কিশোরীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার
Published: 15th, January 2025 GMT
১৩ বছর বয়সী কিশোরীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে চৌহালী উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফকির মো. জুয়েল রানাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক তানভীর মাহমুদ পলাশ স্বাক্ষরিত চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, গঠনতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করায় উপজেলা বিএনপির সুপারিশে জুয়েল রানাকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি রুমানা মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু এতে অনুমোদন দিয়েছেন। বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটিকেও জানানো হয়েছে। গত রোববার একই কারণে তাঁকে শোকজ করা হয়।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাহিদ মোল্লা জানান, ফকির মোঃ জুয়েল রানার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জেলা কমিটিকে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছিল।
চৌহালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান জানান, মামলা হওয়ার পর নির্যাতিত শিশুটিকে মঙ্গলবার শারীরিক পরীক্ষা করানো হয়েছে। প্রতিবেদন পেতে সময় লাগবে।
জানা যায়, পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে ১১ ডিসেম্বর রাতে উপজেলা সদরের চর সলিমাবাদ বাজার এলাকায় ডেকে নিয়ে বিএনপি নেতা জুয়েল রানা শিশুটিকে যৌন নিপীড়ন করেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ স র জগঞ জ ব এনপ র স উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
এক সংশপ্তকের রাজনৈতিক পথপরিক্রমা
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদ অসামান্য প্রজ্ঞা ও ধীরস্থির রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচয় দেন। মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অস্থায়ী সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করে যুদ্ধে গতিশীলতা আনেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা প্রায়ই সামরিক সাফল্যের পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকার দরুন তাজউদ্দীনের মতো বেসামরিক নেতৃত্বের অবদান থেকে গেছে আড়ালেই। বেসামরিক প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক সাফল্যও একই কারণে অবমূল্যায়িত। অথচ মুক্তিযুদ্ধ কেবল রণাঙ্গনের জয় নয়; এটি ছিল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, ঐক্য ও জাতিসত্তার নবজাগরণের ফল। বলাবাহুল্য, এর নির্মাতাদের অন্যতম ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর সংহত নেতৃত্বে জাতি পেয়েছিল স্বাধীনতার সুস্পষ্ট রূপরেখা ও দিকনির্দেশনা। তাজউদ্দীন আহমদ আজ বেঁচে থাকলে বয়স হতো ১০০ বছর। মাত্র ৫০ বছর বয়সে তিনি ঘাতকের হাতে প্রাণ দেন, কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীরূপে তাঁর অবদান ইতিহাসে অমোচনীয়। ইতিহাসের দায় মেটানোর প্রয়াসেই মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন ‘তাজউদ্দীন নামে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন’ গ্রন্থটি। এটি কোনো জীবনী নয়, বরং ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত এক রাজনৈতিক যাত্রার গভীর ঐতিহাসিক ও মানবিক আখ্যান।
‘উপসংহার’ ও ‘গ্রন্থপঞ্জি’ বাদ দিলে গ্রন্থটিতে মোট অধ্যায় রয়েছে নয়টি। অধ্যায়গুলোর শিরোনামের কোনো কোনোটির নামকরণে কাব্যিকতা রয়েছে। পাঠক এতে গ্রন্থটি পড়ার বাড়তি আগ্রহ পাবেন। ‘যুদ্ধদিনের কথা’, ‘মুক্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী’, ‘যখন অর্থমন্ত্রী’, ‘ক্ষমতার রসায়ন’ প্রভৃতি অধ্যায় একদিকে যেমন কাব্যিকতা দ্বারা শোভিত, অন্যদিকে রুচিশীল পাঠকের আগ্রহ ও কৌতূহল বৃদ্ধির টনিক হিসেবেও কাজ করবে। ইতিহাসের মোড় ঘোরানো কয়েক বছরের কথা গ্রন্থটির উপজীব্য হলেও, বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে তাজউদ্দীনের ঐতিহাসিক বিবর্তনকে লেখক চমৎকারভাবে সমীকৃত করতে পেরেছেন।
তাজউদ্দীন নামে একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন
মহিউদ্দিন আহমদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
পৃষ্ঠা: ২৩০
মূল্য: ৫৮০ টাকা
১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া তাজউদ্দীন কৈশোর থেকেই রাজনীতিমুখী ও কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তাঁর কিশোর হৃদয়ে জাগায় দেশপ্রেমের অগ্নিশিখা। শিক্ষাজীবনে তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী—ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে দ্বাদশ, উচ্চমাধ্যমিকে চতুর্থ এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক। রাজনীতিতে গভীরভাবে যুক্ত থেকেও তিনি জেলে বসে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তাঁর এই দৃঢ়তা ও অধ্যবসায়ই ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়কের ভিত গড়ে দেয়। রাজনীতিতে তাজউদ্দীনের ভূমিকা ছিল নেপথ্যের। আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের সময় তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে প্রণীত ছয় দফা কর্মসূচির মূল কাঠামো ও ভাষার বিন্যাসে ছিল তাজউদ্দীনের সৃজনশীল হাত। এই ছয় দফার ভিত্তিতেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানায় সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদাররা গণহত্যা চালায়।
২৫ মার্চের ভয়াল রাতের পর তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছান এবং ৩ এপ্রিল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, ‘এটা আমাদের যুদ্ধ—আমরা চাই ভারত আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সৈন্য বা অস্ত্র না দিক।’ তাঁর এই বক্তব্যে প্রকাশ পায় গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাধীনচেতা মনন। তিনি কুষ্টিয়া সীমান্তে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে ঐতিহাসিক অধিবেশন আহ্বান করেন। সেখানে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় অসীম দূরদর্শিতা ও স্থিতধী নেতৃত্বের পরিচয় দেন। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, খন্দকার মোশতাকের বিশ্বাসঘাতকতা ও নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেন এবং সরকার, মুক্তিবাহিনী ও জনগণকে একসূত্রে গেঁথে বিজয়ের পথে পরিচালিত করেন। তাঁর ১০ এপ্রিলের ঐতিহাসিক ভাষণে প্রতিফলিত হয় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদী অর্থনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের স্বপ্ন—যে দর্শনে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভিত্তি।
বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগপর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন, পরে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন। আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করেন। কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতা ও বিভাজনের কারণে ১৯৭৪ সালে তিনি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য হন। লেখক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘একটা ভবন তৈরি করতে অনেক পিলার লাগে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় তাজউদ্দীন যে একটা পিলার, এটা তো অস্বীকার করা যায় না। অথচ বিনিময়ে তিনি পেলেন উপেক্ষা আর অবহেলা। যে পদ্ধতিতে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় করা হয়, সেখানে সামান্যতম সৌজন্য ছিল না। সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রতিবেদনে যেভাবে তাঁর চরিত্র হনন করা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের নায়কের এই অপমান প্রাপ্য ছিল না।’
যিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পুরোধা, আজীবন জনগণের কল্যাণ ও স্বাধীনতার স্বপ্নে নিবেদিত সেই নিভৃতচারী, ত্যাগী দেশপ্রেমিক তাজউদ্দীন আহমদকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকেরা। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁকে হত্যা করা হয়। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে নিভিয়ে দেয়নি, বরং আরও দীপ্ত করেছে ইতিহাসের পটে। তাঁর আদর্শ, কর্ম ও চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক। মহিউদ্দিন আহমদের গ্রন্থটি পাঠে সহৃদয় পাঠক বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এই মহানায়কের পরিণতিপর্বে উত্তরণের অন্তরঙ্গ বিবরণ পাবেন।