যখন রওনা দিয়েছিলেন, তখন সকালের গায়ে যে পাতলা সর ছিল, তা শুকিয়ে এখন ঘেমো গরম ছেড়েছে। অসময়ে বাস থেমেছে শুধু তাদের জন্য। রাস্তার ধারে মুদিদোকানের পেছনে টিউবওয়েল বেশ কয়েকবার চেপে ঠান্ডা পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়েছেন শামসুল হক। সুপারভাইজার ছেলেটা কোল্ড ড্রিংক নিয়ে তরতরিয়ে উঠে গেছে। শামসুল হকের হাঁটুতে ব্যথা, আজকাল বাসের পাদানি এত উঁচু করে কেন যে! নাকি তার নিজের উচ্চতাই কমে গেছে। বয়স ষাটের ওপর হলে কি মানুষ খর্বকায় হতে শুরু করে!
শাহানা মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। এমন বোকার মতো কাণ্ড কোনো ডায়াবেটিসের রোগী করতে পারে বলে শামসুল হকের জানা নেই। ছেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তেজনা আর ভাগনির জন্য গুচ্ছের জিনিস গুছিয়ে নেওয়ার নাওয়া-খাওয়াহীন ব্যস্ততায় সে কিনা ওষুধও ঠিকমতো খেতে ভুলে গেছে! বাস ছাড়ার পরপরই একটু ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল শাহানাকে, ভেবেছিল একটু ঘুমিয়ে উঠলে ভালো বোধ করবে।
পাশের সিটের দম্পতির ছয়-সাত বছরের মেয়েটা একবার জানালার ধারে মায়ের কাছে বসছে, তো আরেকবার ঝাঁপিয়ে বাবার কোলে আসছে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে, সকৌতুক দেখছিলেন শামসুল হক। শিশিরের মেয়েটার বয়স মাত্র ষোলো মাস, বড় হলে হয়তো এমনই হবে, কাঁধ ছাপিয়ে চুল, বড় বড় বিস্ময়াচ্ছন্ন চোখ। ফটোর শিশুটি আগামীকাল তাঁদের সামনে ঘোরাঘুরি করবে! ভাবলেই মনে স্ফুর্তি হচ্ছে তাঁর।
শামসুল হক তখন খবরের কাগজ আদ্যোপান্ত পড়ার আগ্রহে পাশ ফিরে একবার দেখেছিলেন শুধু। শাহানার জোড়া ভ্রু কুঁচকে ছিল, চিড় খাওয়া কপালের প্রৌঢ় ত্বকে ক্লান্তি দেখেছিলেন কিন্তু কিছু মনে হয়নি। খবরের কাগজে মন দিতে গিয়ে বরং মেজাজ খারাপ হচ্ছিল, দেশ যে কোথায় যাচ্ছে! অধিকাংশ মানুষ কী নির্দ্বিধায় রবীন্দ্রনাথকে, শেখ মুজিবকে বিচারের মানদণ্ডে তুলে দেয়, তাদের অবদানের চুলচেরা হিসাব করে, অথচ রাজাকার, আলবদর আর যুদ্ধাপরাধের ইতিহাসকে সামনে আনলে নমনীয় হয়ে ওঠে। এরশাদ সরকারের কৃতকর্ম ভুলে যায়, জেলার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে লোকটাকে মাফও করে দেয় কেউ কেউ। ওর আমলে গুলিবিদ্ধ ডাক্তার মিলনকে একবার দেখেছিলেন শামসুল হক। কেন যেন ভুলতে পারেন না। কী ভদ্র চেহারা আর ব্যবহার! টগবগে তরুণ, জীবনটা ভালোভাবে শুরু হতে না-হতেই মৃত্যু খড়্গ নিয়ে দণ্ডায়মান। নাহ, ভালো লাগে না আর! রাষ্ট্র তার মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারে না, এ হতাশা রাখার জায়গা কই! আপনাআপনি মাথার দুলুনি নেতিবাচক হয় শামসুল হকের।
রাজনৈতিক ভাবনা তাঁর আসে বটে কিন্তু তাঁর বয়সী অসমর্থ, অপারগ মানুষের কী করার আছে? অপারগ! হ্যাঁ, বয়সের নেমে যাওয়া স্রোতে এভাবে নিজেকে দেখতে শিখছেন শামসুল হক।
থাকুক, এই দেশ তার ক্ষুদ্র স্মৃতিশক্তি আর কুম্ভীলকবৃত্তি নিয়ে। খবরের কাগজের বেশির ভাগ সংবাদ আজকাল শামসুল হকের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। তার চেয়ে পাশের শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকা ভালো। সৌভাগ্যক্রমে নিজের ছেলেটা অন্তত দেশের বাইরে সেটেল করতে পেরেছে, কী ভীষণ ভার নেমে যাওয়া অনুভব! ভালো লাগে তাঁর।
হঠাৎ কোমরের কাছে শাহানার একটা হাতের খোঁচা খেয়ে আর জ্ঞ-জ্ঞ শব্দে সম্বিত ফিরেছিল শামসুল হকের। হাত ধরে সরাতে যেতেই যেন তড়িতাহত হলেন তিনি, এ যে বরফের চেয়ে ঠান্ডা! হাত ঠান্ডা কিন্তু কপাল ঘামছে। আশপাশের দৃশ্যাবলি পেছনে ফেলে সে সময় বাস বেশ দ্রুত চলছে। চলন্ত বাসে ব্যালান্স সামলে দাঁড়িয়ে জোরেসোরে সুপারভাইজার ছেলেটাকে ডাক দিলেন। তাঁর আতঙ্কভরা কণ্ঠ শুনে আরও কয়েকজন হুড়মুড় করে দাঁড়িয়ে পড়ে। দরজার কাছে দাঁড়ানো কোট-টাই পরা তরুণ মুখ উজিয়ে আসে।
‘স্যার, কী সমস্যা?’
ছেলেটি কি তাঁর ছাত্র, নাকি তাঁর পেশাগত ব্যবহারবিধিতে ‘স্যার’ বলা নিয়ম বলে বলছে? শাহানার অবস্থা দেখে নার্ভাস হচ্ছেন শামসুল। সুপারভাইজারের কাঁধে হাত রাখেন। মনে হচ্ছে একে স্কুলে পড়িয়েছিলেন, ভরসা করতে ইচ্ছা করে। এ রকম অবস্থার মুখোমুখি তাঁকে নিজের বাড়িতে কখনো হতে হয়নি।
ঠান্ডা হাত-পা নিয়ে শাহানার কম্পমান মোটাসোটা শরীর, দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রাখতে হচ্ছে। ছেলেটা এসে ঝুঁকে দেখে প্রথমেই প্রশ্ন করে, ‘ডায়াবেটিস আছে নিকি? মিষ্টি খাওয়ান লাগবে। সঙ্গে চকলেট নাই? শরবত, সেভেন আপ?’
উদ্বেগহীন, তবু বিনীত কণ্ঠস্বর। হয়তো এ ধরনের যাত্রী সে হামেশা মোকাবিলা করে। সিটের ওপর দিয়ে মাথার কাছে আরও দু-একজন উপযাচক যাত্রী।
শাহানার ডায়াবেটিস ধরা পড়ল মাস আষ্টেক আগে। এর মধ্যে দূরপাল্লার কোথাও তো তাঁরা যাননি। সঙ্গে এ ধরনের খাবার পানীয় রাখার সতর্কতার দরকার পড়েনি। বয়সের কড়া নাড়া এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়, এ কথা বুঝিয়ে বলতে হবে শাহানাকে।
এসি বাসের জানালা খোলার উপায় নেই, শামসুল হক পর্দা টেনে দিয়ে স্ত্রীকে আধশোয়া হতে দেন, হাত-পায়ের পাতায় একটু তেল মালিশ করতে পারলে হয়তো ভালো হতো। বাসভর্তি যাত্রীরা উৎসুক, একটু অধৈর্যও। কে আর গন্তব্যে না পৌঁছে মাঝপথে সময়ের অপচয় চায়? তবু ঝাঁপ খুলে বসে থাকা দোকানের কাছে বাস থেমেছে। একখণ্ড ক্ষীণ আশঙ্কাও হয়েছিল যে এরা বুঝি অসময়ে, অচেনা বিরান জায়গায় শাহানাসহ তাঁকে নামিয়ে দিয়ে যায়। এই আরেক উপসর্গ হয়েছে—ভয়। পা ফেলতে, অগ্রে-পশ্চাতে, উঠতে-নামতে আবছায়া ভয় ঘিরে থাকে আজকাল। কিছুক্ষণ আগেও কী আতঙ্কই না ঘিরে ধরেছিল স্ত্রীকে নিয়ে! আগে এমন ছিল না, নিজের চারপাশ এত শূন্য, খালি মনে হতো না। শাহানা পাশে না থাকার কথা ঘুণাক্ষরেও আর চিন্তায় আনতে পারেন না শামসুল হক।
ভেজা তোয়ালে দিয়ে হাত-মুখ মুছিয়ে সেভেন আপ খাইয়ে দিলে ধীরে ধীরে কিঞ্চিৎ স্থির হয়েছে শাহানা। পাশের বাচ্চা মেয়েটা মায়ের কোলে সিঁটিয়ে বসে ছিল। ওর বাবা একটা চকলেট বার এগিয়ে দেয়। ব্লাড সুগার না মেপে আরও মিষ্টিজাতীয় কিছু খাওয়ানো কি ঠিক হবে? হঠাৎ করে মেজাজ সপ্তমে উঠে যায় শামসুল হকের, নিখুঁত করে সব গুছিয়ে এনেছে, মেয়েমানুষের কারবার! খালি বেয়াক্কেলে ওষুধটাই খেতে ভুলে গেছে। আর ব্লাড সুগার মাপার যন্ত্রটা? এনেছে তো?
জার্নিতে বমি হতে পারে আশঙ্কা করে কাজের মেয়েটাকে দিয়ে আদাকুচিও করিয়ে এনেছে; অথচ ওই ছোট্ট মেশিনটা ভুলে রেখে এসেছে! পায়ের কাছে রাখা ব্যাগ সিটের ওপর তুলে তবু আঁতিপাঁতি করে খোঁজেন শামসুল হক। এত রাজ্যের জিনিস নিতে হয় বোনঝির বাড়িতে যেতে হলে! বড় মিনারেল ওয়াটারের বোতলভর্তি ঘানিভাঙা শর্ষের তেল। সেটা একটু কাত হতে দেখে শাহানা চিঁহি চিঁহি করে, পড়ে যায় না যেন।
গাছের সফেদা আর গুটি আমের আচারের পোটলার নিচে ঢেঁকিছাঁটা চালের গুঁড়ার প্যাকেট.
বেগুনি রঙের পাটভাঙা শাড়ি পরেছে শাহানা। জার্নির বেহদ্দ দশায় দলামোচড়া হয়ে গেল। কী আর করা! ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হলেও হাতে সময় থাকবে। নীনার বাসায় গোসলটোসল সেরে, খেয়ে, বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কাছেই ফার্মেসি আছে, ততক্ষণে ইনসুলিন আর ওষুধ কিনে আনা যাবে।
ও পাশের বাচ্চা মেয়েটা শাহানাকে সুস্থির দেখে আবার এগিয়ে এসেছে। তার হাতে একটা ছবি আঁকা কাগজ। শামসুল হকের দিকে এগিয়ে দেয়, কাঁচা হাতে ফুল, মেঘ, কোণে একটা নৃত্যরত পরি, গায়ে রঙিন পাখা লাগানো।
‘বলতে পারবা একটা পেরেকের ওপর কয়টা পরি নাচতে পারে?’
ভারিক্কি স্বভাবের বাইরে বেরিয়ে আসা এত কিছুর পরে কঠিন হলেও শামসুল হক এবার হাসেন। আর তা ছাড়া এ প্রশ্নের উত্তরও তো তার জানা নেই।
ঠোঁট গোল করে, চোখের মণি দশদিকে ছড়িয়ে মেয়েটা কথাও বলতে পারে, ‘ইশ, পারো না? সোওজা... হাজার হাজার পরি নাচতে পারে। কারণ, পরিরা তো মাটির ওপরে নাচে না। ওরা তো উড়ে উড়ে নাচে, পায়ের নিচে পেরেক থাকলেই কী, আর না থাকলেই কী! ওদের কি আর ব্যথা লাগবে?’ মেয়েটার ঠোঁট ওলটানো দেখে শামসুল হকও ঠোঁট ওলটান। হ্যাঁ, কমছে, মানসিক চাপ ধীরে ধীরে হালকা হচ্ছে।
শাহানা আবার চোখ বন্ধ করেছে। শামসুল হক কপালে হাত দিয়ে দেখলেন, শাহানার স্বাভাবিক উত্তাপ। ঘুমাক। ক্লান্তি কাটবে।
এদিককার রাস্তাঘাট বেশ ভালো। ভাঙাচোরা কম, দুধারে ছায়াময় গাছপালা, লাগোয়া পরিচ্ছন্ন ঘরবাড়ি, দূরে বিস্তীর্ণ মাঠ, দেখলে মনে হয় দেশটা ভালো আছে। ভালো, এমন ওপর ওপর সারফেস লেভেলে ভালো দেখানো মন্দ কী? ভেতরে পোকা খাওয়া আমের সিঁদুরে রং দেখে কিছু মানুষ ভুলবে, কিনেও ফেলবে, খারাপ কী?
