওয়ার বিষয়টি তাঁর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধায়নের বিস্তৃতি ইঙ্গিত করে। প্রায় এক দশক ধরে এসব নথি সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্তটিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে ৫ আগস্টের পর ওই চিঠি বা চিরকুটগুলো আবিষ্কৃত হওয়া কেবল নিপীড়ন যন্ত্রের ক্ষুদ্রতম অংশের সঙ্গেও শেখ হাসিনার সক্রিয় জড়িত থাকার প্রমাণই দেয় না; বরং সীমিত এবং বিপৎসংকুল হলেও সর্বোচ্চ দমনমূলক পরিবেশেও যে অবৈধ আদেশ অস্বীকারের জন্য অল্প কিছু হলেও স্থান ছিল, কর্মকর্তাদের বিবেকবোধও যে পরিস্ফুটিত হতে পারত, এটিরও বিরল স্মারক হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুনগুমের ঘটনা সেনাবাহিনীর না জানার সুযোগ নেই১৯ জুন ২০২৫আওয়ামী লীগ দায় চাপাচ্ছে বাহিনীর ওপরগুমে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দিক তুলে ধরে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের আদেশ দেওয়ার সময় ডিজিএফআইতে যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁরা কার্যত সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ করে শেখ হাসিনা ও মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মধ্যবর্তী সংযোগকারীর ভূমিকায় ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব). আকবর হোসেন তদন্ত কমিশনকে জানান, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল বা জেআইসিতে বন্দী থাকা হুম্মাম কাদের চৌধুরীর (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে) বিষয়টি তিনি সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
ডিজিএফআইতে কর্মরত একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তাও কমিশনকে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর পরিচালককে এক বন্দীর ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনভাবে কথা বলতে শুনেছিলেন, যাতে স্পষ্ট ছিল শেখ হাসিনা ওই বন্দী সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং এ বিষয়ে নিজস্ব মতও দিয়েছিলেন। মন্তব্যটি যে রকম সহজ ভঙ্গিতে করা হয়েছিল তা ইঙ্গিত করে, যেসব ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ মনে হতো, প্রতিষ্ঠানের ভেতরে সেসব ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে কমিশন বলছে, এসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাই বেসামরিক আদেশদাতাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বাস্তবায়ন কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে অবস্থান করতেন। এটি স্পষ্ট যে এ ধরনের ঘটনা নিরাপত্তা বাহিনীর নিজস্ব কাঠামো থেকে নয়; বরং রাজনৈতিক আদেশের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে। বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে গুমের ঘটনা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এসেছে। বারবার বিকল্প ব্যাখ্যা দিয়েছে, যেমন গুম হওয়া ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছেন বা অপরাধে জড়িত ছিলেন। তবে শেখ হাসিনার নির্দেশের দায় প্রমাণ করতে পারে এমন সাক্ষ্যদাতারা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের অবস্থান নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
আরও পড়ুনগুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল১৯ জুন ২০২৫আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৬ এপ্রিল আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত আবারও প্রকাশ্যে দল বা এর নেতৃত্বের কোনো ভূমিকার কথা অস্বীকার করেন। তবে এবার তিনি দাবি করেন, তাঁদের শাসনামলে বলপূর্বক গুমের ঘটনা যদি কিছু ঘটে থাকে, তা শুধু সামরিক বাহিনীর নিজস্ব উদ্যোগে ঘটতে পারে। এ ধরনের কাজ শেখ হাসিনা বা তাঁর মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের নির্দেশনায় করা হয়নি।
অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনাগুলোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে বয়ান তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে সামরিক বাহিনীকেই একমাত্র দোষী হিসেবে চিহ্নিত করছে; যা একদিকে অসত্য, অন্যদিকে বেসামরিক নেতৃত্বের দায় সম্পূর্ণরূপে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে একটি আরও উদ্বেগজনক নতুন ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যেসব ব্যক্তি শুরুতে গুমের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, যাঁদের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তাঁরা এমন অপরাধে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁরাও এখন একধরনের দ্বিতীয় স্তরের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে বৈধ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল, তাঁদের পলায়নে সহায়তা করে এই ব্যক্তিরা নতুন করে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন।
