Prothomalo:
2025-09-18@04:52:49 GMT

মনকাঁটা

Published: 16th, September 2025 GMT

খুব মাথা ঘুরছে। এত বেশি ঘুরছে যে নিজেকে লাটিম মনে হচ্ছে। যতক্ষণ সজোরে ঘুরতেছিল ততক্ষণ খাড়ার ওপরই ছিলাম, যেই ঘূর্ণনটা একটু কমল, এমনিই দপ করে পড়ে গেলাম। আমার কপাল ভালো, যে জায়গাটায় পড়লাম, সেটা বালুময়। জায়গাটার নামই বালুকান্দা। আর এই বালুকান্দার বালুতে গুদামঘরের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে পড়েই তো বড় হলাম। প্রায় প্রতিদিন স্কুলের পর বা স্কুল থেকে পালিয়ে এই গুদামঘরের ছাদেই বসে থাকতাম। বসে থাকতে থাকতে যখন বিরক্ত হয়ে যেতাম, তখন শুরু হতো ছাদ থেকে লাফানো। বালুকান্দার বালুও ছিল স্যাঁতসেঁতে তুলার মতো নরম। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লে ব্যথার বদলে আরামই লাগত। সেই বাল্যবান্ধব বালুতে এত দিন পর আবার মাথা ঘুরান দিয়ে পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়েও আমার মাথা ঘুরানটা কিন্তু থামেনি। তবে ঘূর্ণনের স্পিড কমে তা ঘড়ির কাঁটায় রূপ নিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে ঠিক আমার মাথা না, পুরো শরীরটা ঘড়ির কাঁটা হয়ে ঘুরছে, টিকটিক টিকটিক। টিকটিক আওয়াজটা কি সত্যিই হচ্ছে, না আমি বানাচ্ছি, তা একটু চিন্তা করে বলতে হবে।

হ্যাঁ, আওয়াজটা হচ্ছে মনে হচ্ছে, কিন্তু ঠিক কোথায়, তা ধরতে পারছি না, যেন ঘড়ির ঘূর্ণন আর আওয়াজ আলাদা জায়গায়। আওয়াজটা হচ্ছে দূরে কোথাও, পূর্ব দিকে কি? আমি ঘুরছি এখানে ঘড়ির কাঁটা হয়ে আর আওয়াজটা আসছে বালুকান্দার ওই পাড় বাবুবাজারের নামা থেকে। সেখানে অনেকগুলো শিয়ালের গর্ত আছে। সেখানে শিয়ালরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে থাকে। রাতের বেলায় বার হয় খাবারের সন্ধানে। আমাদের হাঁস–মুরগির অর্ধেক তো শিয়ালদের পেটেই গেল। এই নিয়ে আমার আম্মার প্যানপ্যানানি প্রায় থামেই না। আর আমার আব্বা নির্বিকার নির্লিপ্ত বসে থাকে শীতকালের রোদে, ওনার বহু বছর আগের কেনা কাশ্মীরি শাল গায়ে দিয়ে। আম্মার ঘ্যানঘ্যানানি শুনে মুচকি মুচকি হাসে, খুব নিচু গলায় আমারে কয়।

মুরগি খাইছে তো কি হৈচে। এরলাগি এয়াল কি মাইরে লাইতে অইব নাহি? তুই নিজে খাচ না। এয়ালদেরও তো খাওন লাগে নাহি। ভুখের কষ্ট সব প্রাণীর এহই।

আমরা বাপবেটা অতি সতর্কতার সঙ্গে হাসি। হো হো করে হাসব; কিন্তু কোনো শব্দ হবে না। আমরা বহুদিন প্র্যাকটিস করে এই হাসি রপ্ত করেছি। আমরা প্রাণ খুলে হাসি আর খুব সন্তর্পণে শেয়ালদের গল্প করি। শিয়ালদের তো অনেক বুদ্ধি।

শেয়ালদের এত বুদ্ধি কেন? কই পাইল এরা এত বুদ্ধি?

কই পাইল, মানুষই বানাইছে গল্পে গল্পে, ওরা যে আমাদের মুরগি খায়া ফেলে তা না, নানা রকম উপকারও করে।

কেমনে?