২.কল্যাণপুর পার হয়েছে কি হয়নি, ট্রাফিক পুলিশের খটাং খটাং লাঠির বাড়ি সিএনজির গায়ে। আরেকটু হলে উইন্ডশিল্ড ভেঙে যেত। লিকলিকে ড্রাইভার সব শক্তি কবজিতে এনে গিয়ার চেপে মুহূর্তে দুটো রিকশা আর মোটরসাইকেলের ফোকর গলে মাথা সেঁধিয়ে দিল। পেছনে পুলিশ লাগাতার লাঠি চালিয়ে চিৎকার করে থামতে বলছে। শাহানা ভয় পেয়ে আঁকড়ে ধরেছে শামসুল হককে। একটা বাস আর রিকশার মাঝখানে সরু জায়গা পেয়ে ড্রাইভার ছোকরা গিয়ার চেপে সাঁ করে বেরিয়ে ব্রিজের নিচ দিয়ে রীতিমতো ঢোঁড়া সাপ হয়ে এঁকেবেঁকে কখন যে তাঁদের তাজমহল রোডে নীনার বাসার সামনে এনে ফেলল, বোঝা গেল না।
‘পুলিশ থামতে বলল, তারপরও থামলা না?’ ভাড়া দিতে দিতে শামসুল হক জানতে চাইলেন।
‘আরে থামতে কইলেই থামতে হইবো নাকি? আমি আমার সুবিধামতো থামুম। থামায়া যখন-তখন কাগজপত্র দেখতে চাইলেই হইলো? সব আছে, আমি কি খালি হাতে গাড়ি লইয়া রাস্তায় নামছি নাকি?’ ছেলেটা বেশ চোয়াড়ে, শামসুল হকের মনে হয়।
শাহানা দুর্বল গলায় কেন যেন ছেলেটাকে সমর্থন করে, ‘ঠিকই আছে, নিজের পাওনা নিজেই বুঝে নিতে হয়, খালি খালি ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ দিবে আর মাইর খাবে কেন?’
কয়েক দিন ধরে শাহানার কথাবার্তায়ও নরম ভাব কমে গেছে। যেকোনো বিষয়কে টেনে, গুটিয়ে, গোল করে নিজেদের পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলবে। ছেলে দেশে বেড়াতে এসেছে, কোথায় একটু স্মিতহাস্য থাকবে; তা না, যত্তসব! এই বয়সে এসে সর্বক্ষণের সঙ্গীর ওপর বেশিক্ষণ মেজাজ ধরে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর ঘসির আগুনের মতো শাহানার তাতানো রাগ-অভিমানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাহস শামসুল হকের আগে ছিল, এখন কমে যাচ্ছে। সারা দিনের বাসযাত্রায় অসুস্থ হয়ে বেচারি এমনিতেই কাহিল। শামসুল হক বিরক্তি গোপন করে এক হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বাসার ভেতরে ঢোকান।
ছেলের সঙ্গে তিন বছর আগে দেখা হয়েছে। তখন বউমা আসতে পারেনি, নাতনির জন্ম হয়নি। ঢাকায় থাকার জায়গার অভাব-ছেলের এই গুরুতর অজুহাতকে জীবনের সফলতা-বিফলতার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ মনে হয়েছে। শিবগঞ্জের স্থাবর-অস্থাবর সব বিক্রি করে ঢাকায় একটা ঠাঁই করা যায় কি না, এমন চিন্তা মনে উঁকি দিলে একবার খোঁজখবরও করেছেন। কিন্তু ঢাকা শহরের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে সুচ গাঁথা। সোনার সুচ। পায়ের কড়ে আঙুল ঠেকালেও ‘আহ্’ করে উঠতে হয়।
এবার শিশির বউকে রাজি করিয়েছে, সে হোটেলে থাকবে। নিজের ভেতরে থেকে থেকে উত্তেজনা আর স্তিমিতি দুটোই অনুভব করছেন শামসুল হক।
শাহানা এই বন্দোবস্তে যারপরনাই নারাজ। এবার তার ইচ্ছা ছিল, ছেলে-বউমার আগমন, নাতনির মুখদর্শন ইত্যাদি ওজর দেখিয়ে পরিচিত লোকজনজকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। বাপ-দাদার ভিটে না হলেও শিবগঞ্জেই তো গত তিরিশ বছর কাটল। চেনাজানাও কম নয়। তাদেরই আপন বলে মনে হয়। শিশির কিনা একবাক্যে নাকচ করে দিল, এবার শিবগঞ্জে যাওয়ার সময় পাবে না তারা। বউমার শখ, একটু তাজমহল দেখবে। প্রেমের আশ্চর্য সমাধি না দেখে ফিরে গেলে বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়দের কাছে গল্প করার নাকি কিছু থাকবে না! শিশির তিন সপ্তাহ ছুটির আট দিন বাদ দিয়ে রেখেছে; এয়ার ইন্ডিয়াতে মুম্বাই, সেখান থেকে আগ্রা। ফেরার পথে ঢাকায় মাত্র এক রাত! তখন কি শাহানারা আবার ঢাকায় আসবে? নাকি আসতে পারবে?
‘কী দরকার?’ শিশিরের কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকে। তারা ব্যাগ-স্যুটকেস গুছিয়েই রেখে যাবে, ফেরার পথে কোনোমতে একটা রাত, আসলে আধখানা রাত। ভোর ছটায় ফ্লাইট হলে রাত তিনটায় এয়ারপোর্টে থাকতে হবে। হোটেলের গাড়ি পৌঁছে দেবে। আম্মা-আব্বার শুধু শুধু কষ্ট করার কোনো দরকার নেই।
শুধু শুধু কষ্ট! কী বলে তাদের ছেলে! চোখ বন্ধ করে মনে মনে একটা হাত ছেলের দিকে বাড়িয়ে রাখেন শামসুল হক। তীব্র আশা হয়, লাফ আর দৌড়ের মাঝামাঝি ভঙ্গিতে কোনো কিশোর এসে তাঁর বাহুমূল ধরে ঝুলে পড়বে। তিনি তবু গম্ভীর চালে ‘কী চাই’ বলবেন। মুখের রেখায় কোনোভাবেই কোমল ভাব ফুটে উঠতে দেবেন না। শিশির ক্যাডেট কলেজের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কাকে কীভাবে নাকাল করেছে, অনর্গল বলে যাবে আর তিনি চোরাচোখে দেখবেন ছেলের গোঁফের অনতি আভাস, হাড় শক্ত হয়ে ওঠা কাঁধের ব্যাস, ঘাড়ের ওপরে হালকা সবুজাভ চুলের ছায়া, কী যে মায়া লাগবে তার! বুকে চেপে চেপে ছেলেকে আদর করতে ইচ্ছা করবে। কিন্তু শামসুল হক কখনো সেটা করবেন না। কত দীর্ঘ দুপুর, বিকেল তিনি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের গেটের কাছে চায়ের দোকানে বসে ভিজিটিং আওয়ারের অপেক্ষায় কাটিয়েছেন। ঢাকা শহরে তাঁদের আত্মীয়স্বজন থাকতে শুরু করেছে আর কদিন! কতবার চাকরির কারণে ঢাকায় এসে পুরান ঢাকার সস্তা হোটেলে, এমনকি কমলাপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কাটিয়েছেন!
