মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের পদক্ষেপ কি কৌশলগত ভুল
Published: 6th, December 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এ আদেশে তিনি তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা টিমকে মুসলিম ব্রাদারহুডের কিছু শাখাকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন (এফটিও) হিসেবে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা যাচাই করতে বলেছেন। এটা তাঁর প্রশাসনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা একটি বেপরোয়া নীতিগত ভুলের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে, মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থিতিশীল হবে এবং যেসব শক্তিকে ওয়াশিংটন মোকাবিলা করার দাবি করে, তাদেরই ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
এ আদেশে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি এবং জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে ৩০ দিনের মধ্যে একটি রিপোর্ট দেবেন। এ রিপোর্টে মিসর, জর্ডান ও লেবাননে মুসলিম ব্রাদারহুডের শাখাগুলোকে এফটিও হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা উচিত কি না, সেটি উল্লেখ থাকবে।
এটি প্রথমবারের মতো হলো, তা নয়। গত দশকে বহুবার চেষ্টা হয়েছে; ট্রাম্পের প্রথম আমলে কংগ্রেসের কিছু সদস্য, বিশেষ করে সিনেটর টেড ক্রুজ এমন চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, মার্কিন সরকারের ভেতরে বাস্তববাদী পেশাদারেরা ছিলেন, যাঁরা মৌলিক সত্যটি বুঝতেন: মুসলিম ব্রাদারহুড একটি আন্দোলন হিসেবে এ ধরনের চিহ্নিতকরণের আইনি মানদণ্ড পূরণ করে না; বরং তা করা হবে ভয়াবহ নীতিগত ভুল।
মার্কিন আইনে কোনো সংগঠনকে এফটিও হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়: সংগঠনটি অবশ্যই বিদেশি হতে হবে; সেটিকে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে হবে অথবা তা করার সক্ষমতা ও অভিপ্রায় থাকতে হবে এবং এসব কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্র বা এর জনগণের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে হবে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষেত্রে এই তিনটির মধ্যে দুটি শর্ত অনুপস্থিত। মিসর, জর্ডান বা লেবাননে ব্রাদারহুডের কোনো শাখাই বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সহিংসতার সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যভাবে যুক্ত নয়। তারা রাজনৈতিক, সামরিক বা অর্থনৈতিক—কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বা নাগরিকদের জন্য প্রকৃত হুমকি তৈরি করে না। পরিহাস হলো, আরব স্বৈরশাসকদের সমর্থকেরা প্রায়ই ব্রাদারহুডকে ওয়াশিংটনের দালাল বা এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করেন।
সংস্কারবাদী আন্দোলনমিসরে ব্রাদারহুড এক শতাব্দী পুরোনো একটি সংস্কারবাদী আন্দোলন, যা গামাল আবদেল নাসেরের সময়ের দমন-পীড়নের অভিজ্ঞতার পর ১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকে অহিংস অংশগ্রহণের পথে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। দশকের পর দশক তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দরিদ্র জনগণের জন্য সামাজিক সেবা প্রদান করেছে। বিশেষভাবে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে তারা ছিল জঙ্গি জিহাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ, যা হাজারো মিসরীয়কে আল-কায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল।
২০১১ সালের বিপ্লবের পর ব্রাদারহুড সংসদীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং মুহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁকে অপসারণ করা হয়। এরপর ঘটে রাবা হত্যাকাণ্ড, যা আধুনিক মিসরীয় ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। ফলে এক যুগব্যাপী নজিরবিহীন দমন-পীড়নের সূচনা হয়।
আরও পড়ুনমুসলিম ব্রাদারহুড বনাম যুক্তরাষ্ট্র১৮ এপ্রিল ২০১৩গণহত্যা, কারাবন্দী ও নির্বাসনের মধ্যেও ব্রাদারহুড নেতৃত্ব অহিংস অবস্থানেই অবিচল থাকে, যা সংগঠনের বহু তরুণ সদস্যের হতাশার কারণ ছিল। এখন ব্রাদারহুড সাংগঠনিকভাবে বিভক্ত, রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষিত এবং মিসরের ভেতরে তাদের কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং অর্থহীন। আইনি ভিত্তি দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ হলেও মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য একেবারেই স্পষ্ট।
