বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে যেসব বিদেশি নাগরিক কাজ করেছিলেন ফরাসি ঔপন্যাসিক অঁদ্রে মালরো তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন মোটা দাগে উপনিবেশবাদ বিরোধী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে বাঙালির ওপর নারকীয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক- বাহিনী। পাকিস্তানিদের সেই হত্যাযজ্ঞের খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যায়। ফরাসি ঔপন্যাসিক অঁদ্রে মালরো ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করে একটি বিবৃতি দেন। শুধু তা-ই নয়, বাঙালিদের পক্ষে গঠিত মুক্তিবাহিনীর একটি ইউনিটের তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

১৮ সেপ্টেম্বরের এ বিবৃতিতে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর আগেও মালরো স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের হয়ে সম্মুখসমরে লড়াই করেছিলেন বিপ্লবীদের পক্ষে। এবার তিনি একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড তৈরি করার আহ্বান জানান। ২২ অক্টোবর অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মালরো বলেন, ‘‘ফাঁকা বুলি আওড়াবার অভ্যাস আমার নেই.

..ট্যাংক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমার আছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অধীনে একটি ট্যাংক ইউনিটে অংশগ্রহণে আমি অটল।’’ এমনকি ফরাসি নাগরিক হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করা যদি সম্ভব না হয়, তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। এ নিয়ে একের পর এক বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। 

আরো পড়ুন:

শীতেও শরীর ঘামে? করণীয় জেনে নিন

ফিলিস্তিনি বিয়েতে ‘জাফ’ সহ আরও যা যা  হয়

অঁদ্রে মালবো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে চিঠি লেখেন। তিনি পাকিস্তানিদের যুদ্ধ বন্ধ করতে আহ্বান জানাতে বলেন এবং তাদের সাহায্য দেওয়া বন্ধ করতে বলেন। সে সময় অনেক ফরাসি যুবক অঁদ্রে মালবোর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে তাকে চিঠি লেখেন। যদি শেষ পর্যন্ত তিনি সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে আসতে পারেননি। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ফ্রান্সে গিয়ে মালরোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি তার সঙ্গে দেখা করবেন এবং নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবেন’’। 

অঁদ্রে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও বিশ্ব জনমত গঠনে যে ভূমিকা রেখেছিলেন তা অসামান্য্ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে মালরো বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন অঁদ্রে মালবো। ১৯৭৩ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে অঁদ্রে স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, কবি সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলী আহসান এ ছাড়া শাহীন স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্লোগানে স্লোগানে তাকে বরণ করে নিয়েছিলেন। আবেগাপ্লুত মালরো একটি শিশুকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন।  বাংলাদেশের সব মানুষের প্রতি প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন অঁদ্রে মালবো।

সেই সফরে অঁদ্রে মালবো প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে। তাকে দেওয়া হলো একটি রুপার নৌকা। 
১৯৭৩ সালের ২২ এপ্রিল অঁদ্রে মালরোর সম্মানে বিশেষ সমাবর্তনের আয়োজন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ওই সমাবর্তনে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার উপাধি প্রদান করা হয়।

ঢাকা/লিপি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব শ বব গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

আজ ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস

আজ ৩ ডিসেম্বর, ঠাকুরগাঁও ‍মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই এবং মুক্তিকামী জনগণের প্রতিরোধে চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে পাকিস্তানি সেনাদের। সেদিন, সকালে হাজার হাজার মানুষ মুক্ত ঠাকুরগাঁও শহরের রাস্তায় বের হয়ে আসেন। বের হয় আনন্দ মিছিল। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের জনপদ। 

ঠাকুরগাঁও জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ড আব্দুল মান্নান জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর সারা দেশের মতো ঠাকুরগাঁয়েও পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করে। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চালায় নির্যাতন। গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে মেতে ওঠে তারা। পাশাপাশি চলতে থাকে অগ্নিসংযোগ। ১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও।

আরো পড়ুন:

‘১৭ বছরে ৯৪ হাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা আড়াই লাখ করা হয়েছে’ 

বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নানা সাজিয়ে পুলিশে চাকরি

এরই মধ্যে সংগঠিত হতে থাকে ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তিকামী মানুষ। তারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে তুলোন দুর্বার প্রতিরোধ। ঠাকুরগাঁও তখন ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কমান্ডার ছিলেন বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার এম. খাদেমুল বাশার। এ সেক্টরে প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ২৯ নভেম্বর এই মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। এরপর তারা শক্তি বৃদ্ধি করে সদলবলে প্রবেশ করে ঠাকুরগাঁয়ে।

তিনি জানান, ২ ডিসেম্বর রাতে ঠাকুরগাঁয়ে প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ লড়াইয়ে সে রাতেই শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে ২৫ মাইল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর ভোরে ঠাকুরগাঁও শহর শত্রুমুক্ত হয়। সেদিন সকাল থেকেই ঠাকুরগাঁও শহরে মানুষ জড়ো হতে থাকেন। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় আনন্দ মিছিল। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের জনপদ। তাদের অনেকের হাতে ছিল প্রিয় স্বদেশের পতাকা।

এলাকাবাসী জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁও ছিল মহকুমা। বর্তমান ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার ১০টি থানা ছিল এই মহকুমার অন্তর্গত। ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে পল্লী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত গণকবর আর বধ্যভূমি। ঠাকুরগাঁও জেলার অধিকাংশ গণকবর আর বধ্যভূমিগুলো এখন বেহাল অবস্থায় রয়েছে। অযত্ন আর অবহেলার মধ্যে পড়ে থাকা গণকবরগুলো দেখার কেউ নেই। অধিকাংশ গণকবর আর বধ্যভূমি এখন গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

আব্দুল মজিদ বলেন, “ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুকানপুর ইউনিয়নে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে মারা যাওয়াদের শুকানপুকুরীতে মাটি চাপা দেয় তারা। আমাদের এই শুকানপুকুরী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করার দাবি জানাচ্ছি।”

রাজাগাঁও ইউনিয়নের বিমলা রাণী বলেন, “পাকিস্থানি বাহিনী আগে খরিলুপের বাড়িত আইছিল। খরিলুপের বাড়ি থেকে আসিল হামার বাড়ি। হামরা সবাই দৌঁড়াদৌঁড়ি করি। কিন্তু হামাক সবাকে ধরে নিয়ে আসিল। হামার বস্তির তামাক লোকলাকে ধরে নিয়ে আসিছিল। সবাকে লাইন করে দাড়ায় থুইল। ওই সময় মুই গর্বপতি ছিনু। মিলিটারি বন্দুনটা দিয়ে মোর পেটটাতে গুতা দিছে আর মুই কিছু কহিবা পারু না।”

ঢাকা/মঈনুদ্দীন/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে, মুক্তিকামীদের উল্লাস
  • রাধানগরে ৩৬ ঘণ্টার লড়াই, পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী
  • যুদ্ধ ছাড়াই ৭ আমিরাতকে কীভাবে একটি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললেন শেখ জায়েদ
  •  ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে…’ 
  • আজ খোকসা মুক্ত দিবস
  • একটি কঙ্কাল
  • আজ ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস