অনিয়ম আর গাফিলতির ক্ষতি ২২২ কোটি টাকা
Published: 13th, December 2025 GMT
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নগরের আগ্রাবাদে তিন তারকা হোটেল সেন্ট মার্টিন লিমিটেডের গৃহকর নির্ধারণ করেছিল ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। দুই দফায় ৩ কোটি ১২ লাখ টাকা কমিয়ে সেই গৃহকর নির্ধারণ করা হয় ১৮ লাখ টাকা। কোনো ধরনের শুনানি না করে এবং আপিল রিভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান মেয়রের সই ছাড়াই এভাবে কর কমিয়ে দেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে গৃহকর নির্ধারণে এই অনিয়ম চিহ্নিত করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা দল। গত সেপ্টেম্বরে এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা কমানো অস্বাভাবিক। গত সপ্তাহে এই প্রতিবেদন প্রথম আলোর হাতে আসে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগে এ ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১১টি খাতে। ঘষামাজা করে গৃহকর কমানো এবং সাইনবোর্ডের আকার কম দেখিয়ে কর নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে এসব অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া বকেয়া গৃহকর ও ট্রেড লাইসেন্স ফি আদায়েও রাজস্ব বিভাগের গাফিলতি ছিল। এসব অনিয়ম ও গাফিলতির কারণে সিটি করপোরেশনের ২২২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব অনিয়মের সঙ্গে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা জড়িত। এসব অনিয়মের ঘটনা ঘটে ২০২২–২৩ ও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে।
এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন জানিয়েছেন, হোটেল সেন্ট মার্টিন লিমিটেডের কর নির্ধারণের অনিয়মসহ রাজস্ব বিভাগের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শুনানি ও মেয়রের সই ছাড়া কর কমানো
সিটি করপোরেশনের বিধি অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের নির্ধারণ করা কর মূল্যায়ন নিয়ে আপত্তি থাকলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আবেদন করতে পারেন। আবেদনের ভিত্তিতে আপিল রিভিউ বোর্ড শুনানির মাধ্যমে চূড়ান্ত গৃহকর নির্ধারণ করে। এতে অবশ্যই আপিল রিভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান, তথা সিটি করপোরেশনের মেয়রের সই থাকতে হবে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অনিয়ম করা ৩৭টি হোল্ডিংয়ের (স্থাপনা) জন্য বার্ষিক কর মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। রিভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান মেয়রের সই ছাড়াই ১৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা কমিয়ে কর মূল্যায়ন চূড়ান্ত করা হয় ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অস্বাভাবিক কর কমানোর কারণে সিটি করপোরেশনের ক্ষতি হয় ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা (১৭ শতাংশ হারে)।
এদিকে চিটাগং কনটেইনার ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। কিন্তু আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান বা মেয়রের স্বাক্ষর ছাড়া গৃহকর চূড়ান্ত করা হয় ১৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা; অর্থাৎ ১০ গুণ গৃহকর কমানোতে সিটি করপোরেশনের ক্ষতি হয় ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এ ছাড়া একইভাবে মেয়রের স্বাক্ষর ছাড়াই ৪০টি হোল্ডিংয়ের গৃহকর কমানো হয় ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
নগরের তিন তারকা মানের হোটেল আগ্রাবাদ লিমিটেডের বার্ষিক কর মূল্যায়ন নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ কোটি টাকা। কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে কর কর্মকর্তা নিজ হাতে আপিল ফরমে বিধিবহির্ভূতভাবে বার্ষিক মূল্যায়ন নির্ধারণ করেন ৮৫ লাখ টাকা; অর্থাৎ একসঙ্গে কমানো হয় ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী কর আদায় হলে সিটি করপোরেশন পেত ১ কোটি ২১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের কর কর্মকর্তারা করদাতাকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে কর কমিয়েছেন।
