আজ থেকে ঠিক ৪৩ বছর আগে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে ব্ল্যাকফ্রায়ার্স সেতুর নিচে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় ইতালির ব্যাংক কর্মকর্তা রবের্তো কালভির মরদেহ। ঘটনাটি তখন গোটা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। কারণ, এই মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ইতালির রাজনীতি, মাফিয়া, ফ্রিম্যাসন গোষ্ঠী, এমনকি ভ্যাটিকান সিটির বিষয়াদিও। তাঁর মৃত্যু ঘিরে অনেক প্রশ্ন এখনো রহস্যঘেরা রয়ে গেছে।

রবের্তো কালভি ছিলেন ইতালির তৎকালীন সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ব্যাঙ্কো অ্যামব্রোজিয়ানোর চেয়ারম্যান। ভ্যাটিকানে অবস্থিত রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এ কারণে তিনি ‘গডস ব্যাংকার’ বা ‘ঈশ্বরের ব্যাংকার’ নামে পরিচিত ছিলেন।

হঠাৎ নিখোঁজ, অতঃপর রহস্যজনক মৃত্যু

১৯৮২ সালের জুনে ৬২ বছর বয়সী কালভি নিখোঁজ হন। নিখোঁজের ঠিক ৯ দিন পর, অর্থাৎ ১৮ জুন সকালে, তাঁর মরদেহ পাওয়া যায় ব্ল্যাকফ্রায়ার্স সেতুর নিচে ঝুলন্ত অবস্থায়। তবে যুক্তরাজ্যের পুলিশের কাছে যা সবচেয়ে বেশি বিস্ময়ের সৃষ্টি করে, সেটি হলো তাঁর মৃত্যুর আশ্চর্যজনক পরিস্থিতি। সেতুর নিচে একটি নির্মাণকাঠামোয় (স্ক্যাফোল্ডিং) ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল তাঁর লাশ। ওই সময় কালভির পকেটে ছিল ইটের টুকরা; সঙ্গে ছিল বিভিন্ন দেশের মুদ্রার সমন্বয়ে প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড সমমূল্যের নগদ অর্থ। এ ছাড়া তাঁর কাছে পাওয়া যায় ভুয়া পাসপোর্ট, যাতে নাম লেখা ছিল ‘জিয়ান রবার্তো ক্যালভিনি’। আরও ছিল ব্রাজিলের ভিসাসহ একটি ওয়ানওয়ে টিকিট।

এসব অদ্ভুত দিক থাকা সত্ত্বে ওই বছরের জুলাইয়ে প্রাথমিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কালভির শরীরে কোনো অপরাধমূলক চিহ্নের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ওই ব্যাংকার আত্মহত্যা করেছেন। তবে তখনই অনেকের সন্দেহ ছিল, এই মৃত্যুর পেছনে হয়তো আরও গভীর ও অন্ধকার কিছু ঘটনা লুকিয়ে আছে।

তদন্ত শুরু হলে বেরিয়ে আসে এক জটিল আর্থিক ষড়যন্ত্রের চিত্র। এ ঘটনায় একই সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ইতালির ব্যাংক খাত, মাফিয়া, ফ্রিম্যাসন গোষ্ঠী (বিশেষ প্রতীক ধারণ করা গোপন ভ্রাতৃত্ব সংঘ) এবং সর্বোপরি ভ্যাটিকান।

বিবিসির সাংবাদিক হিউ স্কালি তাঁর এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের এক অবিশ্বাস্য জটিল জালের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কালভি।’ এই ব্যাংকারের মৃত্যুর ঘটনা ইতালিতে ব্যাপক রাজনৈতিক ও আর্থিক কেলেঙ্কারির সূত্রপাত ঘটায়। স্বল্প সময়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার গায়েব হয়ে যায়, আর রেখে যায় এক দীর্ঘস্থায়ী রহস্য।

কালভির মৃত্যু নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। বেশ কিছু ঘটনা এ প্রশ্ন তোলার পেছনে কাজ করেছে। যেমন আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি সামনে আসার পরে কালভি ইতালির রোম থেকে পালিয়ে লন্ডনে যান। পালিয়ে যাওয়ার আগে কালভি গোঁফ কেটে ছদ্মবেশ নেন। রোম থেকে অস্ট্রিয়া হয়ে একটি প্রাইভেট বিমানে চড়ে গোপনে লন্ডনে আসেন। লন্ডনে এসে তিনি এক মাসের জন্য একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিলেন। তাঁর হাতে ছিল পাসপোর্ট ও ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো যাওয়ার বিমানের টিকিট। আত্মহত্যার আগে কেউ এমন প্রস্তুতি নেয় কি না, সে প্রশ্ন উঠেছিল তখনই।

