তখন সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন প্রবাল দে। পত্রপত্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের হিপিদের খবরাখবর পড়ে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি আগ্রহ জন্মাল। ১৯৬৯-৭০ সালের সেই সময়ে মাত্রই তাঁর সংগ্রাহকজীবন শুরু হয়েছে। তাই হিপিদের জিনস প্যান্ট, টি-শার্ট, লকেট দেওয়া গলার চেইন ইত্যাদি তাঁর কিশোর মনে দাগ কেটে যায়। কিন্তু চট্টগ্রামে বসে দূরদেশের হিপিদের পোশাক-পরিচ্ছদ আর অলংকার হাতে পাওয়া তো সহজ নয়। তবে তিনি হাল ছাড়লেন না। অনেক কষ্ট করে একদিন সংগ্রহও করে বসলেন হিপি পুরুষের প্যান্টের সঙ্গে লাগানো দুটি চেইন। যে চেইনের সঙ্গে হিপিরা চাবি লাগিয়ে রাখে। প্রবাল দের আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু চেইন তো পাওয়া গেল কিন্তু অন্যান্য বস্তু পাবেন কী করে?

সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া প্রবাল তখন বিদেশ থেকে আসা পুরোনো কাপড়ের দোকানে হানা দিলেন। ধীরে ধীরে সেসব দোকান থেকে সংগ্রহ করলেন পোশাকের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন গয়না, কোটপিন, লকেট ইত্যাদি। হিপিদের পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়নাগাটির পাশাপাশি তাঁর সংগ্রহে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকল ধাতব মুদ্রা, অ্যান্টিকসহ বিচিত্র সব বস্তু। এভাবেই নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রবাল দে।

৩৫ বছরের সংগ্রহ

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। তাঁদের ভাষা, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতিসহ পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকারেও রয়েছে নিজস্বতা। ৩৫ বছর ধরে এসব সংগ্রহ করে চলেছেন প্রবাল। তাঁর সংগ্রহের বড় একটি অংশ আবার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নাগাটি। বর্তমানে তাঁর সংগ্রহে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের যেসব গয়না রয়েছে, তার বেশির ভাগই রুপার তৈরি। অন্যান্য ধাতুর মধ্যে আছে টিন ও তামা।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়নায় একসময় রৌপ্যমুদ্রা খুব ব্যবহৃত হতো, বিশেষ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজা পঞ্চম ও ষষ্ঠ জর্জের আমলে প্রচলিত বিভিন্ন মুদ্রা। রৌপ্যমুদ্রার মূল্যমানের তারতম্যের ভিত্তিতে গয়নাগুলোর বাজারমূল্যেও দেখা যেত ভিন্নতা। এক রুপির মুদ্রায় গড়া গয়নার দাম ছিল বেশি। প্রবাল দের সংগ্রহে মুদ্রা দিয়ে বানানো এ রকম বেশ কয়েকটি গয়না রয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা গলায়, কানে, নাকে, হাতে, পায়ে ভিন্ন ভিন্ন গয়না পরে থাকেন। অঞ্চলভেদে একই গয়না ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচয় পেয়েছে, যেমন নারীদের গলায় পরা নেকলেস কোথাও হাঁসুলি, কোথাও আবার চাম্বেল নামে পরিচিত। কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের মধ্যেও গয়না পরার চল আছে। প্রবাল দের সংগ্রহে পুরুষদের ব্যবহৃত তেমন কিছু গয়নাও আছে, মুরং পুরুষেরা এগুলো পরে থাকেন।

এসব গয়না সংগ্রহ করার জন্য বাংলাদেশের নানা প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন প্রবাল। তবে জন্মস্থান চট্টগ্রাম হওয়ায় একটা সুবিধা হয়েছে, হাতের কাছেই পেয়েছেন অনেক জাতিগোষ্ঠীর সান্নিধ্য। কিন্তু কেউ তো আর এমনি এমনি গলার গয়না খুলে তার হাতে গুঁজে দেবে না, তার জন্য দিতে হবে টাকা। অনেক সময় টাকার পরিমাণ হতো তার সাধ্যের বাইরে। অর্থাভাবে কিনতে না–পারা তেমন কিছু গয়নার কথা ভেবে এখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গয়না ছাড়াও এ অঞ্চলের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধাতব মুদ্রা সংগ্রহের নেশাও প্রবাল দের তীব্র। মুদ্রার পাশাপাশি বিভিন্ন পুরোনো বস্তু দিয়ে তাঁর চট্টগ্রামের বাসাটিকে বিশাল এক সংগ্রহশালায় পরিণত করেছেন প্রবাল, যেসব বস্তুর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কর্মসূচি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