প্রথমত, এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্পকে ঘিরে থাকা চরম ডানপন্থী উগ্রপন্থীদের জন্য একটি জয়। যেমন সেবাস্তিয়ান গোরকা, ট্রাম্পের সিনিয়র কাউন্টারটেররিজম পরিচালক, যাঁকে নিয়ে ইউরোপের নব্য নাৎসিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বহু প্রতিবেদন রয়েছে এবং লরা লুমার, যিনি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইসলামবিরোধী প্রচারণার জন্য পরিচিত এক কট্টর ডানপন্থী কর্মী। দুজনই দীর্ঘদিন ধরে ব্রাদারহুডকে বৈশ্বিক ইসলামপন্থী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছেন এবং এটিকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্তির জন্য জোরদার লবিং করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ প্রকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন, যেমন আল–কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটকে মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে। ঐতিহাসিকভাবে সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এমন মধ্যপন্থী ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করে যুক্তরাষ্ট্র অনিচ্ছাকৃতভাবে আরও উগ্র বিকল্পগুলোর প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে। এভাবে এই সিদ্ধান্ত নিজেই তার পূর্বাভাস সত্যে পরিণত করবে।দ্বিতীয়ত, আরবের স্বৈরশাসকেরা বহু বছর ধরে ব্রাদারহুডকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ওয়াশিংটনে লবিং করছেন। কারণ, এটি এখনো তাঁদের সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—যারা আরব বসন্তবিরোধী প্রতিবিপ্লবের স্থপতি—ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে দেখছে এ অঞ্চলের সংগঠিত রাজনৈতিক বিরোধিতার শেষ চিহ্নটুকুও নিশ্চিহ্ন করার সুযোগ হিসেবে। সময়টিও সন্দেহজনক—সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হোয়াইট হাউস সফরের কয়েক দিনের মধ্যেই এই ঘোষণা এল।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ইসলামকে ইসরায়েল তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে; আরব সমাজে এর ব্যাপক জনসমর্থন এবং অধিকৃত ভূখণ্ডে ইসরায়েলি নীতির প্রতি এর প্রত্যাখানের কারণে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী ঘোষণা করলে ইসরায়েলের অন্যতম প্রভাবশালী আদর্শিক প্রতিপক্ষ দুর্বল হবে, যা ইসরায়েলি স্বার্থের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসরায়েলপন্থী থিঙ্কট্যাংকের বেশ কিছু প্রতিবেদন ট্রাম্প প্রশাসনকে ব্রাদারহুডের নির্দিষ্ট শাখাগুলোকে এফটিও তালিকাভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মুসলিম দাতব্য ও অধিকার–সংক্রান্ত সংগঠনগুলোর সঙ্গে ব্রাদারহুডকে যুক্ত করার প্রচেষ্টা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত লবিং সংস্থাগুলো, বিশেষত যেসব সংগঠন গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে সক্রিয়। এদের কয়েকটি সংগঠন ফেডারেল ও অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলোকে ‘চরমপন্থা মোকাবিলার’ নামে ইসলামি নাগরিক সংগঠনগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট তাঁর রাজ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড ও কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনসকে সন্ত্রাসী সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জাতীয়ভাবে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, এটা তার একটি অশুভ ইঙ্গিত।
দীর্ঘমেয়াদি পরিণতিমুসলিম ব্রাদারহুডকে এফটিও হিসেবে চিহ্নিত করার বিষযটি মার্কিন নিরাপত্তা স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে ভয়াবহ ও ব্যাপক পরিণতি বয়ে আনবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক ইসলামি আন্দোলনের মুখোমুখি দাঁড় করাবে, যা আরব ও মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে গভীরভাবে প্রোথিত। ব্রাদারহুড কেবল একটি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংগঠন নয়; এটি একটি ধারণা, যার লাখ লাখ সমর্থক গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা স্থানে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ প্রকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন, যেমন আল–কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটকে মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে। ঐতিহাসিকভাবে সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এমন মধ্যপন্থী ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করে যুক্তরাষ্ট্র অনিচ্ছাকৃতভাবে আরও উগ্র বিকল্পগুলোর প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে। এভাবে এই সিদ্ধান্ত নিজেই তার পূর্বাভাস সত্যে পরিণত করবে।
আরও পড়ুনব্রাদারহুড ফিরবে শক্তিশালী হয়ে২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩এটি হতাশাগ্রস্ত কিছু তরুণকে আরও চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকিও তৈরি করবে। ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করার বিষয়টিকে উগ্রপন্থীরা ব্যবহার করবে এই বার্তা দিতে যে শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ড অর্থহীন; বিশেষ করে যখন এই তরুণেরা দেখতে পায়, ওয়াশিংটন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারাকে আলিঙ্গন করছে, যিনি একসময় হায়াত তাহরির আল-শামের নেতা ছিলেন এবং যাঁর মাথার দাম একসময় ১০ মিলিয়ন ডলার ছিল। কিন্তু তাঁকে এখন হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ কার্যকলাপকে অপরাধী বানানো হলে উগ্র গোষ্ঠীই লাভবান হয়।
এফটিও ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যকার অবিশ্বাস আরও গভীর করবে। বিশেষত যখন তাদের নাগরিক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে মিথ্যা অজুহাতে লক্ষ্যবস্তু করা শুরু হবে। ফলে বিচ্ছিন্নতা বাড়বে এবং রাজনৈতিক বিভাজন তীব্রতর হবে। বিশেষ করে মিশিগান ও পেনসিলভানিয়ার মতো ‘সুইং’ অঙ্গরাজ্যগুলোতে।
শেষত, এই পদক্ষেপের ফলে কাতার ও তুরস্কের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়তে পারে, যে দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন মিত্র এবং যারা নির্বাসিত ব্রাদারহুড নেতাদের আশ্রয় দিয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, কয়েক দশকের মধ্যে ব্রাদারহুড এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে: রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং অঞ্চলজুড়ে দমন-পীড়নের কারণে সামাজিকভাবে সংকুচিত। এমন এক আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা কেবল বিশ্লেষণগত দিক থেকে অসংগত নয়, কৌশলগত দিক থেকেও আত্মঘাতী।
এই ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাম্প উগ্রপন্থীদের দুর্বল করবেন না; বরং আরও শক্তিশালী করবেন। তিনি আমেরিকানদের আরও নিরাপদ করবেন না; বরং যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অনিরাপদ করে তুলবেন। আর তিনি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা আনবেন না; বরং এর ভাঙন আরও ত্বরান্বিত করবেন। সংক্ষেপে, এটি ওয়াশিংটনের নেওয়া সবচেয়ে ভ্রান্ত ও কৌশলগতভাবে ব্যয়বহুল পদক্ষেপগুলোর একটি, যা বছরের পর বছর ধরে মার্কিন স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করছে।
খালিল আল-আনানি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি দুটি বইয়ের লেখক—ইনসাইড দ্য মুসলিম ব্রাদারহুড: রিলিজিয়ন, আইডেন্টিটি অ্যান্ড পলিটিকস এবং ইসলামিজম অ্যান্ড রেভল্যুশন অ্যাক্রস দ্য মিডল ইস্ট।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র এই স দ ধ ন ত চ হ ন ত কর র র জন ত ক সন ত র স পদক ষ প র জন য কর র স ক ত কর কর ছ ন স গঠন এফট ও ইসর য করব ন ইসল ম সবচ য
এছাড়াও পড়ুন:
দেশের সুরক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর ত্যাগ ও নিষ্ঠা দৃষ্টান্তমূলক: প্রধান উপদেষ্টা
বাংলাদেশের নিরাপত্তা, অগ্রগতি ও জাতি গঠনে সশস্ত্র বাহিনীর অবদানের প্রশংসা করে দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠাকে দৃষ্টান্তমূলক বলে বর্ণনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিরপুর সেনানিবাসে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স (এনডিসি) ও আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স (এএফডব্লিউসি) ২০২৫-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
আরো পড়ুন:
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিলেন তিন বাহিনী প্রধান
আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পেশাদার সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রত্যয় সেনাপ্রধানের
বাসস লিখেছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
জাতীয় নিরাপত্তা, অগ্রগতি, জাতি গঠন এবং সংকটকালে জনগণের পাশে দাঁড়ানোয় সশস্ত্র বাহিনীর অবদানের প্রশংসা করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মহামারির মতো সংকটে সশস্ত্র বাহিনীর অব্যাহত প্রচেষ্টা দেশের জনগণের কল্যাণে তাদের প্রস্তুতি ও অটল নিষ্ঠার প্রমাণ বহন করে।”
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তিতে অবদান রাখার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এই অংশগ্রহণ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি বাড়িয়েছে।
আগামী নির্বাচনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আগামী ফেব্রুয়ারিতে আমাদের জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটে সত্যিই একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে হবে। এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হবে না, বরং শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করবে। ভোটাররা যখন ভোট দিতে বের হবেন, তা উৎসবমুখর হবে এবং জাতি গর্বের সঙ্গে স্মরণ করবে যে তারা দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে অংশ নিয়েছেন।”
প্রধান উপদেষ্টা বক্তব্যের শুরুতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন, “এটি একটি বিশেষ মাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বিজয়ের মাস। আমরা সকলেই গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি সেই বীরদের, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ ছাড়া সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আত্মত্যাগকে আমরা স্মরণ করি, যারা দেশের মুক্তির সংগ্রামে অবদান রেখেছেন।”
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জীবন উৎসর্গ করা সকল শহীদ ও আহতের প্রতি সম্মান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে সম্ভব করা সকল শিক্ষার্থী ও দেশবাসীর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা, যারা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের সঙ্গে জীবন উৎসর্গ করেছেন ও আহত হয়েছেন।”