‘পনেরোটা দিনও থাকবে না? তাজমহল দেখাই লাগবে?’
রাগ হলে শাহানার নাকের পাটা ফুলে যায়। কিন্তু এখন বর্ষণক্লান্ত দিনের মতো ক্লান্তি নিয়ে কথা বলছে। শামসুল হকের নিজেরও বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা করে। শিশিরের আরেকটু বিবেচনাবোধপ্রত্যাশী মন মুখর হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু স্ত্রীকে নিজের দুর্বলতা দেখানো অঙ্ক শিক্ষকের, হোক না অবসরপ্রাপ্ত; ভালো দেখায় না। কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।
বাড়িতে বসে একবার অবশ্য বলেছিলেন, ‘তুমি নাহয় থাকো, আমি একলা যাই। ছেলে কি আর মাকে না দেখা দিয়ে ফিরতে পারবে?’
অনেকক্ষণ চুপ করে ধোয়া কাপড় ভাঁজ করেছে শাহানা। খোলা চুল আর থমথমে মুখে তার মাতৃমূর্তি বড় বিষণ্ন দেখিয়েছিল। বিছানায় বসে বালিশে খোল পরাতে পরাতে বলেছে, ‘না, যাই। কে আমার ছেলেক নিয়া গেল, তাকে একটু দেখা লাগবে না?’
ছেলের বউয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে শাহানার আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া যেন গতিপথ ছেড়ে মুখ ঘোরানো নদী, স্পষ্টত স্রোত নির্দেশনাহীন, বুকের মধ্যে জেগে ওঠা চর।
৩.‘খালার ডায়াবেটিস এমন খারাপ টার্ন নিয়েছে, নিজে যখন শিবগঞ্জে যাবে না, শিশিরের উচিত ছিল একটা রেন্ট-এ-কারের কথা জোর দিয়ে বলা; মা-বাপ আরাম করে ঢাকায় আসত।’—খালার আনা জিনিসপত্র ডাইনিং টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখতে রাখতে গজগজ করে নীনা। টেনে চুল বাঁধা নীনার কালো গভীর চোখের পাতা ঘন ঘন পলক ফেলে। ওর ওড়নায় হলুদ মসলার দাগ। খালাতো ভাই, ভাই-বউয়ের আসা উপলক্ষে রান্নাবান্না প্রায় শেষ। ছুটা বুয়াকে রাতের খাবার খাওয়া পর্যন্ত থাকতে বলেছে সে। রাতে খেয়ে ওরা হোটেলে যাবে, এভাবে প্ল্যান করেছে নীনা। তৌহিদের জরুরি মিটিং সেরে ফেরার পথে ছেলেমেয়েকে কোচিং থেকে তুলে বাড়িতে ফিরলে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিতে হবে। শামসুল হক গোসল সেরে চা খেয়ে টিভির খবর দেখতে বসেছেন।
এমিরেটস ল্যান্ড করবে রাত পৌনে নয়টা নাগাদ। কথা ছিল, সবাই মিলে এয়ারপোর্টে যাবে। কিন্তু দুর্বল শরীরে শাহানাকে আবার টানাহেঁচড়া করা ঠিক হবে না। নীনাও ঘরের কাজের অজুহাতে পিছিয়ে গেল। ভাই-বউ আর ভাতিজিকে একেবারে বাসায় এলেই দেখবে।
শাহানাও দোনোমনা করে হাল ছেড়ে দেয়। কত ছাড়ই তো দিতে হয় তাকে! এয়ারপোর্টে ছেলের দেখা পাওয়া কী আর এমন আহ্লাদের কথা! উপরন্তু তার বেগতিক শরীর কখন কী করে বসে! থাক, শাহানাও বাসায় বসে ছেলের প্রতীক্ষা করুক। সরু সুতানলি আরেকটা সাধও পাক খায় মনে-শিশির তাকে না দেখে উতলা হবে নিশ্চয়ই। তিন বছর দেখেনি মাকে। ফোনে অবশ্য কথা বলে, কিন্তু তা-ই বা কী এমন! ভালো করে খাওয়াদাওয়া, শরীরের যত্ন, এসবের বাইরে কি কোনো দিন অন্য কিছু শিশির তাকে বলেছে? মনে করার চেষ্টা করে শাহানা। নিশ্চয়ই বলেছে। শিশির যখন স্কুলে, ক্যাডেট কলেজে, যখন শাহানা রাত জেগে জেগে ছেলের বইয়ে মলাট লাগাত, ছুটিতে বাড়ি এলে তার মার্জিনবিহীন রুলটানা খাতায় স্কেল চেপে ধরে লম্বা লাইন টেনে দিত, দু শ পৃষ্ঠার ভারী খাতা, হাত ধরে যেত শাহানার। তখন নিশ্চয়ই কিছু বলত শিশির, আহ্লাদ করে জড়িয়ে ধরত মাকে। তারপর ক্যাডেট কলেজে ফেরার সময় প্রতিবার গুছিয়ে দেওয়া পিঠা, আচার, নকশাদার বেডকভার-এসব নিয়ে বন্ধুরা কী বলেছে, শিশির কী বলেনি তাকে! আধো আধো বোল থেকে বয়ঃসন্ধি, কিংবা আরও বড় হয়ে শিশিরের কত কথা, কত ভঙ্গিমা দেখে শাহানা খিলখিল করে, নয়তো অজান্তে আপনমনে হেসেছে। কেন মনে পড়ে না? কেন কেবল খেলার সময় পড়ে গিয়ে ছিলে আসা হাঁটুর দগদগে ঘার চেহারাটা মনে পড়ে? বুকের ভেতর হঠাৎ হু হু হাহাকার করে ওঠে শাহানার। ছেলের শিশুকাল স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ভাসে না বলে তার কান্না পায়।
নীনা শাহানাকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দরজা টেনে দিয়ে গেছে; শিশিররা এলে কে জানে আড্ডা-গল্পে কত রাত হয়! জানালা দিয়ে বাইরের ভোঁতা আলো পাশের বাড়ির ছাদ ছুঁয়ে ভেতরে চলে আসে, সেখানে তারে শুকাতে দেওয়া কাপড়, কেউ তুলে নিতে ভুলে গেছে। আবছা অন্ধকারে সব রং কালো দেখায়। যুবক ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মা-বাবাকে দেখতে দেশে ফিরছে, অথচ শাহানার মন কেবলই পুত্রের শৈশবকাল ফেরত পেতে চাইছে।
