‘নাটক মানে স্বার্থ ত্যাগ’—শেখানো মানুষটা আর নেই
Published: 23rd, July 2025 GMT
সমসাময়িক ভারতীয় মঞ্চনাটকের অন্যতম পথিকৃৎ, ‘থিয়েটার অব রুটস’ আন্দোলনের অগ্রদূত রতন থিয়াম আর নেই। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে মণিপুরের ইম্ফলের আঞ্চলিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। দ্য হিন্দু, আসাম ট্রিবিউনসহ একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।
রতন থিয়াম ছিলেন এমন এক শিল্পী, যিনি মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী শিল্পরূপ ও পারফরম্যান্স ধারাগুলোকে আধুনিক নাট্যভাষার সঙ্গে মিশিয়ে নির্মাণ করেছিলেন এক অনন্য নাট্যশৈলী। তাঁর থিয়েটারে স্থান পায় লোকসংস্কৃতি, আধ্যাত্মবাদ, দার্শনিক গভীরতা এবং প্রথাভাঙা দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ছিলেন। পাশাপাশি ছিলেন ভারতের জাতীয় নাট্যবিদ্যালয় (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা, এনএসডি)-এর চেয়ারম্যান।
‘সভ্যতা, সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি? কোট-প্যান্ট পরা, মুঠোফোন হাতে ঘোরা? একেবারেই নয়। এসব তো আর্টিফিশিয়াল জিনিস, নকল। সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে এসবের সম্পর্ক নেই। বরং এসবের মধ্যে থেকে আমরা সত্যিকারের সভ্যতা থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। শিকড়ে ফেরার জন্যই আদিবাসী সংস্কৃতিকে জানা দরকার।’
রতন থিয়াম ছিলেন এমন এক শিল্পী, যিনি মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী শিল্পরূপ ও পারফরম্যান্স ধারাগুলোকে আধুনিক নাট্যভাষার সঙ্গে মিশিয়ে নির্মাণ করেছিলেন এক অনন্য নাট্যশৈলী। তাঁর থিয়েটারে স্থান পায় লোকসংস্কৃতি, আধ্যাত্মবাদ, দার্শনিক গভীরতা এবং প্রথাভাঙা দৃষ্টিভঙ্গি।জীবনকালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন রতন থিয়াম। ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত শুভাশিস সিনহার নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘নাটক করতে গেলে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। স্যাক্রিফাইস.
এই বিশ্বাস থেকেই ১৯৭৬ সালে তিনি গড়ে তোলেন ‘কোরাস রেপার্টরি থিয়েটার’। এই দলের মঞ্চে উঠে এসেছে মণিপুরের নিজস্ব সংগীত, নৃত্য, মার্শাল আর্ট, লোককাহিনি ও পৌরাণিক বয়ান। তাঁর কাজকে বলা হয় ‘সাইকো-ফিজিক্যাল থিয়েটার’, যেখানে শরীর ও চেতনার গভীর সংযোগ ঘটে। তাঁর নাটকে বারবার উঠে এসেছে যুদ্ধ, যন্ত্রণা, বিচ্ছিন্নতা।তাঁর ব্যাখ্যায়, ‘ম্যাকবেথ’ ছিল একধরনের মানসিক ব্যাধির নাট্যরূপ, যেখানে আছে ক্ষমতার মোহ, পাপবোধ ও আত্মধ্বংসের ঘূর্ণি।
রতন থিয়ামের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘চক্রব্যুহ’, ‘ঋতুসংহার’, ‘উত্তর প্রিয়দর্শী’, ‘আশিবাগি ইশেই’, ‘ইম্ফল ইম্ফল’, ‘কারানাভারাম’ (মহাভারতের কর্ণকে নিয়ে), ‘দ্য কিং অব ডার্ক চেম্বার’(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা’ অবলম্বনে) এবং বহুল আলোচিত ‘ম্যাকবেথ’। তাঁর ব্যাখ্যায়, ‘ম্যাকবেথ’ ছিল একধরনের মানসিক ব্যাধির নাট্যরূপ, যেখানে আছে ক্ষমতার মোহ, পাপবোধ ও আত্মধ্বংসের ঘূর্ণি।
