Prothomalo:
2025-12-14@17:30:50 GMT

একটি সাদাকালো ছবি

Published: 14th, December 2025 GMT

আলতাফ আমার কাছে একটি সাদাকালো ছবির নাম, আর সেই ছবিটা জুড়ে একটি বড় ইতিহাস। শোষকের বিরুদ্ধে একজন শিল্পীর বিপ্লবী হওয়ার ইতিহাস। 

সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘তরুণ মাহফিল’ সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের পিতার বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া ছেলে তুমি আলতাফ। কালো অশুভ ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে করতে তুমি একটি কাঁথা আর তোমার বেহালা নিয়ে চলে এসেছিলে ঢাকাতে। সেখানে ধূমকেতু শিল্পী সংঘের নিজামুল হকের সাহচর্যে তোমার গণসংগীতের সঙ্গে পথচলা শুরু। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম গান ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে’ তোমাকে এই বিপ্লবী পথে সুরে সুরে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছিল তখন থেকেই। তোমার সুর করা প্রথম ভাষা আন্দোলনের গান ছিল এটি।

তখন থেকেই আসলে তুমি হয়ে উঠেছিলে একুশের মধ্যমণি। সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছ চারণকবির মতো। গান লিখেছ, সুর করেছ, ছায়ানৃত্য তৈরি করেছ, গীতিনাট্য রচনা করেছ। পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ, যুবলীগ, যুক্তফ্রন্টের মঞ্চ বা কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে তোমার অংশগ্রহণ ছিল দ্বিধাহীন। এর মধ্যেই তুমি সুর করে ফেলেছিলে বাংলাদেশের জন্য তোমার শ্রেষ্ঠ উপহার। অমর একুশের গান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতাটি তোমার সুরে হয়ে উঠেছিল শোক, ঘৃণা, প্রতিরোধ আর মুক্তির জন্য অনন্য এক সৃষ্টি। 

তুমি মানুষকে কখনো ‘ওরে বাঙালি তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ দিয়ে কাঁদিয়েছ, আবার ‘আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস’ দিয়ে উদ্বেলিত করেছ। ১৯৭০-এর ভয়াবহ বন্যায় তুমি গেয়ে উঠেছ ‘এই ঝঞ্ঝা মোরা রুখব, এই বন্যা মোরা রুখব’, পথে পথে অর্থ সংগ্রহ করেছ। একটি শিল্প কখন যে বিপ্লবে পরিণত হয়, সেটা তোমার জীবনের পথে যাত্রী না হলে বুঝে ওঠা মুশকিল।

একাত্তরের ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালি নিধনের যে পৈশাচিক যজ্ঞ শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলে তুমি। আবদুল লতিফ, তোমার ছায়াসঙ্গী হাফিজ, রাজা হোসেন প্রমুখকে নিয়ে দিনরাত আচ্ছন্নের মধ্যে গান লিখেছ, সুর করেছ। গানগুলো সবার অগোচরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে তুমি, যেন বেতারে প্রচারিত গানগুলো উজ্জীবিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের।

ওই সময়ে কলা, সবজি, কাগজের ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল তোমার ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডে। এসব ফেরিওয়ালার সঙ্গে তোমার দীর্ঘক্ষণের আলাপচারিতা মাকে বিস্মিত করত। মা পরে বুঝতে পেরেছিল ওরা সবাই ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা—ঢাকার খবর সীমান্তের ওপারে মেলাঘরে পৌঁছে দেয়। এই অতিথিদের মাধ্যমে তুমি ওখানে টাকা পাঠাতে, তোমার গান পাঠাতে আর নিজের কাছে গড়ে তুলতে হালকা গোলাবারুদের মজুত।

ধীরে ধীরে তোমার ৩৭০ নম্বর বাড়িটি দুর্গে পরিণত হলো। ঢাকার গেরিলা আক্রমণের সূচনা তোমার হাত ধরে, তোমার ছায়াসঙ্গী যন্ত্রসংগীতশিল্পী শহীদ হাফিজের মতিঝিলে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। এর পর থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা ও অস্ত্রাগার হিসেবে তোমার বাসা হয়ে উঠেছিল অন্যতম। তুমি ধারণা করতে শিল্পীদের কেউ শত্রু মনে করে না। একাত্তরে সুরে সুরে তোমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।

