আজও পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ নেই রংপুরে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়ন করেনি। প্রতিশ্রুত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় রংপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা।
পিছিয়ে পড়া রংপুরে বহুল প্রতীক্ষিত গ্যাসের সুবিধা না পাওয়ায় নগরীর এক তরুণ উদ্যোক্তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ল। সুলতান আহমেদ নামের এ তরুণ উদ্যোক্তা হতাশার সঙ্গে জানালেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ নিয়েও রংপুরবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে হাসিনা সরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যাস সরবরাহ উদ্বোধনের প্রায় দেড় বছর পরও গ্যাস সরবরাহ অধরাই থেকে গেছে। নির্বাচনে সুফল পেতে আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাস সরবরাহ উদ্বোধন নাটক সাজিয়েছিল।’
শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর গ্যাস সঞ্চালন লাইনের উদ্বোধন করা হয়। রংপুরের পীরগঞ্জের নিয়ামতপুর চৌরাহাট এলাকায় গ্যাসস্টেশন প্রাঙ্গণে ফলক উন্মোচন ও গ্যাস প্রজ্বালন করেন পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার।
ওই সময় জানানো হয়, দেশের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিশ্রুত বগুড়া থেকে রংপুর হয়ে নীলফামারীর সৈয়দপুর পর্যন্ত স্থাপিত দেড়শ কিলোমিটার পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এ গ্যাস আবাসিক এলাকায় নয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পিত শিল্পকারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ করা হবে। প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরের জেলা কক্সবাজার থেকে কিংবা প্রায় সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার দূরের সিলেট থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে এ গ্যাস সরবরাহ হবে। দু’সপ্তাহের মধ্যে বিতরণ কার্যক্রম শুরু করার কথা জানায় পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল)। এ ক্ষেত্রে প্রথমে সৈয়দপুর ইপিজেডে ও পরবর্তীতে রংপুরে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠলে পাইপলাইন স্থাপন করে গ্যাস সরবরাহ করা হবে বলে জানানো হয়।
কিন্তু প্রতিশ্রুতিই শেষ, বাস্তবায়ন কিছুই হয়নি। রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আকবর আলী বলেন, গ্যাস সংযোগ পেলে শিল্পকারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় আমরা হতাশ।
রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক সাব্বির আহমেদ বলেন, রংপুরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল গ্যাস সরবরাহ হলে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠাসহ বিসিক এলাকার শিল্পকারখানার পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে। কিন্তু সে স্বপ্ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের রংপুর মহানগর সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, দ্রুত গ্যাস সঞ্চালনের মাধ্যমে ইপিজেডসহ বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তুলে রংপুর বিভাগের শিল্পায়নকে এগিয়ে নেওয়া সময়ের দাবি।
শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাস এলেই এ অঞ্চলের শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। পীরগঞ্জ থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত মহাসড়কের পাশে অনেক দেশি-বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তা প্লট কিনে গ্যাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। গ্যাস পেলে আরও বেশি কলকারখানা গড়ে উঠবে। এতে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের সংকট কমে যাবে।
রংপুর অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য রাষ্ট্রীয় দুটি কোম্পানি কাজ করছে। সঞ্চালনের দায়িত্বে রয়েছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল), আর বিতরণ অংশের প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে পিজিসিএল। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ‘বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ৩০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ করে জিটিসিএল। এ প্রকল্পটি ১ হাজার ৩৭৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
এ ব্যাপারে পিজিসিএলের উপমহাব্যবস্থাপক এবং রংপুর-নীলফামারী, পীরগঞ্জ শহর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ফজলুল করিম বলেন, বিতরণ লাইনের কাজ সম্পন্ন করতে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজটি শেষ হবে। বর্তমানে রংপুর নগরীতে শিল্পকারখানায় গ্যাস
সরবরাহের জন্য শহর দিয়ে পাগলাপীরের সলেয়াশাহ পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ য স সরবর হ ন প রকল প স য়দপ র ল ইন র র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাস অপচয়ে বছরে ক্ষতি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি: পেট্রোবাংলা
কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে গ্যাস অপচয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে অপচয় হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ গ্যাস। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মার্চ পর্যন্ত অপচয় হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এতে আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে ২ শতাংশ।
‘দেশের জ্বালানিনিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়; গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এতে বলা হয়, ২ শতাংশ অপচয় গ্রহণযোগ্য, তাই ওইটুকু সমন্বয় করেই আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা।
পেট্রোবাংলা বলছে, গ্যাস অপচয়ের জন্য দায়ী হচ্ছে পুরোনো, জরাজীর্ণ পাইপলাইন; গ্যাস সরবরাহ লাইনের গ্যাসস্টেশন রাইজারে লিকেজ (ছিদ্র); তৃতীয় পক্ষের উন্নয়নকাজে পাইপলাইন ছিদ্র হওয়া এবং আবাসিক খাতে প্রচুর অবৈধ সংযোগ। তবে এসব অপচয় রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সরবরাহব্যবস্থায় মিটারিং/ মনিটরিং ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা; লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কারিগরি ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা; অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও উচ্ছেদ কার্যক্রম জোরদার করা এবং আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা।
দেশের গ্যাস খাতের চিত্র তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে কমতে ১৫ বছর আগের জায়গায় চলে গেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস চুরি ও অপচয় কমাতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এটা ভালো করে দেখা উচিত।
শিল্পে নতুন সংযোগে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর আছে, খোঁজ পেলেই বিচ্ছিন্ন করা হবে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যেহেতু তারা বেশি দাম দেবে। তাই অগ্রাধিকার বিবেচনা করে তিনটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম ধাপের তালিকায় থাকছে, যেসব কারখানায় এখনই সংযোগ দেওয়া যাবে। এগুলো পরিদর্শন প্রায় শেষের দিকে, আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এটি করা হবে। এটি হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কিনে মজুত করা যাবে। তবে এগুলো রাতারাতি করা যায় না, পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে
তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মো. শোয়েব। তিনি বলেন, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তৈরি পিএসসির খসড়া জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৫০টি কূপ সংস্কার, উন্নয়ন ও খননের প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৮টির কাজ শেষ হয়েছে। জাতীয় গ্রিডে নতুন করে দিনে ৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হয়েছে। ৪টি কূপের কাজ চলমান। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী।
সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
পেট্রোবাংলার আর্থিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে অর্ধেক বকেয়া। গত মে পর্যন্ত গ্যাস বিল বকেয়া ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। ১৩–১৫ হাজার কোটিতে বকেয়া নেমে এলে সন্তোষজনক। সবচেয়ে বেশি বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এরপর সার কারখানায় বকেয়া আছে ৯৬৪ কোটি টাকা। তবে বিদেশি কোনো কোম্পানির কাছে বিল বকেয়া নেই পেট্রোবাংলার। সব বিল শোধ করা হয়ে গেছে।
গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা
পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা মোট ভর্তুকি নিয়েছে ৩৬ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার হিসাবে গত অর্থবছরে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হয়েছে ২৭ টাকা ৫৩ পয়সা। তারা বিক্রি করেছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সায়। এর মানে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা।