Prothomalo:
2025-12-14@13:22:33 GMT

মৃত্যুতেও হয়রানির শেষ হয়নি

Published: 14th, December 2025 GMT

২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৩৪/এ নম্বর কোয়ার্টার থেকে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনীরুজ্জামানকে বের করে এনে কোয়ার্টারের সামনেই গুলি করে। মুনীরুজ্জামান ঘটনাস্থলেই নিহত হন কিন্তু জ্যোতির্ময় মেরুদণ্ডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে রক্তস্নাত অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে টেনে ঘরে নিয়ে আসেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা, মেয়ে স্কুলছাত্রী মেঘনা আর বাড়ির কাজের মেয়ে স্বর্ণা।

বাইরে তখন প্রচণ্ড গোলাগুলি, কারফিউ। এই তিন নারী রক্তক্ষরণ হতে থাকা মুমূর্ষু মানুষটিকে একটি পুরো রাত এবং পরের পুরোটা দিন আপ্রাণ চেষ্টায় ঘরের ভেতর রেখে শুশ্রূষা দিতে থাকেন। ঢাকা মেডিকেল তাঁদের বাড়ি থেকে দূরে নয়, কিন্তু সেখানে যাওয়া তখন অসম্ভব। ২৭ তারিখ ভোরে কারফিউ কিছুক্ষণের জন্য শিথিল হলে মরিয়া হয়ে অচেনা এক পথচারী নারীকে ডেকে একটা চিরকুট লিখে বাসন্তী গুহঠাকুরতা অনুরোধ করেন ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে পৌঁছে দিতে। চিরকুট পেয়ে হাসপাতালের কর্মীরা স্ট্রেচারে করে নিয়ে যান অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে। সেই ভবনের অন্য শিক্ষকেরা তাঁদের পরিবার নিয়ে তখন যে যাঁর মতো পালাচ্ছেন। মেঘনা আর স্বর্ণাকে নিয়ে বাসন্তী গুহঠাকুরতা চলে গেলেন ঢাকা মেডিকেলে।

সেদিন দুপুরে অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে ইমার্জেন্সি থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো সার্জারি বিভাগের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর বেডে। তিনি ভর্তি হলেন ডা.

মতিউর রহমানের অধীনে এবং ডা. আলী আশরাফের ইউনিটে। প্রায় পাঁচ দশক পর ২০১৯ সালে আমরা যখন অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলি, তিনি স্পষ্ট স্মরণ করতে পারেন সেদিনের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে। তিনি বলেন, মেরুদণ্ডে গুলি লাগায় জ্যোতির্ময়ের তখন প্যারাপ্লেজিয়া হয়ে গিয়েছিল। হাত-পা সবই ছিল অবশ। ছিল সেপটিসেমিয়া, অর্থাৎ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল রক্তে আর দুদিন ধরে রক্তক্ষরণে তাঁর শরীরের অবস্থা ছিল সঙিন। ২৮ মার্চ জ্যোতির্ময়কে বন্ধু ডা. টি হোসেন তাঁর প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা আর সম্ভব হয়নি। ২৯ তারিখ থেকে জ্যোতির্ময়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৩০ মার্চ সকালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

আমরা আবিষ্কার করি, হাসপাতালে মৃত্যু হলেও তাঁর পরিবার জ্যোতির্ময়ের মৃতদেহটি পায়নি, পায়নি একটি যথার্থ মৃত্যুসনদ এবং আরও দেখি, তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাপ্য অর্থ প্রদানে জ্যোতির্ময়ের পরিবারকে যুদ্ধের পুরো সময়ে অপদস্থ করেছে আমলাতান্ত্রিকভাবে।...স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এই ঐতিহাসিক লজ্জা মোচনের সুযোগ আছে সংশ্লিষ্ট দুই প্রতিষ্ঠানের।