একাত্তরের আগস্টের ৩০ তারিখ দুই ট্রাংক অস্ত্রসহ ভোরবেলা তোমাকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল তোমার শ্যালক, প্রতিবেশী, আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা। শত অত্যাচারেও কারও নাম বলোনি। উর্দুতে পারদর্শী আলতাফ একটি উর্দু শব্দ উচ্চারণ করোনি। তোমার সঙ্গের বন্দীদের জীবন দান করে গেছ তুমি।

আলতাফ, তোমার এই তিরোধান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ। তোমার লড়াই বাংলাদেশের একটি বিপ্লব। তোমার উন্নত শির এই স্বেচ্ছামৃত্যু একটি বীরগাথা। আলতাফ একটি দীর্ঘ পথের নাম, যেখানে আছে শুধু ‘স্বদেশ, স্বদেশ, স্বদেশ মোদের ঘর রে’।

প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩

লেখক: শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স র কর আলত ফ

এছাড়াও পড়ুন:

এক সপ্তাহে ৪০ মরদেহের ডিএনএ সংগ্রহ করল সিআইডি

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ অজ্ঞাতনামা ১১৪ জনের পরিচয় শনাক্তে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ব্যবস্থাপনায় মরদেহ উত্তোলনের কাজ চলছে। গত এক সপ্তাহে ৪০টি মরদেহ তোলা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ ও ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। অজ্ঞাতনামা শহীদদের স্বজনদের সঙ্গে ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা হবে।

আজ রোববার সন্ধ্যায় সিআইডির গণমাধ্যম শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ৭ ডিসেম্বর সকাল থেকে রাজধানীর রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থান থেকে এই মরদেহ উত্তোলন করা হচ্ছে। ঢাকা জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এ কাজে সহযোগিতা করছে।

সিআইডি বলছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার (ওএইচসিএইচআর) মাধ্যমে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ লুইস ফনডিব্রাইডার আর্জেন্টিনা থেকে ঢাকায় এসে পুরো কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকেরাও এ কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। কবর থেকে মরদেহ তোলার আগেই তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

সিআইডির গণমাধ্যম শাখার তথ্য অনুসারে, রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থান থেকে গত এক সপ্তাহে ৪০টি মরদেহ তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ ডিসেম্বর ২টি, ৮ ডিসেম্বর ৪টি, ৯ ডিসেম্বর ৬টি, ১০ ডিসেম্বর ৬টি, ১১ ডিসেম্বর ৭টি, ১৩ ডিসেম্বর ৭টি এবং রোববার আরও ৮টি মরদেহ উত্তোলন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ। আন্তর্জাতিক মিনেসোটা প্রটোকল সম্পূর্ণরূপে মেনেই কাজটি করা হচ্ছে। মরদেহ তোলার পর তার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ, ময়নাতদন্ত করে পুনরায় দাফন করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী এসব মরদেহের ডিএনএ নমুনা, ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে। এই কাজ চলমান থাকবে।’

সাতটি শহীদ পরিবারের ১১ স্বজন ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন

নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে জসীম উদ্দিন খান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পরিচয় জানতে সাতটি শহীদ পরিবারের ১১ জন স্বজন তাঁদের ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন। অজ্ঞাতনামা সব কটি মরদেহ তোলার পর তাঁদের ডিএনএ নমুনার সঙ্গে স্বজনদের নমুনা মিলিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করা হবে। তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত করাই এখন আমাদের মূল কাজ।’

সিআইডির তথ্য অনুসারে, এখন পর্যন্ত জুলাইয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে নিখোঁজ হওয়া সোহেল রানা (২৮), গোপীবাগ থেকে নিখোঁজ রফিকুল ইসলাম (৫০), উত্তরা থেকে নিখোঁজ মো. আসাদুল্লাহ (৩১), মোহাম্মদপুর থেকে নিখোঁজ মাহিন মিয়া (২৫), উত্তরা থেকে নিখোঁজ ফয়সাল সরকার (২৫), রফিকুল ইসলাম (২৯), আহমেদ জিলানীর (৩০) স্বজনেরা ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে যাঁরা শহীদ গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ১১৪ জনের পরিচয় জানা যায়নি। অজ্ঞাতনামা এসব মরদেহ রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন কবরস্থানে গণকবর দেওয়া হয়েছিল। বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে লাশগুলো দাফন করেছিল।

সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, রায়েরবাজার কবরস্থানে তারা জুলাইয়ে ৮০ জনের ও আগস্টে ৩৪ জনের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছিল।

এসব মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে গত ৪ আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান পুলিশি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লাশ উত্তোলনের নির্দেশ দেন। পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদনটি করেন মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক মাহিদুল ইসলাম।

সম্পর্কিত নিবন্ধ