শিশু সাজিদের করুণ মৃত্যু ও রুষ্ট চাষীদের বিপদ
Published: 14th, December 2025 GMT
কয়েক বছর আগের কথা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে পানি খেতে চেয়েছিলাম। তিনি আলমারি থেকে একটা পানির বোতল বের করলেন। তারপর পিয়নকে ডেকে বললেন, ‘ওনাকে হাফ গ্লাসের একটু বেশি পানি দাও। লাগলে উনি আবার নেবেন।’ সেই প্রথম পানি মেপে দেওয়ার ঘটনায় আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম। আর ওই চিকিৎসককে মনে মনে কঞ্জুস ভেবেছিলাম।
এর কয়েক বছর পরের কথা। ২০২২ সালের মার্চ মাসে সেচের পানি না পেয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দুই সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারানডি ও রবি মারানডি বিষ পান করে আত্মহত্যা করলেন। এরপর আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ওই চিকিৎসক কতটা দূরদর্শী ছিলেন। আবার বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটা গবেষণা তথ্য দেখে চমকে উঠলাম, ‘এক কেজি ধান উৎপাদনে নাকি বরেন্দ্র অঞ্চলে তিন হাজার লিটার পানি খরচ হয়।’
এবার শিশু সাজিদের মায়ের কান্না সারা দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে। সরকার পানি নীতি বাস্তবায়ন করুক। বিএমডিএ পানি রেশনিং করুক। আমাদের চোখের পানি আর সেচের পানি মিলেমিশে যেন একাকার না হয়।এদিকে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে তুলতে মাটির নিচের জলধারক স্তর (অ্যাকুইফার) মারা যাচ্ছে। যে স্তরে পানি থাকে, সেই স্তরে মোটা বালু থাকে। তাকে অ্যাকুইফার বলা হয়। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে অ্যাকুইফারের মোটা বালু যখন ধুলা হয়ে যায়, তখন ওই অ্যাকুইফারকে মৃত বলা হয়। তারপর ওপর থেকে যতই বৃষ্টি হোক, ওই স্তরে আর পানি জমে না। রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর ও গোমস্তাপুর উপজেলা এবং নওগাঁর পোরসা, সাপাহার ও নিয়ামতপুর উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নের মাটির নিচের অবস্থা এখন সেই রকম।
সুইজারল্যান্ড সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন ও সুইস রেডক্রস যৌথভাবে ‘সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের’ আওতায় ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত একটি জরিপ সম্পন্ন করেছে। এই জরিপ থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের এই তথ্য জানা গেছে। তার আলোকে গত ২৫ আগস্ট জাতীয় পানিসম্পদ নির্বাহী কমিটি এলাকাটিকে পানি সংকটাপন্ন ঘোষণার নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। গত ৬ নভেম্বর সরকার এই এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। তার আগে ওয়ারপো ২০১৮ সালে পানি বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। এখন এই বিধিমালা অনুযায়ী ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হবে। এতে অগ্রাধিকার পানি খাওয়ার পানি।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার শুরু করে। তারা মাটির নিচের পানি শূন্যতার অবস্থা আন্দাজ করে ২০১৫ সাল থেকে বরেন্দ্র এলাকায় সেচের জন্য আর নতুন নলকূপ না বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। অভিযোগ রয়েছে, সেই ঘোষণা ষোলো আনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে চাষিরা যেখানে–সেখানে সেচ পাম্প বসানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। বোরিং করে দেখছেন মাটির নিচে কোথায় অ্যাকুইফার পাওয়া যায়। গবেষকেরা বলছেন, কোথাও কোথাও পকেট অ্যাকুইফার রয়েছে। তাতে কিছু পানি অবশিষ্ট রয়েছে। তা যেকোনো সময় ফুরিয়ে যেতে পারে। আর ফুরিয়ে গেলেই সেই এলাকার মানুষকে পানি কিনে খেতে হবে। কিন্তু কার কথা কে শোনে! ওই এলাকার কৃষকেরা এতে রুষ্ট হচ্ছেন। আমি যেমন ওই চিকিৎসককে কঞ্জুস ভেবে মনে মনে রুষ্ট হয়েছিলাম।