৪.স্যুটকেসবোঝাই ট্রলির ওপরে বসা লাল ফ্রক পরা ফুটফুটে শিশুটির দিকে চোখ যায় প্রথমে, মুহূর্তে শামসুল হকের লবণাক্রান্ত হৃদয় দ্রবীভূত। সারা দিনের বাসযাত্রা, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষার ক্লান্তি মনে থাকে না। তার শিশির আর শিশিরের মেয়ে! একই শোণিতধারা তাদের শরীরে! কী আশ্চর্য! হাতে ছুঁয়ে দেখতে, কোলে নিয়ে গালে গাল ঠেকাতে প্রাণ আইঢাঁই করে ওঠে। শামসুল হকের বাড়ানো হাতের দিকে দেখামাত্র ভ্যা... করে কেঁদে ওঠে তাশান। ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’ করে নিজের গুটিয়ে নেওয়া হাতের দিকে দেখেন শামসুল, শিরা বেরিয়ে আঙুলের গিঁটগুলো স্পষ্ট।
শিশির আগের চেয়ে সমর্থ, ঋজু আর ভালো স্বাস্থ্য। কানাডা-আমেরিকা থেকে খারাপ স্বাস্থ্য নিয়ে ফেরার কথা থাকে না তো! তার পেছনে সুশ্রী মেয়েটি তাঁদের বউমা। ছবিতে দেখেছেন, ফোনে কথা বলেছেন কদাচিৎ। এরা সবাই তাঁর নিজস্ব! শামসুল হকের গলার কাছে কফ জমে, কথা জড়িয়ে যেতে চায়।
তৌহিদ গাড়ি আনতে ড্রাইভারকে ফোন করে। দীর্ঘ, ক্লান্তিকর বিমানযাত্রা শেষ হয়েছে; বাইরে বেরিয়ে গরমের হলকা লেগে লিসার বমি ভাব হয়। তার মাথাও ধরেছে। যত দ্রুত সম্ভব, সে পেইনকিলার খেয়ে এসি ছেড়ে শুয়ে পড়তে চায়।
‘তাহলে আব্বা, আমরা বরং হোটেলে যাই আজকে।’ গাড়ি এয়ারপোর্ট ছেড়ে রাস্তায় রোডে পড়লে আলাপচারিতাও গতি পায়।
‘তোর আম্মা...’ শামসুল হকের কণ্ঠস্বরের খেদ তার নিজের কাছে ধরা পড়ে যায়। শাহানার শরীর ভালো কি না, এটা তো শিশিরের জানতে চাওয়ার কথা।
‘আম্মার সঙ্গে তো কাল সকালে দেখা হচ্ছেই। এক কাজ করেন, সকালে আপনারা হোটেলে চলে আসেন। সবাই একসঙ্গে নাশতা খাব, ‘শিশির কোলের কাছে রাখা ব্যাকপ্যাক থেকে ফেসক্লথ বের করে তাশানের গলার কাছে জমা ঘাম মুছে দেয়।
‘তোমার আপা কত কিছু রান্না করে বসে আছে, ‘তৌহিদও ক্ষুণ্ন কণ্ঠে বলতে চায়।
‘তা-ই নাকি? ইশ! নীনাপা-টা আর বদলাইলো না’ শিশির দেশে বেড়াতে আসার আনন্দ নিয়ে খোলা গমকে হাসে, ‘খাব খাব, তাড়া কিসের? দেন ফোন করি আপাকে। সব খাওয়াদাওয়া ফ্রিজে তুলে রাখেন, আমি কালকে সন্ধ্যায় গিয়ে খাব।’
রাত দশটার ঢাকা শহরে বেশিক্ষণ লাগে না হোটেলে পৌঁছে যেতে। কোনার দিকের রুম পায়নি বলে লিসার কাছে আফসোস করে শিশির। পাঁচতলা তবু ঠিক আছে, ঢাকা শহরের ভিউটা ভালো দেখা যাবে। দুজন হোটেল বয় স্যুটকেসগুলো লিফট থেকে ঘরে রেখে যায়। লিসা তড়িঘড়ি মেয়ের কাপড় বদলে ঘুমের জামা পরিয়ে দেয়। সে দাদু আর খালুর দিকে ভয়ার্ত চোখ দিয়ে দেখে মায়ের সঙ্গে সিঁটিয়ে থাকে। শিশির ঠেলে ঠেলেও তাকে শামসুল হকের কাছে ভেড়াতে পারে না।
৫.পাঁচতারা হোটেলের রুম এ রকম হয়, ধারণা ছিল না। নরম আর ঠান্ডা সৌন্দর্য দিয়ে মোড়া ঘরটায় ঢুকে শাহানা একটু জবুথুবু হয়ে বসে থাকে। নীনা জোর করে তার একটা সিল্কের শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে, অনভ্যাসের একটা অস্বস্তি হচ্ছে। শিশির আর লিসা বাথরুমে মেয়েকে গোসল করাচ্ছে। সবাই তৈরি হলে নাশতা খাওয়া হবে।
হাঁটু অব্দি প্যান্ট গুটিয়ে শিশির বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। মেয়েকে গোসল দেওয়া শেষ করেছে দুজন মিলে। লিসার হাত ধরে গুটগুট করে বেরিয়ে আসে, বাথরোবে জড়ানো, কী সুন্দর তাদের নাতনি! শাহানা উঠে হাত বাড়াতে গেলে আরেক দফা ভয় পেয়ে বাবাকে জাপটে ধরে তাশান। শিশির মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাসে, ‘দেখো, সাধে কি আর এখানে এসে উঠলাম! এদের বাথরুম, গোসল এসব সারতে অসুবিধা হতো নীনাপার বাসায়।’
‘আসলে কমোড ছাড়া খুব অসুবিধা হতো।’ লিসা কথাবার্তা শুনতে পেয়েছে।
‘আজকাল ঢাকা শহরে কত অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট আছে, তৌহিদ ভাই সেই মোহাম্মদপুরের মান্ধাতা বাসায় পড়ে আছে। কেমন অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে ছিল, এখনো কি ওই রকমই আছে?’
