অমর রাতটিকে ভোর না হতে দেওয়ার তীব্র চেষ্টা ছিল প্যারিসের চ্যাম্পস ইলিসেস অ্যাভিনিউতে। আর্ক দ্য ট্রায়াম্পে সমর্থকদের প্যারেড শোভাযাত্রার উল্লাসও বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল শৃঙ্খলা আর নিয়মকানুনের। প্রিয় দলের কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রাখতে দে লা বাস্তিলেও চলছে বুনো উৎসব। ফরাসি চ্যানেলের এসব খবর দেখে মনে হচ্ছিল ফুটবলের কাছে এমন একটি রাতই তো চেয়েছিল প্যারিস অনেক বছর ধরে। পাবলো পিকাসো, ভ্যান গঘদের প্যারিসকে বিশ্ব চিনেছে চিত্রশিল্প দিয়ে। ভিক্টোর হুগোর কবিতা দিয়েও শোন নদী পারের শহরটি হৃদয় জয় করেছে। জিদান, এমবাপ্পেদের বিশ্বকাপ দিয়েও জয় করেছে ফুটবলকে। তবে যে শুধু ছবি বা কবিতা নয়, ফুটবলও নয়। এই প্যারিস আরও কিছু বলতে চেয়েছিল ইউরোপকে।
যারা তাদের ক্লাব ফুটবলের আসরকে চাষাভুষার লিগ (ফার্মার্স লিগ) বলে আড়ালে নাক সিটকাত, যারা কিনা ফুটবলের ক্লাব ঐতিহ্য নেই বলে সুযোগ পেলেই খাটো করার চেষ্টা করত; সেই ইউরোপিয়ান প্রতিবেশীদের ফরাসি ক্লাবের সৌরভে মাত করে দিয়েছে পিএসজি (প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন)। মিউনিখে ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে মতো দুমড়েমুচড়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিজেদের প্রথম শিরোপা জিতে নিয়েছে পিএসজি। দেখিয়ে দিয়েছে মেসি-নেইমার-এমবাপ্পেদের মতো নক্ষত্র ভিড়িয়েও যে আলো তারা আইফেলের মাথায় জ্বালাতে পারেনি, সেখানে দেজিরে দোয়ে, সেনি মায়ুলুর মতো ‘লিটল স্টার’ দিয়েই পিএসজি বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে। হাকিমি, দেম্বেলে, দেন্নারোমার মতো ঝিকিমিকি তারাদের নিয়েই ‘সিটি অব লাইট’ এখন ইউরোপিয়ান ফুটবলের সবচেয়ে সুখী শহর।
ভালোবাসার সেই শহরের দুই বিদেশিও বোধহয় এ মুহূর্তে সবচেয়ে গর্বিত দুই অতিথি। তাদের একজন স্পেনের লুই এনরিকে, অন্যজন কাতারের ধনকুবের নাসের আল খেলাইফি। প্যারিসের ক্লাবে ফুটবলের রঙ ছড়াতে চৌদ্দ বছর আগে তিনি এসেছিলেন পেট্রো ডলারের অঢেল ভান্ডার নিয়ে। কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্টের হয়ে ২০১১ সালে পিএসজির সভাপতি ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেন। ইব্রাহোমোভিচ থেকে শুরু করে কাভানির মতো তারকাদের ভিড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মুকুট চেয়েছিলেন। নেইমারকে রেকর্ড অর্থে, মেসিকে সম্মান দেখিয়েও এনেছিলেন একটি ট্রফি পাওয়ার জন্য। এমবাপ্পের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন প্রায় সাত মৌসুমে। কিন্তু কয়েকবার সেমিফাইনাল এবং একবার ফাইনালে উঠেও কপাল খোলেনি তাদের।
আশাভঙ্গ হয়ে এক সময় এমবাপ্পেও ‘আমি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারে, এমন দলে যেতে চাই’ বলে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান। প্রকৃতির বিচার কিনা কে জানে, এমবাপ্পের ছেড়ে আসা সেই দলটিই এখন ইউরোপ সেরা। এক্স হ্যান্ডলে প্রাক্তনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এমবাপ্পে-নেইমার। কিন্তু কী কারণে যেন শুধু মেসিই নিশ্চুপ। আসলে পিএসজির এই অর্জনে ইতিহাসকে মনে রাখতে হবে এই নাসের আল খেলাইফিকে।
সেইন্ট জার্মেইন কখনও ভুলতে পারবে না কোচ এনরিককেও। তিনিই প্রথম তারকানির্ভর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের মিথ ভেঙে পিএসজির লকার রুমে তারুণ্যনির্ভর একটি দল গড়ে তোলেন। এদিন ফাইনালে যে দলটি খেলেছে, এর গড় বয়স ২৪ বছর ৭ মাস। সেখানে ইন্টারের গড় বয়স ৩০ বছর ৪ মাস। ইন্টারের আট ফুটবলারের এর আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। সেখানে এক মারকুইনহোস ছাড়া পিএসজির কেউ আগে এমন মঞ্চে পা রাখেননি। তাই ম্যাচ শুরুর আগে ধারাভাষ্যকার মজা করেই বলছিলেন ‘ম্যান ভার্সেস বয়েজ’-এর লড়াই হতে যাচ্ছে।
এনরিকে এই টগবগে তারুণ্য দিয়েই জয় করতে চেয়েছিলেন ফাইনালের মঞ্চ। বার্সার ইয়ামালের মতোই বছর উনিশের ফরাসি ফরোয়ার্ড দুয়েকে দিয়ে বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন। দুটি গোল করার পাশাপাশি একটিতে অ্যাসিস্ট করে দুয়েই প্যারিসের আকাশে ‘ডায়মন্ড’ হয়ে ওঠেন। এমনিতে পজেশন ফুটবল কৌশলে বিশ্বাসী এনরিকে। একেকটি গোলে তাই ২০ থেকে ২৬টি পাসিং করতে দেখা যায় পিএসজিকে। এদিনও ম্যাচের ৫৯.
হাকিমির ট্যাপ ইনে প্রথম যে গোলটি পায় পিএসজি, সেখানে টাচ ছিল দুয়ের। পরের গোলটি দুয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ উপস্থিতির সুযোগ লাগিয়ে পেয়ে যান। এবং তাঁর দ্বিতীয় গোলটি আসে অসাধারণ চিপ শটে। কুড়ি মিনিটের মধ্যে দুটি গোল খাওয়ার পর ইন্টারের থুরাম-লাওতারো আক্রমণ জুটি অসহায় হয়ে পড়ে। গ্যালারিতে প্যারিসের দর্শকরা কোরাস গাইতে শুরু করেন। কী নিয়ে তারা গান বেঁধেছিলেন জানা যায়নি, তবে সেটা ফরাসি মেলোডিতে জন টেলরের ছড়াটা একটু ঘুরিয়ে ‘টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল প্যারিস স্টার...’ হলে নিশ্চিত মানিয়ে যেত!
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প এসজ ইন ট র র ফ টবল র এমব প প প এসজ র ফ ইন ল এনর ক ইউর প
এছাড়াও পড়ুন:
ঘোড়াধাপ হাটে ধান বেচা
২ / ৯হাটে মধ্যে ধানের বিশাল স্তূপ