আরও ঘটনা আছে। ওই সময় কালভির মৃত্যুই একমাত্র ঘটনা ছিল না। কারণ, কালভির মৃত্যুর ঠিক আগের দিন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব তেরেসা কোরোশের মিলানে অবস্থিত ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের চতুর্থ তলা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন। তেরেসা একটি চিঠি রেখে গিয়েছিলেন, যেখানে কালভিকে ‘ব্যাংক ও কর্মীদের সর্বনাশকারী’ বলে অভিশাপ দিয়ে যান তিনি।

গোপন গোষ্ঠী, মাফিয়া ও ভ্যাটিকানের ছায়া

কালভি ও তাঁর ব্যাংক ব্যাঙ্কো অ্যামব্রোজিয়ানো এমন এক জগতে কাজ করত, যেখানে অর্থ, রাজনীতি, ধর্ম ও অপরাধ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। ব্যাঙ্কো অ্যামব্রোজিয়ানো প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৬ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাংকটির সঙ্গে ভ্যাটিকানের ক্যাথলিক চার্চের দীর্ঘ সম্পর্ক তৈরি হয়। এমনিতে ভ্যাটিকান সিটির নিজস্ব একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এটির নাম ইনস্টিটিউট ফর রিলিজিয়াস ওয়ার্কস (আইওআর), যা ভ্যাটিকান ব্যাংক নামেই বহুল পরিচিত। একপর্যায়ে এই ভ্যাটিকান ব্যাংকই ব্যাঙ্কো অ্যামব্রোজিয়ানোর প্রধান শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।

ভ্যাটিকান ব্যাংককে এককথায় ধর্মীয় ব্যাংক বলা যায়, যেখানে পোপ ও পুরোহিতদের ব্যাংক হিসাব থাকে। তাঁরা এর মাধ্যমে চার্চের বিভিন্ন আর্থিক বিনিয়োগও পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু যেহেতু ভ্যাটিকান নিজেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, তাই ইতালির কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই ব্যাংকের ওপর নজরদারি করতে পারে না।

ব্রিটিশ সাংবাদিক হিউ স্কালি বলেন, ‘ভ্যাটিকানে মুদ্রার বিনিময় নিয়ন্ত্রণ বা অন্য কোনো সরকারি বিধিনিষেধ নেই; সেখানে গোপনীয়তাই সবচেয়ে মূল বিষয়। গোপনীয়তার ধরন এত গভীর যে এখান থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা বিশ্বের যেকোনো জায়গায় পাঠানো সম্ভব এবং তা কেবল সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ছাড়া কেউ জানেন না।’

এবার গল্পে আসি, রবের্তো কালভি ব্যাঙ্কো অ্যামব্রোজিয়ানো ব্যাংকের প্রধান হিসেবে ভ্যাটিকান ব্যাংকের চেয়ারম্যান আর্চবিশপ পল মারসিনকাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে এই মার্কিন আর্চবিশপের (মারসিনকাস) এমন কিছু আর্থিক সংযোগ ও সহযোগী ছিলেন, যাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো।

এ বিষয়ে সাংবাদিক হিউ স্কালি জানান, এসব সহযোগীর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ছিলেন ব্যাংকার মিশেল সিনডোনা, যাঁর সঙ্গে মাফিয়াদের যোগাযোগ ছিল। ব্যাংকিং জগতে তাঁকে ‘শার্ক’ বা হাঙর নামে চেনেন সবাই। সিনডোনা একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সে জন্য ২৫ বছরের কারাদণ্ড পান। পরে তাঁকে ইতালির একটি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তিনি ১৯৮৬ সালে সায়ানাইড মেশানো কফি পান করে রহস্যজনকভাবে মারা যান।

রবের্তো কালভি ও মিশেল সিনডোনা উভয়েই ছিলেন গোপন ফ্রিম্যাসন গোষ্ঠী প্রোপাগান্ডা ডুয়োর (পি-২) সদস্য। প্রোপাগান্ডা ডুয়োর সদস্য হওয়ায় ১৯৬০-এর দশকের শেষ থেকে কালভি ও সিনডোনার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। শুরুর দিকে কালভিকে তাঁর ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের বিষয়ে নানা পরামর্শ দিতেন সিনডোনা।