শামসুল হক, শাহানা দুজন অন্য কিছু বলার চেয়ে নাতনির দিকে বেশি মনোযোগী হয়। দেখতে কার মতো, অবয়বে কার চেহারার প্রতিভাস-এই সব আলোচ্য বিষয়ে শিশির মায়ের স্বভাবে মেয়েকে দেখতে পায় শুনে গলিত মোম হয়ে হাসে শাহানা। আহহা, মেয়েটা একবার কোলে আসলেও তো পারে!
লিসা স্যুটকেসের ডালা খুলে কাপড় বের করছে। তার পরনে সুতির পাজামা আর ছোট শার্ট, বাচ্চার মা মনে হয় না। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে শাশুড়ির জন্য একজোড়া সোনার চুড়ি এনেছে সে। শাহানার পোড়াটে ত্বকে সে দুটো অত্যুজ্জ্বল দেখায়। চুড়ি দুটো পছন্দ হয়েছে তার, অন্তত শিবগঞ্জে দেখানোর মতো জিনিস। তবে শিশিরের বাবার জন্য অন্য কিছু আনতে পারত; স্যুট পরার জায়গা কোথায় শিবগঞ্জে! কানাডায় গেলেও নাহয় কথা ছিল।
এই ভাবনা শাহানার জড়সড় অনুভূতিকে আরও প্রবল করে একটা শুকনো আবর্তে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বুকের ভেতর অন্তত একটা সাধ পোষা ছিল, বারান্দায় ঝোলানো জ্যান্ত টিয়া পাখির মতো সে সাধ অহরহ ডানা ঝাপটাত। প্রতিবেশীদের কাউকে কাউকে মুখ ফুটে বলেও ফেলেছে, ‘আট-দশটার কী দরকার বাবা, আমার এক ছেলে আমার দশ ছেলের শখ পূরণ করে। ও তো যেকোনো দিন মা-বাপকে নিতে পারে, খালি কাগজপত্র জমা দিলেই হয়া যাবে। ওইখানে বয়স্কদের কত সুবিধা! চিকিৎসা ফ্রি, বয়স্ক ভাতা আছে।’
সেই সব বিশ্রামালাপে বিদেশবাসের লম্বা ফিরিস্তি দিতে পারে শাহানা। একেবারে চলে গেলে বাড়িঘরের কী বিলিবন্দোবস্ত হবে, শখের জিনিসপত্র, খাটপালঙ্ক কাকে দেওয়াথোয়া আর কী কী নিজেদের সঙ্গে যাবে-এই সব ভেবে কত সুখ-সুখ নিদ্রাহীনতার রাত কেটেছে তার!
এবারই তো ঘরবাড়ি ভালো করে দেখভাল করতে বলে কাজের মেয়েটিকে বলেছে, ‘সব ঠিকঠাক দেইখো, যখন একবারে যাব, তখন বাড়ির যে জিনিস চাও, তা-ই দিয়া যাব।’
শামসুল হক চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে যখন বিয়ে করেছিলেন, শাহানা তখন সাতাশ। সন্তানধারণে ইচ্ছুক দম্পতির রাতারাতি গর্ভধারণ হবে এমন কথা নেই, তবু তাঁরা আশা করেছিলেন। সে আশা পূরণ হতে পাক্কা নয়টি বছর লেগেছিল। শেষের দিকে শাহানা পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। শামসুল হকও অঙ্ক-বিজ্ঞান থেকে মাথা সরিয়ে ভাগ্যে বিশ্বাসী হয়ে ওঠার প্রাক্কালে এক আশ্চর্য দিনে শাহানা সুসংবাদ নিয়ে এসেছিল।
শাহানার মনে আছে সেই ভোরবেলাকার কথা। স্বামীকে জানানোর আগে সে বেশ কয়েক দিন অপেক্ষা করেছিল, যখন নিশ্চিত হয়েছিল যে তাকে মানসিকভাবে আরও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে তার প্রত্যাশিত ঋতুস্রাব দেখা দেবে না।
আর সেই ছেলে কিনা কাল রাতে তার সঙ্গে দেখা না করে হোটেলে এসে উঠল! ভাগনির বাসায় সবার সামনে নিজেকে কেমন ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল শাহানার!
৬.শিশিরের জেটল্যাগের ঘুমের সময় তাশান নানির কাছে ঘেঁষল একটুখানি, পরক্ষণে ঝাঁপ দিয়ে মায়ের কোলে ফিরে গেল। ছেলের শ্বশুরবাড়ির খবরাদি নিয়ে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঢাকা শহরের জনস্রোত দেখে বিকেল পার করে, নীনার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হলো।
শাহানা অবাক হয়ে দেখল, নীনার ছেলে-মেয়ে দুটোর জন্য ওরা শুধু চকলেট নিয়ে এসেছে। ছয়-ছয়টা স্যুটকেসবোঝাই শুধু মেয়ের ডায়াপার, ক্যানফুড, সিরিয়াল দুধ ইত্যাদি। আরে, এখানকার শিশুরা কি খায় না? এই তো শিবগঞ্জে তাদের পাড়ার অ্যাডভোকেটের মেয়ে এসেছিল, দুই বাচ্চা সঙ্গে করে, তারা তো দিব্যি ঘরের রান্না খেয়ে ফিরে গেল, কিচ্ছু অসুখবিসুখ হয়নি। নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে শাহানার, বলত, ‘যত পুতু পুতু করবে, সন্তান তত তোমার থেকে সুবিধা নিবে।’
নীনা টেবিলভর্তি রোস্ট, পোলাও আরও আরও গুচ্ছের খাবার দিয়ে সাজিয়েছে। তৌহিদের ভাই-ভাবিও তাদের বাচ্চাসহ নিমন্ত্রিত। লিসা খেতে বসলে শিশির তাশানকে কোলে নিয়ে ঘুরছিল, মেয়েটা এখনো মা-বাবা ছাড়া কারও কোলে যাচ্ছে না। এর মধ্যে দুবার বউয়ের কাছে এসে লোকমা খেয়ে গেছে শিশির। শাহানা আড়চোখে দেখে ঝটপট চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
‘আহ নীনাপার হাতের রান্না!’ মেয়েকে কোলে নিয়ে শিশির সবার খাবার তদারক করে।
‘তুই তো অনেক দিন খালার হাতের রান্নাও খাস নাই, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটা। আমাদের মা-খালারা রান্না এক্সপার্ট’, নীনা কি শিশিরকে খোঁচায়? শাহানা একটু সন্ত্রস্ত থাকে, টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকা লিসার মুখ দেখে নেয় একঝলক।
‘খালা-খালুকে তোদের কাছে নিয়ে যা, প্রতিদিন মায়ের হাতের রান্না খাবি।’ নীনার কথায় শিশিরের টলটলে দিঘির মতো হাসিটা কি নিভে আসে একটু? কিন্তু সে এভাবে বলতে পারে অবশ্যই।
‘আর তা ছাড়া কত দিন বয়স্ক মানুষ দূরে দূরে একলা থাকবে?’ খালাতো বোন হলেও শিশিরের খাতির ওর সঙ্গে আপনের চেয়ে বেশি ছিল। কত রকমেই না সে জ্বালাতন করেছে নীনাকে! ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময়, বাইরে যাওয়ার আগে বছরখানেক তো নীনার বাসায়ই ছিল, সেই কবে থেকে এই বাসা ওর ঢাকার মেইলিং অ্যাড্রেস। শাহানা, শামসুলের অসুখবিসুখে, ডাক্তার দেখানো ইত্যকার দরকারে এখানেই তারা ঠাঁই পায়। সেই নীনা এমন করে বলতে না পারলে আর কে বলবে?