নাটক করতে গেলে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। স্যাক্রিফাইস...প্রথমেই জানতে হবে যে মঞ্চনাটকে কোনো স্টার ইমেজ নেই। যে যতই ভালো পারফরম্যান্স করুক না কেন, কোনো স্টার ইমেজ নেই, পপুলারিটি নেই, টাকাপয়সা আসবে না। অর্থাৎ এখানে কোনো ইন্ডাস্ট্রি নেই। নাটক হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যেখানে সৌন্দর্যবোধ বা নান্দনিকতার খোঁজে অনেক কলা বা ক্র্যাফটকে জড়ো করা হয়। রতন থিয়ামরতন থিয়ামের মৃত্যুতে ভারত ও বাংলাদেশের নাট্যজগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। রতন থিয়ামের কর্ম, দর্শন ও বিশ্বাস ভারতীয় থিয়েটারে নতুন ভাষা ও প্রস্তাব এনেছে, যা শুধু ভারত নয়, গোটা প্রাচ্য নাট্যদর্শনকে দিয়েছে গভীর দিশা। তাঁর মৃত্যুতে থিয়েটার হারাল এক দিকপাল ব্যক্তিত্বকে, যিনি মাটি, মানুষ ও মননের গভীর যোগসূত্রে নির্মাণ করেছিলেন এক প্রান্তিক শিল্পভাষা। এমনটাই বলছেন অনুরাগী, ভক্তরা। আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাঁকে ‘থিয়েটার অব রুটস’ আন্দোলনের অগ্রনায়ক উল্লেখ করে বলেন, ‘তিনি ছিলেন এমন একজন দূত, যিনি মণিপুর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছেন। তাঁর শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে।’ মণিপুরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এক টুইটে লেখেন, ‘রতন থিয়াম ছিলেন ভারতীয় থিয়েটারের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা এবং মণিপুরের গর্বিত সন্তান। তাঁর শিল্পনিষ্ঠা, দূরদৃষ্টি এবং মণিপুরি সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা শুধু থিয়েটারজগৎকেই সমৃদ্ধ করেনি, আমাদের পরিচিতি ও অস্তিত্বকেও করেছে সমৃদ্ধ। তাঁর কাজ ছিল মণিপুরের আত্মার প্রতিধ্বনি—যেখানে ছিল আমাদের গল্প, সংগ্রাম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ। তাঁর আত্মা শান্তিতে বিশ্রাম করুক। রেখে যাওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে এবং যাঁদের অনুপ্রাণিত করেছেন, তাঁদের মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন তিনি।’
রতন থিয়ামের কর্ম, দর্শন ও বিশ্বাস ভারতীয় থিয়েটারে নতুন ভাষা ও প্রস্তাব এনেছে, যা শুধু ভারত নয়, গোটা প্রাচ্য নাট্যদর্শনকে দিয়েছে গভীর দিশা। তাঁর মৃত্যুতে থিয়েটার হারাল এক দিকপাল ব্যক্তিত্বকে, যিনি মাটি, মানুষ ও মননের গভীর যোগসূত্রে নির্মাণ করেছিলেন এক প্রান্তিক শিল্পভাষা।মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে রতন থিয়ামউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রফরম য ন স রতন থ য় ম র মণ প র র এমন এক
এছাড়াও পড়ুন:
খেলার নামে আদম পাচার ঠেকাতে তৎপর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ
বিদেশে খেলোয়াড় পাঠানোর নামে মানব পাচারের ঝুঁকি রোধ এবং যোগ্য খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত করতে নতুন নিয়ম চালু করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। ৯ অক্টোবর এনএসসি এক চিঠিতে ফেডারেশনগুলোকে জানিয়েছে, এখন থেকে বিদেশে ক্রীড়া দল পাঠানোর আগে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে ফ্লাইটের কমপক্ষে ১০ দিন আগে জিওর (সরকারি আদেশ) জন্য প্রস্তাব পাঠাতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচিত খেলোয়াড়দের ফিটনেস ও পারফরম্যান্স–সংশ্লিষ্ট প্রমাণপত্রও এনএসসিকে দিতে হবে।
অভিযোগ আছে, কিছু ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন অনেক বছর ধরেই দলের সঙ্গে ভুয়া খেলোয়াড়-কর্মকর্তা পাঠিয়ে আদম পাচার করে আসছে। দুই একটা ঘটনা সামনে এলেও এসবের বেশির ভাগই থেকে যায় আড়ালে। ছোট খেলাগুলো থেকেই এ ধরনের অভিযোগ বেশি আসে। এনএসসির একটি সূত্র জানিয়েছে, মূলত এ ধরনের অপকর্ম ঠেকাতেই বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে ফ্লাইটের অন্তত ১০ দিন আগে জিওর প্রস্তাব পাঠানোর নিয়ম করা হয়েছে। এনএসসির পরিচালক (ক্রীড়া) আমিনুল এহসান সরাসরি তা না বললেও তাঁর কথায়ও সে আভাস আছে, ‘আমি বলব না শুধু আদম পাচার রোধ করতে এই নিয়ম করেছি। তবে কোথাও কোথাও এসব খেলার নামে মানব পাচারের প্রশ্ন চলে আসে।’
