মধ্য জুলাইয়ে ‘জুলাই সনদ’ হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মৌলিক সংস্কারে জনমত জরিপ করা হবে। প্রথম ধাপের সংলাপে যেসব মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয়ধাপের সংলাপ ৪ জুন ঈদের ছুটির আগেই শুরু হবে। 

সোমবার জাতীয় সংসদে সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব কথা বলেছেন। তিনি জানান, পাঁচ সংস্কার কমিশনের ১৬৬ সুপারিশের বিষয়ে মতামত নিতে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি বৈঠক করেছে কমিশন। গড়ে সাড়ে চার ঘণ্টা করে বৈঠক হয়েছে। 

প্রথম ধাপের সংলাপে অধিকাংশ দল আনুপাতিক পদ্ধতি উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ দুইবারে সীমাবদ্ধ করার সুপারিশে একমত হয়েছে। তবে বিএনপিসহ কয়েক দল এ সুপারিশে রাজি নয়। 

কমিশন এই সুপারিশগুলোকেই মৌলিক সংস্কার বলছে। ৩৩ দলের একটি দুটি বাদে বাকিরা রাজি হলেও কী ঐকমত্য হয়েছে বলে গণ্য করা হবে না- এ প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেছেন, শুধু সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মতামত দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো কতটা জনপ্রতিনিধিত্ব করে তাও বিবেচনা করতে হবে। 

ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছিলেন, সেসব সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেগুলো নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ হবে। তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো সনদে রাজনৈতিক দলগুলো সই করবে। 

সনদ বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতার জন্য তা সংবিধানের তপশিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিনা- প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেছেন, সনদের বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। কিন্তু তা কীভাবে করা হবে, রাজনৈতিক দলগুলোই ঠিক করবে। 
যেসব সংস্কারকে মৌলিক বলা হচ্ছে সেগুলোতে জনগণের মতামত নিতে জরিপ চালাতে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, আগে সংবিধান এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে যেভাবে জরিপ করা হয়েছিল, একই পদ্ধতিতে আবার জরিপ করা হবে। 

গত ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১১ আগস্ট। সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নে কমিশন গণভোট, গণপরিষদ, পরবর্তী সংসদসহ ছয়টি বিকল্প দিয়েছে। এনসিপি চায় গণপরিষদ। জামায়াত চায় গণভোট। বিএনপির অবস্থান, আগামী সংসদে সাংবিধানিক সংস্কার হবে। কীভাবে সংস্কার হবে প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেছেন, সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের। রাজনৈতিক দলগুলো নির্ধারণ করবে প্রক্রিয়াটা কী হবে।

আলী রীয়াজ বলেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এর মধ্যে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতবার নির্বাচিত হতে পারবেন, একজন সংসদ সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া কী হবে- এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গেছে।

সংবিধান সংস্কারে যেসব বিষয়ে একমত হওয়া গেছে তা তুলে ধরতে গিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ না রাখার ব্যাপারে অধিকাংশ দল মতামত দিয়েছে। আলী রীয়াজ বলেন, ‘দলগুলো বলছে বহুত্ববাদ রাখলে শব্দগত কারণে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। সংবিধানের মূলনীতিতে ১৮ বছর ধরনিপেক্ষতা ছিল। তাতে কী পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল?’

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণেও একধরনের  ঐকমত্য। তবে এর পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনে ঐকমত্য রয়েছে। কমিশন সুপারিশ করেছে, প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন বন্টন হবে। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন থাকলেও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির ঐকমত্য হলেও কীভাবে তা হবে, সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।

৭০ অনুচ্ছেদের বড় বদল না আনতে দলগুলোর ঐকমত্য রয়েছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে সব দল নীতিগতভাবে একমত। বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শনকে অসদাচরণ হিসেব বিবেচনা করে শাস্তি দেওয়ার সুপারিশে সব দল একমত। দল নিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বিধানের ব্যাপারেও অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে মেয়াদ শেষেও শাস্তি দিতে বেশিরভাগ দল নীতিগতভাবে একম। 