আরও পড়ুনঅনেক অপরাধী ক্ষমতার আসনে১৮ জুন ২০২৫বন্দিশালায় কর্মরতদের ওপর নজরদারিগুমসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে এমন সাত কর্মকর্তার বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার নথিপত্র পর্যালোচনা করেছে গুম–সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনাগুলোর প্রকৃতি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে এগুলো একক ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন কাজ ছিল না; বরং প্রতিটি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ইউনিটের একাধিক সদস্যের অংশগ্রহণ ছিল, যা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অজান্তে হওয়া
প্রায় অসম্ভব। এসব ইউনিটে গোয়েন্দা সংস্থার নিজস্ব সদস্যরা নিয়মিতভাবে নিযুক্ত থাকতেন, যাঁদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল সহকর্মীদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে ঊর্ধ্বতনদের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া। তবে ওই সব নথিপত্রে কোথাও ‘গুম’ শব্দটি উল্লেখ করা হয়নি।
কমিশন যে নথিগুলো পর্যালোচনা করেছে, সেখানে অত্যন্ত যত্নসহকারে গুমের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা লিপিবদ্ধ ছিল। এমনকি তাঁদের বিস্তৃত আত্মীয়–পরিজন, এমনকি স্ত্রীর খালার রাজনৈতিক পরিচয় পর্যন্ত নথিতে উল্লেখ ছিল। পাশাপাশি ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ, যেমন দুর্নীতি, শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অসদাচরণের কথাও উল্লেখ ছিল। তবে নথিতে গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের কোনো উল্লেখ করত না।
আরও পড়ুনগুম করা হতো তিনটি ধাপে ১৫ জুন ২০২৫প্রশ্ন তুললে ক্ষতির মুখে পড়তে হতোঅন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে গুম, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কিংবা প্রতিষ্ঠানগত জবাবদিহির মতো বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। যেসব সদস্য এই প্রশ্ন তুলেছিলেন বা ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন, তাঁদের প্রায় ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে।
বয়স চল্লিশের কোঠায় একজন কর্মকর্তা তদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, গুম বিষয়ে তিনি নিজস্ব মত প্রকাশ করেন এবং তৎকালীন সরকার নির্ধারিত অবস্থান মেনে চলেনি। এ জন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তিনি কমিশনকে বলেন, প্রতিটি নতুন পোস্টিংয়ের (পদায়ন) আগে তাঁর নতুন কর্মস্থলের সহকর্মীদের সতর্ক করে দেওয়া হতো, যাতে তাঁকে বিশ্বাস না করা হয়। এমনকি তাঁর পারিবারিক যোগাযোগের ওপর নজরদারি করা হতো। তাঁর বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ আনা হতো। যদিও তিনি কখনো কোনো ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গ করেননি। তারপরও তথাকথিত অভ্যন্তরীণ তদন্ত এবং নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিলকরণের মতো প্রশাসনিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাঁর পেশাগত অগ্রগতি নষ্ট করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুনগুমের ঘটনায় প্রধান ভূমিকা পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও সিটিটিসির০৫ জুন ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ৫ আগস ট র পর কর মকর ত দ র গ ম র ঘটন য় ন কর মকর ত র জন ত ক অবস থ ন তৎক ল ন সহকর ম পর চ ল হয় ছ ল প রক শ আওয় ম সদস য অপর ধ ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
বাঙালি মুসলমান চিন্তার মেরুকরণ
কিস্তি: ১
১৯২০ সালের কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহ্মদ যখন এ কে ফজলুল হকের কাছে পত্রিকা করার নিয়ত নিয়ে সলা-পরামর্শ করতে গেলেন, হক চাইলেন পত্রিকার নামটি হোক মুসলমানি শব্দে। ‘হিন্দুরা তোমাদের কাগজ কিনবেন না। পক্ষান্তরে মুসলমানরাও বুঝতে পারবেন না যে কাগজখানা মুসলমানদের।’ মুজফ্ফর ও নজরুলের বুঝ ছিল ভিন্ন। তাঁরা পত্রিকার নামে আলাদা করে মুসলমানি চিহ্ন প্রকটিত না করে, এমন নাম দিতে চাইলেন যেন দুই সম্প্রদায়ের গ্রাহকই পত্রিকা কেনেন। অগত্যা পত্রিকার নাম হলো ‘নবযুগ’।
এভাবে ১৯২০ সালে নবযুগপত্রিকা শুরু হলো এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে। এই পত্রিকা চালুর আলোচনায় মুজফ্ফর ও নজরুল বাদেও ছিলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোজাম্মেল হক, নবনূর পত্রিকার সাবেক ম্যানেজার উমেদ আলী মিয়া, নূর লাইব্রেরির মালিক মঈনুদ্দীন হুসয়ন, সিলেট নিবাসী ফযলুল হক সেলবর্সী প্রমুখ। পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যুক্ত হলেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী; অর্থাৎ নজরুলের সাংবাদিক–জীবনের প্রথম দুই সহকর্মী হলেন মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। খুবই চিত্তাকর্ষক এই সমাবেশ? কেন? সেটাই এই লেখার প্রতিপাদ্য। এই তিনজনের মধ্যে দুজন কীভাবে বামে চলে গেলেন আর অন্যজন গেলেন ডানে এবং দ্বন্দ্ব উঠল ঘনিয়ে, সে গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।
বিশ শতকের শুরুর দিকে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রবল নড়াচড়া শুরু হয়। উপনিবেশি-আধুনিক শিক্ষায় বিপুল সংখ্যায় শরিক হয় তারা। নতুন ধরনের যে শাসন সংশ্রয়; অর্থাৎ কলোনিয়াল প্রশাসন, মুদ্রণমাধ্যম ও লোকজমায়েত—তাতে তারা শামিল হয়। আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার আল-এসলাম (১৯১৪-১৯১৯), নাসিরউদ্দীনের মাসিকসওগাত আর ত্রৈমাসিকবঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার মতো পত্রিকা নতুন ধরনের মধ্যস্থতা বা মেডিয়েশন সম্ভব করল। আরও এল ‘মোসলেম ভারত’, ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘মোসলেম’, ‘মোহম্মদী’ ইত্যাদি। মতামত ও চিন্তার এই বিপুল উৎপাদন ও সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গেই এই সমাজের ভেতর নানা প্রবণতা আলাদা হয়ে প্রকটিত হলো। ভেদরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।
১৯২০ সালে নবযুগপত্রিকা শুরু হলো এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে। পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যুক্ত হলেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী; অর্থাৎ নজরুলের সাংবাদিক–জীবনের প্রথম দুই সহকর্মী হলেন মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। এই তিনজনের মধ্যে দুজন কীভাবে বামে চলে গেলেন আর অন্যজন গেলেন ডানে এবং দ্বন্দ্ব উঠল ঘনিয়ে, সে গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।বর্তমান লেখার চলতি অনুমান হলো, পশ্চিমকেন্দ্রিক আধুনিক দুনিয়ায় ফরাসি বিপ্লবের সিলসিলায় ভাবাদর্শিক দুই মেরু হিসেবে যে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী ভাগ করা হয়, সেটা বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রথম স্পষ্ট হয় বিশের দশকে। বাম-ডানের এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতা বুঝতে ১৯২০ সালের নবযুগপত্রিকার দুই তরুণ সহকর্মী কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ও ফযলুল হক সেলবর্সী (১৮৯৫-১৯৬৮)—এই দুজনকে নিয়ে সংক্ষেপে এ প্রবন্ধের আলাপ। ১৯২০ সালে যখন দুজনে সহকর্মী হলেন, একজনের বয়স ২৫, আরেকজনের ২১। কলকাতার বুকে কর্মরত এই দুই তরুণ বুদ্ধিজীবীর নিয়ত ও নিয়তিতে পরের ১০ বছর যে মেরুকরণ ঘটে, তার হদিস নিলে বাঙালি মুসলমান সমাজে উদীয়মান ভাবাদর্শিক মেরুকরণের কুলুজিটা ভালোই বোঝা যাবে।
নজরুল আর সেলবর্সী—এ দুজনের মধ্যে তুলনা হয় না, আবার হয়ও। নজরুল বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম প্রধান চরিত্র। আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের অনুভবিক আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে সেলবর্সীকে ‘খ্যাতনামা মুজাহিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন উত্তরকালের এক লেখায় মুহম্মদ এনামুল হক। মূলধারার আধুনিক জাতীয় ইতিহাসে সেলবর্সী প্রায় বিস্মৃত চরিত্র। তবু উপনিবেশি বাস্তবতায় বাঙালি মুসলমান সমাজে আধুনিক সংশ্রয়ের উন্মেষে এই দুই ‘সাংবাদিক’ যুক্ত ও শরিক ছিলেন। দুটি পরস্পরবিরোধী প্রবণতার স্বর হিসেবে তাঁদের তুলনা করলে সেকালের সামাজিক মুখর বাহাসের পরিচয় পাওয়া যায়, তাই এই বিসদৃশ তুলনা।
তুর্কি-আফগান সমাচারকৃষক অধ্যুষিত বাঙালি মুসলমান সমাজে উনিশ শতকের ফরায়েজি, তরিকায়ে মুহম্মদিয়া ইত্যাদি আন্দোলনের ফলে এই সমাজের বিশ্ববীক্ষা প্রসারিত হয়েছিল। বিশ শতকে এসে প্রথম মহাযুদ্ধ ও খেলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সমাজের উদীয়মান মধ্যবিত্ত অংশের চিন্তা ও তৎপরতার একটা নতুন পর্যায় শুরু হয়। উপনিবেশি সংশ্রয়ে ভদ্রলোক হিসেবে নিজের সংস্থান করা এবং প্রাধান্যশীল হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের সঙ্গে অনুকরণ, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা—এই ত্রিবিধ সম্পর্কে যুক্ত হয়ে যে বিম্ব-বিড়ম্বনার (মাইমেটিক কনফ্লিক্ট) জন্ম হলো, তা থেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজে স্বাতন্ত্র্যের বোধ প্রবলতর হলো। এই সময়ে মুসলমান সমাজের বিশ্ববীক্ষার কল্পিত ভূগোলে দুটি অঞ্চলের স্থান উল্লেখযোগ্য: তুরস্ক ও আফগানিস্তান। বাংলা, তথা উপমহাদেশে মুসলমান রাজবংশগুলো জাতিগতভাবে তুর্কি ও আফগান বলেই বিবেচিত। ফলে কাকতাল নয় যে নজরুল ও সেলবর্সী নিয়ে আমাদের আলাপের সূচনাও তুরস্ক ও আফগানিস্তানকে ঘিরে।
নজরুল বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম প্রধান চরিত্র। আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের অনুভবিক আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে সেলবর্সীকে ‘খ্যাতনামা মুজাহিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন উত্তরকালের এক লেখায় মুহম্মদ এনামুল হক। মূলধারার আধুনিক জাতীয় ইতিহাসে সেলবর্সী প্রায় বিস্মৃত চরিত্র।ফযলুল হক সেলবর্সী (১৮৯৫-১৯৬৮)