এই ধর, আগুন মাসে যহন খেতে ধান, তহন ইঁন্দুর সব ধান কাইট্টা নিজের গাতায় নিয়ে যায়। এয়াল তহন ইঁন্দুর খায়া আমাদের ধান রক্ষা করে। দেখবি এয়াল কহনও ধানের সিজনে হাঁস–মুরগি বা ছাগল খায়তে আসে না। আসে কার্তিক মাসে বা চৈত্র মাসে, যহন খেতে ধান নাই, জঙ্গলে ইঁন্দুর নাই।

শিয়ালদের অনেক বুদ্ধি কীভাবে তা চিন্তা করতে গিয়ে দেখি আমার নিজের বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। আমি ঠিক চিন্তা করতে পারছি না। আমার শরীরের ঘূর্ণন আমার মাথার বুদ্ধিকে কি তরল করে ফেলছে? আব্বা বলে, এত বুদ্ধি দে কী করবি? বুদ্ধি কম থাহা ভালা। বেশি বুদ্ধির মানুষ ইতর কিছিমের হয়।

আমার ছোট চাচা যে পাগল হয়ে গেছিল, উনি কি বেশি বুদ্ধির মানুষ ছিল?

আব্বার মুখ থেকে খুব সন্তর্পণে হাসিটা অপস্রিয়মাণ হয়ে যায়। যেন শীতের সকালে ভুল করে এক টুকরা মেঘ এসে উত্তাপের একমাত্র ভরসা রোদটা ঢেকে দিল। প্রশ্নকর্তা আমি রাজ্যের বোকামি মাথায় নিয়ে বসে থাকি। আর ভাবি আমার যদি আরেকটু বুদ্ধি থাকত। তাহলে নিশ্চয় আব্বাকে এই প্রশ্নটা করতাম না। আমার ছোট চাচা অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী ছিল। পড়াশোনায় সব সময় ফার্স্ট। কলেজে গিয়ে প্রথমে নেতা হয়ে উঠল, দাদা এটা নিয়ে অনেক চিৎকার–চেঁচামেচি করত; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তারপর মাস্তান হয়ে গেল। তারপর ড্রাগ অ্যাডিকটেড। তারপর একদিন বুদ্ধি করে আমগাছের ডালে ঝুলে পড়ল। কেন ঝুলে পড়ছিল, তা আমরা জানি না। কেউ কোনো দিন মুখও খোলেনি সে ব্যাপারে। আমরাও জিজ্ঞেস করার সাহস করিনি। এটা কোনো রহস্য এবং সেই রহস্য জানতে হবে সে চিন্তাও কোনো দিন মাথায় আসেনি। বুদ্ধি কম বলেই হয়তোবা। অনেক ছোটবেলায় আমার ছোট চাচা আমাকে আর আমার বড় ভাইকে দুটি কাঠের তলোয়ার বানিয়ে দিছিল। আমার দুই ভাই সেই তলোয়ার ফাইটে একজন আরেকজনকে রক্তাক্ত করে দিয়েছিলাম। ছোট চাচা যখন কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখল, দুজনকে তখন কিছু বলেনি। সেই কাঠের তলোয়ার নিয়ে আমরা শীতের সন্ধ্যায় আগুন পোহাতে বসি। চাচা কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল, তারপর তলোয়ারগুলো খড়ের আগুনে দিয়ে দিল। আমরাও কিছু বলিনি। যেন এটাই সঠিক কাজ। সেদিন সন্ধ্যায় কাঠের তলোয়ার আগুনে দেওয়াতে আমরা অনেকক্ষণ ধরে আগুন পোহাতে পেরেছিলাম। আমাদেরকে কেউ পড়তে হবে, সেই জন্যও ডাকেনি। মনে হয়েছিলও যেন দুনিয়ার সমস্ত যুদ্ধবিগ্রহকে, সমস্ত তলোয়ারের ইতিহাসকে আমরা শ্মশানে শেষকৃত্য করে জগতে ফিরে এসেছিলাম। সেই রাতে বাল্লে মাছের ঝোল আর মুলার সঙ্গে টেংরা মাছের শুঁটকির তরকারি দিয়ে ছোট চাচা, আমি আর আমার বড় ভাই একই পার্টিতে বসে খুব আয়েস করে খেয়েছিলাম যুদ্ধ-মৃত্যুর প্রথম খানা।

তারপর বহু বহুদিন পর ছোট চাচা নাকি ভাতের কষ্ট সইতে না পেরে আমগাছে ঝুলে পড়েছিল। এটা আসলে একটা বোগাস কথা। খাইতে না পেয়ে কেউ আত্মহত্যা করে, আমার বিশ্বাস হয় না। মাস্তান হয়ে উনি প্রথমেই ওনার ভাগের জমিজমা বিক্রি করে দেন। দাদা তত দিনে গত হয়েছেন। আমার আব্বার ব্যবসা–বাণিজ্যও আর আগের মতো নেই যে উনি কিনে নেবেন। তাই কোথায় বিক্রি করল, তা কেউ জানতেও যায়নি। সবকিছু শেষ করে ওনার মধ্যে শুরু হয়েছিল ধ্বংসাত্মক প্রবণতা। একবার তো ওনার মা, মানে আমার দাদি, ছোট চাচি আর ওনার একমাত্র মেয়েকে ঘরের মধ্যে তালাবব্ধ রেখে ঘরে আগুন দেয়। সেই দিন কপাল ভালো যে পাড়া-প্রতিবেশী খুব সহজেই ওনার ঘরের বেড়া ভেঙে সবাইকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছিল। সেই ঘটনার পর ছোট চাচা বহুদিন নিরুদ্দেশ ছিল। আমরা বাড়ির সবাইও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। যাক বাবা আপদ গেল কোনো এক অসিলায়।

তারপর একদিন আমরা খবর পেলাম যে উনি আমাদের গ্রামের পাশে উজার বাড়ির জঙ্গলে পেতনিদের বাসা বলে খ্যাত যে বিশাল গাবগাছ, তার নিচে আস্তানা গাড়ছে। মাথায় বাবরি চুল, দাড়ি গোঁফে নাকি ওনাকে চেনাই যায় না। উজার বাড়িতে রাতের বেলায় তো দূরের কথা, মানুষ দিনের বেলায়ও যায় না। সেই জঙ্গলে আস্তানা, আমরা শুনেও দেখতে যাব কি না, সে নিয়ে দোনামোনায় ছিলাম। আমাদের বাড়ির কেউ কেউ গিয়ে দেখে এসেছে ঘটনা সত্যি। উনি গাবগাছের নিচে ধ্যানে মগ্ন। তার কিছুদিন পরই উনি আমগাছে ঝুলে পড়েন। যেদিন আমগাছে ঝুলে পড়েন তার আগের দিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমার মা আমার এই ছোট চাচাকে নিজ সন্তানের মতোই বড় করেছিলেন; কিন্তু মাস্তান হয়ে যাওযার পর, ড্রাগ অ্যাডিকটেড হয়ে যাওয়ার পর ওনার ভালোবাসা রূপ নিয়েছিল চরম ঘৃণায়। তারপর থেকে ছোট চাচা আমাদের বাড়ি এলেই আম্মা কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিতেন। ছোট চাচকে এমনকি বারান্দায়ও বসতে দিতেন না। সেই রাতেও যখন উনি কিছু একটা খাইতে দিতে বলেছিলেন, আম্মা কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, কুত্তার মতোই চে চে করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই তাড়িয়ে দেওয়ার খবর আর কারও জানা না থাকলেও আমার ছিল। আমার কেন যেন খুব ইচ্ছা করছিল সেদিন ছোট চাচাকে ডেকে এনে খাইতে বলি। আমাদের সেই রাতে অনেক ভালো খাবারদাবার ছিল। কোনো উপলক্ষে না, তবে ভালো। মাছ মাংস ডাল সবই ছিল। তা–ও আমার মা আমার ছোট চাচাকে খাইতে দেয়নি শুধু ওনার কর্মকাণ্ড ঘৃণা করত বলে। আমার কেন যেন মনে হয়, আমার ছোট চাচা সব অপমান সইতে পারলেও সেই রাতের অপমান সইতে পারেননি। তার পরের দিনই উনি ঝুলে পড়েন।

