ট্রাম্পের শুল্কের আঘাতে বড় সংকটে ভারত
Published: 5th, December 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করেছেন। অনেক পণ্যে শুল্ক ২৫ থেকে বেড়ে ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। ফলে ভারতের রপ্তানি অর্থনীতি বড় ধাক্কা খাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। ভারতীয় পণ্য দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে সুলভ ছিল। কিন্তু ভারতের প্রায় অর্ধেক পণ্য এখন যুক্তরাষ্ট্রে এত ব্যয়বহুল হয়ে গেছে যে সেগুলো মার্কিন বাজারে বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে ভারতের সাধারণ মানুষের ওপর।
গত দুই দশকে বৈশ্বিক রপ্তানিতে ভারতের অংশ ২০০৫ সালের ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে বেড়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছেছে। সংখ্যাটি ছোট
মনে হলেও এর পেছনে ছিল রপ্তানিকারক, নীতিনির্ধারক ও শ্রমিকদের দীর্ঘ পরিশ্রম। তাঁরা জানতেন, উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন ট্রাম্পের শুল্কনীতি সেই অগ্রগতিকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিতে পারে অথবা আরও খারাপ কিছু ঘটাতে পারে।
পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। সেপ্টেম্বর মাস ছিল শুল্ক কার্যকর হওয়ার প্রথম পূর্ণ মাস। ওই মাসে ভারতের পণ্য আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি বেড়ে ৩২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এটি ছিল গত ১৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি। আগস্টে এ ঘাটতি ছিল ২৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। অক্টোবর মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আগের বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের পণ্য রপ্তানি কমে যায় ৯ শতাংশ।
এটি শুধু পরিসংখ্যানের গল্প নয়; এর পেছনে বাস্তব মানুষের কষ্ট লুকিয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমনির্ভর শিল্পগুলো। টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, চামড়া, রত্ন ও গয়না, জুতা, হস্তশিল্প এবং সামুদ্রিক খাবার খাতে ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছে।
এসব খাতে কোটি কোটি মানুষ কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে অনেক নারী ও প্রথম প্রজন্মের শিল্পশ্রমিকও আছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার যখন ভূরাজনৈতিক খেলায় ব্যস্ত, তখন ভারতের এই শ্রমিকেরা কীভাবে তাঁদের পরিবারের খাবার জোগাবেন, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রই ভারতীয় কার্পেট ও গালিচার সবচেয়ে বড় বাজার। এ খাতের প্রায় ৬০ শতাংশ রপ্তানি যায় সেখানে। কিন্তু এখন এসব পণ্যের ওপর শুল্ক ২ দশমিক ৯ থেকে বেড়ে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে মার্কিন ক্রেতারা তুরস্ক ও চীন থেকে পণ্য নিচ্ছেন। এমনকি মিসরে তুরস্কের মালিকানাধীন কারখানা থেকেও তাঁরা এসব পণ্য কিনছেন।ট্রাম্পের শুল্কে, বিশেষ করে টেক্সটাইল ও পোশাক খাত মারাত্মক আঘাত পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ১০ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক ও বস্ত্রজাত পণ্য রপ্তানি করেছে। এটি ভারতের মোট পোশাক রপ্তানির ৩৫ শতাংশ। এই খাতে লাভের হার এমনিতেই খুব কম, অনেক ক্ষেত্রে তা এক অঙ্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর ওপর হঠাৎ শুল্ক ১৩ দশমিক ৯ থেকে লাফিয়ে ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশে উঠে যাওয়ায় ভারতের পোশাক কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকেই ছিটকে পড়েছে।
উৎপাদকেরা বসে থেকে পরিস্থিতি বদলানোর অপেক্ষাও করতে পারছেন না। এর মধ্যেই বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক, ডেনিম ও কৃত্রিম তন্তুর সরবরাহ বাড়াচ্ছে। পাকিস্তান এখন বিশ্ববাজারে ডেনিম (যেমন জিনসের কাপড়) ও ফ্লিস (শীতের কাপড় তৈরির নরম উলের মতো সুতি বা কৃত্রিম কাপড়) উৎপাদন ও রপ্তানিতে ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান শক্ত করছে।
আরও পড়ুনশেষ হাসি কে হাসবেন, মোদি নাকি ট্রাম্প১৪ আগস্ট ২০২৫আর কম্বোডিয়া ফ্যাশন পণ্যের একটি বড় কেন্দ্র হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি দেশগুলোও সুযোগ নিচ্ছে। মেক্সিকো ও সিএএফটিএ-ডিআর জোটভুক্ত দেশগুলো (পাঁচটি মধ্য আমেরিকার দেশ, ডমিনিকান রিপাবলিক ও যুক্তরাষ্ট্র) দ্রুত সরবরাহ আর শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে মার্কিন খুচরা বিক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে। ফলে ভবিষ্যতে যদি ভারতের ওপর শুল্ক কমেও, তত দিনে সরবরাহব্যবস্থা বদলে যাবে এবং ভারতের কষ্টে গড়া বাজার হারিয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রই ভারতীয় কার্পেট ও গালিচার সবচেয়ে বড় বাজার। এ খাতের প্রায় ৬০ শতাংশ রপ্তানি যায় সেখানে। কিন্তু এখন এসব পণ্যের ওপর শুল্ক ২ দশমিক ৯ থেকে বেড়ে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে মার্কিন ক্রেতারা তুরস্ক ও চীন থেকে পণ্য নিচ্ছেন। এমনকি মিসরে তুরস্কের মালিকানাধীন কারখানা থেকেও তাঁরা এসব পণ্য কিনছেন।
চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ২০২৪-২৫ সালে ভারতের মোট চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২১ দশমিক ৮ শতাংশ গেছে যুক্তরাষ্ট্রে, যা একক কোনো দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু নতুন শুল্কনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার এখন ভারতীয় পণ্যের জন্য কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক শাস্তি, মোদির ভারতের সামনে সহজ কোনো পথ নাই১১ আগস্ট ২০২৫ভারতের সব খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গয়না ও রত্নশিল্প। সেপ্টেম্বর মাসে মুম্বাইয়ের সান্তাক্রুজ ইলেকট্রনিকস এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (এসইইপিজেড) থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রত্ন ও গয়নার রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ৭১ থেকে ৭৬ শতাংশ কমে গেছে।
এই পরিসংখ্যানের আড়ালে রয়েছে হাজার হাজার কারিগর, পোলিশ শ্রমিক ও ছোট উদ্যোক্তার হাহাকার। হঠাৎ তাঁদের কোনো অর্ডার নেই, কোনো আয় নেই। তাঁদের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অনেক রপ্তানিকারক আগেই বুঝেছিলেন, শুল্ক বাড়তে পারে। তাই তাঁরা আগে থেকেই বেশি পরিমাণে পণ্য পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন। এ কারণেই চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি বছরে ১৩ শতাংশ বেড়ে ৪৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। কিন্তু পুরো শুল্কব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার পর নতুন অর্ডার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সাময়িক এ কৌশল কিছুটা সময় এনে দিয়েছিল, কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হয়নি।
আরও পড়ুনট্রাম্প আবার যেভাবে মোদিকে ধোঁকা দিলেন২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা বাণিজ্যিক ধাক্কায় ভারতের ক্ষতি কমাতে হলে একটি পরিকল্পিত বহুমুখীকরণ কৌশল দরকার। শুরুতে ভারতকে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও শক্ত করতে হবে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বস্ত্র, চামড়া ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একীভূত আঞ্চলিক টেক্সটাইল ও পোশাক সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি রপ্তানি কমলেও ভারত বিশ্বব্যাপী পোশাকশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকতে পারবে। তবে উপমহাদেশের অস্থির ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এটি বাস্তবায়ন করা সহজ নয়।
শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমানে কংগ্রেস পার্টির এমপি
স্বত্ব : প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ : সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র র ওপর শ ল ক স প ট ম বর ২ দশম ক ৯ সরবর হ ত রস ক সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি, আবার পুতিনকেও উষ্ণ অভ্যর্থনা: একসঙ্গে দুই কূল কি রাখতে পারবে ভারত
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুই দিনের সফরে ভারতে পৌঁছেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে পৌঁছানোর পর দেশটির বিমানবাহিনীর পালাম ঘাঁটিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাঁকজমকপূর্ণ ও আনুষ্ঠানিক আয়োজনের মাধ্যমে তাঁকে স্বাগত জানান। শুক্রবার দুজন শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হবেন।
তিন বছর আগে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু করার পর প্রেসিডেন্ট পুতিনের এটাই প্রথম ভারত সফর। সর্বশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বের নয়াদিল্লি সফর করেন তিনি।
এবারের সফরে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি ২৩তম রাশিয়া-ভারত বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেবেন পুতিন। শুক্রবার শীর্ষ বৈঠকের আগে পুতিনকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হবে। পরে তিনি নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেবেন। এ হায়দরাবাদ হাউসেই পুতিন অবস্থান করবেন।
ভারতের মস্কোর দিকে ঝুঁকে পড়ার শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। তা হয় ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে ওয়াশিংটন সামরিক ও আর্থিক সহায়তা বাড়াতে থাকায়। তখন রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে এবং মস্কো ভারতের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য বন্ধুরাষ্ট্র হয়ে ওঠে। রাশিয়ার এই ভূমিকাকে এখনো মূল্যায়ন করে ভারত।পুতিনকে যে ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের সঙ্গে বরণ করে নেওয়া হলো, তেমন আনুষ্ঠানিকতা কেবল নয়াদিল্লি তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সৌজন্যেই দেখায়। এরপরও মোদি একইসঙ্গে পুতিনের রাশিয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি গভীর কৌশলগত অংশীদারত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এটাই ভারতের কূটনীতির বিশেষ দিক। একদিকে রাশিয়ার উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান ও সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি তেল কেনা এবং স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে গড়ে ওঠা দৃঢ় বন্ধুত্ব ধরে রাখা। অন্যদিকে প্রযুক্তি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত বর্ধিত শুল্ক প্রত্যাহার করবেন বলে আশা করা।
পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের পর ভারত তার কৌশলগত সম্পদ (বিশাল বাজার এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান) কাজে লাগিয়ে হোয়াইট হাউস ও ক্রেমলিন দুই পক্ষেরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
তবে যুদ্ধ শুরুর পর পুতিন প্রথম ভারত সফরে এলেন এমন সময়ে, যখন মোদি একটি উদ্বেগজনক সময় পার করছেন।
নয়াদিল্লি এখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে খুবই প্রয়োজনীয় বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এই শুল্কের অর্ধেকই আরোপিত হয়েছে ছাড় মূল্যে রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রাখায় নয়াদিল্লির জন্য ওয়াশিংটনের সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে।
নয়াদিল্লি সম্প্রতি ওয়াশিংটনকে সন্তুষ্ট করতে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তারা রাশিয়ান তেল কেনা কমিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) কিনতে রাজি হয়েছে।
এরপরও পুতিনের এবারের সফরে যে বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে, তা হলো মস্কোর সঙ্গে আরও প্রতিরক্ষা চুক্তি—অস্ত্র কেনা, যেটাকে পাকিস্তান ও চীনের কাছ থেকে নিজের রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে ভারত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান ও চীন দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা বেড়েছে।
ভারতকে কত জটিল এক পরিবেশের মধ্যে পথ চলতে হয়, তা এ বিষয়ে বোঝা যায়: রাশিয়া চীনেরও ঘনিষ্ঠ অংশীদার, আবার পাকিস্তানের অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান উৎসগুলোর একটি বেইজিং।
পুতিনের জন্য লালগালিচা বিছিয়ে নয়াদিল্লি পশ্চিমা বিশ্ব ও চীন দুই পক্ষকেই এই বার্তা দিচ্ছে যে ভারতের ‘বিকল্প আছে’, এমনটাই মনে করছেন অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর কান্তি বাজপেয়ী।
প্রফেসর কান্তি বাজপেয়ী বলেন, এটা একটা ইঙ্গিত যে ভারত রাশিয়ার সঙ্গেই থাকতে চাচ্ছে, যদিও মস্কো ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই অধ্যাপকের মতে, তেল আর অস্ত্রের বাইরে এটা একধরনের কূটনৈতিক কৌশল, বেইজিং ও ওয়াশিংটনকে দেখানো যে দিল্লির হাতে তৃতীয় বিকল্প আছে। আর এতে তার দর–কষাকষির সুযোগও আরেকটু বাড়ে।
পরীক্ষিত বন্ধুত্বরাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়, যখন সদ্য স্বাধীন দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জোটনিরপক্ষ’ ছিল, কিন্তু নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পথচলার শুরুতে শিল্প খাত ও অর্থনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক সহায়তা পেয়েছিল।
অবশ্য ভারতের মস্কোর দিকে ঝুঁকে পড়ার শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। তা হয় ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে ওয়াশিংটন সামরিক ও আর্থিক সহায়তা বাড়াতে থাকায়। তখন রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে এবং মস্কো ভারতের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য বন্ধুরাষ্ট্র হয়ে ওঠে। রাশিয়ার এ ভূমিকাকে এখনো মূল্যায়ন করে ভারত।
বিশ্বে অস্ত্র বিক্রির ওপর নজর রাখা চিন্তনপ্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরই) তথ্যমতে, গত চার বছরে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের অস্ত্র কেনা কমলেও মস্কো এখনো দেশটির প্রধান সামরিক সরবরাহকারীর অবস্থানে রয়েছে।
এসব রুশ সামরিক সরঞ্জামের বড় অংশই কেনা হয়েছে ভারতের প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকা চীনের দিকে নজর রেখে। অবশ্য চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মস্কোর ঘনিষ্ঠ অংশীদারগুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই দেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সীমান্ত উত্তেজনা রয়েছে।এসব রুশ সামরিক সরঞ্জামের বড় অংশই কেনা হয়েছে ভারতের প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকা চীনের দিকে নজর রেখে। অবশ্য চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মস্কোর ঘনিষ্ঠ অংশীদারগুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ দেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সীমান্ত উত্তেজনা রয়েছে।
অন্যদিকে বেইজিং ভারতের বৈরী দেশ পাকিস্তানের বড় অস্ত্র সরবরাহকারী, যার মধ্যে জঙ্গিবিমানও রয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বলেছে, এ বছরের শুরুতে সীমান্তে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের সময় ভারতের যুদ্ধবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করতে তারা এটা (চীনা জঙ্গিবিমান) ব্যবহার করেছিল। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ভারতের যেসব যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছিল, সেগুলোর একটি ছিল রাশিয়া নির্মিত সুখোই এসইউ-৩০।
রয়টার্সের তথ্যমতে, বর্তমানে ভারতের ২৯টি যুদ্ধবিমানের মধ্যে বেশির ভাগই রাশিয়ান সুখোই এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমান।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, এই সপ্তাহে রাশিয়ার সঙ্গে (ভারতের) আলোচনা সম্ভবত তাদের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান এসইউ-৫৭–এর জন্য সম্ভাব্য অস্ত্র চুক্তি নিয়ে হবে।
কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির অর্থনৈতিক সম্পর্ক বারবার শিরোনামে এসেছে, যা সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিলে রাশিয়ার তেলের দাম দ্রুত কমতে থাকে, ভারত সেই সুযোগ লুফে নেয়। বিকাশমান অর্থনীতিতে রসদ জোগানো এবং দেশের ১৪০ কোটি মানুষকে সহায়তার জন্য আগ্রহী ভারত রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনা ব্যাপকভাবে বাড়ায়। দেশটি ক্রেমলিনের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশের একটি হয়ে ওঠে।
পশ্চিমাদের সমালোচনার জবাবে ভারত বারবার বলেছে, দেশের জনগণ ও অর্থনীতির প্রতিই তাদের প্রথম দায়িত্ব।
নয়াদিল্লিভিত্তিক চিন্তনপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) ডিস্টিংগুইশড ফেলো নন্দন উন্নিকৃষ্ণনান বলেন, ‘আমাদের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ আছে। তাদের দারিদ্র্যসীমার বাইরে নিয়ে আসা দরকার…আর সেটা করতে গেলে ভারতের সব বড় শক্তির সঙ্গে একটি পরিশীলিত কর্মসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন।’
কিন্তু গত আগস্টে ট্রাম্পের ধৈর্য কমে আসে এবং তিনি ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন। এটা ছিল ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি, পাশাপাশি রাশিয়ার তেল কেনার শাস্তি।
এরপর অক্টোবরে ট্রাম্প রাশিয়ার দুটি বৃহত্তম তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন, যা ভারতে বিভিন্ন দপ্তরে ধাক্কার মতো হয়ে আসে। ভারতের বাণিজ্য ও তেল পরিশোধন–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো রয়টার্সকে জানিয়েছে, ডিসেম্বর মাসে দেশটির তেল আমদানি কমে অন্তত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নামতে যাচ্ছে।
ওয়াশিংটনের আর্থিক চাপ শুধু সম্পর্কেই টান দিচ্ছে না, বরং বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির উত্তেজনা প্রশমনও যেন দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ভারতের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক কার্যকর হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই একটি সম্মেলনে যোগ দিতে মোদি সাত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চীনে যান। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সেই সম্মেলন আয়োজনের লক্ষ্য ছিল, পশ্চিমাদের পাল্টায় বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিতে বেইজিংয়ের সমক্ষতা তুলে ধরা।
সেই সম্মেলনেই মোদি ও পুতিনের সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে দুজন হাসি দিয়ে উষ্ণ ও দৃঢ় করমর্দন করেন, এরপর জনসমাগম থেকে সরে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্টের লিমুজিনে বসে প্রায় এক ঘণ্টার একটি ব্যক্তিগত বৈঠক করেন।