চাষিরাও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারে বিধিনিষেধ জারি করায় সরকারের ওপর মনে মনে রুষ্ট। তাঁরা উপজেলা সেচ কমিটির অনুমতি ছাড়াই পানির সন্ধানে জমিতে ‘বোরিং’ করেই যাচ্ছেন। কেউ কেউ বোরিংয়ের মুখটাও বন্ধ করার কথা ভাবছেন না। গত বুধবার (১০ ডিসেম্বর) সেই রকম একটা বোরিংয়ে পড়ে তানোরের শিশু সাজিদ। পরের দিন তার লাশ উদ্ধার করা হয়। সাজিদের মা রুনা খাতুন দোষী ব্যক্তির বিচার দাবি করেছেন। তাঁর আহাজারি দেখে হাজার হাজার মানুষ চোখের পানি ফেলেছেন। শিশুটি উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখতেও অনলাইনে চোখ রেখেছিলেন সারা দেশের মানুষ। শিশুটি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছে না–ফেরার দেশে।
এখন কার কথা বলবেন—সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যাকারী চাষি অভিনাথ মারানডি, রবি মারানডি, তাঁদের মামলার আসামি গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন আর তানোরের পানির খোঁজে সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে বোরিং করা চাষি কছির উদ্দিন—কাকে কী বলবেন? আসামি সাখাওয়াত হোসেন ৪ মাস ৯ দিন হাজত খেটে বেরিয়েছেন। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন। সাজিদের মা শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুর পর্যন্ত মামলা করেননি। করেন আর না করেন, দায়িত্ব অবহেলার দায় কিছুতেই চাষি কছির উদ্দিন এড়াতে পারেন না। এই সবকিছু ঘটছে পানির জন্য। পানি দিয়ে ধান চাষের জন্য।
বাংলাদেশ সরকারের একজন উপসচিব রাজ্জাকুল ইসলাম ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি শাসনব্যবস্থা’ নিয়ে গবেষণা করেছেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন, ‘এই এলাকায় ধান চাষের চেয়ে অন্য ফসল করা চাষির জন্য লাভজনক। কিন্তু চাষি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ধান ছাড়তে চায় না। অন্য ফসল চাষের ঝুঁকি নিতে চায় না। তা ছাড়া সে ধান চাষের টেকনোলজি ঐতিহ্যগতভাবেই জানে। গোলা ভরা ধান থাকবে—এটা তার মানসিক শান্তি ও সামাজিক মর্যাদা।’
তাঁরা বুঝতে পারছে না যে তাঁরা গাছের ডালে বসে গোড়া কাটছে। মানে ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে। এভাবে পানির স্তর নেমে যেতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে তাদের ধান চাষ ছাড়তে হবে তাই নয়, বোতলজাত পানিও কিনে খেতে হবে।
এবার শিশু সাজিদের মায়ের কান্না সারা দেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে। সরকার পানি নীতি বাস্তবায়ন করুক। বিএমডিএ পানি রেশনিং করুক। আমাদের চোখের পানি আর সেচের পানি মিলেমিশে যেন একাকার না হয়।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বর ন দ র র জন য ই এল ক সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
একটি সাদাকালো ছবি
আলতাফ আমার কাছে একটি সাদাকালো ছবির নাম, আর সেই ছবিটা জুড়ে একটি বড় ইতিহাস। শোষকের বিরুদ্ধে একজন শিল্পীর বিপ্লবী হওয়ার ইতিহাস।
সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘তরুণ মাহফিল’ সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের পিতার বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া ছেলে তুমি আলতাফ। কালো অশুভ ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে করতে তুমি একটি কাঁথা আর তোমার বেহালা নিয়ে চলে এসেছিলে ঢাকাতে। সেখানে ধূমকেতু শিল্পী সংঘের নিজামুল হকের সাহচর্যে তোমার গণসংগীতের সঙ্গে পথচলা শুরু। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম গান ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে’ তোমাকে এই বিপ্লবী পথে সুরে সুরে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছিল তখন থেকেই। তোমার সুর করা প্রথম ভাষা আন্দোলনের গান ছিল এটি।