জটিলতা শুরু হয় তাঁর লাশ স্থানান্তর নিয়ে। ডা. টি হোসেন ঢাকা মেডিকেলে অ্যাম্বুলেন্স পাঠান লাশ নিতে। কিন্তু এ ধরনের গুলি ও অপঘাতের মৃত্যু হাসপাতালে ‘পুলিশ কেস’ হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকে এবং সে ক্ষেত্রে লাশ নিতে স্থানীয় থানা অথবা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন লাগে। ঢাকা মেডিকেল তখন রমনা থানার অধীনে। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী রমনা থানায়ও হত্যাযজ্ঞ চালানোয় থানা তখন অকার্যকর। তা ছাড়া কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যোগাযোগেরও তখন পরিস্থিতি নেই। হাসপাতালে তখন টহলে আছে পাকিস্তানি সেনা। যথাযথ নিয়ম না মেনে লাশ বাইরে নেওয়া দুরূহ। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃতদেহ পড়ে থাকে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায়। ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। গুমোট আর বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখে বাসন্তী গুহঠাকুরতা চলে আসেন হাসপাতাল থেকে।

পরবর্তী সময়ে জ্যোতির্ময়ের সন্ত্রস্ত পরিবার তাদের ড্রাইভার গোপালকে পাঠায় লাশ নেওয়ার জন্য। পরপর দুই দিন গিয়েও লাশ হাসপাতাল থেকে ছাড়াতে পারেননি গোপাল। ৫ এপ্রিল হাসপাতালে গিয়ে গোপাল জানতে পারেন, ড. জ্যোতির্ময়ের লাশ হাসপাতালে নেই। লাশ কোথায় নেওয়া হয়েছে, সেটি কেউ বলতে পারে না। গোপালকে ভবিষ্যতে হাসপাতালে যেতেও বারণ করা হয়।

আমরা গবেষণার অংশ হিসেবে ঢাকা মেডিকেলের ৫০ বছরের পুরোনো ১৯৭১ সালের ডেথ রেজিস্টার অনুসন্ধান করি এবং তাতে কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য পাই। আমরা দেখতে পাই, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে দাগ টেনে সেই রেজিস্টার খাতায় আর কোনো মৃত্যু লিপিবদ্ধ করা হয়নি। কাকতালীয়ভাবে নতুন করে আবার ডেথ রেজিস্টার লেখা শুরু হয় ৩০ মার্চ থেকেই, যেদিন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা মারা গেছেন। সে তারিখে আরও মৃত্যুর ভিড়ে আবিষ্কার করি অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার নাম। আমরা দেখতে পাই, তাঁর ভর্তি নিবন্ধন নম্বর ১৪৪৪/১২। মৃত্যুর সময় উল্লেখ আছে ৩০ মার্চ, সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। লাশ কে নিয়েছে, এ প্রশ্নের কলামে দেখতে পাই, ‘পুলিশ’, নিচে একটি লাল দাগ দেওয়া। জ্যোতির্ময়ের লাশ তাঁর পরিবার হাতে পায়নি। লাশ কোথায় নেওয়া হয়েছে, আদৌ কোনো সৎকার হয়েছে কি না, তা কোনো দিন আর জানতে পারেনি পরিবার।

এরপর সেই যুদ্ধের দিনে বাসন্তী গুহঠাকুরতার জীবনে শুরু হয় আরেক ব্যক্তিগত যুদ্ধ। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃত্যুর পর নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে বাসন্তী গুহঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরে যাননি। প্রতিবেশীর কাছে পরিচয় গোপন রেখে কখনো শুভানুধ্যায়ীদের বাড়িতে, কখনো রোগী সেজে বিভিন্ন হাসপাতালে উদ্বাস্তুর মতো থেকেছেন। আবার সেই ঘোর বিপদের দিনেই তাঁর ফেলে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁকা বাড়ি থেকে চুরি হয় মূল্যবান সামগ্রী। একপর্যায়ে অর্থকষ্টে পড়ে যান বাসন্তী গুহঠাকুরতা। এ সময় তিনি তাঁর স্বামী জ্যোতির্ময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের বকেয়া বেতন-ভাতা পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষকের কাছে আবেদন করেন।

আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-সংক্রান্ত নথি নিরীক্ষা করে এক নাটকীয় পাকচক্রের সন্ধান পাই। সেই নথিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে জানাচ্ছে, মৃত্যু-পরবর্তী আর্থিক সুবিধাগুলো পাওয়ার জন্য তাঁকে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃত্যুসনদ জমা দিতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে মৃত্যুসনদ ছাড়াই জ্যোতির্ময়ের লাশ ঢাকা মেডিকেল থেকে উধাও হয়ে গেছে। তিনি যে মারা গেছেন, তার কোনো প্রমাণ পরিবারের হাতে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি থেকে আরও দেখতে পাই, অর্থ জোগাড়ের বিকল্প পথ হিসেবে বাসন্তী গুহঠাকুরতা ১৯৭১ সালের ২৪ মে জ্যোতির্ময়ের ফেডারেল ইনস্যুরেন্সের সঙ্গে করা একটি জীবনবিমার টাকা পরিশোধের আবেদন করেছেন। কিন্তু সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ৩০ জুন লিখিতভাবে বাসন্তীকে জানায়, বিমাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামানত হিসেবে রক্ষিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দিলেই কেবল তাঁকে বিমার টাকা পরিশোধ করা হবে।

ঘোর চক্করে পড়ে যান বাসন্তী গুহঠাকুরতা। নথি থেকে আমরা জানতে পারি, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পিএইচডি করতে বিদেশে যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আট হাজার টাকা শিক্ষাঋণ নিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই ঋণের বিপরীতে জ্যোতির্ময়ের ১৫ হাজার টাকার জীবনবিমা জামানত হিসেবে রেখে দিয়েছিল। আমরা লক্ষ করি, বাসন্তী গুহঠাকুরতা ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে সেই জামানতের ছাড়পত্রের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন করছেন। অবশেষে দেখতে পাই, ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট একটি চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখছে, জ্যোতির্ময়ের ছাড়পত্র তারা দিতে পারছে না। কারণ, তাঁর কাছে তাদের কিছু পাওনা আছে। কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, তারা হিসাব কষে দেখেছে, শিক্ষাবৃত্তি ঋণের আসল বাবদ ২,১৫৫.৩০ টাকা এবং সুদ বাবদ ১,৭১০.৬০ টাকা, অর্থাৎ সর্বমোট ৩,৮৬৫.৯০ টাকা জ্যোতির্ময়ের পক্ষ থেকে অনাদায়ি রয়ে গেছে। জ্যোতির্ময়ের পক্ষ থেকে সে টাকা ফেরত দিলেই কেবল বিমার টাকার ছাড়পত্র দেওয়া হবে।

সুদ পরিশোধের এই আমলাতান্ত্রিকতা চলতে থাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। ইতিমধ্যে বাসন্তী গুহঠাকুরতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করা টাকার সমপরিমাণ চেক জমা দেন কর্তৃপক্ষের কাছে। নথি বলছে, অবশেষে ওই বছরের ৩০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ সুদ নিয়ে বিমাটির স্বত্ব হস্তান্তর করে বাসন্তী গুহঠাকুরতার হাতে।

কিন্তু নাটক তখনো শেষ হয়নি। আমরা দেখতে পাই, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে জানিয়েছে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাড়পত্রে হবে না, টাকা পেতে হলে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিতকরণের একটি ফরমও পূরণ করতে হবে। সেটি করতে হবে একজন চিকিৎসককে, দ্বিতীয় আরেকজন চিকিৎসককে সাক্ষী রেখে। বাসন্তী গুহঠাকুরতা জ্যোতির্ময়ের মৃত্যুসনদ উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু থানা-পুলিশসহ নানা জটিলতায় ঢাকা মেডিকেল থেকে মৃত্যুসনদ পাওয়াটি অনিশ্চিতই থেকে যায়। তবে আনুষ্ঠানিক মৃত্যুসনদ প্রস্তুত না হলেও বিমার ফরমে তাঁর মৃত্যুসংক্রান্ত স্বাক্ষর করতে রাজি হন সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আলী আশরাফ এবং ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ডা. এম এ আবদুল মজিদ।

