একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানিকগঞ্জে বড় আকারে সফল যতগুলো যুদ্ধ হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম গোলাইডাঙ্গার যুদ্ধ। ২৯ অক্টোবর জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার গোলাইডাঙ্গায় যুদ্ধটি হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই তুলনায় মুক্তিবাহিনীর ক্ষতি ছিল সামান্য। এমন অর্জন মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙা করে। বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে বিজয় অর্জনের দিকে এগিয়ে যান তাঁরা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর দুই) বইয়ে লেখা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সিঙ্গাইর থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনী। গোলাইডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। ২৯ অক্টোবর ওই ক্যাম্পের বীর মুক্তিযোদ্ধারা খবর পান যে তিন শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ১০–১২টি নৌকা নিয়ে ক্যাম্পটি দখল করতে অগ্রসর হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি দল গোলাইডাঙ্গা খালের মোড়ে এবং অন্য দল খালের অপর পাড়ে অবস্থান নেয়।
একই বইয়ে লেখা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে স্থানীয় স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যায়। সেখানে কাউকে না পেয়ে ফেরার জন্য রওনা হয়। পথে পাকিস্তানি বাহিনীর সব কটি নৌকা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের আওতার মধ্যে আসে, তখন মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি সেনাদের প্রায় সব কটি নৌকা ডুবে যায়। প্রায় এক শ পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (তৃতীয় খণ্ড) বইয়ে লেখা হয়েছে, এই খবর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে যায়। তখন পাকিস্তানি সেনাদের সমর্থনে হেলিকপ্টারে করে হামলা চালানো হয়। ওই এলাকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর দুই) বইয়ে উল্লেখ আছে, গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা এলএমজি, এসএলআর, ৩০৩ রাইফেল ও গ্রেনেড ব্যবহার করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। সেসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল রকেটবোমা, চায়নিজ এসএমজি, চায়নিজ অটোমেটিক রাইফেল, রকেট লাঞ্চার প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (তৃতীয় খণ্ড) বইয়ে লেখা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনারা ডুবুরি নামিয়ে পানি থেকে মৃত সেনাদের লাশ তুলে নিয়ে যায়। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা তোবারক হোসেন (লুডু)। সার্বিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাবিলদার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি। সেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাকিস্তানি সেনাদের আসার খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভাগ হয়ে যান, আলাদাভাবে অবস্থান নেন। গোলাইডাঙ্গা ত্রিমুখী খালের তিন পাড়ে তিনটি বাংকার (মাটির গর্ত) করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে অবস্থান নেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ৩২ জনের মতো। পাকিস্তানি সেনারা যখন বিদ্যালয়ের দিকে যায়, তখন মুক্তিযোদ্ধারা কিছু করেননি। সিদ্ধান্ত নেন, ফেরার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হবে। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা নৌকায় করে ফেরার পথে খালের ত্রিমুখী স্থানে তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে এই যুদ্ধে ৮৩ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ১০ থেকে ১৫ জন পাকিস্তানি সেনা বেঁচে পালিয়ে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে নেন। এর এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর ওই এলাকায় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে গানপাউডার ছিটিয়ে, ওপর থেকেই গুলিবর্ষণ করতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। এতে শতাধিক বাড়িঘর আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। গ্রামের ৮ থেকে ১০ জন শহীদ হন।
অসমসাহস, দেশপ্রেম আর অল্প অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এই যুদ্ধে বড় সাফল্য পেয়েছিলেন। এই অর্জন তাঁদের আরও জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী করেছিল, আশপাশের এলাকার মুক্তিযোদ্ধারাও প্রেরণা পেয়েছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
হাদিকে জড়িয়ে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে অপপ্রচারেরর অভিযোগে মামলার আবেদন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনে দলটির মনোনীত প্রার্থী মির্জা আব্বাসের কাছে চাঁদা দাবি ও মানহানির অভিযোগে ঢাকার আদালতে মামলার আবেদন করা হয়েছে। তাতে আসামির তালিকায় রাখা হয়েছে দৈনিক আজকের কণ্ঠ ও পত্রিকাটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাডমিনসহ অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের। অভিযোগ করা হয়েছে, শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় মির্জা আব্বাসকে জড়িয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে।
ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালতে রোববার ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান ভূঁইয়া এ মামলা করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি রেকর্ড করে অভিযোগটি গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) তদন্ত করার নির্দেশ দেন।
বাদীর আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা–৮ আসনে সম্ভাব৵ স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদি দুর্বৃত্তের গুলিতে আহত হওয়ার পর একই আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন আসামিরা।
অভিযোগে বলা হয়, হাদির গুলিবিদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মির্জা আব্বাসের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত চরিত্র ও আচরণ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা হয়। এ উদ্দেশ্যে ১২ ডিসেম্বর বেলা ৩টা ২৫ মিনিটের দিকে দৈনিক আজকের কণ্ঠ নামের অনলাইন পোর্টালে ‘মির্জা আব্বাসের ক্যাডারদের গুলিতে ওসমান হাদি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
মির্জা আব্বাসের ব্যক্তিগত চরিত্র ও আচরণ নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে বলে মামলার আরজিতে বলা হয়।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গত শুক্রবার ঢাকার বিজয়নগরে গুলি করে পালিয়ে যায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই ব্যক্তি। মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদি এখন হাসপাতালে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। তাঁর ওপর হামলাকারী হিসেবে একজনকে চিহ্নিত করে তাঁর তথ্য পেতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার।
আরও পড়ুনওসমান হাদির ওপর হামলা বৃহৎ চক্রান্তের ক্ষুদ্র অংশ: মির্জা আব্বাস১৩ ডিসেম্বর ২০২৫আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট ব্যাহত করতেই ওসমান হাদির ওপর এই হামলা হয়েছে বলে মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে বিএনপিও গতকাল সমাবেশ করেছে। সেখানে মির্জা আব্বাস বক্তব্যও দেন।