সিটি করপোরেশনে অনিয়ন, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। মেয়রের পরিবর্তন হলেও এগুলোর কোনো পরিবর্তন হচ্ছে নাআখতার কবির চৌধুরী, সম্পাদক, সুজন, চট্টগ্রামএদিকে নিয়মনীতি না মেনে আগ্রাবাদ লিমিটেড ও হোটেল সেন্ট মার্টিন লিমিটেডের গৃহকর কমানোর ঘটনা তদন্তের জন্য আইন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত জেলা জজ) মহিউদ্দিন মুরাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সিটি করপোরেশন। এ ব্যাপারে জানতে হোটেল আগ্রাবাদ ও হোটেল সেন্ট মার্টিন লিমিটেডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গৃহকর, ফি আদায়ে গাফিলতি
সিটি করপোরেশন সিটি করপোরেশনের ২০২২–২৩ ও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে গৃহকর খাতে বকেয়া ছিল ১৭৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ট্রেড লাইসেন্স ফি খাতে বকেয়া ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা। এ ছাড়া দোকান ভাড়ার ৬ কোটি টাকা এবং রিকশা লাইসেন্স ফির ৯০ লাখ টাকা বকেয়া আছে। এই বকেয়া আদায়ে সিটি করপোরেশনের যথাযথ তৎপরতা ছিল না বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সিটি করপোরেশন দুই অর্থবছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সাইনবোর্ড ফি হিসেবে ১ কোটি ৩১ লাখ ৭১ হাজার টাকা আদায় করে। কিন্তু আদায় হওয়া অর্থের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বাবদ ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি।
এদিকে সিটি করপোরেশন রিকশা লাইসেন্স ফি, মেডিকেল বর্জ্য ইজারা, সৌন্দর্যবর্ধন ফি খাত থেকে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা আদায় করে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এই আদায়ের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে ৫৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা করেনি।
এসবের বাইরে সাইনবোর্ডের আয়তন কম দেখিয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা এই অনিয়ম করেছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়মে পরিণত হয়েছে। মেয়রের পরিবর্তন হলেও এগুলোর কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। প্রভাবশালীদের গৃহকর কোনো ধরনের নিয়মনীতি ছাড়া কমিয়ে দিলেও সাধারণ জনগণ কিন্তু হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র কর মকর ত র আগ র ব দ গ হকর ক র গ হকর ব যবস থ র ঘটন তদন ত ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
মিয়ানমারের মর্টারশেল ও গুলির শব্দে কাঁপছে টেকনাফ সীমান্ত
কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের ভেতরে চলমান সংঘর্ষের জেরে মর্টারশেল বিস্ফোরণ ও টানা গোলাগুলির শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) ভোর থেকে কয়েক ঘণ্টা ধরে বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো কেঁপে ওঠে।
স্থানীয়দের বরাতে জানা গেছে, ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপার থেকে একটানা মর্টারশেল নিক্ষেপ ও ভারী অস্ত্রের গোলাগুলি চলতে থাকে। এসময় বাংলাদেশের ভেতরে কয়েকটি বসতঘরের টিনের চালা ভেদ করে গুলি এসে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল মোস্তফা জানান, নাফ নদীতে একটি মর্টারশেল পড়লে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠতে দেখা যায়।
তিনি বলেন, ‘‘আজ শনিবার ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত প্রায় চার ঘণ্টা ধরে পুরো সীমান্ত এলাকায় মর্টারশেল বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির বিকট শব্দে সীমান্তবর্তী বাড়িঘর কেঁপে ওঠে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।’’
স্থানীয়রা জানান, হোয়াইক্যং বাজার এলাকার মোহাম্মদ হোসেন, আব্দুল কুদ্দুস এবং বালুখালী গ্রামের সরওয়ার আলমের বাড়িতে কয়েকটি গুলি এসে পড়েছে।
হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (এসআই) খোকন কান্তি রুদ্র বলেন, ‘‘মিয়ানমার সীমান্তের দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। কয়েকটি বসতঘরে গুলি পড়ার তথ্য পেয়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’’
ঢাকা/তারেকুর/এস