পুরোনো দলিলে আমরা তাঁদের দুজনের স্বাক্ষর করা মৃত্যুসংক্রান্ত ফরমটিও উদ্ধার করি। সেই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে এই দুজন চিকিৎসক জ্যোতির্ময়ের মৃত্যুবিষয়ক ফরমে সই করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন নিঃসন্দেহে। তবে আমরা লক্ষ করি, তাঁর মৃত্যুবিষয়ক তথ্যে এক কৌতূহলোদ্দীপক ধাঁধা আছে। দেখতে পাই, জ্যোতির্ময়ের মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি’। এটি সত্য, আবার সত্য নয়। কারণ, ‘বুলেট ইনজুরি’ কথাটির উল্লেখ না থাকায় এটি যে নিরীহ কোনো আঘাত নয়, এর পেছনে যে রয়েছে ভয়ংকর এক নির্মমতা, সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। পাকিস্তানি সেনা পরিবেষ্টিত সেই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ঝুঁকি এড়াতে এমন একটা দ্ব্যর্থবোধক কারণ উল্লেখ করে বিমার অর্থ পাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়াটাই হয়তো তখন সবচেয়ে সমীচীন পথ মনে করেছেন তাঁরা। বাসন্তী গুহঠাকুরতাও তাঁর স্মৃতিচারণায় মৃত্যুর কারণ হিসেবে এই ‘বুলেট’ শব্দের অনুপস্থিতিতে বিস্মিত হয়েছেন। যদিও তিনি লিখেছেন, ‘মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছিল “নিউমোনিয়া”।’ তার কোনো দালিলিক প্রমাণ অবশ্য আমরা পাইনি।

যাহোক, মৃত্যুর এই প্রত্যয়নে বিমার অর্থ পাওয়ার জটিলতা মিটলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক পাওনা আদায়ের আমলাতান্ত্রিকতা তখনো মেটেনি। নথিপত্রে আমরা দেখতে পাই, বাসন্তী গুহঠাকুরতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থছাড়ের জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিবিধ চিঠি-চালাচালি করছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁকে মৃত্যুসনদ এবং নানা জটিল দেনা-পাওনার পাকচক্রে ঘোরাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান জানাচ্ছেন, জ্যোতির্ময়ের কাছে ২০৫ টাকা মূল্যমানের চারটি বই পাওনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার জানাচ্ছেন, জ্যোতির্ময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাটে বেশ কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পাওয়া যায়নি, যার আনুমানিক মূল্য ৭৪৮ টাকা। হিসাবরক্ষণ বিভাগ জানাচ্ছে, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হিসেবে জ্যোতির্ময় ছাত্রদের কশনমানির যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতেন, সেখানেও কিছু টাকার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। ছাড়পত্রের আগে কর্তৃপক্ষ বাসন্তী গুহঠাকুরতার কাছ থেকে এসব বিষয়ে সদুত্তর চায়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এসব চিঠি-চালাচালি হচ্ছে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে। যুদ্ধের সময়জুড়েই এই চিঠি-চালাচালি চলে, কিন্তু অর্থছাড় তিনি পাননি।

অবশেষে অর্থছাড়ের নথিতে চূড়ান্ত অনুমোদন আসে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১২ আগস্টে, তৎকালীন উপাচার্য মোজাফফর হোসেন চৌধুরীর স্বাক্ষরে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে নিহত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃত্যুকেন্দ্রিক ঐতিহাসিক একটি ক্ষতকে উন্মোচন করতে আমাদের অনুসন্ধান। আমরা আবিষ্কার করি, হাসপাতালে মৃত্যু হলেও তাঁর পরিবার জ্যোতির্ময়ের মরদেহটি পায়নি, পায়নি একটি যথার্থ মৃত্যুসনদ এবং আরও দেখি, তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাপ্য অর্থ প্রদানে জ্যোতির্ময়ের পরিবারকে যুদ্ধের পুরো সময়টিতে অপদস্থ করেছে আমলাতান্ত্রিকভাবে। আমরা মনে করি, স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এই ঐতিহাসিক লজ্জামোচনের সুযোগ আছে সংশ্লিষ্ট দুই প্রতিষ্ঠানের। লেখার শুরুতে যে প্রস্তাবটির কথা বলেছি, সেটি উল্লেখ করতে চাই এবার।

আমরা প্রস্তাব করি, এই সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃত্যুর সঠিক কারণটি উল্লেখ করে একটি প্রতীকী মৃত্যুসনদ ইস্যু করুক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের শতবর্ষপূর্তির এই বছরে যুদ্ধকালীন দুর্দিনে জ্যোতির্ময়ের পরিবারের কাছ থেকে যে সুদের টাকাটি আদায় করেছিল, সেটি প্রতীকীভাবে ফিরিয়ে দিক এবং আমলাতান্ত্রিক নির্যাতনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করুক।

ঢাকা মেডিকেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি ব্যতিক্রমী যৌথ অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার পরিবারের সদস্যের কাছে ইতিহাসের এই ঋণ শোধ করার সুবর্ণ সুযোগ নিতে পারে এই ঐতিহাসিক বছরে।

প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০২১

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক ও জনস্বাস্থ্যবিদ

খায়রুল ইসলাম: ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আমল ত ন ত র ক জ য ত র ময়ক ১৯৭১ স ল র ম ত য সনদ র ছ ড়পত র র পর ব র পর স থ ত স বর ণ ব সন ত র জন য অর থ প র একট

এছাড়াও পড়ুন:

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল জেনোসাইড পরিকল্পনার কৌশলগত অংশ

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ দিকে অবশ্যম্ভাবী পরাজয় বুঝতে পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের দোসর আলবদর–আলশামসের সহযোগিতায় পরিকল্পিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য শিক্ষক, লেখক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের ধরে নিয়ে যায় ও নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেই সময় রায়েরবাজার, মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য বধ্যভূমি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ‘জীবন্ত সাক্ষী’ হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।

জেনোসাইড সংঘটনের সময় বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করার ঘটনা শুধু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে, তা নয়; বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জেনোসাইড বা সমপর্যায়ের অপরাধযজ্ঞে বুদ্ধিজীবী হত্যার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। তাই টার্গেটেড বুদ্ধিজীবী হত্যা কোনো আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং জেনোসাইড পরিকল্পনার একটি কৌশলগত অংশ।

একেক দেশের অপরাধীরা নিজস্ব কৌশল বিবেচনায় সেই দেশের বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট করে হত্যা করে থাকে। সাধারণভাবে বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা কাদের বুঝি আর কেনই–বা তাঁরা যেকোনো জেনোসাইডে টার্গেট হন, তার প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণাত্মকভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছি এই লেখায়। 

২.

জেনোসাইড-অধ্যয়নে ‘বুদ্ধিজীবী’ (ইনটেলেকচুয়াল) বলতে কেবল ‘শিক্ষিত মানুষ’কে বোঝায় না, বরং একটি সমাজের চেতনা, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও সংগঠন–কাঠামোকে প্রভাবিত করতে সক্ষম এমন নেতৃত্বশীল ও চিন্তাশীল শ্রেণিকে বোঝানো হয়। সে কারণেই বুদ্ধিজীবী হত্যায় শুধু শিক্ষক বা অধ্যাপকেরাই নন, যেকোনো পেশার এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করা হয়, যারা একটি নির্দিষ্ট ভাবাদর্শকে অন্যের মধে৵ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

ইতালীয় তাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামসি তাঁর প্রিজন নোটবুকস–এ বুদ্ধিজীবী ধারণাটিকে ‘ট্র্যাডিশনাল ইনটেলেকচুয়ালস’ দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে ‘অর্গানিক ইনটেলেকচুয়ালস’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘অল মেন আর ইনটেলেকচুয়াল, বাট নট অল মেন হ্যাভ ইন সোসাইটি দ্য ফাংশন অব ইনটেলেকচুয়ালস’ অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিই চিন্তা করতে পারেন; কিন্তু তাঁরা সবাই সমাজে বুদ্ধিজীবীর সামাজিক ভূমিকা রাখতে পারেন না।

তবে অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে উঠে এসে সেই গোষ্ঠীর ইতিহাস ও মতাদর্শকে সংগঠিত করে, রাজনৈতিক ভাষা দেয় এবং প্রতিরোধ ও আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলে। তাই প্রায় সব জেনোসাইডে এই অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা আলাদাভাবে টার্গেটেড হন।

৩.

ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টসের (আইসিজে) ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ইভেন্টস ইন ইস্ট পাকিস্তান ১৯৭১’ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাঙালিদের দমনে প্রাথমিক ক্র্যাকডাউন ব্যর্থ হলে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের মনোযোগ নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী/দলের ওপর কেন্দ্রীভূত করে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দলের সদস্য, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী এবং হিন্দুধর্মাবলম্বীরা (পৃ. ৩১)।’

তবে স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের শনাক্ত করার সেনা-অনুমোদিত তালিকা তৈরির প্রমাণ মেলে ঢাকার তৎকালীন অন্যতম প্রধান পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে (মুনতাসীর মামুন, ১৯৯৯)।

শুধু তা–ই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিক অ্যান্টনি মাসকারেনহাস তাঁর রেপ অব  বাংলাদেশ বইয়ে বলেন যে হত্যাযজ্ঞ ব্যক্তিদের তালিকা সেনাবাহিনীর কাছে প্রস্তুত ছিল। (পৃ. ৯৩) 

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে, ১১ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এভাবে কতজন বুদ্ধিজীবীকে মেরে ফেলা হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। কেউ কেউ দুই হাজার জন বলে মনে করেন, আবার কেউ কেউ শত শত বলে মনে করেন। তবে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় শহীদ ৫৬০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম প্রকাশ করে এবং বলা হয়, চূড়ান্ত তালিকা পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করা হবে।

এই হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটনে তৎকালীন আলশামস ও আলবদর সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে অংশ নিয়েছিল, যাদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠনের পক্ষে কথা বলা সব বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করা।

পাকিস্তানি অফিসারদের পরিচালনায় এই অভিযানগুলো রাতের অন্ধকারে চালানো হয়, যখন বন্দুকের মুখে বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; আর কখনো ফিরে না আসার জন্য। তাঁদের অনেককে ঢাকা কলেজ অব ফিজিক্যাল এডুকেশন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

মেরে ফেলার পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ মিরপুর ও রায়েরবাজারের কাছে নির্জন ইটভাটায় ট্রাকে করে নিয়ে স্তূপ করে ফেলে আসা হয়, যেখানে পরবর্তী সময়ে দুটি শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশের অন্যান্য অংশেও একই রকম নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

৪.

বাংলাদেশ জেনোসাইড ছাড়াও ১৯১৫ সালে আর্মেনীয় জেনোসাইডের সময় অটোমান শাসকপক্ষ তৎকালীন আর্মেনিয়ান চিকিৎসক এবং কবি রুপেন চিলিংগিরিয়ানকে গ্রেপ্তার করে জেনোসাইড শুরু করে। কেবল রুপেনই নয়, সেই সময়ে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। অটোমান শাসক রুপেনকে গ্রেপ্তার করেন কারণ, তাঁকে এমন একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যিনি জনসাধারণকে প্রভাবিত করতে পারেন, ফলে কর্তৃপক্ষের জন্য তিনি ‘বিপজ্জনক’ ছিলেন (ওয়ানগেনহেইমের রিপোর্ট, ১৯১৫)।

জানা গেছে, ওই সময় প্রায় ১৮০ জন আর্মেনিয়ান বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার করে নির্বাসিত করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩০ জন জীবিত ফিরে এসেছিলেন।

এ ছাড়া ১৯১০-৩০ সালের মধ্যে জার্মানির নাৎসিরা হাঙ্গেরিতে ইহুদি বুদ্ধিজীবী নাগরিকদের বিপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছিল। হাঙ্গেরির হলোকাস্ট জাদুঘর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ২০ বছর সময়কালে সবচেয়ে বেশি হত্যা করা হয়েছে আইনজীবী, চিকিৎসক ও শিক্ষকদের।

এ তথ্য থেকে বোঝা যায় যে ইহুদি বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হলোকাস্টের অংশ হিসেবেই কার্যকর করা হয়েছিল। এরপর আমরা যদি কম্বোডিয়ার জেনোসাইডের দিকে তাকাই, সেখানে দেখতে পাই যে খেমাররুজের চার বছরের শাসনের পর দেশটি তার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি হারিয়েছে সাংঘাতিকভাবে।

জেনোসাইডের পর ৪৫০ জন চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র ৪৫ জন এবং ২০ হাজার শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৭ হাজার জন বেঁচে ছিলেন। খেমাররুজ বৌদ্ধভিক্ষুসহ একাধিক ভাষা জানা লোকদেরও লক্ষ্যবস্তু করেছিল, এমনকি যারা চশমা পরত, তাদেরও ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হতো অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত হওয়ার সন্দেহে (বেন কিরনান, ২০০৫)।

এভাবে আপনি যে জেনোসাইড নিয়েই পড়বেন বা গবেষণা করবেন, কৌশলগত উপায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার উদাহরণ পাবেন নিশ্চিতভাবেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ৯ মাসজুড়েই  এ দেশের প্রতিটি জেলাতেই বুদ্ধিজীবী হত্যা সংঘটিত হয়েছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তার সহযোগীদের বুদ্ধিজীবী হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কারণ ছিল বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে উদ্ভূত স্বাধীনতার শক্তির উৎসকে  নির্মূল করা, জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করা। (নয়নিকা মুখার্জি, ২০০৭)।

৫.

