পাকিস্তানকে ৩৪০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চীন
Published: 29th, June 2025 GMT
পাকিস্তানকে ৩৪০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ঋণ দিয়েছে চীন। রবিবার পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।
চীনের এই ঋণদানের ফলে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ১৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, বেইজিং ২১০ কোটিন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছিল। এই অর্থ গত তিন বছর ধরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে রয়েছে এবং আরো ১৩০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক ঋণ পুনঃঅর্থায়ন করেছে, যা ইসলামাবাদ দুই মাস আগে পরিশোধ করেছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে আরো ১০০ কোটি ডলার এবং বহুপাক্ষিক অর্থায়ন থেকে ৫০ কোটি ডলারও পাওয়া গেছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, “এটি আমাদের রিজার্ভকে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছে।”
ঋণ, বিশেষ করে চীনা ঋণ, পাকিস্তানের নিম্ন বৈদেশিক রিজার্ভ বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা আইএমএফ চলতি অর্থবছরের শেষে ৩০ জুন ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি হওয়া প্রয়োজন ছিল।
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৭ বিলিয়ন ডলারের আইএমএফ বেলআউটের আওতায় চলমান সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়েছে।
ঢাকা/শাহেদ
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্বল+দুর্বল=আরও দুর্বল, নাকি সবল ব্যাংক
শূন্য আর শূন্য যোগ করলে শূন্যই হয়। আবার দুই শূন্য মিললে যে শূন্যই হয়—এরশাদের সময় এ কথাটি অশ্লীল উপায়ে জনপ্রিয় করেছিলেন রাজনীতিবিদ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। এবার কথাটি অর্থনীতিতে প্রয়োগ করা যাক। যেমন দুর্বল+দুর্বল=আরও দুর্বল।
এটি মূলত ব্যাংক একীভূত ও একত্রীকরণ (মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজেশন) নিয়ে একটি গবেষণার ফলাফল। ১৯৯৭-৯৮ সালের পূর্ব এশীয় অর্থনৈতিক সংকটের সময় দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূত করার নীতি আসলে কতটা কার্যকর ছিল, তা নিয়েই গবেষণাটি করেছিলেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসরের অ্যাকাউন্টিংয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মাইকেল এস শিহ। গবেষণাটি দ্য কোয়ার্টারলি রিভিউ অব ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্স নামের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক শিহ ১৯৯৬-২০০১ সময়ে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডের ৫০টির বেশি ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, যখন দুই ব্যাংকের দেউলিয়া ঝুঁকি ৫০ শতাংশের বেশি, তখন তারা একীভূত হলে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। অর্থাৎ দুই দুর্বল ব্যাংক মানেই হলো আরও দুর্বল ব্যাংক। একটি অসুস্থ ব্যাংক আরেকটি অসুস্থ ব্যাংকের হাতে সুস্থ হতে পারে না।
আরও দেখা গেছে, জোর করে মার্জার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াতে পারেনি; বরং এতে অনেক সময় নতুন করে অদক্ষ ব্যাংক তৈরি হয়েছে। তবে একটি ভালো ব্যাংকের সঙ্গে আরেকটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার ফল কিছুটা ভালো হয়েছিল।
খেলাপি ঋণ যখন ৭৭ শতাংশবাংলাদেশ পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে একটি বড় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এই পাঁচ ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা বা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ।
এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটির ৯৬, গ্লোবাল ইসলামীর ৯৫, সোশ্যাল ইসলামীতে ৬২ ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৮ শতাংশ। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব ব্যাংকের টিকে থাকার কোনো কারণ নেই। তবে বন্ধ করে দেওয়াও সমাধান নয়। কারণ, পাঁচ ব্যাংকের আমানতই আছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। এই আমানতের দায় অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে।
► একীভূত নতুন ব্যাংক চালাবে সরকার। তবে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। এর আগপর্যন্ত ব্যাংকটি ঠিকঠাকমতো চালাতে হবে। ► দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে সফল হওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ, ব্যয়বহুল; প্রয়োজন সঠিক তদারকি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং শেষ পর্যন্ত ভালো বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করা। ► ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী সবকিছু চলবে বলা হলেও সরকারি মালিকানাধীন একটি বড় ব্যাংক হবে, আর সেখানে প্রভাবশালীরা সুবিধা নেবেন না, তা কি আর হয়!ব্যাংক একীভূত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। সরকারই বলেছে, একীভূত নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা, আর পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধনে রূপান্তর করা হবে। বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা সরকার দেবে। অর্থাৎ জনগণের করের টাকা দিতে হবে। ভবিষ্যতে আমানতকারীরা তাঁদের অর্থ ফেরত পাবেন, কিন্তু সাধারণ শেয়ারধারীরা কিছুই পাবেন না।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, পাঁচ দুর্বল ব্যাংক মিলে আরেকটি বড় দুর্বল ব্যাংক হবে, নাকি সফল হবে সরকারের পরিকল্পনা?