তারপর আমরা কত দিন কীভাবে বেঁচেছিলাম, আমার মনে নেই। শিয়াল কি তখনো ছিল? আমাদের জমিখেতি বহু আগেই ইটের ভাটা হয়ে গেছে। বাবু বাজারের নামা বলে এলাকায় আর কিছু নেই। বালুকান্দার বালু বহু আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। তাহলে আমি যে বালুর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি, সেটা কোথায়? শিয়ালের ডাক শুনছি, তলোয়ারের আগুনের তাপ এসে আমার মুখ ঝলসে দিচ্ছে। স্যাঁতসেঁতে তুলার মতো নরম বালুর মধ্যে আমি গড়াগড়ি খাচ্ছি। আমার শরীর তখন ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করে ঘুরছে। মনে হচ্ছে আমি যেন ছোট চাচার কবরের ঝুরঝুরে মাটির মধ্যে শোয়া।

২.

আমার দাদি যেদিন মারা যান, সেদিন আমার বৃত্তি পরীক্ষা ছিল। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা। আমার মা আর আমাদের জাগির মাস্টার মিলে আমাকে না জানিয়েই পরীক্ষা দিতে পাঠিয়ে দেন থানা শহরে। আমার পরীক্ষা ভালো হয়নি সেদিন। বৃত্তি আমি পাইনি। বেশ কয়েক দিন পর যখন আমি বাড়ি ফেরত আসি, আমাকে দেখে প্রতিবেশী কোনো এক চাচি কেন হাউমাউ করে কাঁদছিলেন, আমি বুঝিনি। ওনার কান্নাজড়িত অস্পষ্ট কথাও সব বুঝিনি। কেবল বুঝছিলাম আমার দাদি মারা গেছেন এবং আমি তাকে শেষ দেখা দেখতে পারিনি। বাড়িতে পৌঁছার পরও আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন, সঙ্গে আমিও, কিন্তু সেই কান্না কতটা মৃতের জন্য ছিল, তা আমার মনে নেই। মৃত্যুর সময় অনুপস্থিতির একটা মজা আমি ছোটবেলায় পেয়ে গেছিলাম। তারপর যখনই কোনো মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পারতাম, তখনই আমি পালিয়ে যেতাম। সেটা করেছি বাবা মারা যাওয়ার সময়, মা মারা যাওয়ার সময়। তারপর কোনো মৃত্যুই আমি আর কাছ থেকে দেখিনি। দেখতাম না, নানা অসিলায় দূরে থাকতাম।

জীবনে আমি দুটি মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম; একটা এক মুরগির বাচ্চার মৃত্যু আরেকটা একটা পাখির। মুরগির বাচ্চাটা তখন আমারই বয়সী ছিল। যখন সে মরে আমি একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। তারপর যখনই কেউ মারা যেত, আমার কেবল সেই মুরগির বাচ্চার শেষনিশ্বাস নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টার কথাই মনে পড়ত। আমার খুব কষ্ট হতো এই ভেবে যে মুরগির বাচ্চাটাকে আমি কোনো হেল্প করতে পারিনি, তাকে সহযোগিতা করতে পারিনি একটু নিশ্বাস নেওয়ায়। সেই কষ্ট লাঘবের আশায়, যখন অনেক বড় হয়েছি, তখন একটা শালিককে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখে হাতে তুলে নিই। তাকে চেষ্টা করি কিছুটা কমফোর্ট দিতে। কিন্তু আমার এই কমফোর্টকে সে কোনোই তোয়াক্কা না করে মুরগির বাচ্চার মতোই নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে একসময় থেমে যায়। আমি বুঝি তাকে আর কোনোভাবেই কমফোর্ট বা ডিসকমফোর্ট, কোনোটাই দেওয়ার সুযোগ নেই। আমি তাকে আমার বাড়ির বেকইয়ার্ডে অতি যত্নের সঙ্গে দাফন করি।

এখন আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার কি এখন শালিকের মতোই অন্তিম সময়? আমি কি ঘুরতে ঘুরতে একসময় থেমে যাব? আব্দুর রহমান বয়াতির কথা মনে পড়ে, ‘একটা চাবি মাইরা দিছে চাইরা জনম ভরা ঘুরতে আছে।’ ঘড়ির কাঁটার মতোই আমি এখন ঘুরছি থেমে যাওয়ার আতঙ্ক নিয়ে, ছোট চাচার কবরে, যা বালুকান্দার বালুর মতোই নরম, ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে।

৩.

ছোট চাচা আমারে ধমক লাগায়, ‘এই বান্দরের বাচ্চা মাটির মধ্যে গড়াগড়ি খায়তাছস কেন? যা বাড়ি যা। গিয়া দেখ চেয়ারম্যান বাড়িতে আগুন লাগছে।’ আমি ঘাড় তোলার চেষ্টা করি, আগুন দেখার চেষ্টা করি, কোথাও কোনো আগুন দেখি না। চারদিকে কেমন যেন ঝাপসা, এই ঝাপসার কারণ কি ধোঁয়া না কুয়াশা, আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারি না। চেয়ারম্যান বাড়ি কোন দিকে, উত্তরে না দক্ষিণে না পুবে না পশ্চিমে, কোন দিকে ছিল। আমি ঘড়ির কাঁটা হয়ে ঘুরি, ঘুরে ঘুরে দেখার চেষ্টা করি, কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পারি না এক আকাশ ছাড়া, আকাশের কোনো দিক আছে কি না জানি না, নক্ষত্ররাজির সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই, দাদা নক্ষত্র দেখে দিক বলে দিতে পারতেন। উনি অন্ধকার রাতেও শুধু নক্ষত্র দেখে দেখে নাকি নৌপথে গন্ডগোলের সময় বাড়ি আসছিলেনও কাশিপুর থেকে। কাশিপুর দাদার পীরের বাড়ি। সেখানে তিনি সময় পেলেই চলে যেতেন, আপদে-বিপদে যেতেন, দিনকাল ভালো হলে যেতেন, ফসল ভালো হলে যেতেন, মন্দ হলেও যেতেন, কোনো পরামর্শের দরকার হলে যেতেন। ওনার পীর (বাবাজানের) অনুমতি ছাড়া উনি কোনো কাজ করতেন না। গন্ডগোল যখন দেশে লাগি লাগি করতেছিল, তখনই নাকি তিনি বাবাজানের কাছে চলে গিয়েছিলেন পরামর্শ করার জন্য। ওনার অবস্থান কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ওনার জন্য সহজ ছিল না। কারণ, তিনি তখন এলাকার চেয়ারম্যান, বহুদিনের পুরোনো চেয়ারম্যান। তার ওপর নির্ভর করে এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা। একদিকে মুক্তিবাহিনী আরেক দিকে সরকার। কার পক্ষ নেবেন তিনি?

মুক্তিবাহিনীর পক্ষ নেওয়া ওনার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ ওনার বিদ্রোহী বড় ছেলে যাকে দাদা বেশ কয়েক বছর আগেই ত্যাজ্য করেছিলেন এলাকায় আকাম–কুকাম করার অপরাধে, সেই বড় ছেলেই এখন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। বড় চাচার সঙ্গে দাদার বিরোধ নাকি চরমে গিয়েছিল কোনো এক ইলেকশনের সময়। চাচা দাদার বিরুদ্ধে ইলেকশনও করেছিলেন, যদিও দাদাই পাস করেন; কিন্তু ওনাকে বেশ বেগ পাইতে হয়েছিল। বড় চাচা স্বভাবে দুষ্ট, আকাম-কুকামের রাজা, দশগ্রামের যত খারাপ মানুষ আছে, সবাই নাকি তার চেলাচামুণ্ডা। এলাকায় ভেরাইটি শো করা, জুয়ার আসর বসানো, নরসিংদী থেকে মেয়ে এনে প্যান্ডেল করে নাচানো—এই সবই ছিল ওনার পছন্দের কাজ। দাদা এসব পছন্দ করতেন না। সেই বিরোধের জের ধরেই বাপছেলের কুরুক্ষেত্র আমাদের সংসারে নাকি শুরু হয়েছিলও বহু বছর আগে। আমরা তখন ছোট, কিছুই বুঝি না, শুধু দেখি ছোট চাচা, আব্বা আর দাদা খালি মিটিং করেন রাতবিরাতে। মাঝেমধ্যে শুনেছি বড় চাচাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। দাদাই নাকি পুলিশ খবর দিয়ে নিয়ে আসতেন। দাদি কান্দে, ছোট চাচাকে কবুতরের মাংস আর চিটারুটি টিফিন ক্যারিযার ভরে থানা–হাজতে পাঠায়। কয়েক দিন পর বড় চাচা জেল থেকে ফেরত আসেন, তারপর যেই সেই। এই করে করেই ওনার দিন যাচ্ছিল। তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাপ ও ছেলে দুজন দুপথে পা বাড়ান। বিরোধ তখন চরমে।

এইগুলো আমার সবই শোনা কথা দাদির কাছে। তবে বড় চাচা যে আমাদের পরিবারের বাইরে, আমাদের বিরুদ্ধে, তা আমরা ছোটবেলায় বুঝে যাই এবং ওনার বাড়ির দিকে কখনো যেতাম না। ওনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হলেও কথা বলতাম না। আমরা দুই পক্ষই লজ্জায় মাথা নিচু করে একদল আরেক দলকে ক্রস করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পার হয়ে যেতাম। স্বাধীনতার পর বড় চাচাই চেয়ারম্যান হন। দাদাকে তত দিনে মুক্তিবাহিনী মেরে ফেলেছে। সবাই বলাবলি করে বড় চাচার নির্দেশেই নাকি এটা হয়েছে। দাদির কাছে শুনছি দাদাকে মুক্তিবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে জীবন্ত কবর দিয়েছিল। এটাই ছিল দাদার শেষ ইচ্ছা। দাদা নাকি একটা আরজি করছিলেন, যারা দাদাকে মেরে ফেলার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল তাদের কাছে। দাদার শেষ আরজি ছিল ওনাকে যেন জীবন্ত একটা কবরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কবরটা ছিল ওনার বড় ছেলের বড় নাতি রিশুর। রিশু খুব আদরের নাতি ছিল দাদার। তখনো বড় ছেলের সঙ্গে ওনার বিরোধ চরমে পৌঁছেনি। একান্নবর্তী পরিবারে প্রথম শিশু, সবাই লাইন দিয়ে থাকত কে কোলে নেবে। একজন রাখে তো আরেকজন এসে সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিত। সেই রিশু একদিন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেল বাড়ির পেছনের পুকুরে। তারপর যখন ভেসে উঠল ততক্ষণে সব শেষ। রিশুর ঘটনা দিয়েই নাকি পরিবারে বিরোধের শুরু। পুকুরে যাওয়ার আগ মুহূর্তে নাকি দাদার কাছেই বসা ছিলও রিশু। বড় চাচি নাকি দাদাকে সরাসরিই বলে বসছিল, ‘আপনার উদাসীনতাই আমার ছেলের মৃত্যুর কারণ।’ তারপর দাদাও আর কোনো দিন চাচির সঙ্গে কথা বলেননি। সেই প্রিয় নাতির কবরে শুয়ে শেষনিশ্বাস নিতে চেয়েছিলেন দাদা। তার কথামতো যে দুজন তারে খুন করতে ধরে নিয়ে গেছিল, তারা তাই করল। দাদা তো খুব দাপুটে লোক ছিলেন। পঁচিশ বছর চেয়ারম্যানি করেছেন এলাকায়। হেন মানুষ নেই দাদাকে সালাম না দিয়ে রাস্তা ক্রস করত। সেই সম্মানী লোক একটা আবদার করবেন, সেটা না রাখার শক্তি কি মার্ডারারদেরও ছিল? দাদির মুখে শোনা এই সব গল্প বড় হয়ে এলাকার নানা গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম। পরে মনে হয়েছে গল্প আসলে একই, তবে নানা লোক নানাভাবে বলে এই যা। এলাকায় অবশ্য এই গল্পও চালু আছে যে দাদাকে মুক্তিরা মেরে গাছে ঝুলায়ে রাখছিল। বড় চাচার নির্দেশে পরে নদীতে ভাসায়ে দেয়। চাচাকে কি একবার জিজ্ঞেস করব? কোন নদীতে ফেলছিল? সে নদীতে কি অনেক ক্ষুধার্ত কুমির ছিল?

বড় চাচা আসলে আমাদের আপন চাচা না। দাদার অবৈধ সন্তান। সেটাও নাকি কাশিপুরের ঘটনা। দাদা তার পীরের বাড়ি গিয়ে থাকতেন, এটা তার বিয়ের আগের ঘটনা। তখন সেই পীরের বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে নাকি আকাম করতে গিয়ে এই সন্তানের জন্ম হয়। পীরের নির্দেশে এই মেয়েকে কিছুদিনের জন্য বিয়ে করলেও তাকে কোনো দিন বাড়ি আনেননি। তারপর দাদির সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর নাকি একদিন এই ছেলেকে নিয়ে এসে দাদির হাতে দেয় এবং ঘটনা খুলে বলে। তারপর দাদিই এই ছেলেকে মাতৃস্নেহে বড় করেন। এই সবই গল্প। আমার পরিবারের গল্প আমি সারা জীবন মানুষের কাছেই শুনেছি। পরিবারের লোকজন কখনো এসব নিয়ে মুখ খুলত না। লোকজন এ–ও বলাবলি করে যে দাদা নাকি বউ আর বাচ্চাসহই রওনা করছিলেন পীরের বাড়ি থেকে, তারপর আসার পথে কোনো এক নদীতে, মেঘনা নাকি তিতাস, এখন আর মনে করতে পারতেছি না, যেখানে ক্ষুধার্ত কুমির কিলবিল করছিল, সেখানে বড় চাচার মাকে ধাক্কা দিয়ে নৌকা থেকে ফেলে দেয়। দাদার ক্ষমতার কারণে সেই মার্ডার নিয়ে কেউ কোনো দিন টুঁ শব্দ করার সাহস করেনি। বড় চাচা নাকি মায়ের হত্যার বদলা নেওয়ার জন্যই দাদাকে তার দলের লোক দিয়ে হত্যা করে। মাতৃহত্যার বদলা নেওয়া হলো, আবার রাজাকার পিতাকে ক্ষমা না করার দৃষ্টান্তও স্থাপন হলো—এক ঢিলে দুই পাখি। এসবই মানুষের গালগল্প। এ রকম বহু গল্প চালু আছে আমাদের এলাকায়।

বড় চাচা তখন কত বড় ছিলেন? উনি কি দেখছিলেন মাতৃহত্যার দৃশ্য? সেই জিঘাংসা কি মনে মনে পোষণ করতেন সব সময়? তিলে তিলে কি ওনার ক্ষমতাকেও গড়ে তুলছিলেন দাদার সঙ্গে শেষ বোঝাপড়া করার জন্য?

দাদির মুখে এই সম্পর্কে কোনো দিন কিছু শুনিনি। গ্রামবাসীর কথাও সত্যি হতে পারে। সত্যি যদি না হয়, তবে বাপ ছেলের বিরোধ কীভাবে খুনখারাবি পর্যন্ত যায়? কীভাবে একটা গোটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়?

এ ঘটনার পর বড় চাচাকে দাদি আর কোনো দিন ছেলে হিসেবে গণ্য করেননি। আর কোনো দিন বড় ছেলের নামও মুখে নেননি। দাদির শেষ গল্পটা ছিল ঘড়ির কাঁটার। মৃত্যুর সময় সব প্রাণীই নাকি ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরতে ঘুরতে উত্তরশিরানা হয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করে। আমিও এখন ঘুরছি। আমার শেষনিশ্বাস নেওয়ার সময় কি ঘনিয়ে এসেছে দাদি?

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম রগ র ব চ চ আম র ছ ট চ চ বড় চ চ র আম দ র ব ত রপর য পর যখন র পর ব দ ন আম ন আম র পর ব র আম র দ র জন য র মত ই এল ক য় আম র ম দ ন পর অন ক ব বড় ছ ল আর ক ন ও আম র আম র ব পর ক ষ আম র ক হয় ছ ল র আগ র করছ ল আওয় জ একদ ন প রথম র সময় আমগ ছ

এছাড়াও পড়ুন:

অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।

বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী

‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত

সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের  প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।

জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে  বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।

লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