অনেক সময় শুনি, কোনো কোনো ফেডারেশন ভুয়া খেলোয়াড় নিয়ে যায়। এনএসসির উদ্যোগটাকে তাই ভালোই বলব। এটা জবাবদিহির মধ্যে পড়ে।ফারহাদ জেসমিন, সাবেক অ্যাথলেট ও বিএও অ্যাথলেটস কমিশনের চেয়ারম্যানএনএসসির কাছে ফেডারেশন বা অ্যাসোসিয়েশন এত দিন জিওর জন্য খেলোয়াড়দের নামই শুধু পাঠাত। যাঁর নাম দেওয়া হতো, তিনি আসলেই খেলোয়াড় কি না বা খেলোয়াড় হলে তাঁর যোগ্যতা কী বা যোগ্য কাউকে বাদ দিয়ে অযোগ্য কাউকে নেওয়া হচ্ছে কি না, এসব যাচাই–বাছাই করা হতো না। এনএসসি তাই জানত না কিসের ভিত্তিতে একজন খেলোয়াড়কে দলে নির্বাচিত করা হয়েছে। নতুন নিয়মে এনএসসিকে এসব দিতে হবে।
জিওর জন্য আবেদনকারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে সময় লাগে বলে ১০ দিন আগে তালিকা চাওয়ার যুক্তি আছে। কিন্তু পারফরম্যান্স আর ফিটনেসের তথ্যপ্রমাণও পাঠানোর নিয়মটা একটু অভিনবই, যা নিয়ে অবশ্যই নানা রকম প্রশ্ন তোলা যায়। তবে জিওর জন্য ফ্লাইটের ১০ দিন আগে নাম চাওয়ার নিয়মটাকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাথলেটস কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক অ্যাথলেট ফারহাদ জেসমিন লিটি বলেছেন, ‘অনেক সময় শুনি, কোনো কোনো ফেডারেশন ভুয়া খেলোয়াড় নিয়ে যায়। এনএসসির উদ্যোগটাকে তাই ভালোই বলব। এটা জবাবদিহির মধ্যে পড়ে।’
আরও পড়ুনবিশ্বকাপের আগে সৌদি লিগে খেলতে চেয়েছিলেন মেসি, সৌদি সরকারের ‘না’১১ ঘণ্টা আগেআদম পাচার যেহেতু সব ফেডারেশন করে না, ক্রিকেট-ফুটবলসহ অনেক ফেডারেশনের জন্য নির্বাচিত খেলোয়াড়দের তথ্য এনএসসিকে দেওয়াটা বিব্রতকর হতে পারে। কারণ, এই ফেডারেশনগুলো একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দল গড়ে। তাদের সব তথ্য চাওয়া ফেডারেশনের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ কি না, এমন প্রশ্ন আসেই।ক্রীড়াঙ্গনে স্বজনপ্রীতি ঠেকাতেও এ নিয়ম ভূমিকা রাখবে বলে ফারহাদ জেসমিনের আশা, ‘অনেক ফেডারেশন অনেক সময় যোগ্যতার বিচার না করে নিজেদের পছন্দের খেলোয়াড় নিয়ে যায়। দেখে মনে হয়, বিদেশভ্রমণই মুখ্য, পারফরম্যান্স মুখ্য নয়।’ বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, ‘এটা ভালো উদ্যোগ। কারণ, এনএসসির জানার অধিকার আছে, বিদেশে টুর্নামেন্টে আমরা কাদের নিয়ে যাচ্ছি।’ সম্প্রতি হকি তারকা রাসেল মাহমুদকে বয়সের অজুহাতে বাদ দেয় হকি ফেডারেশন। এ নিয়ে সমালোচনা হলে এনএসসিকে বিষয়টি তদন্তও করতে হয়।
এনএসসির নতুন নিয়ম অনুযায়ী ক্রিকেট-ফুটবলসহ সব খেলাতেই বিদেশে দল পাঠানোর জন্য নির্বাচিত খেলোয়াড়দের নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হবে। কিন্তু আদম পাচার যেহেতু সব ফেডারেশন করে না, ক্রিকেট-ফুটবলসহ অনেক ফেডারেশনের জন্য নির্বাচিত খেলোয়াড়দের তথ্য এনএসসিকে দেওয়াটা বিব্রতকর হতে পারে। কারণ, এই ফেডারেশনগুলো একটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দল গড়ে। তাদের সব তথ্য চাওয়া ফেডারেশনের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ কি না, এমন প্রশ্ন আসেই।
আরও পড়ুনআগে চা পরে লাঞ্চ—বদলে যাচ্ছে ক্রিকেটের শতবর্ষ পুরোনো এক রীতি১৫ ঘণ্টা আগেএনএসসির পরিচালক আমিনুল এহসান অবশ্য তা মনে করেন না, ‘প্রায় প্রতিদিনই এনএসসির কাছে অনেক খেলোয়াড় অভিযোগ করেন, কোনো না কোনো কর্মকর্তার অপছন্দের কারণে নাকি তিনি দল থেকে বাদ পড়েছেন। এ কারণেই খেলোয়াড় নির্বাচনের তথ্যগুলো এনএসসির জানা থাকলে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়কে একটা উত্তর দেওয়া যায়। এটা ফেডারেশনের কাজে হস্তক্ষেপ নয়। স্বচ্ছতার স্বার্থে এনএসসি তা জানতে চাইতে পারে।’