জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রতি মানুষের প্রত্যাশা যেমন বিপুল, তেমনি আলোচনা-সমালোচনাও হচ্ছে প্রচুর। শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনকে পরাজিত করে নতুন দিনের সূচনাকারী যে ছাত্র-জনতা; তাদের গঠিত রাজনৈতিক দল ঘিরে নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষা ডানা মেলাই স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির মূল নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররা যুক্ত থাকলেও জনতার দেখা নাই কোনো কমিটিতে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান; কিন্তু ছাত্রদের বাইরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনতার প্রতিনিধিত্ব না থাকাটা বড় প্রশ্নচিহ্ন হিসেবে রয়ে গেল। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় ঐক্য ও যূথবদ্ধতার মূল চেতনা থেকে সরে আসার নমুনা চারপাশে; শুধু ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল কি তারই একটি?

আরও প্রশ্ন আছে। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে এনসিপি নেতৃবৃন্দ রাজধানীতে সুরম্য কার্যালয়ে বসে দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করছেন; পাঁচতারকা হোটেলে জমকালো ইফতার মাহফিলের আয়োজন করছেন, এদিক-ওদিক যেতে বিলাসবহুল গাড়ি, এমনকি হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। এই বিপুল অর্থের উৎস কী? নিশ্চয়ই শুভানুধ্যায়ীদের অংশগ্রহণ, গণচাঁদা, স্পন্সরশিপ। সাত মাস আগেও যে তরুণেরা চাঁদা তুলে হাজারখানেক টাকার মাইক ভাড়া করে লাখ লাখ ছাত্র-জনতাকে রাস্তায় নেতৃত্ব দিয়েছেন; আজ তাদের অনুষ্ঠান পাঁচতারকা হোটেল ছাড়া হবে না? প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এনসিপির তবে পার্থক্য থাকল কোথায়? কেন ধনীরা তাদের অকৃপণ চাঁদা দিচ্ছে? এই অনুরাগ তারা বরাবরই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ বড় দলগুলোকে দেখিয়ে এসেছে; এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এনসিপি। তাহলে আদর্শ, বিবেচনাবোধ কিংবা পক্ষ-প্রতিপক্ষ কোথায় থাকে আর! আজ যে চাঁদার ফাঁদে পড়ছে এনসিপি; তাতে স্বার্থের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যাচ্ছে, যেমন ছিল বা আছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর। সরকারি আনুকূল্য থেকেও তাদের দূরে থাকা সংগত। নইলে ‘কিংস পার্টি’ অভিধা থেকে মুক্তি মিলবে না। 
দলীয় আদর্শ বা নীতির স্পষ্ট অবস্থান এনসিপির এগিয়ে চলবার জন্য জরুরি। ডান ও বাম উভয় ধারার কর্মীদের অংশগ্রহণে দলটি তৈরি বলে তারা আপাত মধ্যপন্থি ধরনের মনোভাব প্রকাশ করছে। কখনও ডান ধারার প্রভাবও দেখা যাচ্ছে। এভাবে দোদুল্যমান আদর্শ রাজনৈতিক দলের বিকাশে অন্তরায়। দিন কয়েক আগে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নেত্রী সামান্তা শারমিনকে দেখা গেল। উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের ‘নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে আপনার দলের অবস্থান কী?’– এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরি তিনি দিতে পারলেন না। নানা কথার মারপ্যাঁচে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি অস্পষ্টই রয়ে গেল।

নারীদের প্রবল উপস্থিতি ও নেতৃত্বে যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠল মাত্র সাত মাস আগে জুলাইতে; তার ঘন বারুদ ও অশ্রুর কণা উড়ে যাওয়ার আগেই সামান্তা শারমিনের মতো নেত্রী নারী-পুরুষের সমান অধিকার সম্পর্কে সরাসরি কথা বলতে পারছেন না। এর নাম তবে রাজনীতি! হায়!

২.


সংবিধান ও সংস্কার প্রশ্নেও সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে এনসিপিতে। সংবিধান বদল করে গণপরিষদ ভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাবনা নিয়ে তারা এগোচ্ছেন। তারা এই ভাবনা ভাবতেই পারেন, তবে তা কতখানি বাস্তবসম্মত ও প্রয়োজনীয়, সেটি নির্ণয়ও জরুরি। দেশের মানুষের সামনে প্রধান সমস্যাগুলো কী? কেন তারা শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনে অস্থির হয়ে রাজপথে নেমে এলো? বৈষম্যপীড়িত সমাজে মৌলিক চাহিদাগুলোই সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নাই। দেশের স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে ব্যাংকিং খাত বা শিক্ষা– সবই ধনীদের জন্য, তৃণমূলে এসবের কোনো সুবিধার চিহ্নমাত্র নাই। বড় বড় প্রকল্পের নামে উন্নয়নের গালগল্পে নিজের স্বজন-পরিজন ও দলীয় লোকজনের ভান্ডার স্ফীত করার যে সংস্কৃতি; তাতে বঞ্চিত হয়েছে দেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে কালো টাকা। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, জবাবদিহির অভাবে ভেঙে পড়েছে সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি, বাক ও মানবাধিকার– কোনো পর্যায়ের অধিকার মানুষের নিজের থাকেনি; সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে সরকারি অঙ্গুলি হেলনে।

এসব জনসমস্যা সমাধানে সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে না; প্রয়োজন জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন। আর নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন বর্তমান দায়িত্বরত সরকারের সদিচ্ছা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো সংস্কার, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি কর্তৃপক্ষ যাতে কোনো পক্ষের হয়ে কাজ করতে না পারে, তার আইন তৈরি ও সেটি প্রয়োগ। সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ সরকার যাতে আবার একদলীয় না হয়ে ওঠে এবং একনায়কতন্ত্র চাপিয়ে দিতে না পারে, তার ন্যূনতম কাঠামো প্রস্তুত করা। এসব কাজে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য স্থাপন দ্রুততম সময়ে আদায় করাও বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। 

৩.
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দেশ পরিচালনার দায়িত্বে না থাকলে সেখানে যেমন জবাবদিহি উপেক্ষিত হয়; একইভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাবে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করে। দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। এর ধারাবাহিকতায় মব সন্ত্রাস, নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, নারীবিরোধী কর্মকাণ্ড, ছিনতাই-রাহাজানি-খুনসহ বিভিন্ন ধরনের উস্কানিমূলক আচরণ অব্যাহতভাবে চলছে। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ ও উচ্চারণ অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও অসহনীয় করে তুলছে।
ডিএমপি কমিশনার সাজ্জাত আলী ১৫ মার্চ গণমাধ্যমে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি ব্যবহার না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এর বদলে তিনি ‘নারী নির্যাতন’ বা ‘নারী নিপীড়ন’ শব্দ ব্যবহারের অনুরোধ করেছেন। তিনি ‘রিজনেবল’ করে বিষয়টিকে দেখাতে বলেছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন জানিয়েছে, গত ১০ বছরে সাড়ে ৫ সহস্রাধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। চলতি আন্দোলন-প্রতিবাদের মধ্যেই তিন জেলায় পাঁচ শিশুকে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিএমপি কমিশনার বলছেন সাংবাদিকদের রিজনেবল হতে! একই প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘একটা জিনিস বুঝতে হবে, ধর্ষণ কিন্তু ব্যক্তি ও পারিবারিক ক্ষেত্রের একটা অপরাধ। ধর্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটাই দায় হতে পারে, রাষ্ট্র যদি গ্রেপ্তার ও বিচার না করে’ (প্রথম আলো, ১৪ মার্চ ২০২৫)।
না, মাননীয় আইন উপদেষ্টা। ধর্ষণ ব্যক্তি বা পারিবারিক ক্ষেত্রের অপরাধ হলেও এর মূল শিকড় বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে প্রোথিত, যা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। রাজনৈতিক মূল্যবোধ সামাজিক মূল্যবোধকে প্রভাবিত করে। দেশে ভঙ্গুর মূল্যবোধের ছাপ আমরা দেখি নারীর প্রতি পুনঃপুনঃ আক্রমণাত্মক কথা ও আচরণে। পাড়া-মহল্লায়, মাঠে, ওয়াজ মাহফিলে, শ্রেণিকক্ষে, রাস্তায়, বাজারে নারীর প্রতি কটূক্তি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের কোনো একটিকে ‘অন্যায়’ বলে ন্যূনতম শনাক্তটুকুও করছে না বর্তমান সরকার। এসবের ফল দাঁড়াচ্ছে– লাগামহীন ধর্ষণকাণ্ড। সরকারকে নারীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে; একইভাবে বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের অনুরাগ থাকতে পারবে না। যদি জাতীয় নাগরিক পার্টি বা অন্য কোনো দলের প্রতি বর্তমান সরকারের আনুকূল্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তবে আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়েও জটিলতা দেখা দেবে। 

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এনস প ছ ত র জনত পর স থ ত সরক র র র জন য অন ষ ঠ এনস প জনত র

এছাড়াও পড়ুন:

‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি

‎নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আইনসৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে সকল ধর্মমত, সকল  সম্প্রদায় তারা একত্রিত হয়েছে।

সকলেই সার্বিক সহয়তা করছে যাতে করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উৎসব সুন্দর ভাবে পজলন করতে পারে। পূজাকে ঘিরে  একটি গোষ্ঠি চাইবে পূজা উৎসব নষ্ট করে দেয়ার জন্য। 

সে জন্য আমাদের তৎপরতা রয়েছে। আমাদের  গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তার পাশাপাশি র‍্যাব, বিজিবি,  সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশবাহিহনী সবাই কাজ করছে যাতে করে সুন্দর ভাবে পূজা উৎসব শেষ করতে পারি।

‎‎মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর)  শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫নং ঘাটে দূর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জনের স্থান পরিদর্শনকালে তিনি এ নির্দেশনা দেন।

‎দূর্গা পূজা বিজয়া দশমী শেষে প্রতিমা বিসর্জনের সময় যেকোনো অপ্রীতিকর দূর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুন্দর ভাবে প্রতিমা বিসর্জনের স্থান নিরাপদ রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন জেলা প্রশাসক।

‎‎জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ২২৩টি পূজা মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বর্তমানে পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে।

‎‎এসময় তিনি প্রতিটি মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে ও নির্বিঘ্নে পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ সহযোগিতার নির্দেশনা দেন।

‎‎তিনি বলেন, সকলে মিলে সব উৎসব উদযাপন করাই বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব।

‎‎এসময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‎পূজাকে  ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি
  • নুরুল হকের ওপর হামলার ঘটনায় জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন
  • ১৭ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ, নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই হাজার সদস্য
  • ফরিদপুরে অবরোধ শনিবার পর্যন্ত স্থগিত
  • আসন্ন নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নির্দেশ ডিএমপি কমিশনারের