তখন থেকেই আসলে তুমি হয়ে উঠেছিলে একুশের মধ্যমণি। সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছ চারণকবির মতো। গান লিখেছ, সুর করেছ, ছায়ানৃত্য তৈরি করেছ, গীতিনাট্য রচনা করেছ। পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ, যুবলীগ, যুক্তফ্রন্টের মঞ্চ বা কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে তোমার অংশগ্রহণ ছিল দ্বিধাহীন। এর মধ্যেই তুমি সুর করে ফেলেছিলে বাংলাদেশের জন্য তোমার শ্রেষ্ঠ উপহার। অমর একুশের গান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতাটি তোমার সুরে হয়ে উঠেছিল শোক, ঘৃণা, প্রতিরোধ আর মুক্তির জন্য অনন্য এক সৃষ্টি।
তুমি মানুষকে কখনো ‘ওরে বাঙালি তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ দিয়ে কাঁদিয়েছ, আবার ‘আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস’ দিয়ে উদ্বেলিত করেছ। ১৯৭০-এর ভয়াবহ বন্যায় তুমি গেয়ে উঠেছ ‘এই ঝঞ্ঝা মোরা রুখব, এই বন্যা মোরা রুখব’, পথে পথে অর্থ সংগ্রহ করেছ। একটি শিল্প কখন যে বিপ্লবে পরিণত হয়, সেটা তোমার জীবনের পথে যাত্রী না হলে বুঝে ওঠা মুশকিল।
একাত্তরের ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালি নিধনের যে পৈশাচিক যজ্ঞ শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলে তুমি। আবদুল লতিফ, তোমার ছায়াসঙ্গী হাফিজ, রাজা হোসেন প্রমুখকে নিয়ে দিনরাত আচ্ছন্নের মধ্যে গান লিখেছ, সুর করেছ। গানগুলো সবার অগোচরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে তুমি, যেন বেতারে প্রচারিত গানগুলো উজ্জীবিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের।
ওই সময়ে কলা, সবজি, কাগজের ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল তোমার ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডে। এসব ফেরিওয়ালার সঙ্গে তোমার দীর্ঘক্ষণের আলাপচারিতা মাকে বিস্মিত করত। মা পরে বুঝতে পেরেছিল ওরা সবাই ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা—ঢাকার খবর সীমান্তের ওপারে মেলাঘরে পৌঁছে দেয়। এই অতিথিদের মাধ্যমে তুমি ওখানে টাকা পাঠাতে, তোমার গান পাঠাতে আর নিজের কাছে গড়ে তুলতে হালকা গোলাবারুদের মজুত।
ধীরে ধীরে তোমার ৩৭০ নম্বর বাড়িটি দুর্গে পরিণত হলো। ঢাকার গেরিলা আক্রমণের সূচনা তোমার হাত ধরে, তোমার ছায়াসঙ্গী যন্ত্রসংগীতশিল্পী শহীদ হাফিজের মতিঝিলে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। এর পর থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা ও অস্ত্রাগার হিসেবে তোমার বাসা হয়ে উঠেছিল অন্যতম। তুমি ধারণা করতে শিল্পীদের কেউ শত্রু মনে করে না। একাত্তরে সুরে সুরে তোমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।
একাত্তরের আগস্টের ৩০ তারিখ দুই ট্রাংক অস্ত্রসহ ভোরবেলা তোমাকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল তোমার শ্যালক, প্রতিবেশী, আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা। শত অত্যাচারেও কারও নাম বলোনি। উর্দুতে পারদর্শী আলতাফ একটি উর্দু শব্দ উচ্চারণ করোনি। তোমার সঙ্গের বন্দীদের জীবন দান করে গেছ তুমি।
আলতাফ, তোমার এই তিরোধান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ। তোমার লড়াই বাংলাদেশের একটি বিপ্লব। তোমার উন্নত শির এই স্বেচ্ছামৃত্যু একটি বীরগাথা। আলতাফ একটি দীর্ঘ পথের নাম, যেখানে আছে শুধু ‘স্বদেশ, স্বদেশ, স্বদেশ মোদের ঘর রে’।
প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩
লেখক: শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে