কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে শিকল দিয়ে বেঁধে ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ সেদিনের ভয়াবহ ঘটনা ভুলতে পারেননি এখনও। দিন কাটছে ভয় আর আতঙ্কে। ঘটনার তিন দিনেও মুখোশ পরা যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তাকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবারের সদস্যরা।

পাশবিক নির্যাতন শেষে ওই গৃহবধূকে শিকলে বেঁধে বিবস্ত্র অবস্থায় ঘরের মেঝেতে ফেলে যায় জড়িত ব্যক্তিরা। পরে তার বৃদ্ধ শাশুড়ির চিৎকারে স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে গৃহবধূকে পড়ে থাকতে দেখতে পান। কেউ একজন তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। তখন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে ভুক্তভোগীর মেঝেতে পড়ে থাকার ছবি তোলেন, আবার কেউ ভিডিও ধারণ করেন। এরই মধ্যে এসব ছবি ও ভিডিও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েছেন ভুক্তভোগী নারী।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার পর নাঙ্গলকোট উপজেলার দৌলখাঁড় ইউনিয়ন কান্দাল গ্রামে ওই গৃহবধূর ওপর পাশবিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। গৃহবধূর স্বামী ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। বাড়িতে ৭০ বছর বয়সী অসুস্থ শাশুড়ি আর দুই বছর বয়সী কন্যাসন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। ২২ বছর বয়সী ওই গৃহবধূকে শিকল দিয়ে বেঁধে পাশবিক নির্যাতনের পর তার মাথার চুলও কেটে দেওয়া হয়। 

এ ঘটনায় শুক্রবার সকালে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন নির্যাতিত ওই গৃহবধূ। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে ওইদিন রাতে অভিযোগটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে।

রোববার বিকেলে ওই গৃহবধূর স্বামী জানান, ওই লম্পটরা যখন আমার স্ত্রীকে  শিকলে বেঁধে তালা মেরে বিবস্ত্র অবস্থায় ঘরের মেঝেতে ফেলে যায়, তখন আশপাশের লোকজন এসে প্রথমে ঘর থেকে একটি কাপড় তাঁর শরীরে দেয়। এ সময় স্থানীয় লোকজন এসে অনেকে এ ঘটনার ভিডিও করে ফেলে। পরে এসব ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এমন ঘটনায় আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। মানুষের মধ্যে কি মনুষ্যত্ব নেই? ৯৯৯-এর মাধ্যমে ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ এসে আমার স্ত্রীর শিকলে দেয়া তালা খোলে। আমি তখন ঢাকায় আমার কর্মস্থলে ছিলাম। এ ঘটনায় আমার স্ত্রী মানসিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি লম্পটদের বিচার চাই।

এ মামলার দু’জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা একজনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান আসামির নাম ইমাম হোসেন (২৪)। তিনি একই গ্রামের বাসিন্দা। শুক্রবার রাতে তাকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার কুমিল্লার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলায় জাহিদুল্লাহ (২৫) নামের একজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 

নির্যাতিত গৃহবধূ জানিয়েছেন, ঘটনার সময় ইমাম হোসেনের মুখে জাহিদুল্লাহ নামটি শুনেছেন তিনি। মামলার অজ্ঞাতনামা ওই আসামি ঘটনার সময় মুখোশ পরা ছিলেন। তিনি গৃহবধূকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ।

ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে ভুক্তভোগী গৃহবধূ বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। জীবন্ত লাশের মতো বেঁচে আছি। আমার আর কোনো কিছু চাওয়ার নেই, শুধু ওই লম্পটদের কঠোর শাস্তি চাই। ঘটনার মূল হোতা ইমাম হোসেন গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে যেই লম্পট মুখোশ পরা অবস্থায় আমার সর্বনাশ করেছে, সে এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। আমি তার ফাঁসি চাই। ইমাম হোসেনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে আসবে। দ্রুত বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।

নির্যাতিত ওই গৃহবধূর আরও বলেন, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘরের দরজা ভেঙে প্রবেশ করে তিনজন। পাশবিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি ওই লম্পটরা লুট করে নিয়েছে ঘরে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ মালামাল। নির্যাতন ও লুট শেষে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা ঘরে জামাকাপড়ের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া আমার মাথার চুলও কেটে দেয়।

নাঙ্গলকোট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একে ফজলুল হক বলেন, মামলার প্রধান আসামি এখন কারাগারে আছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। শনিবার কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে  গৃহবধূর মেডিকেল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। মামলার অপর দুই আসামিকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন ঙ গলক ট গ হবধ র গ হবধ ক আম র স ঘটন র

এছাড়াও পড়ুন:

কঙ্গো প্রজাতন্ত্র: প্রাকৃতিক সম্পদই যখন অভিশাপ

গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (Democratic Republic of Congo), যা সংক্ষেপে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত। এটি মূলত মধ্য আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটি দেশ। সোনা, কোবাল্ট ও কোল্টানের মতো অত্যন্ত দামী এবং বিরল খনিজ সম্পদ থাকার পরেও এ দেশটি আজ বিস্ময়করভাবে পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ, যেখানে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহ যুদ্ধ চলছে। এই দেশের খনিজ সম্পদের আনুমানিক মূল্য ২৪ ট্রিলিয়ন থেকে ৩৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে, যা কঙ্গোকে বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছে। এত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কঙ্গো কীভাবে আজ এ পর্যায়ে পৌঁছালো, তা জানতে হলে নজর দিতে হবে এই দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, ভূ-রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, সর্বোপরি কারা কীভাবে এই দেশটির অস্থিরতার সুযোগে লাভবান হচ্ছে সেদিকে।

আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কঙ্গো মূলত: নয়টি প্রতিবেশী দ্বারা পরিবেষ্টিত; সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, সাউথ সুদান, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, তাঞ্জানিয়া, জাম্বিয়া, অ্যাঙ্গোলা এবং রিপাবলিক অফ কঙ্গো। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে রুয়ান্ডা, যে দেশটিকে অনেকেই কঙ্গোর এই বর্তমান দুর্দশার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন।

কেন রুয়ান্ডাকে দায়ী করা হয় সেই আলোচনায় একটু পরে আসছি। প্রাকৃতিকভাবে দারুণ সম্পদশালী হলেও কঙ্গোয় প্রতি চারজনের তিনজনেরই মৌলিক কিছু নাগরিক অধিকার যেমন বাসস্থান, সুপেয় খাবার পানি কিংবা পর্যাপ্ত খাবারের সুবিধা নেই। প্রতি ১২ জনের একজন শিশু ১২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে। এক কোটি ১০ লাখ মানুষের এই দেশ বিশ্বের দরিদ্রতম পাঁচটি দেশের একটি এবং এর প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। বিশ্ব ব্যাংকের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী কঙ্গোর মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৬২৭ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার।

অথচ স্বর্ণালঙ্কারে ব্যবহারযোগ্য সোনা, বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় কোবাল্ট, এমনকি মোবাইল ফোনের জন্য অতি দরকারি কোল্টান এর সবচাইতে বড় রিজার্ভ রয়েছে কঙ্গোতে। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে খনিজ হিসেবে যে কোবাল্ট থাকে তার প্রায় ৮০% রিজার্ভ আছে কঙ্গোতে। আর রয়েছে সৌর প্যানেলের অপরিহার্য উপাদান কপার। বৈদ্যুতিক গাড়ি, মোবাইল ফোন, সৌর প্যানেল, বর্তমান যুগে এই তিনটি আইটেমের চাহিদা তুঙ্গে। ফলে পরাক্রমশালী দেশগুলোর সবারই দৃষ্টি রয়েছে এই দেশটির দিকে। 

কঙ্গোর মানচিত্রের দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায় যে অধিকাংশ খনিগুলো হচ্ছে দেশটির পূর্বাঞ্চলে। যদিও এগুলোর যৎসামান্য মালিকানা কঙ্গো সরকারের, মূল মালিক হচ্ছে সুইজারল্যান্ড, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীনসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানি।

নব্বই দশকের গোড়া থেকেই চীনা কোম্পানি কঙ্গোতে আসা শুরু করে। মূলত মার্কিন কোম্পানি এসব খনি চীনা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। 

নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মার্কিন কোম্পানি তাদের সেই সময়ে নেওয়া এই সিদ্ধান্তের জন্য এখন আফসোস করছে। যাই হোক, বর্তমানে চীন কঙ্গোর শতকরা ৫০ ভাগ কোবাল্ট এবং শতকরা ৭০ ভাগ কপারের খনি নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০০৮ সালে চীন ও কঙ্গো সিকোমাইন চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করে। এই খনির বিনিময়ে চীন, কঙ্গোলিজদের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়েছে?
 
খনিজ সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে কঙ্গোর উপার্জিত অর্থের সিংহভাগই নষ্ট হয়েছে দুর্নীতিতে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির সূচকে কঙ্গোর অবস্থান বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম। এই পরিসংখ্যানটি কঙ্গোর সর্বব্যাপী দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে সরকারি দপ্তর থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি, দুর্নীতি যেন কঙ্গোর প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কাঠামোর প্রতিটি স্তরে শিকড় গেড়ে বসে আছে। মূলত কঙ্গোর দুর্নীতিবাজ নেতারাই দেশের এই সম্পদ থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। কঙ্গোকে শোষণ করার এই প্রবণতা শুরু হয়েছে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই, যখন বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড ১৮৮৫ সালে এই দেশটিকে তার ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে দখল করেন এবং একে কঙ্গো হিসেবে নামকরণ করেন। নিষ্ঠার এই রাজার সময়েই প্রায় এক কোটি কঙ্গোলিজকে হয় হত্যা করা হয়েছে, না হয় রোগে বা ক্ষুধায় মৃত্যুবরণ করেছে। অনেককে দাসত্ব মেনে নিতে হয়েছে অথবা বাধ্য হয়ে রাবার বাগানে গাড়ি বা সাইকেলের টায়ার বানানোর কাজ করতে হয়েছে।

১৯৬০ সালে প্যাট্রিস লুবাম্বার নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের পর কঙ্গোর জনগণ এক নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। লুবাম্বা বিশ্বাস করতেন, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের জনগণের কল্যাণেই ব্যবহার হওয়া উচিত। কিন্তু এই স্বপ্ন দ্রুতই দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়, যখন পশ্চিমাদের পরোক্ষ মদদে তাকে বন্দী করে হত্যা করা হয়।

ধারণা করা হয়, লুবাম্বা তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, যা পশ্চিমাদের জন্য ছিল এক বড় শঙ্কার বিষয়। কঙ্গোর জনগণের পক্ষে এই ক্ষত থেকে আর সেরে ওঠা হয়নি। এরপর থেকে একের পর এক শাসকের আমলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অব্যবস্থাপনা দেশটিকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

এসব শাসকের মধ্যে মবুতু অন্যতম, যিনি ১৯৬৫ সালে এক সামরিক অভ্যুথানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। সীমাহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই শাসক দীর্ঘ ৩২ বছরের জন্য দেশটির ওপর জেঁকে বসেছিলেন। এমনকি তিনি দেশের নাম পরিবর্তন করে জায়ারে রেখে দেন। ব্যাপক দুর্নীতি, আত্মসাৎ, স্বৈরশাসন, রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, সামরিক বাহিনীর প্রতি উদাসীনতার মতো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে থাকলেও পশ্চিমারা তার এই কর্মকাণ্ড দেখেও না দেখার ভান করতো- পিছে মবুতু যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে হেলে যান। 

দুর্নীতি ও লুটপাটের যে শাসনব্যবস্থা মবুতুর আমলে সূক্ষ্মভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল, সেটিই পরবর্তীতে কঙ্গোর সরকার পরিচালনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। ১৯৯৭ সালে মবুতুর শাসনের অবসান হলেও তার উত্তরসূরি লরেন্ট কাবিলা এবং লরেন্টের ছেলে জোসেফ কাবিলার সময়েও দৃশ্যপটের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বরং বাকিসব স্বৈরাচারদের মতো জোসেফের সময়কার দুটি নির্বাচনই ছিল দারুণ বিতর্কিত।

সুতরাং শোষণ ও দুর্নীতি কীভাবে কঙ্গোর সাধারণ মানুষদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে বাধাগ্রস্ত করছে তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। কিন্তু শোষণ-দুর্নীতি ছাড়াও কঙ্গোলিজদেরl জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে বছরের পর বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কঙ্গোর গৃহযুদ্ধটি চলছে দেশের পূর্বাঞ্চলে, যেখানে অবস্থিত দেশের প্রধান খনিজ সম্পদের বৃহত্তম অংশ। বিভিন্ন গেরিলা গোষ্ঠী এখানে খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণের জন্য যুদ্ধরত আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রুয়ান্ডা ইস্যু। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডাতে এক ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা হয়, যেখানে সংখ্যাগুরু হুতুরা প্রায় ৮ লাখ সংখ্যালঘু টুটসি ও মধ্যপন্থী হুতুদের হত্যা করে। দাঙ্গা পরবর্তীতে অনেক রুয়ান্ডান সীমান্ত অতিক্রম করে কঙ্গোতে আশ্রয় নেয়, যার মধ্যে কিছু হুতু অপরাধীও ছিল। ৩০ বছর আগের সেই গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব আজও অব্যাহত আছে । যার প্রমাণ, কঙ্গোর প্রধান দুই গেরিলা গোষ্ঠীগুলোর একটি হলো এফডিএলআর, যার পিছনে কাজ করছে হুতু চরমপন্থী।

অন্যদিকে আছে এম-২৩, যার চালিকা শক্তি হিসেবে আছে জাতিগত টুটসি। কঙ্গোর সরকার অভিযোগ করে যে রুয়ান্ডা এম-২৩ কে সমর্থন দিচ্ছে, অপরদিকে রুয়ান্ডা অভিযোগ করে যে এফডিএলআরকে পরিচালনা করছে কঙ্গোর সরকার। এছাড়াও আছে আরেক জঙ্গি গোষ্ঠী এডিএফ, যার উত্থান উগান্ডায় এবং এইচসি গোষ্ঠী। সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের সম্পর্ক আছে বলে অভিযোগ করা হয়। সব কিছু মিলে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের অবস্থা একেবারেই লেজেগোবরে।

২০২৫ সালের শুরুতে এম-২৩ বিদ্রোহীরা রুয়ান্ডার সমর্থন নিয়ে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে অভিযান চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে এবং প্রায় সাত লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব ২৭৭৩ গ্রহণ করে এম-২৩ বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে এবং রুয়ান্ডাকে এই বিদ্রোহীদের প্রতি সহায়তা বন্ধ করতে ও কঙ্গো থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সংঘাত এখনো অব্যাহত আছে এবং ‘ব্ল্যাক ওয়াটারের’ মতো ভাড়াটে সৈনিকদের ব্যবহারের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে।

চলমান এই সংঘাতের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি থেকে নানা উপায়ে অবৈধভাবে সম্পদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। মনে করা হয় যে, রুয়ান্ডা বিশ্ববাজারে যে সোনা রপ্তানি করে তার সিংহভাগই কঙ্গো থেকে পাচার হওয়া। কঙ্গো পৃথিবীর সবচাইতে বড়­ কোল্টান উৎপাদনকারী দেশ হলেও রুয়ান্ডা সবচাইতে বৃহৎ কোল্টান রপ্তানিকারক দেশ। ডটগুলো মিলালেই বোঝা যাবে কোন কোন দেশ কঙ্গোর চলমান এই সংঘাতে লাভবান হচ্ছে।

রুয়ান্ডার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৪ সালে দেশটির সঙ্গে একটি বিতর্কিত খনিজ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী পশ্চিমারা যে নিজের স্বার্থে অন্যের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে জলাঞ্জলি দিতে পারে তা আরেকবার প্রমাণিত হয় এই চুক্তির মাধ্যমে। তবে শুধু ইউরোপ নয়, কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ উগান্ডা, বুরুন্ডি, তাঞ্জানিয়া, এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার হয় বলে জাতিসংঘের তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ফলে পরবর্তীতে এসব খনিজ আন্তর্জাতিক বাজারে সহজলভ্য।

সুতরাং কঙ্গোর এই বর্তমান হতশ্রী চেহারার গল্পের পিছনে রয়েছে তাকে শোষণের ইতিহাস। রয়েছে স্বাধীনতা পাওয়ার পর বছরের পর বছর ধরে চলা স্বৈরশাসন আর গণতন্ত্রের অভাব। শীতল যুদ্ধের সময়কার পশ্চিমা ব্লক আর কমিউনিস্ট ব্লকের ‘যে কোন মূল্যে কাছে রাখার’ প্রতিযোগিতা স্বৈরশাসনকে আরও প্রলম্বিত করেছে। আর ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতি যেন কঙ্গোর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থেকে তাকে পিছনে টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

লাইবেরিয়া এবং আইভরিকোস্টের মতো দেশে অনেকটা একই সমস্যা ছিল। কিন্তু এসব দেশ এখন অনেকটাই শান্ত। অর্থনৈতিকভাবে হয়তো তারা এখনো স্বাবলম্বী হতে পারেনি। কিন্তু গৃহযুদ্ধের সময় যেভাবে মানুষ রাস্তাঘাটে মারা পড়তো, সেই ভয়াবহতা এখন নেই বললেই চলে। লাইবেরিয়া ও আইভরিকোস্ট এ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটা বড় ভূমিকা ছিল।

বিবদমান দলগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে, বেসামরিক জনগণকে রক্ষা করে, সর্বোপরি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে এই দেশগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘ কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কিন্তু কঙ্গোতেও চলছে গত ২৬ বছর ধরে। কিন্তু কেন এখানে এখনো শান্তি ফিরে এলো না? জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কি তাহলে ব্যর্থ হচ্ছে নাকি অন্য কোনো অন্তর্নিহিত কারণ আছে? 

সোনা, কোবাল্ট আর কোল্টান পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই পাওয়া যায়। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে যান ও মোবাইল ফোন উৎপাদনের অপরিহার্য কাঁচামাল— কোবাল্ট ও কোল্টানের খনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশ্ব শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এই খনিজসম্পদ দখলের লক্ষ্যে তারা যেকোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। এখানে ন্যায়-অন্যায়বোধ কিংবা কঙ্গোর সাধারণ মানুষের অন্তহীন দুর্ভোগ কোনো কিছুই বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিতে পারেনি। অর্থনৈতিক স্বার্থই যে এখানে মুখ্য, তার প্রমাণ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২০২৪ এর রুয়ান্ডার সঙ্গে চুক্তি।

রুয়ান্ডার গোষ্ঠীগত বিভেদ যেন এই সঙ্কটে ঘি ঢেলেছে। এখানে রুয়ান্ডার বক্তব্য যাই হোক না কেন, কঙ্গোর অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে যে তারা লাভবান হচ্ছে তা একেবারেই অনস্বীকার্য। ফলে, প্রভাবশালী দেশ থেকে শুরু করে প্রতিবেশী দেশ, এই সঙ্কট জিইয়ে রেখে তাদের চাওয়াটা পূরণ করতে চায়। লাইবেরিয়া এবং আইভরি কোস্টও প্রাকৃতিক সম্পদশালী দেশ। কিন্তু তার সম্পদ কঙ্গোর মতো এতো বহুমুখী আর দুর্লভ নয়। হয়তো এই কারণেই লাইবেরিয়া- আইভরিকোস্ট পেরেছে সঙ্কট কাটিয়ে একটা পর্যায়ে আসতে। যেটা কঙ্গোর জন্য এখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি। প্রাকৃতিক সম্পদই যেন কাল হলো কঙ্গোর জন্য। তাহলে কি কঙ্গোর এই অমানিশা কাটিয়ে উঠার কোনো আশা নেই। আছে, তবে তার জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

প্রথমত, কঙ্গোর জন্য প্রয়োজন একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার, যার প্রতি দেশটির সিংহভাগ জনগণের শ্রদ্ধা থাকবে। শাসনকাজে যারা থাকবেন তারা ব্যক্তিস্বার্থে কাজ না করে, জনগণের জন্য কাজ করবেন। দেশের সম্পদকে বিদেশিদের হাতে তুলে না দিয়ে দেশের কল্যাণার্থে ব্যয় করবেন।

কঙ্গো থেকে বাংলাদেশের কি কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে? বাংলাদেশে হয়তো কঙ্গোর মতো প্রাকৃতিক সম্পদ এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অন্যতম কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছে। ফলে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তি বাংলাদেশকে সব সময়েই গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করেছে। অতএব, দেশের রাজনৈতিক শক্তি, রাষ্ট্রীয় সংস্থা, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, গুরুত্বপূর্ণ মহল তথা আপামর জনগণ জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ না থাকলে বাংলাদেশে বিপদ অনিবার্য।

লেখক: কর্নেল মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম

সম্পর্কিত নিবন্ধ