যাহোক, পি-২ নামের এই ফ্রিম্যাসন গোষ্ঠীর সঙ্গে আবার চরম উগ্র ডানপন্থী একটি সংগঠনের সম্পৃক্ততা ছিল, যে সংগঠন চালাতেন ইতালির ধনকুবের ও স্বঘোষিত ফ্যাসিবাদী লিচিও জেলি। সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দেশটির সামরিক বাহিনী, রাজনীতিক, সংবাদপত্র জগতের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এবং এমনকি ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনিও। এটি নামে একটি ফ্রিম্যাসন সংগঠন হলেও বাস্তবে ছিল মাফিয়া ও বিভিন্ন রকমের কালোকারবারের সঙ্গে জড়িত একটি গোষ্ঠী।

১৯৮১ সালের মার্চে ইতালির পুলিশ লিচিও জেলির দপ্তরে অভিযান চালিয়ে একটি সিন্দুক থেকে শত শত সন্দেহভাজন পি-২ সদস্যের একটি তালিকা উদ্ধার করে। ওই তালিকায় রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তাসহ গণমাধ্যমের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং পরবর্তী সময়ে ইতালির প্রধানমন্ত্রী হওয়া সিলভিও বারলুসকোনির নামও ছিল। এ তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর দেশটিতে রাজনৈতিক ভূমিকম্প ঘটে। ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আর্নালদো ফোরলানি এবং তাঁর পুরো মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। এক পুলিশপ্রধান আত্মহত্যা করেন, আর এক সাবেক মন্ত্রী অতিমাত্রায় ওষুধ সেবনের পর হাসপাতালে ভর্তি হন।

পুলিশের অভিযানে এমন কিছু দলিলও উদ্ধার হয়, যাতে ব্যাংক কর্মকর্তা রবের্তো কালভির বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক কার্যকলাপ ও অবৈধ অফশোর লেনদেনে জড়িত থাকার প্রমাণ ছিল। সেই সূত্র ধরে ১৯৮১ সালের মে মাসে কালভিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের নিয়ম লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আদালত তাঁকে চার বছরের কারাদণ্ড দেন। তবে আপিলের প্রক্রিয়া চলাকালে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কালভি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পালানোর সময় তাঁর সঙ্গে ছিল অ্যামব্রোজিয়ানো ব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়ে স্পর্শকাতর কিছু নথিতে ভরা একটি ব্রিফকেস। তিনি লন্ডনে পালিয়ে আসার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ব্যাংক ধসে পড়ে এবং বিশাল ঋণের বোঝা রেখে যায় (দেউলিয়া হয়)।

মিলিয়ন ডলার উধাও

রবের্তো কালভি নিখোঁজ হওয়ার আগেই ইতালির তদন্তকারীরা আবিষ্কার করেন, তাঁর (কালভি) ব্যাংক থেকে প্রায় ১৫০ কোটি (দেড় বিলিয়ন) ডলার গায়েব হয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, এই অর্থ ভ্যাটিকান ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছিল। ভ্যাটিকান ব্যাংক ইতালির বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার আওতার বাইরে থাকায় এটি সম্ভব হয়েছিল।

ওই অর্থের কিছু অংশ ক্যাথলিক চার্চের নির্দেশে স্বল্প সুদে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। বাকি অর্থ লুক্সেমবার্গ ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন ‘ভুয়া’ বা ‘শেল কোম্পানিতে’ রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে আবার তা ইতালিতে ফেরত এনে কালভির জন্য অ্যামব্রোজিয়ানো ব্যাংকের শেয়ার কেনার কাজে ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে কালভি ব্যাংকের অর্থ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন।

ইতালির পুলিশ ভ্যাটিকান ব্যাংকের চেয়ারম্যান আর্চবিশপ পল মারসিনকাসকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খুঁজেছিল। কিন্তু তিনি ভ্যাটিকানের একজন কর্মচারী হওয়ায় শেষ পর্যন্ত অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান। মারসিনকাস কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেন। অন্যদিকে ভ্যাটিকান কখনোই অ্যামব্রোজিয়ানো ব্যাংকের পতনের জন্য কোনো আইনগত দায় স্বীকার করেনি। তবে ১৯৮৪ সালে তারা বলে যে এই দেউলিয়াত্বের জন্য তাদের একটি নৈতিক দায় রয়েছে। সেই দায়িত্ববোধ থেকে তারা ব্যাংকের পাওনাদারদের কাছে ৪০৬ মিলিয়ন (৪০ কোটি) ডলার স্বেচ্ছায় পরিশোধ করে।