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আরোগ্য কামনায় তিনি দেশবাসীকে দোয়া ও প্রার্থনা করার আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানের এই আনন্দময় মুহূর্তে আসুন আমরা সকল বাংলাদেশির সঙ্গে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।”
স্নাতক সম্পন্ন করা অফিসারদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আজকের গ্র্যাজুয়েশন আপনার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স এবং আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করা সত্যিই একটি বড় অর্জন।”
“এটি আপনার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত। এই অর্জন বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের প্রতিফলন। এখন আপনি উচ্চতর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত, যা আপনাকে জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্র পরিচালনা, নীতি নির্ধারণ, কৌশল প্রণয়ন এবং জাতীয় উন্নয়নের জটিলতাগুলো বোঝার ক্ষমতা প্রদান করবে,’ বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, কলেজটি এমন নেতৃবৃন্দ গড়ে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যারা জটিল ও ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেকে নিবেদিত করতে সক্ষম হবেন।
তিনি উল্লেখ করেন, “আমরা এমন এক এক সময়ে আছি যখন অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের গুরুত্ব এশিয়ার দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে, বাংলাদেশ এমন একটি কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে যা অসাধারণ সুযোগ প্রদান করে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য এই অনন্য ভূ-রাজনৈতিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের টেকসই প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।”
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স একটি কৌশলগত স্তরের কোর্স, যা অংশগ্রহণকারীদের জাতীয় নিরাপত্তা বোঝার, বিশ্লেষণ এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম এবং নেতৃত্বের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।”
“আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স কৌশলগত ও অপারেশনাল স্তরের ওপর কাজ করে এবং কৌশলগত ও ট্যাকটিক্যাল স্তরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সহায়ক। এই কোর্স চলাকালীন, আপনি বর্তমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেমন সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সাইবার হুমকি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিশ্লেষণে যুক্ত হয়ে পড়েছেন,” যোগ করেন অধ্যাপক ইউনূস।
বিদেশি গ্রাজুয়েটদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি আশা করি, এখানে আপনার সময়কালে আপনি এমন বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন যা দিগন্ত বিস্তারী যা আমাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীরতর বোঝাপড়া তৈরি করে।”
তিনি আরো বলেন, “আপনাদের উপস্থিতি আমাদের প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেছে এবং আমি বিশ্বাস করি, আপনারা আপনার নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করবেন। বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ককে আরও মজবুত করবেন। আমি আপনাদের আগামীর জন্য সফলতা কামনা করছি।”
এনডিসির অবদানের প্রশংসা করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করেছে। এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে এনডিসি কেবল সামরিক ক্ষেত্রে নয়, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতি বছর বেসরকারি প্রশাসন,পররাষ্ট্র ক্যাডার, পুলিশ, আর্মি ও বিডিপির উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এনডিসি কোর্সে অংশগ্রহণ করা আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দেয়।”
বিদেশি কর্মকর্তাসহ কোর্সটি চিন্তাধারা বিনিময়, বন্ধুত্ব সৃষ্টি এবং বোঝাপড়া সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য অসাধারণ সুযোগ প্রদান করে বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমি কমান্ড্যান্ট, শিক্ষক ও স্টাফদের আন্তরিক প্রশংসা জানাই, যারা ২০২৫ সালের এনডিসি কোর্স এবং সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধ কোর্সটি উৎকর্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন।”
অধ্যাপক ইউনূস কোর্সে অবদান রাখার জন্য রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স পার্সন এবং বিশেষ বক্তাদের প্রশংসা জানিয়ে বলেন, “আমি সেই দেশের সমর্থনকেও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি, যারা স্টাডি ট্যুরের আয়োজন করেছে, যা এই কোর্সের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
“ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী যে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ তার মূলমন্ত্র ‘সুরক্ষা থেকে জ্ঞান’ বজায় রাখবে। এই প্রচেষ্টা আপনাদের নতুন ভূমিকা গ্রহণের সময় প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা নির্ধারণে পথ দেখাবে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জটিলতা মোকাবিলায় সহায়ক হবে,” যোগ করেন তিনি।
ঢাকা/রাসেল