‘হ্যাঁ, নীনাপা, চাইছিলাম তো, আমার কি ভালো লাগে আম্মা-আব্বাকে এই রকম দূরে ফেলে রাখতে? স্পনসর করার কাগজপত্র সব রেডিও করলাম একবার। তারপর তাশান হওয়ার পরে আমাদের ইনকাম লেভেল ম্যাচ করল না। তিনজনের ফ্যামিলিতে মা-বাবাকে স্পনসর করতে আরও বেশি আয় থাকতে হয় আর লিসা ম্যাটার্নিটি লিভে থাকল, মানে পুরা বেতন নাই, বোঝোই তো আয় আরও কমে গেল। ওখানে ম্যাটার্নিটি লিভ এক বছর।’ শিশিরকে কি একটু ভারাক্রান্ত শোনায়, নাকি শাহানার কানের ভুল!
‘এখন আবার আরেক ইস্যু সামনে। তাশানের একটা ভাই-বোন দরকার, বোঝোই তো, বিদেশে একটা বাচ্চা সারা জীবন লোনলি। লিসা চাচ্ছিল, এখনই আরেকটা বেবি নিয়ে নিতে। তাহলে পরপর দুজন একসঙ্গে ডে-কেয়ারে গেলে ও ওয়ার্কফোর্সে ফেরত যেতে পারবে। তখন আম্মা-আব্বাকে নেওয়াও সহজ হবে।’
শাহানা এবার ভালো করে দেখে; কই বউমাকে দেখে তো আবার পোয়াতি মনে হচ্ছে না! তার খাওয়া শেষ। এবার শিশির বসবে।
নীনার ‘ওমা, তা-ই নাকি?’ র সঙ্গে লিসার লাজুক হাসি আর শিশিরের কথার আধাআধি অনুধাবন করতে পারে। হ্যাঁ, বউয়ের আড়াই মাস চলছে। ‘ওর শরীরের ধরনটা ভালো, গর্ভাবস্থায় খুব একটা নাজেহাল হয় না, খাওয়াদাওয়ার সমস্যা নেই ওর, সবকিছু দেখে গাইনকলোজিস্ট ভ্রমণ করার অনুমতি দিল।’
শিশির বয়ান করে চলেছে, ‘ওখানে আমার এক কলিগ আছে, ম্যারাথন স্প্রিন্টার। ছয় মাস পর্যন্ত দশ কিলোমিটার দৌড়াত! আর এ তো মাত্র তিন সপ্তাহের লাক্সারি ট্রিপ, কী বলো লিসা?’
এইবার মায়ের দিকে ফেরে শিশির, ‘আর আম্মা, চারজন হয়ে গেলে ট্রাভেল করাও আরেক বড় ক্যাচাল হবে, তাই তোমাদের দেখতে আগেই চলে এলাম, ‘ খুশি, দায়িত্ব আর চিন্তিত মুখের চলচ্চিত্র বানিয়ে শিশির বলে যেতে থাকে।
শাহানা মনে মনে কিছু শব্দের আভিধানিক অর্থ খুঁজতে থাকলেও বুঝে যায় যে তাদের কানাডায় যেতে এখনো ঢের বাকি। আদৌ হয় কি না, কে জানে? তবু মুখে বলে, ‘তুই একটু শান্তিমতো খায়া নে তো আগে, কথা বলতে বলতে সব ঠান্ডা হইলো।’
৮.মাইক্রোবাস ছুটে যাচ্ছে সোনারগাঁয়ের দিকে। শিশিরের মেয়েটা কাঁদে কম, তবু কোনো কারণে কেঁদে উঠলে মুখে প্যাসিপেয়ার গুঁজে দেয় লিসা। দেখলে শাহানার দমবন্ধ লাগে। শিশুরা হাসবে, কাঁদবে, কত রকম মুখভঙ্গি করবে, তাদের সঙ্গে বড়রা সবাই শিশু হয়ে উঠবে, এ-ই না হলে হয়! মেয়েটাকে কাঁদতেই দেয় না। কথায় কথায় মুখে সুশ ঠেসে দেয়। তারপরও কাঁচপুর ব্রিজের কাছে প্রবল ট্রাফিক জ্যাম, রিকশা-গাড়ির অদম্য আওয়াজে তীব্র কেঁদে উঠেছে তাশান, ভয় পেয়েছে নির্ঘাত। লিসার মুখ সামান্য বিকৃত দেখিয়েছে, ‘আসলে, এত মানুষ দেখে তো ওর অভ্যাস নেই।’
কথা সত্যি, হঠাৎ করে শিশুর চেতনায় ধাক্কা লাগারই কথা।
সোনারগাঁয়ে এক ঢিলে দুই পাখি, প্রাচীন বাংলার রাজধানী দেখো আর শাড়ি কেনো। লিসার মা-খালারা মিলিয়ে চারজন থাকে কানাডা-আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে। তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো উপহার জামদানি শাড়ি। কারুশিল্প জাদুঘরে গিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ছবি তুলছে ওরা। শিশির সারাক্ষণ পাউচে করে মেয়েকে নিয়ে হাঁটছে। সবাই মিলে ছবি তোলা হলো। শিশিরের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ লিসার ছবি তুলে দিলেন শামসুল হক। শাহানা চোখের কোণ দিয়ে ছেলের বউকে দেখে; মেয়েটার চোখ-মুখের গড়ন আলাদা করে ভালো কিছু নয়, গায়ের রংও কি এমন দুধে-আলতা? নেহাত একটা আলগা চটক আছে। পরক্ষণেই মন নরম হয়ে আসে। আহা, তার পুত্র, তার নাড়িছেঁড়া ধন, এই মেয়েটির কাছে আছে, সে সুখে থাকলেই তার সুখ। কোমল গলায় লিসাকে ডেকে তার সঙ্গে একটা ছবি তুলিয়ে নেয় শাহানা।
চার-পাঁচটা শাড়ি কেনা হলে শিশির মাকে বলে একটা পছন্দ করতে।
‘আমার জন্য লাগবে না, তুই বরং নীনা আর তোর খালাকে দুইটা শাড়ি দে।’ শাহানা সুন্দর করে হাসে। রং-জমিন মিলিয়ে পছন্দ করে বেশ বাহারি আর দামি দুটো শাড়ি। শিশিরকে সাতটা শাড়ির বাহাত্তর হাজার টাকা দাম মেটাতে দেখার উদ্বেগ চটজলদি নিজের ভালো লাগা দিয়ে ঢেকে দিতে পারে শাহানা। তারপর দ্রুতপায়ে গাড়ির দিকে ফেরে। গাড়িতে তার পানির বোতল, ওষুধ আর আজ হাতব্যাগে চকলেট বারও আছে।
৯.প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই শিশিররা মুম্বাইয়ের প্লেন ধরতে বেরিয়ে গেল। এবার কারও বিমানবন্দরে যাওয়ার দরকার পড়েনি। আটদিন ঢাকায় থাকার মানে হয় না। শামসুল হক আগামীকাল সকালে রওনা দিতে চান। নীনার ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা, মেহমান থাকলে তাদের পড়ার ক্ষতি, শিক্ষক মানুষ এসব না বুঝলে আর কে বুঝবে!
নীনা আর তৌহিদ দুজন কী সব কাজ নিয়ে বাইরে গেছে।
রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতে চোখ ফুলিয়ে কাঁদে শাহানা। শামসুল হক টিভি দেখছেন, কান্নার শব্দ বসার ঘরে পৌঁছায় না। চোখে-মুখে পানির ঝাপটাদিয়ে ট্রে সাজিয়ে বসার ঘরে এসে বসে রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে দেয় শাহানা।
‘ঠিকই করছি, নীনার জন্য ওর হাতে আরেকটু ভালো কিছু উঠল না!’
‘তা–ই বলে তুমি এত্তগুলান টাকা দিয়া শাড়ি কিনাবা?’ শামসুল হক ছেলের পক্ষ নিয়ে ফেলেন।
সহসা হিসহিসিয়ে ওঠে শাহানা, ‘পড়াই নাই? ছেলেক ক্যাডেট কলেজে পাঠাই নাই? ছাত্র পড়ায়া পড়ায়া তোমার কোমরে বাত হয়া যায় নাই? বিদেশে ভার্সিটিত চান্স পাইছে, কিন্তু যাওয়ার ট্যাকা বাপের বাড়ির পাওয়া জমিন বেচে আনি নাই? একটা সাধ-আহ্লাদ পূরণ হইছে এই জীবনে? আমাক শিখাবার আইসো না তুমি, এত দিন মুলা ঝুলায়া থুইছে, আমাদের দুইজনেক কানাডায় নিয়া যাবে, এখন তো শুনলা, আরেকটা বাচ্চা নিতেছে ওরা। মা কইতো, ছইলের টান তার নিজের ছইলের জইন্য। ছেলে আর আমাদের নাই, এখন আমাদের আর কিছু নাই!’ হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ে শাহানা। শামসুল হক একাগ্র চিত্তে চায়ে চুমুক দিয়ে চলেন।
শাহানা কেঁদে কেঁদে নিজেই স্থির হয়। ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে ঠান্ডা পানি খায়। আঁচলে মুখ মুছে আবার এসে বসে। ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে থেমে থেমে বলে ওঠে, ‘এখন আমরা ছাড়ব কী জন্য? আমি চায়া চায়াই নিব, আমি এখন প্রতি মাসে শিশিরের কাছে টাকা চায়া চায়া নিব, জমি কেনার টাকা, আরেকটা বাড়ি করে ভাড়া দিতে হবে, আমাদের এইখানে তো বয়স্ক ভাতা নাই, আমাদের চলবে কী দিয়া?’
হঠাৎ কোথাও কিছু একটা বেজে ওঠে। বাসার কলবেল, রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ির হর্ন, নাকি সব ছাপিয়ে বেখাপ্পা কোনো পাখি ডেকে ওঠার আওয়াজ, কে জানে! শাহানাও চকিত হয়ে উঠলে ওর দিকে ভালো করে তাকান শামসুল হক। তার সাদা বুটি নীল সুতিশাড়ি, মেন্দির রং দেওয়া খোলা চুল, কান্নাফোলা চোখের নিচে চেনা ত্বকের ওপর চেনা আঁচিল। কোনো মিল নেই, তবু শাহানা যেন সেই পরি, যার পায়ের নিচে পেরেক আছে, কিন্তু সে উড়ে উড়ে নেচে চলেছে, তার পায়ের নিচে পেরেকটা কি ধীরে ধীরে লম্বা হচ্ছে? নাকি শাহানা ক্রমেই ওপরে উঠে যাচ্ছে? আচ্ছা, যেকোনো সময় তাল হারিয়ে ধপাস করে যদি নিচে পড়ে যায়? যদি যায়, তাহলে পেরেকটা পায়ের পাতা ফুটো করে দিলে শাহানার কত রক্তপাত হবে, ব্যথা বোধ আদৌ করবে কি না, বুঝে উঠতে পারছেন না শামসুল হক।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক য ড ট কল জ স য টক স শ বগঞ জ ট র ওপর আম দ র র স মন র জন য র ভ তর আজক ল বউয় র র একট একব র দরক র বয়স ক চকল ট র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
রাজকীয় ভোজে ট্রাম্প–মেলানিয়াকে কী কী খাওয়ালেন রাজা চার্লস
জমকালো সাজে সেজেছে যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হল। উপলক্ষটাও অনন্য, রাজকীয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সস্ত্রীক যুক্তরাজ্য সফর উপলক্ষে এখানে রাজকীয় নৈশ্যভোজ আয়োজন করেন রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি ক্যামিলা।
বুধবার রাতের রাজকীয় এ আয়োজনে কূটনীতি, খাবার, ঐতিহ্য, সংগীত আর আভিজাত্য একসুতোয় বাঁধা পড়েছিল। ট্রাম্প–মেলানিয়াসহ রাজার অতিথি হয়েছিলেন বিশ্বের ১৬০ জন গণমান্য ব্যক্তি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্মানে রাজা তৃতীয় চার্লসের আয়োজন করা রাজকীয় ভোজের টেবিল। যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসলের সেন্ট জর্জেস হল, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