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য করার সুপারিশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দলগুলো। জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যা ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত এবং ভোট জালিয়াতি ও দুর্নীতির সঙ্গে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনে অধিকাংশ দল একমত। 

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, এমদাদুল হক, আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আল র য় জ র য় জ বল ছ ন র য় জ বল ন মত মত

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা আলোচনা জুনে

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জুনের প্রথম সপ্তাহে বা ঈদের আগে সংস্কার কাজ নিয়ে দ্বিতীয় দফায় আলোচনা শুরু করবে ঐকমত্য কমিশন।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এই আলোচনার উদ্বোধন করবেন। গত ১৯ মে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম দফায় আলোচনা শেষ হয়।

সোমবার (২৬ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐকমত্য কমিশনের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় ঐকমত্য কমিশনের অন্যান্য সদস্যরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন।

আরো পড়ুন:

প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: প্রধান উপদেষ্টা

নির্বাচন ৩০ জুনের ওই পারে যাবে না, সবাই সন্তুষ্ট: প্রেস সচিব

এ সময় সংস্কার প্রক্রিয়া ও নির্বাচন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নাগরিক সমাজ ও তৃণমূলের সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা বাড়িয়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জনগণকে নির্বাচনমুখী করতে হবে। কেউ যেন ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিতে না পারে সেই বিষয়ে নাগরিকদের সচেতন করতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ ভোটের আয়োজন করতে হবে।”

“এত বড় অভ্যুত্থানের পর যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম এটা যেন তেমন বাংলাদেশই রয়ে না যায়,” বলেন তিনি।

আজকের সভায় অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে অনিয়মের সাথে যারা জড়িত তাদের ভূমিকা তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়।

কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, এ বিষয়ে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যেই ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।

কমিশন সদস্য আইয়ুব ভূঁইয়া অবিলম্বে জনপ্রশাসন সংস্কার বাস্তবায়ন কমিশন গঠনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “১৯৮২ সালে এনাম কমিশন বিভিন্ন সরকারি সংস্থার যে অরগানোগ্রাম তৈরি করেছিল সেটাই তাদের এখনো রয়ে গেছে।ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে এবং নতুন অনেক সংস্থা গঠন করা হয়েছে। এ কমিশন গঠন করা হলে এই অরগানোগ্রামগুলো পুনঃগঠন করা যাবে।”

তিনি বলেন, “এনবিআর সংস্কারে জনপ্রশাসন কমিশনের সুপারিশ ছাড়া আরো দুটি কমিশন কাজ করেছে যার ফলে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়েছে।”

বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রতিনিধি এমদাদুল হক রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে তা যেন স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে আহ্বান জানান।

দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন প্রতিনিধি ইফতেখারুজ্জামান প্রাথমিকভাবে গঠিত ছয়টি কমিশনের বাইরে গণমাধ্যম, শ্রম, স্থানীয় সরকার, নারী ও স্বাস্থ্য বিষয়ক যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে সেগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নে একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন।

নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার ২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য প্রণীত খসড়া প্রস্তাবটি অধ্যাদেশ আকারে প্রকাশ করার আহ্বান জানান।

আজকের সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিনিধি সফর রাজ হোসেন।

ঢাকা/হাসান/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংসদীয় গণতন্ত্রই চায় ইসলামপন্থি ছয় দল
  • চার মূলনীতি বহাল রাখার পক্ষে বাম দলগুলো
  • সাম্প্রতিক ঘটনাবলি জাতীয় ঐকমত্য গঠনে আমাদের কী ইঙ্গিত দেয়
  • রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা আলোচনা শুরু জুনের প্রথম সপ্তাহে
  • মৌলিক সংস্কার নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে দলগুলো
  • মিত্র দলগুলো বিএনপির বিপরীতে
  • সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার আলোচনা শুরু জুনের প্রথম সপ্তাহে
  • রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা আলোচনা জুনে
  • বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নে এখনো ঐকমত্য হয়নি: আলী রীয়াজ