এই কারণগুলো ছাড়াও বিভিন্ন কারণে জেনোসাইডের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রধানত জেনোসাইড পরিকল্পনাকারীরা জানে, শিক্ষক, লেখক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ সব বুদ্ধিজীবীই ‘সমাজের মস্তিষ্ক’ হিসেবে কাজ করেন।

তাই তাঁদের হত্যা করলে এটা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা যায় যে আক্রমণের শিকার জনগোষ্ঠীর জন্য সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা বা রাজনৈতিকভাবে পুনর্গঠিত হওয়া ও নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এই কৌশল ‘ডিক্যাপিটেশন লিডারশিপ’ নামে পরিচিত, যা সব জেনোসাইডেই দেখা গেছে। 

দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হলো বুদ্ধিজীবীরা একটি দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার অন্যতম ধারক, তাই তাঁদের হত্যা করা মানে হলো জাতিগত স্মৃতি সংরক্ষণ ও পুনর্গঠনের ক্ষমতাকে অনেকাংশে নষ্ট করা, বিশেষ করে জেনোসাইড–পরবর্তী সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অপরাধীদের শাস্তিসহ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবিদাওয়ার প্রেক্ষাপটও অনেকখানি দুর্বল হয়ে যায় বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্ব ও নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে।

রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ  বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার কারণে বাংলাদেশের জেনোসাইড দীর্ঘ সময় ধরে ছিল একটি ‘ফরগটেন জেনোসাইড’।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক স্কলার গ্যারি জে বাস ১৯৭১ নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী বইয়ের শিরোনাম দিয়েছিলেন দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড।

এর কারণ, হলোকাস্ট কিংবা বসনিয়া ও রুয়ান্ডার জেনোসাইডের তুলনায় বাংলাদেশের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং এই জেনোসাইড নিয়ে একাডেমিক মনোযোগের অভাব, যা অনেকখানি সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে নানা পেশার বুদ্ধিজীবী নিধনের ফলে।

এ ছাড়া বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মনস্তত্ত্বে ভীতির সঞ্চার করে, যা একটি জাতির ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যায়।

৬.

আমাদের মনে রাখতে হবে, জেনোসাইড মানে নিছক মানুষ হত্যা নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার একটি পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।

তাই এই প্রক্রিয়ার অন্যতম কৌশল হলো, দক্ষ পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে তাঁদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেও হত্যা করা এবং এর প্রভাব বাংলাদেশ জেনোসাইডসহ অন্য সব জেনোসাইডেই নানাভাবে প্রতীয়মান।

তাই কেন এই নির্দিষ্ট বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীকে বারবার টার্গেট করা হয়, তার কারণ বিশ্লেষণ করা ও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে এর প্রাসঙ্গিকতা নির্ণয় করা ভীষণ জরুরি, যা ভবিষ্যতে একই ধরনের বুদ্ধিজীবী নির্মূলকাঠামো রোধে আগাম সতর্কতা হিসেবে কাজ করবে।

উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে, এটা অবান্তর: চবি সহ–উপাচার্য
  • কণ্ঠহীনের কণ্ঠস্বর হওয়াই বুদ্ধিজীবীর কাজ
  • স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ভোল পাল্টে ভাব দেখাচ্ছে, তারাই নতুন বাংলাদেশ করতে পারবে: মির্জা ফখরুল
  • বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল জেনোসাইড পরিকল্পনার কৌশলগত অংশ
  • অরক্ষিত বেলতলী বধ্যভূমি, চলে মাদকের আড্ডা
  • চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে বুদ্ধিজীবী হত্যা
  • বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়ার ডাক তারেক রহমানের
  • আকাশপথে কিলো ফ্লাইটের আক্রমণ
  • পাকিস্তানে বাঙালি বন্দিশিবিরের গোপন ইতিহাস