তদন্ত, মামলা, কিন্তু বিচার হয়নি

মামলার তদন্তকারীরা মনে করতেন, বিভিন্ন দেশে গোপন রাজনৈতিক কার্যক্রমে অর্থ সরবরাহ ও মাফিয়া সংগঠনের মতো গ্রাহকদের অর্থ পাচারের জন্য শেল কোম্পানিগুলো গঠন করেছিলেন কালভি। সাংবাদিক হিউ স্কালি বলেন, কালভির আর্থিক লেনদেন নিয়ে পুলিশের তদন্ত ইতালির বহু প্রভাবশালী ব্যক্তির জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে মনে করেন, তাঁর হত্যার পেছনে এটি একটি কারণ ছিল।

ইতালির আরেক সাংবাদিক ফিলো ডেলা তোরে কালভিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। এই সাংবাদিক ১৯৮২ সালে বিবিসিকে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, কালভিকে হত্যা করা হয়েছে। ফিলো ডেলা তোরে বলেন, পি-২ সদস্যরা তাদের বৈঠকে কালো পোশাক পরতেন এবং নিজেদের ‘ফ্রাতি নেরি’ নামে ডাকতেন, যার অর্থ ইতালীয় ভাষায় ‘ব্ল্যাক ফ্রায়ার’ বা ‘কালো ভিক্ষু’।

কালভির পরিবারও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। কালভির পরিবার, বিশেষ করে স্ত্রী ক্লারা কালভি পুলিশকে অধিকতর তদন্ত করতে জোর দাবি জানাতে থাকেন। পাশাপাশি তাঁরা নিজেরাও বেসরকারি গোয়েন্দা ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেন কালভির মৃত্যুর রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য।

১৯৯৮ সালে কালভির মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়। এতে প্রমাণ মেলে, তাঁর গলায় যেভাবে ক্ষত ছিল, তা ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার সঙ্গে মেলে না। এমনকি তাঁর হাতেও ইটের (মৃত্যুর সময় পকেটে ইট ছিল) কোনো চিহ্ন ছিল না। এসব তথ্য পাওয়ার পরে ২০০২ সালে ইতালীয় বিচারকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে এটি আত্মহত্যা নয়, বরং হত্যা। অর্থাৎ কালভিকে সত্যিই হত্যা করা হয়েছিল।

এরপর কালভি হত্যা নিয়ে পুলিশ অধিকতর তদন্ত শুরু করে। ২০০৫ সালে পাঁচজনের বিরুদ্ধে রোমের আদালতে কালভি হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। মামলায় সরকারপক্ষের কৌঁসুলি লুকা তেসকারোলি যুক্তি দেন যে কালভিকে হত্যা করা হয়েছিল মূলত মাফিয়াদের অর্থ আত্মসাতের কারণে। ওই অর্থ তাঁর কাছে পাচারের (মানি লন্ডারিং) জন্য রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া কালভি রাজনীতিবিদসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করতে চেয়েছিলেন। যদিও দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে আসামিরা সবাই খালাস পান। ফলে এখন পর্যন্ত কেউ কালভি হত্যাকাণ্ডের দায়ে দণ্ডিত হননি।

এই ইতালীয় ব্যাংকারকে ঠিক কারা হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারা কালভিকে লন্ডনে হত্যা করেছিলেন, সেসব বিষয় এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। আজ পর্যন্ত কেউই এ হত্যাকাণ্ডের দায়ে দণ্ডিত হয়নি। এর মধ্য দিয়ে কালভির কর্মকাণ্ড, মৃত্যু ও তদন্ত নিয়ে তৈরি হওয়া প্রশ্নগুলো আজও বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রতীক হয়ে রয়েছে।

(বিবিসি থেকে অনুবাদ করেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শফিকুল ইসলাম)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অ য মব র জ য় ন র জন ত ক র তদন ত হয় ছ ল রব র ত র জন য র অর থ মন ত র আর থ ক কর ছ ল হত য র সবচ য় সরক র রহস য সদস য স গঠন অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

জট কমাতে জাহাজ কমানোর উদ্যোগ

কনটেইনারভর্তি পণ্য নিয়ে একের পর এক জাহাজ আসছে। খালাস শেষে রপ্তানি কনটেইনার নিয়ে বন্দর ছাড়ছে এসব জাহাজ। পণ্য পরিবহনের চাপ সামাল দিতে না পারায় বন্দরে কনটেইনার জাহাজের জট বাড়ছে। এই জট কমানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের পথে চলাচলরত কনটেইনার জাহাজের সংখ্যা কমাতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।

জাহাজ যাতে কম আসে সে জন্য বন্দরের নেওয়া পদক্ষেপ হতবাক করেছে শিপিং এজেন্টদের। শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, দুর্যোগের সময় ছাড়া কোনো বন্দরে চলাচলরত জাহাজের সংখ্যা কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার নজির বিশ্বে নেই। বরং বিশ্বের নানা বন্দর বা কনটেইনার টার্মিনালগুলোতে যাতে জাহাজ ভেড়ানো হয় সে জন্য শিপিং কোম্পানিগুলোকে উৎসাহ দেওয়া হয়। এ কাজের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বা টার্মিনাল পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর বিপণন বা বাণিজ্য দল রয়েছে। চট্টগ্রামে হচ্ছে উল্টোটা।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের পথে এখন ১১৮টি কনটেইনার জাহাজ নিয়মিত চলাচলের অনুমোদন রয়েছে। বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও চীনের বিভিন্ন বন্দরে এসব জাহাজ চলাচল করে। ২০ জুলাই বন্দরের এক সভায় বন্দরের পথে চলাচলরত ১৫টি জাহাজ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে ১৫টি জাহাজ কমানো হবে তার তালিকা শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনকে নিজ উদ্যোগে বন্দরকে দেওয়ার জন্য বলা হয় ওই সভায়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, জাহাজজটের কারণে বহির্বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান।

এ বিষয়ে জানতে বন্দর চেয়ারম্যানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।

তবে শিপিং এজেন্টরা এখন পর্যন্ত কোনো জাহাজের নাম বন্দরকে দেয়নি, যেগুলো প্রত্যাহার করা হবে। তালিকা না দেওয়ায় গত মঙ্গলবার বন্দরের উপসংরক্ষক ক্যাপ্টেন মো. জহিরুল ইসলাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে (বুধবারের মধ্যে) ১৫টি জাহাজের তথ্য দেওয়ার জন্য শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন, যেগুলো এই পথ থেকে প্রত্যাহার করা হবে।

শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, বন্দরের এ উদ্যোগ মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো। যেসব কারণে বন্দরে জাহাজজট হয়েছে, তা শনাক্ত করে জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করা উচিত। জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে জট কমবে না।

স্বাভাবিক সময় বন্দরের বহির্নোঙরে পাঁচ–ছয়টি জাহাজ অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু এখন জটের কারণে ক্রেনযুক্ত একেকটি জাহাজ জেটিতে ভেড়ানোর জন্য চার থেকে ১০ দিন পর্যন্ত সাগরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

শিপিং ও বন্দর কর্মকর্তারা জানান, ঈদুল আজহার একটানা ১০ দিনের ছুটি, দুই দফায় পরিবহন ধর্মঘট, কাস্টমসের শাটডাউন কর্মসূচি ও কাস্টমসের শুল্কায়নের সফটওয়্যারের ধীরগতির কারণে বন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। এর জেরে কনটেইনার জাহাজের যে জট তৈরি হয়েছে, তা এখনো কমছে না। কারণ, কনটেইনারে পণ্য পরিবহন বাড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে বন্দরের নতুন উদ্যোগে জাহাজের সংখ্যা কমানো হলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও শ্রীঙ্কার বন্দরগুলোতে বাংলাদেশমুখী কনটেইনারের জট তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন শিপিং এজেন্টরা। একইভাবে এসব বন্দর হয়ে ইউরোপ–আমেরিকামুখী রপ্তানি পণ্যের কনটেইনারের স্তূপ বাড়তে পারে ডিপোগুলোতে।

জানতে চাইলে কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী জিবিএক্স লজিস্টিকস লিমিটেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব অপারেশন মুনতাসীর রুবাইয়াত প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরের পথে জাহাজের সংখ্যা কমানো হলে আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, চাহিদা বাড়লে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যেতে পারে। এতে ভুক্তভোগী হতে পারেন ভোক্তারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