একটু ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করা যাকপূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় মূলত একটি বড়, ভালো বা সুস্থ ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত করা হয়েছিল। অনেকগুলো বন্ধও করে দেওয়া হয়। সব দেশই তখন ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য আলাদা তিনটি সংস্থা গঠন করেছিল। এর মধ্যে একটি ব্যাংক পুনর্গঠন করার জন্য, ব্যাংকের খারাপ ঋণ কিনে তা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি এবং আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আরেকটি সংস্থা।
১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়া ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য ইন্দোনেশিয়ান ব্যাংক রিস্ট্রাকচারিং এজেন্সি (আইবিআরএ) গঠন করেছিল। এ সময় ৭০টির বেশি ব্যাংক বন্ধ হয়, আর ৪টি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একীভূত হয়ে তৈরি হয় ‘ব্যাংক মানদিরি’ নামে একটি বড় ব্যাংক। একীভূত করার সময় লোকবল কমাতে হয়েছিল, অনেক শাখাও বন্ধ করা হয়।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর খারাপ সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য আইবিআরএ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট নামে আলাদা আরেকটি সংস্থা এবং আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে ২০০৫ সালে গঠন করা হয় ‘ইন্দোনেশিয়া ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন’ নামে আরেকটি সংস্থা।
আরও পড়ুনকেন্দ্রীয় ব্যাংক কি সত্যিই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে১২ নভেম্বর ২০২৫থাইল্যান্ড শুরুতেই ৫৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। ব্যাংক পুনর্গঠন করতে তৈরি করা হয় ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর রিস্ট্রাকচারিং অথরিটি (এফএসআরএ)। খারাপ ঋণ কিনে নিতে গঠন করা হয় ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন (এফআইএএমসি)। এফএসআরএ বিস্তারিত পরীক্ষা করে মাত্র দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আবার চালু করার অনুমোদন দিয়েছিল।
মালয়েশিয়া নিয়েছিল আরও বড় পদক্ষেপ। দেশটি দানা মদাল ন্যাশনাল বেরহাদ নামের প্রতিষ্ঠান গঠন করে। তারা ৫৮টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করে ১০টি বড় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ জন্য দানা হার্তা ন্যাশনাল বেরহাদ নামের আরেকটি সংস্থা তৈরি করা হয়। এই সংস্থা খারাপ ঋণ কিনে নিয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ উদ্ধার করেছিল। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে তৈরি করা হয় মালয়েশিয়া ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (পিআইডিএম)।
দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৯৮ সালে গঠন করে ফিন্যান্সিয়াল সুপারভাইজরি কমিশন (এফএসসি)। তারা ১৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৫টি বন্ধ করে দেয়, একীভূত করে ১০টির বেশি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য গঠন করা হয় কোরিয়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন (কেএএমসিও)। এরপর আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় কোরিয়া ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (কেডিআইসি) নামে আরেকটি সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়।
সংকটের সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই চার দেশের মধ্যে কেবল মালয়েশিয়া আইএমএফের ঋণ নেয়নি। আর ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে সবচেয়ে সফল ছিল মালয়েশিয়া ও কোরিয়া। তবে লোকবল কমানোর কারণে প্রায় সব দেশেই বড় ধরনের অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, যা পুরোপুরি সামাল দেওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে তদারকি ব্যবস্থা সবচেয়ে দুর্বল। আবার সরকারি ব্যাংক পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা এখানে সামান্য। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী সবকিছু চলবে বলা হলেও সরকারি মালিকানাধীন একটি বড় ব্যাংক হবে, আর সেখানে প্রভাবশালীরা সুবিধা নেবেন না, তা কি আর হয়! কাজটি সহজ নয়একাধিক দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার উদাহরণ যে নেই তা নয়, তবে সবার অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। স্পেন ২০১০ সালে কাইসা গালিসিয়া ও কাইসানোভা নামের দুটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করেছিল। এ জন্য সরকারকে বড় অঙ্কের মূলধন দিতে হয়। চালাতে না পারায় এক বছর পরেই সেই ব্যাংক জাতীয়করণ করতে হয়। পরে বিক্রি করে দেওয়া হয় বেসরকারি খাতে। কয়েক হাত ঘুরে এই এখন আবানকা করপোরাসিওন ব্যাংকারিয়া নামে বেসরকারি খাতে পরিচালিত হচ্ছে।
ওটক্রিতিয়ে ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংকের একটি। ২০১৭ সালে ব্যাংকটি চরম আর্থিক সংকটে পড়লে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওটক্রিতিয়ের অধিকাংশ শেয়ার নিজের হাতে নিয়ে প্রায় পাঁচ শ বিলিয়ন রুবল মূলধন সহায়তা দেয়। পরে আলাদা একটি সংস্থা গঠন করে তাদের হাতে খারাপ ঋণ দেওয়া হয়। ২০২২ সালে রাষ্ট্রীয় ভিটিবি ব্যাংকের কাছে ওটক্রিতিয়ে বিক্রি করা হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যাংকটিকে বাঁচাতে পারলেও সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে সফল হওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ, ব্যয়বহুল; প্রয়োজন সঠিক তদারকি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং শেষ পর্যন্ত ভালো বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করা।
আইএমএফের সতর্কবার্তাআন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০০৪ সালে ব্যাংকিং সংকট ব্যবস্থাপনা নামে একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সে সময়ে আর্জেন্টিনা, রাশিয়া, তুরস্ক, ইকুয়েডর ও উরুগুয়ের মতো দেশে ঘটে যাওয়া ব্যাংক–সংকটের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, ভবিষ্যতে সংকট দেখা দিলে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যেন কার্যকরভাবে তা সামাল দিতে পারে।
আইএমএফ বলেছিল, ‘মূল বিষয় হলো, দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ এড়িয়ে চলা। কারণ, এতে আরও বড় কিন্তু দুর্বল ব্যাংক তৈরি হয়, কিংবা শক্তিশালী ব্যাংকটিও দুর্বল হয়ে পড়ে।’
আইএমএফ ব্যাখ্যায় বলেছিল, সংকটকালে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্রুত স্থিতি ফেরাতে দুর্বল দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে। এ কারণে শাখা ও কর্মীসংখ্যা কমে, ব্যয় কিছুটা কমে যায় এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক শক্তি, সম্পদের মান বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ঠিক না হলে সেই একীভূতকরণের ফল হয় আরেকটি ‘বড় কিন্তু দুর্বল’ প্রতিষ্ঠান।
আরও পড়ুনবাংলাদেশে ‘মাফিয়া অর্থনীতি’ দমন কতটা সম্ভব হচ্ছে০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫বাংলাদেশ তাহলে কীভাবে করছেবাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, বেসরকারি খাতের পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে যে বড় ব্যাংক হবে, সেটি থাকবে সরকারি মালিকানায়। সরকার ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে একটি আইনি কাঠামোও তৈরি করেছে। এই অধ্যাদেশে সংকটপূর্ণ সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ‘ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ গঠন অথবা স্থানীয় বা বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সম্পদ হস্তান্তর করার কথা বলা আছে।
এই কাজটির ওপরই নির্ভর করবে সরকারের এই উদ্যোগের সফলতা ও ব্যর্থতার অনেকখানি। এমনিতেই খারাপ ঋণ সম্পূর্ণ উদ্ধার করার নজির নেই। বাংলাদেশে তো সম্ভাবনা আরও কম। কারণ, বন্ধকি সম্পদের দাম বেশি দেখিয়ে ঋণ নেওয়া এবং ভিন্ন খাতে ব্যবহার করার প্রবণতা এখানে অনেক বেশি। বিপুল অর্থ পাচারও হয়ে গেছে। সুতরাং আমানতকারীদের জন্য সরকার যে ‘বেইল ইন’ পরিকল্পনা করছে, ভরসা সেটাই। এ জন্য আমানতকারীদের অনেক বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন হবে।
একীভূত নতুন ব্যাংক চালাবে সরকার। তবে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। তার আগপর্যন্ত ব্যাংকটি ঠিকঠাকমতো চালাতে হবে। যদিও বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনায় সরকার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, এমন নজির নেই। বাংলাদেশে একসময় বেসিক ব্যাংক ছিল সরকারি মালিকানায় পরিচালিত ভালো ব্যাংকের উদাহরণ। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সেই ব্যাংকটি এখন কোনো রকমভাবে টিকে আছে।
বাংলাদেশে তদারকি ব্যবস্থা সবচেয়ে দুর্বল। আবার সরকারি ব্যাংক পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা এখানে সামান্য। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুযায়ী সবকিছু চলবে বলা হলেও সরকারি মালিকানাধীন একটি বড় ব্যাংক হবে, আর সেখানে প্রভাবশালীরা সুবিধা নেবেন না, তা কি আর হয়!
আরও পড়ুন ব্যাংক খাতে ‘লাইসেন্স টু লুট’, বাংলাদেশ সংস্করণ২৩ জানুয়ারি ২০২৩বাংলাদেশ কি পারবে২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে ধস নেমেছিল। এরপর আইএমএফের আর্থিক ও শেয়ারবাজার বিভাগের পরিচালক, অর্থনীতিবিদ টোবিয়াস অ্যাড্রিয়ানের নেতৃত্বে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘গুড সুপারভাইজেশন: লেসনস ফ্রম দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের সেই গবেষণায় বলা হয়েছিল, ব্যাংককে নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাখতে শুধু নিয়মকানুন নয়, কার্যকর তদারকিই আসল চাবিকাঠি।
আইএমএফ ২০১২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬০টি দেশের ব্যাংক তদারকি ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে গবেষণায় আরও বলেছিল, অনেক দেশেই তদারকি সংস্থা সরকারি প্রভাবমুক্ত নয়, তাদের প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষাও নেই। এ অবস্থায় তদারকি সংস্থাকে রাজনৈতিক চাপ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। নীতিনির্ধারকেরা যখন তদারককারীদের সমর্থন দেয় না বা রাজনৈতিক চাপে দুর্বল নিয়মকানুনকে উৎসাহ দেয়, তখনই সংকট শুরু হয়।
আরও পড়ুনব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ আদৌ ফল দেবে কি০১ অক্টোবর ২০২৫আইএমএফ যা বলেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা অনেক বেশি প্রযোজ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়ার কথা বলাটাই যখন ভালোভাবে নেওয়া হলো না, সেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে দেওয়া হবে—এমন প্রত্যাশা না করাই ভালো।
এমনিতে পাঁচ দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার পরিকল্পনা ভালো এবং একই সঙ্গে অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ। নয়ছয় করলে ব্যাংক বন্ধ বা মালিকানা কেড়ে নেওয়া হবে—এমন একটি বার্তা দেওয়ারও প্রয়োজন আছে। ফলে এই মডেল সফল হলে সেটি হবে বিশ্বের জন্য নতুন উদাহরণ। বিশেষ করে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো শাখা বন্ধ না করে, কোনো লোকবল না কমিয়ে। এমনটি এখনো কেউ করতে পারেনি। বাংলাদেশ কি পারবে?
● শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন
*মতামত লেখকের নিজস্ব